বাইরে তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে। জ্বলে গেছে ক্যাম্পাসের আলোগুলো। ম্যাকনেলি একটু উঠে ভারী পর্দাগুলো নিজেই টেনে দিলেন। রাদু জ্বেলে দিলেন আলো। সবাই টানটান। কী হয় কী হয় ভাব। “ঠিক এরকমটাই হচ্ছিল তখনকার পাঠকদের মনে”, যেন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে বললেন ম্যাকনেলি।
– কিন্তু স্টোকার আমাদের সেখান থেকে সোজা নিয়ে গেলেন সেই পাগলের ডাক্তার সিউয়ার্ডের কাছে। তাঁর রোগী রেনফিল্ড ক্রমাগত অদ্ভুত আচরণ করছে। সে মাকড়সা ধরে ধরে আনছে, আর মনোযোগ দিয়ে দেখছে কীভাবে মাকড়সারা মাছি গিলে খায়। সে বলতে থাকে তার “মালিক” এসেছে। মালিক তার সন্ধানে এসেছে। রেনফিল্ড পাগলা গারদ থেকে পালিয়ে পরিত্যক্ত কারফ্যাক্স অ্যাবেতে যায়; এটা সেই সম্পত্তি যার ব্যবস্থা করতেই হার্কার ট্রানসিলভানিয়া গেছিলেন।
এদিকে লুসির শরীর খারাপ হতেই থাকে। হোমউড বাধ্য হয়ে ডাক্তার সিউয়ার্ডের স্মরণাপন্ন হন । তিনিও লুসির অদ্ভুত রোগলক্ষণ দেখে ধন্দে পড়ে যান। চেনা কোনও রোগের সঙ্গে এ রোগের মিল নেই। তিনি তাঁর শিক্ষক ডাক্তার আব্রাহাম ভ্যান হেলসিং-কে আমস্টারডাম থেকে লন্ডনে ডেকে পাঠালেন। এতক্ষণে পাঠক বুঝতে পারে কাহিনির ছেঁড়া সুতোগুলো এক জায়গায় আসছে। ড্রাকুলা বাড়ি কিনেছে হোয়াটবিতে, যেখানে জোনাথন হার্কারের প্রেমিকা মিনা প্রায়ই আসে। শুধু তাই না, সে বাড়ি আবার ডাক্তার সিউয়ার্ডের পাগলাগারদের পাশেই। পাগলা গারদের পাগল রেনফিল্ড ড্রাকুলার শিষ্য। এ যদি অলৌকিক ঘটনা হত, তা হলে এতটা কাকতালীয় সমাবেশকে গাঁজাখুরি ছাড়া কিছু বলা যেতই না। গোটা কাহিনিই হাতে গোনা চার পাঁচটি চরিত্রকে নিয়ে। উপন্যাস তো দূরে থাক, ছোট গল্পেও এমন হয় না।”
– কিন্তু নাটকে তো হয়! বলে উঠল একজন।

– অবশ্যই হয়। আর ব্রাম স্টোকার তো আগাপাশতলা নাটকেরই লোক, সেটা ভুলে গেলে? এর পরের অধ্যায় অতি দীর্ঘায়িত আর একটু ক্লান্তিকরও বটে। ডাঃ সিউয়ার্ডের ডায়রির মাধ্যমে বলা এই অধ্যায়ের মূল হল লুসির শরীরের ক্রমাবনতি। ডাঃ ভ্যান হেলসিং আসেন। লুসির রক্তশূন্য দেহে নতুন রক্ত প্রয়োজন। নিজেই উদ্যোগী হয়ে রক্ত দিলেন আর্থার হোমউড। লুসি কিছুটা সুস্থ হল। মাঝে মাঝে অসুস্থ হলেই তাঁকে রক্ত দিতে হত। দিতেন তাঁর তিন প্রেমিক। হেলসিং বুঝলেন এ কোনও সাধারণ রোগ না। রোগের কারণ মানুষের হিসেবের বাইরে। তাই লুসির গলায় রসুনের ফুলের মালা পরিয়ে দেন তিনি, বন্ধ ঘরে ঝুলিয়ে দেন রসুন। লুসি ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে।
কিন্তু এক রাতে লুসির মা এসব দেখে মেয়েকে সেই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে বন্ধ জানলা খুলে দেন, হটিয়ে দেন রসুনের মালা। পরদিন ভ্যান হেলসিং এসব দেখেই বোঝেন লুসিকে আর বাঁচানো যাবে না। ঘরে ঢুকে রক্তশূন্য লুসিকে বিছানায় লুটিয়ে থাকতে দেখলেন তিনি। ঠিক এখানেই আরও কয়েকটা ঘটনা কাকতালীয়ভাবে একইসঙ্গে ঘটে। লুসির মা, আর্থার হোমউডের বাবা, জোনাথন হার্কারের বস পিটার হকিং আর লুসি… সবাই পরপর মারা যান। উপন্যাসের অর্ধেকও তখন শেষ হয়নি। লুসিকে কবর দেওয়া হল। সিউয়ার্ড ভাবলেন সব রহস্যের ইতি এখানেই। নিজের ডায়রিতে লিখলেন “ Finis”।
– কিন্তু ঘটনার এখানেই শেষ নয়। বলতে লাগলেন ম্যাকনেলি।
