মিষ্টি একবার টুকুনের দিকে পাশ ফিরতেই মুসুন জেগে গেল।
“মাছিমণি, ছুড়ছুড়ি দাও।”
“হ্যাঁ সোনা। দিচ্ছি।” পিঠে আলতো করে হাত বোলাতে লাগল ওর। গরমে বেচারির পিঠে ঘামাচি বেরিয়ে গেছে। অবশ্য ঘুমনোর আগে সুড়সুড়ির নেশাটা মুসুনের প্রায় জন্মের পর থেকেই। পালা করে বাবা-মা দেয় রাতে, আর দুপুরে মা। অবশ্য সূর্যদা, মানে মিষ্টির জামাইবাবু যখন ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে তখন লাঞ্চের পর কাজ করতে করতেও এক হাতে সুড়সুড়ি চলতে থাকে মেয়ের পিঠে। এখন অবশ্য জার্মানির মিউনিখে আছে ন’মাসের একটা অনসাইট অ্যাসাইনমেন্টে।
টুকুনের এসব কিছু লাগে না। সারাদিন দৌড়োদৌড়ি করে, পড়াশোনার সময়টা ছাড়া। একটু শুলেই তাই অনায়াসে ঘুমিয়ে পড়ে। কিছুটা ওর মায়ের মতন। দিদিও এরকম দুরন্ত ছিল ছোটবেলায়। মা বলত ‘সারাক্ষণ ধিঙ্গিপনা’। সেই মেয়ে এখন ঘোরতর সংসারী। শ্বশুর-শাশুড়ি, বর, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। অবশ্য শ্বশুর-শাশুড়ি ছ’মাস এখানে থাকেন, ছমাস মেয়ের কাছে নিউ জার্সিতে। পুজোর আগে চলে আসেন কলকাতায়, আবার দোলযাত্রার পর পরই চলে যান। দিদির ননদরাও পুজোর সময় আসে। ওদেরও এক ছেলে, এক মেয়ে। তখন এই বাড়ি পুরো জমজমাট।
দরজায় বেল বাজল। দিদি পার্লারে গেছে ওকে বাড়িতে রেখে। সীমাদি যেমন খাটতে পারে, তেমনই ঘুমোয়। আর ঘুমোলে কোনও হুঁশ থাকে না। অগত্যা মিষ্টি-ই আস্তে আস্তে নামল খাট থেকে। আইহোল দিয়ে দেখে বাইরে দু’জন ছোট ছেলে। ও আগে এদের দেখেনি, হয়ত টুকুনের নতুন বন্ধু। ব্যাট, উইকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। খুলল ও দরজা।
“আন্টি, ক্ষিতিজ আছে?”
“ও তো একটু ঘুমোচ্ছে, উঠলে তোমাদের ওখানে পাঠিয়ে দেব…”
“না, না, আমি জেগে। আসছি রে আমি।” টুকুন মুহূর্তের মধ্যে হাজির। “মাসিমণি, আমি একটু খেলে আসি?”
“এস। সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসবে কিন্তু।”
“ওককে।” তিনজনে হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

ঘরে ঢুকে মিষ্টি দেখল মুসুনও উঠে পড়েছে।
“আর ঘুমোবে না মুসুন?”
“তুমি ছুড়ছুড়ি দেবে?”
“নিশ্চয়ই দেব। ওপাশে ফেরো।” মুচকি হেসে ঘাড় নাড়ল মিষ্টি।
“এট্টু হাতে আর পায়ে দেবে?”
“সারা গায়ে দেব।” ও বসে বসে মুসুনের সারা গায়ে সুড়সুড়ি দিতে লাগল। দশ মিনিটের মধ্যেই আবার বেল– এবার টুকুন।
“কী হল টুকুন? এত তাড়াতাড়ি চলে এলে?”
“বল হারিয়ে গেল। মনে হয় মাঠের পাশে যে পুকুরটা আছে ওখানে পড়েছে। যেতাম, কিন্তু অস্মিত আর রেহান দু’জনের কেউই যেতে চাইল না ওখানে। বর্ষাকালে নাকি ওদিকে সাপ বেরোয়।”
“ভালই করেছ। হাত-পা ধুয়ে এস।”
আজকের খবরের কাগজটা দেখতে বসল মিষ্টি। মুসুন বেশ গভীর ঘুমে। দাদা এসেছে বুঝতেই পারেনি।
“মাসিমণি, ঘোলা জলে মাছ ধরা মানে কী?” টুকুন কখন হাত-পা ধুয়ে ঘরে এসেছে ও খেয়াল করেনি।
“কোথায় শুনলে এটা?”
