(Little Magazine)
স্মৃতি রোমন্থন বড়ো সহজ কাজ নয়। বিশেষ করে যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা প্রায় সকলেই আজকে মৃত। যা বলছি তার মধ্যে আমার কল্পনার মিশেল বেশি বেড়ে গেল কি না সেটা যাচাই করবার আর কোনো উপায় নেই। আরও মুশকিল হল, আমার যা মনে পড়ছে সেগুলো ঠিকমতো ঘটেছিল তো? শামশের আনোয়ার আরও বহু মহলে পরিচিত। আমি তাঁকে চিনতাম খুবই অল্প দিন। তা ছাড়া শামশেরের মতো বর্ণাঢ্য চরিত্রকে সঠিকভাবে মনে রাখাও মুশকিল। (Little Magazine)
শামশের আনোয়ারের সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৬৩ সালে। তখন সদ্য ভর্তি হয়েছি মৌলানা আজাদ কলেজে। যতদূর মনে পড়ে ইতিহাস অনার্সের ছাত্র ছিল শামশের। কলেজ ভবনের উত্তরদিকের বাহুর একেবারে রাস্তার ধারে ছিল মামার ক্যান্টিন। সেখানে আমরা অনেকেই চা-কফি খেতে যেতাম, আর খেতাম মামার তৈরি বিখ্যাত সিঙাড়া। আমরা বলতাম মামার সিঙারা ঝুমঝুমি হিসেবেও ব্যবহার করা যায় কারণ তার খোলসের ভিতর গুটিকতক আলু দিব্যি নেচে বেড়াতে পারত।
(Little Magazine)
আমরা ছিলাম ইংরেজি অনার্সের ছাত্র। যাকে বলে আলাদা ‘রেলা’। এই ব্যাপারটাকে অন্য-অন্য ছেলেরা খানিকটা মান্য করে চললেও শামশেরের তা নিয়ে কোনো খাতির করার প্রশ্নই উঠত না। কেননা তখনই ও বেশ কিছু কবিতা লিখে নাম-টাম করে ফেলেছে। আমরা উভয়ই উভয়কে প্রথম-প্রথম একটু তির্যক চোখে দেখতাম। তবে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই দুজনে দুজনকে বেশ ভালোভাবে মেপে নেওয়ার পর কবে-কীভাবে ঠিক জানি না, একটা আলাদা দল হয়ে গেল আমাদের।
(Little Magazine)
আমরা যারা ওখানে আড্ডা দিতে যেতাম দিনের বেলাটায়, তার মধ্যে আমাদের অনার্সের নিজস্ব ছাত্ররা তো বটেই, আর ছিল আমাদের কিছু সিনিয়র ছেলে– যারা পাস করে বেরিয়ে গেলেও কলেজে ইউনিয়ন করতে আসত। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ বর্তমানে বামপন্থী আন্দোলনের বড়ো নেতা। এছাড়া যারা আসত, তার মধ্যে আমার ইংরেজি অনার্সের দুজন বন্ধু হিমাদ্রি আর অসিতাভ ছিল। সঙ্গে ছিল বাংলার সুজিত ঘোষ, ইকনমিক্সের তপন ঘোষ, সুদীপ আরও অনেকে। আসত ইতিহাসের সনাতন গাঙ্গুলি। প্রধানত এই ক-জনকে নিয়েই ছিল আমাদের দল। এই দলের মধ্যেও একটা উপদল ছিল, যার সদস্য ছিলাম আমি, সুজিত আর শামশের। সারাদিনের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে আমি আবার অন্যান্য দলের সঙ্গে মিশতাম, তাদের সঙ্গেও আমার বন্ধুত্বটা খারাপ ছিল না। (Little Magazine)