– উজ্জ্বল মোমবাতির শিখা মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে আলতো হাওয়ায়। ইদানীং লন্ডনে মৌ মোমের বড় অভাব। তাই প্রাণির-চর্বি থেকে তৈরি ট্যালো জালিয়েই মোমের কাজ চালানো হচ্ছে। এতে সমস্যা একটাই। চর্বি পোড়া পূতি গন্ধে সারা শহর ভরে থাকে। ইদানীং কিছু কিছু বাড়িতে গ্যাসের আলো, লণ্ঠন চালু হলেও মোমবাতির আলো বড় স্নিগ্ধ লাগে আব্রাহামের। কিন্তু এই মুহূর্তে অদ্ভুত অস্থির লাগছে তাঁর। সদ্য একটা অধ্যায় শেষ করলেন তাঁর উপন্যাসের। সম্ভবত শেষ অধ্যায়। শেষ বাক্যের শেষ শব্দ লিখেছেন “Finis”। একদিকে তাঁর সত্তা বলছে এখানেই শেষ করে দেওয়া যাক। লুসি মারা গেছে। মিনা ফিরে পেয়েছে হার্কারকে। কাহিনির শেষ হিসেবে এর চেয়ে ভাল আর কী বা হতে পারে?
আরও পড়ুন: প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলমে: ক্রিসমাস স্পেশাল বাংলা বার্ষিকীর পূর্বসুরী
কিন্তু একই সঙ্গে মনে একটা খটকা দানা বাঁধছে। সেই ট্রানসিলভানিয়ার কাউন্ট? তাঁর কী হবে? সে তো এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায়। ওঁৎ পেতে অপেক্ষা করছে পরের শিকারের জন্য। তিনি কি পারেন পাঠককে এত বড় বিপদের মুখে ঠেলে গা বাঁচাতে? পারেন না। আর তাই উপন্যাসকে এই জায়গায় শেষ করা যাবে না। ভাবছিলেন আর আনমনা হয়ে পেনসিল-কাটা ছুরিটায় হাত বোলাচ্ছিলেন তিনি। বেখেয়ালে ধারালো ছুরির ডগা বিঁধে গেল তর্জনীতে। ধীর সরু ধারায় বইতে থাকল গরম রক্ত। স্টোকার বিচলিত হলেন না। একবারও হাতের শুশ্রূষার চেষ্টা করলেন না। বরং শান্ত বিজ্ঞানীর মতো দেখতে থাকেন সেই রক্তধারাকে। এইরকম রক্ত দিয়েই কি বাঁচানো যেত লুসিকে? কে জানে! কিন্তু নিজের অজান্তেই মস্ত বড় একটা ভুল করে ফেললেন স্টোকার। রক্তদান নিয়ে এমন কিছু তথ্য দিলেন এই অধ্যায়ে যাতে তাঁর অজ্ঞানতা প্রকট হয়ে উঠল”, ব্রাম স্টোকারকে নিয়ে রাদুর গবেষণা অসামান্য। কথাগুলো তিনিই বললেন। গুঞ্জন উঠল ছাত্রদের মধ্যে।
– কী বলছেন স্যার!
– হ্যাঁ। রক্তদান বা রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যাপারটা তখনও ধোঁয়াশায়। আর তাই স্টোকার তিনজন আলাদা আলাদা লোকের রক্ত লুসির দেহে ঢোকানোর ঝুঁকি নিতে পেরেছিলেন। একমাত্র তিনজনের ব্লাড গ্রুপ এক হলেই এটা সম্ভব। কিন্তু ব্লাড গ্রুপের ধারণা তখন কোথায়? সুতরাং দুটো সম্ভাবনা। এক, তিনজনের রক্তের গ্রুপ একেবারে এক ছিল। তাহলে আবার সেই কাকতালীয় ধারণায় চলে যেতে হয়। অথবা দুই, যেটা অনেক অবিশ্বাসীরা বলেন, ড্রাকুলার কামড় না, লুসি মারা গেছিল এই তিনরকম রক্ত মিশে গিয়েই….।
– তারপর কী হল স্যার? এক ছাত্র অধৈর্য।
– সেটাই বলছি। আবার শুরু করলেন ম্যাকনেলি।
– ওয়েস্টমিনস্টার গ্যাজেট পত্রিকায় অদ্ভুত একটা খবর প্রকাশ পেল। এক রহস্যময়ী মহিলা শিশুদের ভুলিয়ে ভালিয়ে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। পরে তাদের পাওয়া যাচ্ছে, কিন্তু গলায় দাঁত ফোটানোর দাগ আর গোটা শরীর ফ্যাকাশে। ভ্যান হেলসিং রহস্য সন্ধানে নামলেন। তিনি মিনা আর জোনাথনের সঙ্গে দেখা করলে জোনাথন তাঁর জার্নালটা ডাক্তারকে পড়তে দেন। মিনা সেই লম্বা ফ্যাকাশে পুরুষের কথা বলে, যাকে সে লুসির সঙ্গে দেখেছিল। ডাক্তার সিউয়ার্ড আর হেলসিং মিলে ঠিক করলেন লুসির কবর খুঁড়ে কফিন বার করবেন। সেদিন রাতে কবর খুঁড়ে চমকে উঠলেন তাঁরা। কোনও মৃতদেহ নেই। শুধু সাদা পোশাক পরা এক মহিলা যেন রাতের অন্ধকারে এক ঘুমন্ত শিশুকে নিয়ে ছূটে বেরিয়ে গেল। পরদিন সকালে মৃতদেহ যথাস্থানে। কিন্তু লুসি যেন আগের চেয়েও সুন্দর হয়ে গেছে। তাঁর গালে লালিমার ছোঁয়া, ঠোঁট টকটকে লাল। শুধু শ্বা-দন্ত দুটো অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেছে। হেলসিং বুঝলেন লুসি ভ্যাম্পায়ারে পরিণত হয়েছে। তাঁর ভাষায় “un- dead”।
