চৌকিদার বসন্ত
আপনি কি সেই চৌকিদার যে কবির দরজার বাইরে সারারাত পাহারায় থাকেন আর ভোরবেলা ঘুমচোখে প্রথম যাকে দেখেই কবি অবাক – এ যে দেখি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে! ওকে নিমপাতার রস দাও মাটির ভাঁড়ে। আর সেই রস খাওয়া ইস্তক আপনার হৃদয় উদ্বেল, মন উচাটন, হাঁটু ঠক ঠক, হাত কম্পমান। আপনি, মানে চৌকিদার বসন্ত প্রেমে পড়লেন। অথবা প্রেমই এসেছিল কবিকে ডাকতে আর উনি ঘুমুচ্ছেন দেখে জেগে বসে রইল দরজায়। কবি বসন্ত বলে ডাকতেই আপনি ভোল পালটে পাড়ায় মাস্তানি – পলাশ, শিমুল ফুটিয়ে একাকার। এমন রং ছড়ালেন চারদিকে, যে কলকাতা ছেড়ে প্রেম পেতে জনগণ ছুটল বীরভূম। বাঙালি হাঘরে হল, সকালে দাঁত মাজতে এবং দুপুরে কান চুলকোতে ভুলে গেল। ওদিকে মেঠো (রাঙা) পথে গোরুর দল একলা গোয়ালমুখী। কারণ রাখাল বাঁশি মুখে পোজ দিয়েছে সেলফি তুলবে বলে কিন্তু দুটো হাতই বাঁশি পাকড়ে আছে বলে সুবিধে করতে পারছে না। পা দিয়ে মোবাইল দাবানোর চেষ্টা করছে বাবা রামদেব স্টাইলে। গোরুরা ফিরবে কিনা জানা নেই কিন্তু আপনি পৌঁছে গেলেন!
বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ
তখন আপনি বসন্তরঞ্জন। লোকে গোয়ালে যায় দুধ দোয়াতে আর গোবর আনতে (ঘুঁটে)! আর আপনি খড়-বিচালি হাতড়ে, ইতিহাস খুঁড়ে বের করে আনলেন ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’! একেবারে অরিজিনাল ভলিউম! চণ্ডীদাস প্রণীত পরকীয়ার ম্যানুয়াল। আর কী সৌভাগ্য, শিক্ষা পর্ষদ সেই কাব্য গুঁজে দিলেন উচ্চমাধ্যমিক সিলেবাসে। এদিকে বাড়িতে প্রেম শব্দ উচ্চারণ নিষিদ্ধ আর ওদিকে রোজ সকালে সাহিত্যের ইতিহাস ক্লাসে একহাতে উঁচু করে বইটি ধরে পদাবলি পড়াচ্ছেন কালীবাবু। রাধা–রাধা অনুরণন বক্ষপিঞ্জরে। বসন্ত বিদ্বদ্বল্লভ, আপনি না থাকলে প্রেমের হাতেখড়ি হত কি ক্লাস ইলেভেনে? যে কোনও যুগলের দিকে চোখ পড়লেই নিজেকে কৃষ্ণ ভাবার অধিকার, সে তো আপনারই দাক্ষিণ্যে – “তোর বিরহ দহনে। দ্গধিলী রাধা জীএ তোর দরশনে।” চোখে জল এসে যায়। আর হালকা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পাখির পালক (রামপাখি) নাকে সুড়সুড়ি দেয়। কানে কানে বলে – প্রেম আসুক না আসুক, বসন্ত আসবেই।
জল বসন্ত
মানে বোঝার আগেই গোটা বেরিয়ে যাবে। মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত, মায় মুখের ভিতরেও। নিজেকে চিতাবাঘ ভাবা ছাড়া এ রোগের কোনও ওষুধ নেই। চণ্ডীদাস কেন স্বয়ং চণ্ডী এলেও উদ্ধার করতে পারবেন না। পাক্কা তিন হপ্তার প্রেম। চুলকোনোও যাবে না। সারাদিন আপনাকে জড়িয়ে শুয়ে থাকা। বিরহী পাশবালিশ। দিন দশেক বাদে খোসা ওঠা শুরু। সেগুলো আবার যত্ন করে জড়ো কর। এ প্রেমের দান অন্যের ছোঁয়া মানে অভিশাপ। যাওয়ার আগে ছাপ রেখে যাবেন – কানের গোড়ায়, নাকের ডগায়। যাতে ভবিষ্যতে প্রেমিকা মুখের দিকে তাকালেই জানতে পারে এ বৃন্দাবনী লীলার কথা। রাধে, এ আমার গত জন্মের বসন্তের পাপ। রাতে দুঃস্বপ্ন – পাড়ার স্টেশনারি দোকানের রতনদার মুখ। একগাল হেসে বলবেন – বসন্ত দুইপ্রকার; গুটি ও জল। গলা শুকিয়ে কাঠ। জল, জল… নার্স !! সুচিত্রা সেন। আর আপনি ?
