(Durga Puja)
ভাদ্র সংক্রান্তি পেরিয়ে আরেকটা আশ্বিন এসে পড়ল। স্থলপদ্মের কুঁড়ি এলো, ভোরের আলোয় গাছের তলা বিছিয়ে শিউলি ঝরলো অকাতরে, বিকেলের আলো মরে এলে হিমের আবছা চাদর গাঁ-গঞ্জের মাঠ ঘাট নদীতটকে রেশমের ওড়নায় জড়িয়ে ধরলো। মানুষেরা এসব দেখে, ফেলে আসা শরতের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছে মনে মনে। সেসব স্মৃতিরা ভারী ব্যক্তিগত। পেতলের কড়ায় গুড় পাক দিচ্ছে সংসারী হাত, পুজোর আগে আগে নাড়ু মোয়া গুছিয়ে তুলে রাখবার তাড়া কত! (Durga Puja)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬]
নিকোনো উঠোনে আশ্বিনের রোদ্দুর পড়ছে নরম হয়ে। ঘরে ঘরে ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরছে। কত অপেক্ষা, কত আনন্দ জমে আছে মনের কোণটিতে। সেই চিন্ময়ীকেই তো খুঁজে নিচ্ছে মানুষেরা, ওই শাপলার নরম ফুলে, পদ্মের ফুটে ওঠা সুষমায়। বর্ষা পেরিয়ে আসা এই আমাদের মাটির পৃথিবী যেন জেগে উঠছে রূপে-রসে-গন্ধে। একে তাই অকালবোধন বলতে ইচ্ছে করে না আমার। (Durga Puja)

শরতের আলোটির মতো এও যেন ভারী স্বাভাবিক। বাসন্তী পুজোর ভিতরে যে স্বাভাবিকতা আছে! তাকে অস্বীকার না করেও তো একে স্বীকার করা যায়। আর কী আশ্চর্য দেখুন! এই দুটি কালেই পদ্ম ফুটে ওঠে তার স্বাভাবিক বিকাশে। হৃদকমলে ডাক দিয়ে যায় সে নিজের স্বভাবেই। সেই তো কেজো মানুষকে এমন করে ডাক দিয়ে যায় বছর বছর। (Durga Puja)

যে ঘরে বৈভব নেই, অন্ন নেই, ধরা যাক কিছুই নেই, তার ঘরেও শরতের আলোটি অমন করেই লুটিয়ে পড়ে। মানুষকে সে বলতে চায়, বানিয়ে তোলা আলোকসজ্জায় জগজ্জননীকে খুঁজো না, তাঁর খোঁজ পেতে পারো বরং কাশের বনে ধানের ক্ষেতে। হাওয়ায় হাওয়ায় দুলে উঠছে ধানের ক্ষেত। কে যেন ওর মনের মাঝে শরতদিনের খুশিটি বুলিয়ে দিয়ে গেছে। সেই ধানিরঙের খুশি, আলো আর হাওয়ায় ফিরে ফিরে আছড়ে পড়ছে রান্নাঘরের দাওয়ায়। (Durga Puja)
একে তাই গৌরী বলে ডাকতে সাধ যায়, উমা বলে ডাকতে সাধ যায়। আগমনী গানের মতো কোন এক আশ্চর্য সকালের ঘুম ভাঙানিয়া সুর জানে ও। এই আলো আর আশা দিয়ে গড়া মানবজীবনে আমাদের প্রত্যেকেরই বুঝি একখানা করে ‘ঘর’এর ছবি আছে মনে মনে। সে ঘরে আমরা যদি ফিরতে নাও পারি, উমা ফিরুক। গৌরী ফিরুক। মায়ের পাশটিতে বসে ভাত খাক। পান্তা খাক। তেঁতুলের টক খাক। আমি যদি ফিরতে নাও পারি, উমা তো ফিরেছে। সেও কি কম হলো!
এই মুড়ি নাড়ু নিমকির বয়ম বচ্ছরকার গন্ধ নিয়ে জেগে উঠছে ক্রমে। এত ব্যস্ত পৃথিবীর রান্নাঘরে ওরা কি হয়ে উঠতে চাইছে বাংলার মুখ! ওদেরও কি খানিক খানিক জি আই ট্যাগের প্রত্যাশা ছিল? সেকথা ভেবে দেখবেন কেউ হয়তো। না দেখলেও কিছু এসে যায় না তেমন। কত কিছুই তো মুছে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, যাবে নাই বা কেন! নিয়ম দিয়ে কি ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়! (Durga Puja)

গুড়ের নাড়ু, নারকেলের তক্তি আর কুচো নিমকি দিয়ে সাজানো ছেলেবেলাটা আসলেই ভারী সুন্দর। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় মা দুগগাকে শীতল ভোগ দেওয়ার কী আশ্চর্য আয়োজন! ঘরোয়া ভাবনা গুলো জুড়ে জুড়ে তো আর শাস্তর লেখা হয়নি! তবু এই ঘর, এই রান্নাঘর কেমন করে জানি শাস্তরের শরীরে মিলে মিলমিশে আছে। সে দশমীর পান্তা আর কচুর শাকের ভোগেই হোক বা কাঁচা তেঁতুল দিয়ে শাপলার টকে। (Durga Puja)