হেলসিং লুসির তিন প্রেমিকের সঙ্গে কথা বলে স্থির করলেন, এই ভ্যাম্পায়ারকে আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। তিনি তিন ফুট লম্বা একটা কাঠের গজাল বানালেন। আর্থার লুসির বুকে হাতুড়ি দিয়ে গেঁথে দিলেন সেই গজাল। লুসির চোখ খুলে গেল, সে চিৎকার করতে লাগল এক অপার্থিব কণ্ঠস্বরে, ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এল ঝলকে ঝলকে রক্ত, তারপরে সে নেতিয়ে পড়ল চিরতরে। সিউয়ার্ড আর হেলসিং শেষ কাজটা বাকি রাখলেন না। গলা কেটে দু’ টুকরো করে মুখে গুঁজে দিলেন রসুনের কোয়া, যাতে সে আবার না ভ্যাম্পায়ার হতে পারে। কাজ শেষ করে কফিন তালা বন্ধ করে দিলেন পাকাপাকিভাবে।
– ভ্যাম্পায়ার মারার এই পদ্ধতিটা কি স্টোকারের আবিষ্কার? প্রশ্ন ভেসে আসে।

– একদমই না। উত্তর দিলেন রাদু।
– স্টোকার ভ্যাম্পায়ার মিথের যেখান থেকে যা পেরেছেন নিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, আগে যা ভাসা ভাসা ছিল, স্টোকার তাকেই হাজির করেছেন অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্যভাবে। ভ্যাম্পায়ারের বুকে কাঠের গজাল গোঁজার কথা প্রথম পাই ১৮৪৫- এ লেখা সস্তার এক ভূতের বই Varney the Vampire-এ। ১৮৭২ -এ লেখা ল্য ফ্যানুর Carmilla-তেও এই একই পদ্ধতির কথা আছে। ইংলন্ডের লোককথায় রসুন দিয়ে ভূত ভাগানোর পন্থা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন ট্রানসিলভানিয়ানরা বিশ্বাস করতেন আত্মার বা ভূতের ছায়া আয়নায় পড়ে না। স্টোকার সেটা ভ্যাম্পায়ারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেন। তবে ড্রাকুলার রোদে অসুবিধে হলেও সে রোদকে ভয় পায় না। উপন্যাসেই বেশ কয়েকবার তাকে রোদে দেখা গেছে। পরে অবশ্য সিনেমায় এই ব্যাপারটা এত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় যে কোনও কোনও সিনেমায় এমনও দেখিয়েছে যে, আলো গায়ে লাগতেই ভ্যাম্পায়ার গলে পচে মরে যাচ্ছে। তবে হ্যাঁ, ভ্যাম্পায়ারের কামড়ে মারা গেলে সেও যে ভ্যাম্পায়ার হয়ে যায়, এই ধারণাটা কিন্তু স্টোকার প্রথম দেন।
– এবার পালা ড্রাকুলাকে ধরার। হার্কার এতদিন বিভিন্ন জার্নাল, চিঠি, খবরের কাগজ, সিউয়ার্ডের ফোনোগ্রামের রেকর্ড সব কালানুক্রমিকভাবে সাজিয়ে রাখে। অর্থাৎ আমরা এর আগে যা পড়ি, গোটাটাই হার্কারের কেসস্টাডি। পাঁচজন পুরুষ আর এক মহিলা নিয়ে গঠিত হয় ড্রাকুলা সন্ধানীর দল। সত্যি বলতে কি, এখান থেকে মিনাই কাহিনির নায়ক। হেলসিংয়ের মতে “She has a man’s brain and woman’s heart.”
আর বাকিটা তো ইতিহাস…
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Pinterest, Goodreads
*তথ্যঋণ:
১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্যান্ড ভ্যামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্যাম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্যামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস
জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।