ছোটবেলার শীতের আমেজটা আসত বাগান জুড়ে রঙিন ফুলের মেলা, কনকনে ঠান্ডায় নরম সূর্যের রোদ্দুর আর উনুন থেকে বের করা গরম কেকে।
তখন হাতের মুঠোয় পৃথিবী ছিল না, তাই রেডিওতে বেলা দে’র ‘রান্নাঘর’ কিংবা বইমেলা থেকে কেনা খাবার বই-এর রেসিপি অনুযায়ী এটা সেটা কেক। কাঠের আঁচে ঢিমে আগুনে মা’র হাতে করে বহুক্ষণ ধরে ফেটানো নরম তুলতুলে কেক…
এখন হাত বাড়ালেই নানান নাম করা দোকান, নানান ফ্লেভারের কেক, আর হাতের মুঠোয় দুনিয়া হওয়াতে পৃথিবীর নানা প্রান্তের কেক-এর অরিজিন আর রেসিপি (Cake recipes) নিয়ে নানান চমকপ্রদ তথ্য…
এবছর না না করেও শীত পড়ল, চলে এল নতুন বছরও, শীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ‘কেক’ রেসিপিই বা বাকি থাকে কী করে!
আরও পড়ুন: নতুন স্বাদের তিন রেসিপিতে যিশুদিবস জমজমাট
আজ পৃথিবীর তিন প্রান্ত থেকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি ভিন্ন স্বাদের তিন রকমের কেক
১. সেই সুদূর অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড থেকে পাভলোভা
২. ইউরোপে থেকে ক্যারট কেক
৩. আমাদের দেশি বাপুজি কেকের স্বাদ-সমৃদ্ধ কেক… (Cake recipes)

পাভলোভা
আমাদের যেমন বাংলা আর ওড়িশাতে রসগোল্লা কার— সেই নিয়ে যুদ্ধ, ওদিকে হামাস নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ, সেরকম এই পাভলোভা নিয়েও নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার কাড়াকাড়ি যুদ্ধ…
দক্ষিণ গোলার্ধে বড়দিন মানে গরমকাল। সেই গরম কালের খ্রিস্টমাসে, খাবার বানানোর শেষ দিকে যায় ওভেনে ওঠে পাভলোভা। টাটকা বেক করা পাভলোভা ক্রিম আর মরশুমি ফলের টপিং দিয়ে সার্ভ করা অস্ট্রেলিয়ানদের জন্যে খুশি আর গর্বের। ওদিকে ঠিক সেরকম গর্ব নিউজিল্যান্ডবাসীদেরও। এখানেই যুদ্ধ শুরু। হবে না-ই বা কেন! ‘পাভলোভা’র বাইরেটা ক্রাঞ্চি মুচমুচে আর ভিতরটা হালকা নরম স্বাদ মুখে দিলেই স্বর্গ! অনেকে বলেন, পাভলোভা নাকি রাশিয়ান ব্যালেরিনা আনা পাভলোভা যখন ওই দিকে ড্যান্স ট্যুরে যান তখন তাঁর জন্যে বানানো হয়েছিল। এত হালকা ডেসার্ট, তাই বলা হয় পাভলোভার মত হালকা— অ্যাজ লাইট অ্যাজ পাভলোভা… সেই থেকে নামকরণ।
এই কেকের উৎপত্তি আর বিবর্তন নিয়ে গল্পের শেষ নেই।

এমন সুন্দর একটি কেক বাড়িতে বানানো কিন্তু খুব সহজ, বানাতে কী কী লাগবে দেখি—
৪ টি ডিমের সাদা অংশ
১ কাপ চিনি গুঁড়ো
১ চা চামচ ভ্যানিলা এসেন্স
১/২ চা চামচ ক্রিম অফ টার্টার
১ চা চামচ কর্নফ্লাওয়ার
টপিং-এর জন্যে-
২/৩ বড় চামচ হুইপড ক্রিম
কুচি করা ফল পছন্দমতো
লেমন কার্ড (ওই চারটে ডিমের কুসুম+ চিনি গুঁড়ো ২ টেবিল চামচ, লেবুর রস ১ টেবিল চামচ, লেবুর জেস্ট, মাখন ১ টেবিল চামচ দিয়ে ফুটন্ত জলের ওপর বাটি বসিয়ে ক্রমাগত নাড়িয়ে গাঢ় করে বানানো)
ডিমের সাদা অংশ ইলেকট্রিক বিটার-এ ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে, যতক্ষণ না সাদা হয়ে শক্ত পিক হতে শুরু করে। তারপর আস্তে আস্তে চিনি গুঁড়ো মেশাতে হবে, আর আরও শক্ত হয়ে সাদা হবে, শেষের দিকে ক্রিম অফ টার্টার আর কর্নফ্লাওয়ার মেশাতে হবে। ডিমের সাদা অংশটা আর বাটি ওল্টালেও পড়ে যাবে না এমন হবে। এই হল মেরাং।
তারপর একটা বেকিং ট্রেতে বেকিং পেপার মাপ মতো কেটে তাতে গোল দাগ করে নিতে হবে ওই কোয়ার্টার প্লেটের সাইজে। এর মধ্যে মেরাং দিয়ে একটা চামচ দিয়ে পাশগুলো পছন্দসই ডিজাইন করে গোল করে সাজিয়ে দিতে হবে। এটা বেক হবে প্রথমে ১৩০° সেলসিয়াস-এ ২০ মিনিট মতন। তারপর বেক হবে ১০০° সেলসিয়াস-এ প্রায় ৭০-৮০ মিনিট মতন। এরপর একে ওভেনে রেখেই পুরো ঠান্ডা করতে দিতে হবে। আর ঠান্ডা হলে পাঁচ-ছ দিন রাখা যায় এয়ার-টাইট কৌটোতে। সার্ভ করার সময় ওপরে ক্রিম, ফল আর লেমন কার্ড দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া। পারফেক্ট পাভলোভা খেতে হবে বাইরেটা মুচমুচে আর ভিতরটা নরম হালকা।

