যখন দুদিন ছুটির পর আমি অফিসে পা রাখলাম, আমাদের বস আমাকে তাঁর কেবিনে ডেকে একটা চিঠি হাতে ধরিয়ে দিলেন।
‘এটা তোমার জন্যে। তোমার বন্ধু জোসেফ তোমার সঙ্গে দেখা করতে গতকাল এসেছিল।’
‘জোসেফ?’ কোন জোসেফ?’ আমি এই প্রশ্ন করার আগেই বস আমার দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি হেসে একটা চেয়ারে বসার ইশারা করলেন।
‘তাহলে তুমি একজন লেখক, বটে?’ মনে হল এই কথা বলার সময় চেয়ার থেকে এমনকি একটু উঠলেন তিনি।
জোসেফ নামে একজন বন্ধু, একটা চিঠি রেখে যাওয়া আর এই প্রশ্ন ‘তুমি তাহলে একজন লেখক?’ ছোট করে বলতে গেলে, আমি এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এটা সত্যি যে কয়েক বছর আগে আমার একটা উপন্যাস প্রকাশ পেয়েছে, যা প্রায় কেউ লক্ষ্যই করেনি, কিন্তু আমি লেখক হবার কোনও ভান করিনি। আমি চুপ করে থাকলাম, যেহেতু আমি বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দেব।
‘এই সব লেখালেখি, চাকরি আর সংসার করার পর ঘুচে গেছে’— এই কথাটা এতটাই ক্লিশে যে আর বললাম না। কিন্তু এই লোকটা কী করে আমার সাহিত্যকর্মের কথা জানল, যা এমনকি আমিও ভুলে গেছি?
‘আমাদের সহকর্মীদের বিষয়ে কিছুই না জানা আমাদের ব্যর্থতা। দেখ, আমি এটা মাত্র গতকাল জানতে পারলাম, যখন তোমার বন্ধু বইটা দেখালো। যদি প্রচ্ছদে তোমার ছবি না থাকত, আমি বিশ্বাসই করতাম না।’
আমি চিঠিটা খোলার চেষ্টা করলাম।

‘তোমার মনে পড়ছে না?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন…‘জোসেফ নামে এক বন্ধুর কথা? একটু বয়স্ক। অনেকদিন আগে শেষ দেখা হয়েছিল, ও বলছিল’
‘জোসেফ? আমি ঠিক চিনতে পারছি না’ আমি চুপচাপ বসের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
‘তোমার বন্ধু একটা অদ্ভুত চরিত্র, বুঝলে। খুবই আকর্ষণীয় চরিত্র। সে আধঘণ্টার মধ্যে আমাদের সবাইকে জাদু করে নিল’
কে হতে পারে এই লোকটা! এই ‘আমার বন্ধু’, যে জাদুদণ্ড ঘুরিয়ে ২০ জন মাঝবয়সী লোককে বশ করে ফেলেছে…! আমার কোনও ধারণাই ছিল না।
‘জোসেফ নামের কোনও বন্ধুর কথা আমার মনে পড়ছে না’
‘এহ! না, হতেই পারে না। সে তোমাকে খুব ভালোভাবে চেনে। ও কি তোমার ছবিকেন্দ্রিক উপন্যাসটা নিয়ে আসেনি? আহ, বইটার নামটা যেন কী?’
‘মরীচিকা’ আমি আড়ষ্টভাবে বিড়বিড় করে বললাম।
‘হ্যাঁ এটাই। খুব ভালো নাম। আমি যদি একটা উপন্যাস লিখতাম, আমিও এরকমই নাম দিতাম।’ ফোন বাজতে শুরু করলে তিনি কথা থামালেন, কিন্তু রিং থেমে গেলেই আবার বলতে শুরু করলেন। ‘তোমার ওকে ভুলে যাবার কোনও সম্ভাবনাই নেই। সে নিজেও একজন দুর্দান্ত শিল্পী। পাঁচ মিনিটে যে কারও ছবি আঁকতে পারে। পাঁচ মিনিটও লাগে না। অসাধারণ!’