কী করে আমি, সুজিত আর শামশের একটা দল হয়ে গিয়েছিলাম তা আমার মনে নেই। শামশের আর সুজিতের ঘনিষ্ঠতার একটা কারণ ছিল দুজনেরই কবিতা লেখার ক্ষমতা। কিন্তু আমার কবিতা লেখা কোনোদিনই আসত না। বস্তুত তখন আমি কিছুই লিখতে পারতাম না। কিছু-কিছু কবিতা অনুবাদ করেছিলাম। ওই পর্যন্তই। শামশের আনোয়ার আমার কী ধরনের বন্ধু ছিল, তাও ঠিক বলতে পারব না। ওর অনেক কিছুই আমার ভালো লাগত না। কিন্তু দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য আকর্ষণ কাজ করত। আমি তখন বেশ একটু চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে ছিলাম। মনের কথা মনেই চেপে রাখতাম, আর শামশের ছিল স্পষ্ট কথার মানুষ। আমি প্রতিদিন সাড়ে তিনটে নাগাদ ক্যান্টিনের বারান্দা থেকে দেখতাম, ছিপছিপে সৌম্যদর্শন সোনালি ফ্রেমের চশমা আর তখনকার ফ্যাশন অনুযায়ী টাইট জিন্স পরা একটা অবয়ব চলে যাচ্ছে প্রধান ফটক থেকে বেরিয়ে বাঁ-দিকে। আমার ওর সঙ্গে যেতে বিশেষ ইচ্ছে করত। কখনো-কখনো জিজ্ঞেস করেছি, ‘তুই কোথায় যাস?’ ও হ্যা-হ্যা করে বলত, ‘তুই জেনে কী করবি? যাবি আমার সঙ্গে?’ হ্যাঁ বলতে সাহস পেতাম না; কারণ শুনেছিলাম ও যেসব জায়গায় যায় সেখানে আমি হব নিতান্তই অপাংক্তেয়। তা ছাড়া অত সাহসও আমার ছিল না; যদিও খ্যাতি ছিল দুঃসাহসী বলেই!
তবে কোনোদিনই ওর সঙ্গে বেরিয়ে কোথাও যাইনি এমন নয়। যেগুলো মনে পড়ে তার দু-একটা বলি :
ওয়েলিংটন স্কোয়ারে বক্সিং রিং-এর ঠিক উলটো দিকে একটা বার ছিল। সেটার নাম মনে নেই। তার পাশ থেকে দুটো দোকান পরে ছিল একটা চুরুট-পাইপ-তামাক এসবের দোকান। তখন চুরুট বিক্রি হত ওই দোকানগুলোতে— ওরা নিজেদের বলত টোব্যাকোনিস্ট। পাওয়া যেত খুব দামি সিগার। আর পাওয়া যেত ছোটো-ছোটো কতগুলো চুরুট, যেগুলোর নাম ছিল ‘চোট্টা’। অসম্ভব কড়া এবং কটু হত তার তামাক। আমি আর শামশের সেই চোট্টা খেতাম। খেতে যে খুব ভালো লাগত এমন নয়, কিন্তু ডাকাবুকো ছেলেরা এগুলোই খায়, কাজেই আমরাও ওগুলোই খেতাম। একবার মনে আছে হঠাৎ কী খেয়াল হল, দুজনে পাশের বারটাতে ঢুকলাম। সন্ধে অব্দি বসে-বসে রাম খেয়েছিলাম কোকাকোলার সঙ্গে মিশিয়ে। ওখানে বসে শামশের আমাকে বলেছিল, ‘এই যে দ্যাখ তুই আর আমি প্রচুর মদ খাই, প্রচুর কড়া তামাক খাই, কত মেয়েকে চিনি, দেখবি আমরা কেমন লেজেন্ড হয়ে যাব।’ আজ বুঝি, শামশের হয়েছিল ‘লেজেন্ড’। আমার তা হওয়া হয়নি।
আর একবার মনে আছে, খুব গরম সেদিন। দুজনে মিলে খালাসিটোলার ঠান্ডা ঘরটাতে ঢুকলাম। ওই সময়ে খালাসিটোলা একেবারেই ফাঁকা। বারে শুধু বসে আছেন গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলোক। ইন্দ্রদা। ওঁর সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমিও এসেছ? দেখো, বেশি খেও না।’