ক্যারট কেক
বহুকাল ধরেই কেক, পুডিং-এ সুইটনার হিসেবে গাজর ব্যবহার হয়ে আসছে। ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত এক বহু পুরনো ফরাসি রান্নার বইতে ‘গাজর পুডিং’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের চিনি আমদানি কম হয়ে যাওয়ায় কেক, পুডিং-এ মিষ্টতা আনতে গাজরের ব্যবহার বহুলভাবে বেড়ে যায়, আর জনপ্রিয় হয় এই গাজরের কেক। ক্রমে জনপ্রিয় এই কেক বর্তমানে নতুন রূপ পায়— ওপরে ক্রিম চিজ ফ্রস্টিং দিয়ে, কিংবা বাটার ক্রিম ফ্রস্টিং সহযোগে…
কী কী লাগবে
২ কাপ ময়দা
২ চা চামচ বেকিং পাউডার
১/২ চা চামচ বেকিং সোডা
১ ১/২ চা চামচ দারচিনি গুঁড়ো
১ ১/৪ কাপ সাদা তেল
১ কাপ চিনি
১ কাপ ব্রাউন সুগার
১ চা চামচ ভ্যানিলা
৪ ডিম
৩ কাপ গাজর গ্রেট করা
এক চিমটে নুন

ডিম, চিনি, তেল খুব ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে, একদম ভালো করে যাতে হাওয়া ঢুকে সাদাটে হয়ে যায়। এরপর ময়দা, বেকিং পাউডার, বেকিং সোডা, এক চিমটে নুন চালনিতে চেলে নিতে হবে। ডিম চিনির মিশ্রণে এই ময়দার মিশ্রণ ভালো করে মিশিয়ে দিতে হবে, কিন্তু খুব বেশি ফেটানো যাবে না। তারপর ভ্যানিলা, দারচিনি আর গ্রেট করা গাজর দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে ভালো করে।
দুটো পাত্রে ভালো করে মাখন বুলিয়ে, তাতে ময়দা গুঁড়ো ছিটিয়ে, ওই কেক ব্যাটার দু ভাগ করে দুটোতে ঢেলে ১৮০° সেলসিয়াসে গরম করা ওভেনে ৪০-৪৫ মিনিট ধরে বেক করতে হবে। ঠান্ডা হতে হবে ওভেনেই। এর পর ক্রিম চিজ বা বাটার ক্রিম কিংবা হুইপড ক্রিম দিতে হবে। একটা কেক রেখে তার ওপরে ক্রিম দিয়ে তার উপর আর একটা কেক দিয়ে, পুরোটা ক্রিম দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এবার নিজের পছন্দমতো ডেকরেট করে তুলে দিন প্রিয়জনের পাতে।

ঘরে বানানো বাপুজি কেক
উপকরণ-
২ ১/২ কাপ ফ্লাওয়ার
১ কাপ চিনি
২৫ গ্রাম মাখন
১/২ কাপ তেল
১/৪ কাপ টুটি ফ্রুটি
১/৪ কাপ মোরব্বা কুচি
১/৮ চা চামচ বেকিং সোডা
১ ১/৪ চা চামচ বেকিং পাউডার
২ ডিম
ডিম দিতে না চাইলে ৫০ গ্রাম দই
অল্প একটু দুধ
চিনি, তেল, মাখন, ডিম (বা দই) ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হবে।
ওদিকে ময়দা, বেকিং পাউডার আর সোডা চেলে নিতে হবে। এর পর মাখন আর ডিমের মিশ্রণে ময়দাটা মিশিয়ে নিতে হবে ভালো করে। টুটি ফ্রুটি আর মোরব্বা কুচিতে একটু শুকনো ময়দা লাগিয়ে নিতে হবে, যাতে ওগুলো কেকের নীচে না যায়, সেগুলোও মিশিয়ে দিতে হবে। এরপর একটা পাত্রে মিশ্রণ ঢেলে নিয়ে ১৮০° সেলসিয়াসে বেক করতে হবে, ৪৫ মিনিট। তাহলে রেডি সেই স্বাদের কেক।
রইল আনকোরা তিন স্বাদের শীতের কেক। সবার নতুন বছর ভালো কাটুক, উপভোগ করুন শীতের আমেজ।
শ্রুতি অনেকদিন ধরে চক ডাস্টার নিয়ে স্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে ফিজিক্স লিখতেই স্বচ্ছন্দ। সামান্য ও এত ক্ষুদ্র মানুষ, যে জীবনেও কখন হাইজে়নবার্গস আনসার্টেনটি প্রিন্সিপল কাজে লেগে গেছে অজান্তে। বর্ধমানে থাকার অবস্থানটি এতটাই সুনিশ্চিত, যে পিএইচডি উত্তর, উচ্চশিক্ষার মোমেন্টাম সম্পূর্ণ অনিশ্চিত। হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলা শেষ হলেও বাকি থাকে নিশ্চিন্তে আকাশ নদী পাখি আর প্রজাপতির গল্প শোনা।