যেন কথাটা প্রমাণ করতেই তিনি তাঁর টেবিলের ড্রয়ার খুলে নিজের ছবি দেখালেন। আমি দেখতে পেলাম মাত্র চার-পাঁচটা টানে আঁকা ছবিতে লম্বা লম্বা কান আর মোটা নাক নিয়ে আমার বস জীবন্ত হয়ে উঠেছেন।
মাত্র একবার স্কেচটার দিকে তাকালাম, আর অমনি গত দশ–বারো বছর কে যেন মুছে দিল! যেন একটা নদী অতীতে একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়িয়েছিল, আবার একটা উৎস খুঁজে পেয়ে নতুন করে বইতে শুরু করল। অরণ্যের শুকনো বুনো গাছে স্মৃতির নতুন কুঁড়ি গজাল। আর আমি স্মৃতির বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম।

মনায়ি! খুব কম লোকেই তাকে পুরো নামে চিনত। জোসেফ মনায়ি!
আর তারপর আমি টাইপরাইটারের খটখট শব্দ শুনতে পেলাম। আর শুনতে পেলাম একটা নড়বড়ে বাড়ির চারতলায় ওঠার শব্দ। দূরের এক শহরের অন্ধকার সন্ধেগুলো, বিজ্ঞাপনের বোর্ড, ধুলোপড়া দিন, লোকজন, বিশাল বলদ মাথা উঁচু করে অটো রিকশা আর বাসের মধ্যে দিয়ে চলেছে, একটু সামান্য বৃষ্টিতেও কাদার গর্তে বদলে যাওয়া রাস্তাঘাট।
১৯৯০ থেকে ১৯৯৩– এই তিন বছর ওখানে ছিলাম। অন্তত অল্প কয়েকজনের মনে পড়বে একটা পুরনো তিনতলা বাড়ি, যেটা, মিউজিয়াম রোড যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানকার ট্রাফিক আইল্যান্ড থেকে দেখা যেত, আর একটা সিন্ধি ফাইন্যান্স কম্পানি সেখানে কাজ করত। সম্প্রতি সেখানে যাবার সুযোগ হয়েছিল। সেই বাড়িটা ভেঙে ফেলা হয়েছে আর একটা নতুন আকাশ-ছোঁয়া বাড়ি উঠেছে। আমূল পরিবর্তন।
‘দয়াল ইনভেস্টমেন্ট’। একটা ছোট্ট ঘরে কাজ করত। কোম্পানির অস্তিত্বের একমাত্র প্রমাণ ছিল দরজায় ঝোলানো ছোট্ট নামের বোর্ডটা। যদিও অফিস ঘরটা ছোট ছিল, আর সুযোগ সুবিধেও সীমিত ছিল, কিন্তু যারা টাকা জমা রাখত, তাঁদের সংখ্যা নেহাত কম ছিল না। যাইহোক, এটার কোনও প্রচার ছিল না। বণিকরা, বিশেষত মালয়ালি নয় এমন বণিকরা, সেখানে লগ্নি করত আর ধার নিত। এঁরা মূলত চিট নিত আর বন্ডেও টাকা খাটাত, যেগুলো পাঁচ বছরে ডাবল হয়ে যেত আর ডবল টাকা পাওয়া যেত।

সেইসময়টাতে আমি ওখানে কাজ করতাম। সত্যি বলতে কি, আমি ওই কাজটার জন্যেই ওই জায়গাটায় গিয়েছিলাম। লেখক হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর খুব কম মাইনেতে একটা সান্ধ্য দৈনিকে প্রুফ রিডারের কাজের অভিজ্ঞতা— আমার যোগ্যতা বলতে ছিল এই দুটোই। কিন্তু এখানে দয়াল ইনভেস্টমেন্টের পুরো অ্যাকাউন্টিং আমি