“এই তো, পেপারে দিয়েছে।”

মিষ্টি কাগজটা ঘুরিয়ে দেখল ওখানে একটা বড়সড় লেখার হেডিং ‘ঘোলা জলে মাছ ধরার চেষ্টা’।
“হুমম! এটার মানে হল একটা জায়গায় গণ্ডগোল পাকিয়ে সেটা থেকে সুবিধে নেওয়া।”
“গণ্ডগোল থেকে সুবিধে হয় নাকি কারোর?” টুকুন একটু মাথা চুললে নিলো।
“হয়, বৈকি। বলছি…”
“মাছিমণি, কী গল্প বলছ? আমাকেও বল।” মুসুন ততক্ষণে ঘুম ভেঙে উঠে বসেছে।
“একটা খুব বুদ্ধিমান প্রাণীর গল্প।”
“ফক্স?” মুসুন মিষ্টির গা ঘেঁষে এসে বসল।
“উঁহু। এরা জলে থাকে।”
শার্ক?” এবার টুকুন চেষ্টা করল।
“না, এরা জলের বড় প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম বুদ্ধিমান। আচ্ছা – একটা হি্নট দিচ্ছি। মানুষের সঙ্গে এদের দারুণ বন্ধুত্ব হয়। বল দেখি এবার!”
“ডলফিন?” প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল টুকুন।
“বাঃ, একদম ঠিক।”

“পিসিমণিরা ফ্লোরিডায় বেড়াতে গেছিল একটা ওয়াটার পার্কে। সেখানে ডলফিনরা খেলা দেখায়। মাকে বেশ কয়েকটা ভিডিও পাঠিয়েছিল।”
“গ্রেট। এদের মধ্যে খুব ইন্টারেস্টিং একটা জাত হচ্ছে বটলনোজ ডলফিন। এদের মুখ আর দাঁতগুলো এমন, যে দেখলে মনে হবে তোমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।”
“আর একটা হাসির মতন আওয়াজ করে না ওরা?” টুকুন বলল।
“একদম ঠিক। এরা সমুদ্রে বা নদীতে থাকে। গায়ের উপরটা ছাইরঙা বা কালচে কিংবা নীলচে, পেটের দিকটা সাদা। লম্বায় তেরো ফুট অবধি হয়, আর ওজন প্রায় ছ’শো কিলো। কিন্তু এত বড় হলেও জলের মধ্যে এদের স্পিড আর ফ্লেক্সিবিলিটি দেখার মতন। তবে সবথেকে অবাক করার মতো হল এদের বুদ্ধি।”
“মাছিমণি, এদের নাকটা কি বটলের মতন?”
“ঠিক বলেছ। কিন্তু আমরা যেটাকে ওদের নাক ভাবি, সেটাকে বলে স্নাউট, ওখানে ওদের নাক থাকে না। ওদের নাক থাকে মাথার ওপরে। সেখানে একটা ব্লো-হোল থাকে। নিশ্বাস নিতে দশ মিনিটে একবার ওদের জলের ওপর উঠে আসতেই হয়।”
“তিমিদের মতন?”
“ঠিক বলেছ টুকুন। সমুদ্রের প্রায় নাইনটি পার্সেন্ট প্রাণীই কিন্তু জলের ওপরের দিকে থাকে। এরাও তাই খুব নীচে যায় না। ওপরে খাবারের অভাব হয় না।”
“এলা কী খায়? ফিস?”
“কী বুদ্ধি তোমার মুসুনসোনা! একদম কারেক্ট! এরা একটা অদ্ভুত কায়দায় মাছ ধরে। মুখ দিয়ে একটা ‘ক্লিক ক্লিক’ আওয়াজ করতে করতে এগোয় যেখানে জলের গভীরতা একেবারেই বেশি না। সেই আওয়াজ মাছেদের ঝাঁকের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। এতে ওরা বুঝতে পারে ঠিক কোন জায়গায় মাছের ঝাঁক রয়েছে। এটাকে বলে ‘ইকো-লোকেশন’, অর্থাৎ ইকোর মাধ্যমে কোনওকিছুকে লোকেট করা।”

“ইকো কাকে বলে?”
“বাথরুমে দরজা বন্ধ করে চেঁচাবি, দেখবি তোর চিৎকার দু’বার তিনবার শোনা যাবে। সেটাকেই ইকো বলে।” টুকুন ঝটপট বোনকে বুঝিয়ে দিল।
“আর মাছেদের কাছে এই আওয়াজ পৌঁছলে ওরা ভয় পেয়ে আরও একসঙ্গে দল বেঁধে থাকতে চায়। এইবার মাছের ঝাঁক কোথায় বুঝতে পেরে ডলফিনরা বন্ধুদের উদ্দেশ্যে হুইসল দিতে শুরু করে। সেই হুইসল শুনে এক এক করে বেশ কয়েকটা ডলফিন জড়ো হয়ে যায়। তারা একসঙ্গে মাছের ঝাঁকের দিকে সাঁতরে চলে। কাছে এসে কোনও একটা ডলফিন মাছের ঝাঁকের চারপাশে ঘুরতে থাকে। জলের অনেকটা নীচে গিয়ে মাটিতে লেজ ঘষতে ঘষতে ঘুরতে থাকে গোল করে। এর ফলে ওই মাটির তলার কাদা উঠে আসে ওপরের পরিষ্কার জলে। তৈরি হয় একটা ‘মাড রিং’। সেই মাড রিংয়ের মধ্যে যে মাছগুলো আছে তাদের ঘোলা জলে নিশ্বাস নিতে অসুবিধে হয়…”
“কেন অসুবিধে হয় মাছিমণি?”