আবার একদিন কলেজে এসেই হন্তদন্ত হয়ে শামশের আমাকে বলল, ‘ক্লাস করতে হবে না, চল একটা জায়গায় যাব।’ জায়গাটা পার্ক আর লাউডন স্ট্রিটের মোড়ের কবরখানা। নিরিবিলি শান্ত একটা অদ্ভুত পরিবেশ। ‘এখানে এলাম বেলালের সঙ্গে দেখা করতে। ও এলে তো এইখানে রাত্রি কাটায়।’ বেশ মাঝারি চাতালমতো একটা গম্বুজের তলায় শানবাঁধানো পরিষ্কার জায়গা। একপাশে একটা ঝোলা পড়ে রয়েছে। ‘কোনো মানে হয়! আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি। বেলাল গেছে বেরিয়ে।’ জায়গাটা দেখে আমি একেবারে শিহরিত। কী দারুণ ব্যাপার! কিন্তু এমনি-এমনি তো চলে যাওয়া যায় না। আমরা আরও দু-একটা কবর খুঁজে দেখলাম। একটা মিনারের তলায় এক ভবঘুরে পাগল বসে আছে। তার সঙ্গে খানিকটা গল্প চালাবার চেষ্টা করলাম। স্বভাবতই খুব একটা জমল না। শুধু সে ইশারায় তার কবজি দেখাল। হাতঘড়ি পরার দাগ। সেবারেই কি না মনে নেই, অন্য একটা কবরের ঘরে দেখেছিলাম অক্ষত পূর্ণাঙ্গ একটা বাঁদরের কঙ্কাল। (Little Magazine)
যতদূর মনে পড়ে, সেই সময়টাতেই শামশের ওর ‘মা কিংবা প্রেমিকা স্মরণে’ বইটার কিছু কবিতা লিখতে শুরু করেছে। সেইসব সময় নিয়ে অনেক স্মৃতিচারণ আমার সঙ্গে শামশের করেছে যার বেশিরভাগ আমার মনে নেই। শুধু একদিনের কথা বলি, যেদিন শামশের হঠাৎ সারাদিন চুপ করে থাকার পরে বলে উঠেছিল এক সন্ধের কথা, যখন জ্বরতপ্ত শরীর নিয়ে ও একজন পাঞ্জাবি তরুণীকে তৃপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করে।
অন্য কোনো একদিন ক্যান্টিনে বসে হঠাৎ শামশের বলেছিল, ‘তোর আর আমার বীর্য যদি তুলনা করি, তাহলে দেখবি আমারটা অনেক পাতলা।’ এইরকম সব বিচিত্র কথাই আচমকা বলে উঠত আমার বন্ধুটি।
আমাদের কবিতা লেখার কাহিনি বলি। ‘পাস’ ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসে চলত আমাদের কবিতা লেখার প্রতিযোগিতা। শামশের নিজে লিখত না, লিখতাম আমি আর সুজিত। আমি কবিতা পারতাম না কিন্তু ছন্দ আমার হাতে ভালোই বের হত। একবার মনে আছে শামশের হঠাৎ খেপে গিয়ে বলেছিল, ‘দেখ সুজিত, এই আজকে একবার আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে সলিলের কবিতা তোর থেকে ভালো হয়েছে। অন্তত ছন্দ সাজানোতে তো কোনো ভুল নেই!’ সেই আমার শেষবার কবিতা প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া। সেদিনের লেখা কবিতাটার একটা লাইন আমার আজও মনে আছে।
(Little Magazine)
বিশেষ ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ কথাবার্তা আমাদের মধ্যে ছিল না। ব্যক্তিগত যাওয়া-আসাও ছিল না। শুধুমাত্র প্রতিবছর রমজানের সময় শামশেরের মায়ের হাতের হালিম খেতে যেতাম আমি আর সুজিত। দিলখুশা স্ট্রিটের ছোট্ট শান্ত নির্জন ফ্ল্যাটের রান্নাঘরে ততধিক শান্ত মাসিমা আমাদের বড়ো আদর করে খাওয়াতেন। আর খেতাম শবেবরাত উপলক্ষে হালুয়া। তখন থেকেই দেখেছি শামশের কোথায় যেন নিজেকে সরিয়ে রাখতে ভালোবাসত। সবসময় ওকে ঠিক ধরা যেত না।
মাঝে মাঝে আমাদের ৯৪ ধর্মতলা স্ট্রিটের বাড়িতে আড্ডা বসত। মৌলালির দরগার পাশে তখন দুটো কুলীন না হলেও চমৎকার রেস্টুরেন্ট ছিল, যেখান থেকে আমরা পরোটা আর কাবাব কিনতাম। মুখে পড়লেই গলে যাওয়া সেই কাবাবকে আমাদের আরেক বন্ধু বলত ‘গরুর বড়া’। সেই দুটোর একটা এখনও আছে। শুধু তার অকৌলিন্য আরও বেড়েছে।