বসন্ত চৌধুরি
প্রেমে পড়ে লোকে পাগল হয়ে যায়। আপনি সিনেমায় উলটোটা করে দেখালেন স্যার। মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত আপনাকে সারিয়ে তুলল সুন্দরী নার্সের প্রেম! সুস্থ আপনি গটমট করে হেঁটে বেরিয়ে গেলেন। অসুস্থ হয়ে মেমারি লস হয়েছিল আবার সুস্থ হয়েও মেমারি লস! সেই রাত্রি ও সেই চন্দ্র নাকি শুধু আপনাদের – এই বলে হল কাঁপিয়ে গান গেয়ে আপনি হিরো হলেন। ওদিকে নার্সের মাথায় ঢুকল বসন্তর ভুত। একলা রাতের গায়ে চাঁদ ঝুলে রইল ফোস্কার মত। সেই চাঁদ যে আমার পায়ের পাতায় নেমে এসেছে সেটা ঠাহর হল ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর, শ্রীমানি মার্কেটের কাছে এসে। গাছে নতুন পাতা। পায়ে নতুন চটি। পাশে নতুন প্রেম।
বসন্ত কেবিন
জিজ্ঞেস করলে, ‘সরবত খাবে?’
যন্ত্রণা চেপে বললাম, ‘হ্যাঁ।’
সারি সারি গ্লাস ভরতি সবুজ, হলুদ, গোলাপি তরলের দিকে তাকিয়ে যেন নিজেকেই বললে, ‘দোল আসছে।’
চাঁদটাকে অন্য পায়ের আঙুল দিয়ে চেপে ধরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘শান্তিনিকেতন?’
‘না, আমার দোলের কলকাতা ভাল লাগে। দুটো রোজ সিরাপ দেবেন দাদা।’
বললাম না, যে ওই ফ্লেভার একেবারেই অপছন্দ আমার। তার বদলে আমি কলাভবন বললাম আর খোয়াই এর জ্যোৎস্না। তুমি, তোমার বন্ধু এক কোকিলের কথা বললে, যে সারা বছর তোমার জানলার পাশের গাছটায় ডাকাডাকি করে, কিন্তু বসন্তের ঠিক আগে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। তুমি ওই গাছ পাহারা দেবে বলে আর কোথাও যেতে চাও না। আমার বিশ্বাস হল না। আমরা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি দোকানের সিঁড়িতে বসলাম। তুমি মুখ তুলে সামনে তাকিয়ে বললে, ‘পলাশ।’
আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না এই ঘিঞ্জি এলাকায়, প্রাচীন, ভগ্নপ্রায় অট্টালিকার জঙ্গলেও পলাশ ফোটে। আমি একটা ফুল কুড়োনোর জন্যে উঠতে গেলাম… আঃ। ততক্ষণে দাঁড়িয়ে পড়েছ – ‘বাস এসে গেছে।’
‘আবার কবে দেখা হবে?’
‘পরশু? তুমি খাওয়াবে।’
‘কোথায়?’
‘বসন্ত কেবিন – সন্ধ্যেবেলা।’
বাস চলে গেল ধর্মতলার দিকে। আমি একটা ট্যাক্সি ডাকলাম – শ্যামবাজার।
বিকেল থেকে বসে আছি বসন্ত কেবিনে। চা এবং সিগারেট। স্কটিশ আর বেথুন। হেদুয়ায় সৎসঙ্গের সান্ধ্যকালীন সভা। রোলের দোকান থেকে পোড়া তেলের গন্ধ। নো পার্কিংয়ে রাখা ভাড়া গাড়ির স্টিরিওতে নতুন বলিউডি ধামাকা। তোমার মোবাইল সুইচ্ড অফ।
প্রথমে রাগ হল, তারপর কষ্ট। আবার রাগ। রাত নামল। রাস্তায় নেমে বাড়ির দিকে পা চালাই। সিগারেট ধরাতে যাব, কানের কাছে এক পাগল বলল, “কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিন নয়তো?”
আমি সিগারেট ছুঁড়ে ফেলে ট্রাম রাস্তা ধরে উদ্দাম দৌড় লাগালাম কলেজ স্ট্রিটের দিকে। কাঁধের ওপর নিঃশ্বাস পড়তে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি আপনিও দৌড়চ্ছেন আমার সঙ্গে!
অনুব্রত নামী বহুজাতিক সংস্থায় অতি উচ্চপদে আসীন ছিলেন। কিন্তু মনে মনে এখনও স্কটিশের সেই লেখা-পাগল ছাত্রটি। লেখালিখি তাঁর হাড়ে-মজ্জায়। নিয়মিত লেখেন পত্রপত্রিকায়। শখ, সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো আর ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি।
One Response
বসন্ত বসেন তো? লেখা একটু পাগলাটে তাই আরো ভাল লাগল।