দেখতাম। অ্যাকাউন্টিং মানে শুধু অ্যাকাউন্টিং নয়। ওখানে আমার কাজ শুরু হত ডাকে আসা চিঠিগুলো খোলা থেকে, তারপর ব্যাংকে যাওয়া, দোকানদারদের সঙ্গে আলাদা আলাদাভাবে দেখা করা, তারপর গাদা গাদা সার্টিফিকেট, ড্র্যাফট, রিসিট বম্বেতে পাঠানো, স্ট্যাম্প লাগানো, চিঠি খামে ভরা , ডাকে দেওয়া-এই সবই ছিল আমার কাজ। কাজের সময় ছিল সকাল আটটা থেকে সন্ধে আটটা। কিন্তু প্রায়ই আমাকে অনেক রাত অব্দি কাজ করতে হত। সকালে নটা নাগাদ একজন টাইপিস্ট আমাকে সাহায্য করতে আসত। সাধারণত ছটায় সে বেরিয়ে যেত। ওর ছিল অস্থায়ী পদ এবং ওকে দৈনিক মাইনে দেওয়া হত। এর জন্য টাইপিস্টদের নিয়োগ ছিল বেশি। আমার সময়েই অন্তত পাঁচ-ছজন টাইপিস্ট এসেছে গেছে। প্রতিদিন ১০০-র ওপর সার্টিফিকেট টাইপ করতে হত। খুব কড়াকড়ি ছিল যেন নাম, তারিখ আর টাকার পরিমাণে ভুল না হয়। ওদের মাইনেও ছিল খুব সামান্য। প্রতিটি ভুলের জন্যে আবার মাইনে কেটে নেওয়া হত। কোম্পানি খুব কড়া ছিল আর আমি ইচ্ছে করলেও কিছু করতে পারতাম না। কম্পিউটার তখন সবে জনপ্রিয় হচ্ছে।

কয়েক মাসের মধ্যেই কাজটা একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। অফিসের পর অন্য কিছু করার সময় থাকতই না প্রায়, লেখার কথা বাদই দিলাম। যে বইগুলো আমি পড়ার জন্যে কিনেছিলাম, সেগুলোতেও ধুলো জমছিল। অন্য চাকরি খোঁজার পর্যন্ত সময় ছিল না। মাঝেমধ্যে খাওয়াও বাদ দিতে হত। আমি কোম্পানির সঙ্গে তিন বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। ওরা স্ট্যাম্প পেপারে আমাকে দিয়ে বন্ড সাইন করিয়েছিল। সময়ের আগে চাকরি ছেড়ে দিলে মাইনের দশ গুণ টাকা ফেরত দিতে হবে। তাছাড়া অন্য কাজ পাওয়াও কঠিন ছিল। আর যদিও কোনও চাকরি পাওয়া যেত, আমার ভয় ছিল এতে মাইনে কম হবে। ওরা সত্যিই প্রাইভেট কোম্পানিতে সাধারণত যে মাইনে দেয়, তার তুলনায় বেশি দিত। আর তাছাড়া আপাতভাবে আমিই ছিলাম অফিসের ইন চার্জ। এই কোম্পানিতে ঢোকার পর তৃতীয় টাইপিস্ট হয়ে এল মনাই। সে আমার সঙ্গে তিন মাস কাজ করেছিল। সে ছিল এমন একজন যে টাইপিস্ট হিসেবে ওই অফিসে সবচেয়ে কম কাটিয়েছে।
আরও পড়ুন- অনুবাদ গল্প: আলোকবর্ষ: প্রথম পর্ব
যখন একজন টাইপিস্ট কাজ ছেড়ে দেয়, যেটা কোম্পানি খুব কমই খেয়াল করে, ক্লাসিফায়েডে একটা ছোট বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। একটা রেপুটেড কোম্পানি একজন অভিজ্ঞ টাইপিস্ট চায়— এরকম। অন্তত ২০ জন ইন্টারভিউ দিতে আসে। তাদের মধ্যে থেকে একজন আপাত নিরীহ লোককে বেছে নেওয়া কিছু কঠিন নয়। এইবার, অ্যাড দেওয়ার আগেই একজন লোক খোঁজ নিতে এল। বোধহয় কোথাও শুনে।
