আবার ধোঁয়া উঠছে আমাদের গা থেকে। তীক্ষ্ণ কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া। ধোঁয়ায় জিভ ঠেকালে হয়তো দেখা যাবে, তার স্বাদ পোড়া লবণের মতো। ঘরের দেওয়াল থেকে অসংখ্য প্রচ্ছন্ন ঘোড়ার কঙ্কাল চিৎকার করে ওঠে। সেই শব্দের অভিঘাতে সশব্দে ফেটে যায় কাচের নকশা। দরজায় কারও পায়ের শব্দ এসে থামে। সে বোধহয় ইতস্তত করে পাপোসে দাঁড়িয়ে, কাতর গুল্মের মতো। ক্রমাগত ধোঁয়া উঠে যায়। ধোঁয়াকে অনুসরণ করে আরও তীক্ষ্ণ ধোঁয়া উঠে আসে লতিয়ে লতিয়ে। আমাদের দেহ ভাজা মাছের মতো লাল। তেলের পরত লাগা। এরকমভাবেই আমাদের দিনগুলো যাবে হয়তো। এই সোনালি মোড়কে মোড়া অতুলনীয় দিনগুলো যাবে। ঢল নামা রোদে সবে বয়ঃসন্ধিতে পা রাখা ধানখেতের মতো কৌমার্যময় দিনগুলো যাবে। পরিশেষে হয়তো শ্যাওলা থাকবে গাঢ় সবুজ রঙের। হয়তো থাকবে অদৃশ্য মাইক্রো ব্যাকটেরিয়া অথবা বাথরুমের কোনাকুনি দূরের আকাশে বহুদৃষ্ট চাঁদ, তাকে ঘিরে আরশোলার মতো তারা। পুঁতি-সলমা খসে যাওয়া হিরণ্ময় জংগল। একটি দীর্ঘাকার বাড়ির আঠা আঠা মজবুত শরীরের ছায়া। ধোঁয়ার টানেই হয়তো আমাদের পা মাটি কয়েক ইঞ্চি ওপরে উঠে পোশাকের ঝুলের মতো হাওয়ায় ভেসে থাকে। এই তীব্র উত্তাপে আমাদের হয়তো রূপান্তরিত হয়ে যাওয়া উচিত। স্বচ্ছ কেলাস হয়ে যাওয়া উচিত বা হয়তো পাখি হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমরা আগেরই মতো থাকি। যেমন পাহাড়ের ত্বক বা সমুদ্রের অপেয় জল। শুধু আমাদের চোখের নীচে অনন্ত ট্র্যাফিক জামের মতো কালশিটে জেগে ওঠে
অ্যাতো ধোঁয়ার পরেও আমাদের, আমাদের দাহ্যবস্তুর অবশেষ থাকে। দিন পেরিয়ে গিয়ে আরেকটি দিনের মধ্যে পড়ে কিছু-বা বিচ্ছুরণ তোলে। মলাট খোলার পরেই আহা কী তরতাজা একটি সকাল। শিশিরে ভেজা তুলসীমঞ্চের মতো আরও পবিত্রতর রোদ। কাঠের ফোকর থেকে সুদৃশ্য মানুষ বেরিয়ে আসে। হয়তো তার পেছনে কোথাও ঝটাপটি আছে, আছে ধূসর টিকটিকিদের গোষ্ঠী। লিঙ্গ বা যোনির গায়ে বিশদৃস আঁচিল। তবে মলাট খোলার পর শুধু মানুষই দেখা যায়। তাদের মরকতের গাল। বুকের একপাশে পরিপাটি ফেনা। আমরা সেসবের পটভূমিকায় নিজেদের রেখে দিয়ে ভাবি আজ বুঝি প্লাম্বারের রূপ ধরে ঈশ্বর আসবেন। আমরা নগ্ন হয়ে ঘুরে ফিরে দেখাব আমাদের সব বড় বড় হাঁ, যুবতী ফার্নে ভরে যাওয়া সব খাদ বা পরিসরে বাড়তে থাকা সব প্রকট জ্বালামুখ। ভাবি দিনটি হয়তো একটু পা দুমড়ে আমাদের অভিবাদন জানিয়ে যাবে। স্মৃতির ভেতর থেকে হঠাৎ সোঁদা সোঁদা গন্ধ বেরোবে, যে ঝুলে যাওয়া থুতনি আমাদের মুখের দিকে নিষ্পলক শুধু তাকিয়েই থাকে আর ভেতরে ভেতরে আরও বোবা হয়ে যায়- সে আচমকা ইঁদুরের গন্ধ পেয়ে সচকিত হবে। বিভূতি থেকে ফেরৎ নেবে তাঁর নশ্বর চশমা। আমাদেরও দেহের পাশে আরেকটি দেহ বেড়ে উঠতে থাকে। এই দেহে বুকফাটা আর্তি, অনেক জীর্ণ নদীর দাগ আর দুই পাড়ে মসমস করা সুবর্ণ বালু। তখন কোনও ঢেউটিনের দিকে তাকালে আমাদের শিহরণ আসে। লালাগন্থি নড়ে ওঠে। আজ কি তবে আমরা আবার নিয়নের আলোয় দেখা তেমনই মাংসল দুটো সাপ হয়ে যাব? আঙুল অজান্তে কাঠ হয়ে ওঠে। ভুলে যাই অনতিদূরেই আবার, আবারও আগাছায় অলক্ষ্যে আগুন ধরেছে
ছবি সৌজন্যে Pixabay
জন্ম কোচবিহার জেলায়৷ বড় হয়ে ওঠা আলিপুরদুয়ার জেলার হ্যামিল্টনগঞ্জে৷ কলেজে পড়াকালীন লেখালেখির প্রতি আগ্রহ জন্মায় এবং লেখার হাতেখড়ি৷ স্থানীয় ছোট পত্রপত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশ৷ এরপর লেখায় দীর্ঘ সময়ের ছেদ পড়ে৷ আবার গত তিনবছর ধরে লেখায় ফেরা৷ কাব্যগ্রন্থ 'কিছুক্ষণ থাকা অথবা অনন্তকাল' ২০২০ কলকাতা বইমেলায় 'শুধু বিঘে দুই' থেকে প্রকাশিত৷ মূলত কবিতা লিখতে পছন্দ করেন৷ একটু আধটু গদ্যচর্চাও হয়৷