ওই আমাদের অপরাজিতা কন্যে, ওই আমাদের ধূমাবতী! তারও এমন করে মায়ের হাতের সুশ্রষা লাগে কে জানতো! এই বিপ্রতীপ মায়া, এই বিরোধাভাস যেন এই শারদোৎসবের প্রাণ। আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের ভাবনায় চিন্তায় যে শারদা ছায়া ফেলে গেছেন তিনি। তিনি যত না বেশি শাস্ত্রের, তার চেয়ে ঢের বেশি ঘরের। এই ঘর মায়া দিয়ে বানানো পার্থিব শরীরের মতো। যেন চাইলেই একে ছুঁয়ে দেখা যায়। (Durga Puja)

একে তাই গৌরী বলে ডাকতে সাধ যায়, উমা বলে ডাকতে সাধ যায়। আগমনী গানের মতো কোন এক আশ্চর্য সকালের ঘুম ভাঙানিয়া সুর জানে ও। এই আলো আর আশা দিয়ে গড়া মানবজীবনে আমাদের প্রত্যেকেরই বুঝি একখানা করে ‘ঘর’এর ছবি আছে মনে মনে। সে ঘরে আমরা যদি ফিরতে নাও পারি, উমা ফিরুক। গৌরী ফিরুক। মায়ের পাশটিতে বসে ভাত খাক। পান্তা খাক। তেঁতুলের টক খাক। আমি যদি ফিরতে নাও পারি, উমা তো ফিরেছে। সেও কি কম হলো! (Durga Puja)

আপন হয়ে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়ানো কি সহজ! তবু এই আশ্বিনের দিন কত সহজে তাকে বুঝিয়ে দিল। সেই সামান্য বোঝাটুকু নিয়ে একেকদিন খুব ভোরে শিউলি গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। মায়ের গায়ের গন্ধ, হলুদের দাগ লাগা রান্নাঘরের গন্ধে ভরে ওঠা শাড়ির আঁচল… শিউলির গন্ধে ফিরিয়ে দিল কে! ফুলেরা কি ঘরে ফেরার রাস্তা চেনে? এই শরতে… (Durga Puja)
নারকেলের চিড়ে
উপকরণ: নারকেল প্রয়োজনমতো, চিনি, একটি বা দুটি ছোট এলাচ, খাওয়ার কর্পূর এক চিমটে (যদি ইচ্ছে হয়)।

প্রণালী: নারকেলের মালা থেকে নারকেলগুলো বের করে নিন। পিছনের কালো অংশটি বাদ দিয়ে জলে ধুয়ে নিন। এবারে খুব পাতলা পাতলা করে কেটে নিন। এই কাটা নারকেল আরেকবার জলে ধুয়ে নিন। জল ঝরিয়ে রাখুন। কড়াই বসান। নারকেল যতটা পরিমাণে হবে, তার অর্ধেক চিনি দিতে হবে। চিনি অল্প জল মিশিয়ে কড়াইতে দিন। এলাচ অল্প ফাটিয়ে দিয়ে দিন। চিনির সিরা ফুটে উঠলে একটু পরে নারকেলগুলো দিয়ে দিন। ক্রমাগত নাড়তে থাকুন। আঁচ বাড়ালে রঙ নষ্ট হয়ে যাবে। চিনির রস গাঢ় হতে হতে এক সময়ে শুকিয়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেলে রান্না শেষ করুন। রান্না ঠান্ডা করে বোতলে ভরে রাখুন। ইচ্ছে হলে অল্প কর্পূর ছড়িয়ে দিতে পারেন।
কাঁচা তেঁতুল দিয়ে শাপলার টক
উপকরণ : কাঁচা তেঁতুল, শাপলা, কালো সর্ষে, শুকনো লঙ্কা, চিনি বা গুড়, সামান্য তেল এবং স্বাদমতো নুন।

প্রণালী : কাঁচা তেঁতুল ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে মাড়ি/কাথ বের করে রাখুন। কড়াইতে তেল দিন, সামান্য পরিমাণে। তেল গরম হলে শুকনো লঙ্কা আর কালো সর্ষে ফোড়ন দিন। কেটে রাখা শাপলার নালগুলিও দিয়ে দিন। সামান্য নুন এবং হলুদ দিয়ে নেড়েচেড়ে জল দিন, খুব অল্প পরিমাণে। ফুটে উঠে শাপলা আধ সেদ্ধ হলেই তেঁতুল দিন। এবং আরেকটু পরে মিষ্টি দিন। আশ্বিনের দিনে শাপলার টক ভারী উপাদেয়। ঘরের তাপমাত্রায় পরিবেশন করুন এই টক বা অম্বল।
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।