আর একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। সেই ঘটনা শামশেরের চরিত্রের সঙ্গে বড়ো একটা মিলবে না। কলেজে সোশ্যাল হবে। আমরা নাটক করব ‘দ্বান্দ্বিক’। আমি পরিচালক। একটা বড়ো পোস্টার বানানো হয়েছে পশ্চাৎপটে টাঙানোর জন্য। তাতে লেখা ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। হঠাৎ সেখানে উপস্থিত সিপিআই ছাত্র সংসদের দুই নেতা। এই পোস্টার এখানে টাঙানো যাবে না। প্রথমে আমরা আলোচনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম নেতাদের আচরণ নেতাসুলভই। বাধ্য হয়ে আস্তিন গুটিয়ে তেড়ে যেতে হয়েছিল আমাদের কয়েকজনকে। সেই দলের প্রথমে ছিলাম আমি আর শামশের আনোয়ার।
(Little Magazine)
যখন কফি হাউসে ঢুকতাম, তখন শামশেরের অন্য বন্ধুদল। তাদের সঙ্গে আবার আমার বা সুজিতের মিলত না। তারাও আমাদের শামশেরের বন্ধু হিসেবে ঠিক যেন মেনে নিতে পারত না। সম্ভবত ১৯৬৯-’৭০ থেকে আমরা পরস্পরের থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। সেই শেষের দিকের একটা সন্ধের কথা প্রায় অক্ষরে-অক্ষরে আমার আজও মনে আছে। কফি হাউস থেকে বেরিয়ে আমরা দুজনে শ্যামাচরণ স্ট্রিট ধরে হাঁটছিলাম তৎকালীন হ্যারিসন রোডের দিকে। মেয়েদের স্বভাব-আচরণ নিয়ে শামশের বকবক করে চলেছিল। এক-একদিন ও যেন-হঠাৎ করে বেশি কথা বলতে শুরু করত। সেই দিনটা ছিল তেমনই একটা দিন। দিলখুশা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা সিগারেট খাচ্ছিলাম। কোনো একটা মেয়ের আচরণ নিয়ে আমি কিছু মন্তব্য করেছিলাম, আর অমনি শামশের ওর স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে বলে উঠেছিল, ‘শোন সলিল, তোকে একটা জিনিস বলি; যেটা তোর সারাজীবন কাজে লাগবে। ইউ মাস্ট কালটিভেট আ মোস্ট প্রোফাউন্ড ডিসরেসপেক্ট ফর অল উইমেন। দেখবি তখন আর কোনো মেয়ের কথায় তুই আহত হবি না, বিস্মিতও হবি না।’ কথাটা বলেই রাস্তা পার হয়ে ও যেন কোথায় ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।
(Little Magazine)
তারপর থেকে ওর সঙ্গে বসে ভালো করে আর কথা বলা হয়নি। কফি হাউসে দেখা হলে বা রাস্তায় সামনাসামনি পড়লে, শুকনো হেসে খানিকটা কথা বলে যে যার কাজে চলে যেতাম আমরা। তারপর থেকে আমার জীবন এমন একটা পথে চলতে শুরু করল, যে-পথে সত্যি সত্যিই শামশের আনোয়ারের আর জায়গা ছিল না। আরও কিছুকাল পরে ও কোনদিকে চলে গেল আমি আজও জানি না। ওর সঙ্গে আমার আর দেখাই হয়নি। শামশের কোন কথাটা সিরিয়াসলি বলত, আর কোন কথাটা ব্যঙ্গ করে বলত, তা আমি আদৌ বুঝতাম না। শুধু ওর একটা কথা অবশ্য আমি এতকাল মেনে এসেছি : ‘ডু নট এভার বি জাজমেন্টাল’।
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।