“মাছেরা তো জল মুখে নিয়ে মাথায় থাকা ওদের কানকো-ফুলকো দিয়ে অক্সিজেন শুষে নেয় জল থেকে। সেই জল যদি নোংরা হয়ে যায়, তাতে যদি মাটির কণা থাকে তাহলে সেগুলো কানকো-ফুলকোতে আটকে যায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ওরা ওই মাড রিংকে একটা দেওয়াল ভাবে। ভাবে লাফিয়ে ওটা টপকাতে পারলেই আবার পরিষ্কার জল পাবে।”
“সেটাই তো পাবে, তাই না?”
“তা পাবে, কিন্তু রিংয়ের চারপাশ ঘিরে ডলফিনের দল তখন হাঁ করে বসে আছে। অনেক মাছই লাফিয়ে সোজা গিয়ে ওদের মুখে ঢোকে।”
“ওয়াও! কী টেকনিক!” টুকুনের চোখ বড় হয়ে গেল। মুসুন হাততালি দিয়ে উঠল।
“এরা কোন ফিশ? যাদের এরকম ভাবে ধরে ডলফিনরা।”
“অনেক রকম মাছই খায়। তবে এদের সবথেকে প্রিয় মাছ মালেট। আমেরিকার কিছু রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায়। আমি ফ্লোরিডায় খেয়েছি। একটু অন্যরকম খেতে। মাংস সাদা, তবে প্রচুর ফ্যাট আছে। এগুলো অনেকক্ষেত্রে বড় মাছ ধরার কাজেও ‘চার’ হিসেবে লাগানো হয়।”
“আমি মালেট খাব।” মুসুন আদুরে গলায় বলল।
“নিশ্চয়ই খাবে, তবে আজ আমরা ভোলা ভেটকির ফ্রাই খাব। কাল রাতে সব রেডি করে ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। সীমাদি ঘুম থেকে উঠলেই ভেজে দেবে।”
“ইস কী পচা নাম!” মুসুন একটু মুখ বেঁকাল।
“নাম কি ওর একটা? ওকে ইংরেজিতে জিউফিশ বলে। সেটা ভাল তো?”
“নামে কী এসে যায়, খেতে ভাল হলেই হল।” টুকুনের জিভে জল এসে গেছে।
“এটা তো গেল সমুদ্রের বটলনোজ ডলফিনদের টেকনিক। নদীতে যারা থাকে, তারা একটু অন্যরকম একটা কায়দা করে। ওখানে এরকম মাড রিং তৈরি করার মতন বড় জায়গা থাকে না তো। তাই তিন চারটে ডলফিনের একটা দল একটা মাছের ঝাঁককে তাড়া করতে থাকে নদীর পাড়ের দিকে। মাছেরা পালাতে না পেরে দলে দলে পাড়ের ওপর উঠে গিয়ে খাবি খেতে থাকে। ডাঙায় তো ওরা বাঁচতে পারে না। তাই বাধ্য হয়ে জলের দিকে ফিরতে চায়। ডলফিনের দল ততক্ষণে কাত হয়ে পাড়ের ওপর নিজেদের মুখগুলো হাঁ করে খুলে শুয়ে থাকে। কিছু মাছ জলে যায় আর কিছু যায় ডলফিনদের পেটে। প্রচুর মাছখেকো পাখিও সুযোগ বুঝে যোগ দেয় এই মহাভোজে। তাদের পেটেও অনেক মাছ যায়।”
মিষ্টির কথা শেষ হতে না হতেই সীমাদি ঢোকে একটা ট্রেতে তিনটে প্লেট সাজিয়ে। তাতে সদ্যভাজা ফিসফ্রাই আর কাসুন্দি। মুসুন আর টুকুন দু’জনেরই চোখ চকচক করে ওঠে।
প্রান্তিক বিশ্বাসের জন্ম কলকাতায়। স্কুলে থাকতে লেখা শুরু। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত কালান্তর সংবাদপত্র, সময় ও গ্রন্থন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় গল্প, কবিতা ও রম্যরচনা। তারপর ২০০০ সাল থেকে দীর্ঘ পনেরো বছরের বিরতি লেখায়। ফিরে আসা ছোটগল্প, অণুগল্প, নিবন্ধ ও উপন্যাসে। তথ্যপ্রযুক্তির কর্মী, বর্তমানে কর্মরত কলকাতায়। লেখা ছাড়া ঘুরতে, ছবি তুলতে আর আঁকতে ভালোবাসেন।
2 Responses
Tor golpo pore bhalo lage. Khub Sunderland.
Thank you so much Brother 💕