তখন দুপুর। আমি লাঞ্চ খেতে গেছিলাম, যখন ফিরে এলাম, অফিসের বন্ধ দরজার সামনে এই লোকটা দাঁড়িয়ে ছিল। ‘জোসেফ মনাই’ সে নিজেই নিজের পরিচয় দেয়। সে জানায়, সে কাজের খোঁজে এসেছে, টাইপিং জানে সেটাও জানায়।
সাধারণ চাকরিপ্রার্থীর চেয়ে বয়সে বেশ কিছুটা বড়, লোকটার পরনে ছিল মুন্ডু আর লম্বা কুর্তা। লম্বা সাদা চুল, কানের পাশ দিয়ে দুপাশে পরিপাটি করে আঁচড়ানো, চোখে চশমা আর হাতদুটো কুর্তার পকেটে ঢোকানো।

বললাম, ‘আপনি যদি ভালো টাইপিং জানেন তবে আমরা একটা সুযোগ দিতে পারি’। আমার কেমন যেন মনে হচ্ছিল উনি এর উপযুক্ত হবেন না।
যেহেতু টাইপিস্ট এ সপ্তায় আসেনি, অনেক কাজ বাকি পড়ে ছিল। সে আবার বলল সে টাইপিং জানে। ‘আমি তর্জনী দিয়ে টাইপ করি। কিন্তু সব কাজ সময়ে শেষ করতে পারি’ সে বলল।
আমি, পুরো বিশ্বাস না করেই, তার দিকে কিছু কাগজ এগিয়ে দিলাম। দেখলাম, সে টাইপরাইটারের প্লাস্টিক ঢাকনা সরিয়ে তাতে কাগজ পরাচ্ছে।
সে যখন টাইপ করতে শুরু করল, আমি আঁতকে উঠে দেখলাম তার বাঁ হাতে তিনটে আঙুল নেই। সে দুহাতের শুধু তর্জনী দিয়ে টাইপ করছে। দেখে মনে হচ্ছে তিনটে আঙুল যেন কেটে নেওয়া হয়েছে। ধারগুলো থমকে আছে। আমি ওদিকে তাকাতে পারলাম না।
আমরা এ নিয়ে কথা বললাম না, কিন্তু টাইপরাইটারের ছন্দ শুনে বুঝতে পারলাম মনাই-এর টাইপিং স্পিড খুব ভাল। সে কোনওরকম ভুল না করেই টাইপ করে চলেছে। কারেকশনের দরকার হচ্ছে না। কাজটা দেখভাল করারও দরকার হচ্ছে না।
এক সপ্তাহের মধ্যেই সে অফিসে নিজের সব কাজ বুঝে নিলো। এমনকি অবসর সময়ে আমাকে সাহায্য করতেও শুরু করল।
‘খুব ভালো হল তুমি এই অফিসে ঢুকেছ’ আমি ওকে বললাম ‘নাহলে আমি তো এমনকি আটটাতেও বেরোতে পারতাম না।‘ মনাই আমার দিকে ফিরে হাসল। সে ততক্ষণে নিজের কাজ শেষ করে জানলায় দাঁড়িয়ে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ছিল।

এখন যখন আমি খানিকটা সময় পাচ্ছিলাম, আমি কিছু গল্পের চূড়ান্ত খসড়া করে বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতে শুরু করি। যদিও সবকটাই সঙ্গে সঙ্গে ফেরত এসেছিল।
মনাই প্রায়ই দুপুরে অফিস থেকে বেরিয়ে যেত। সে বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করত। সঙ্গে টিফিন আনার অভ্যাস তার ছিল না। সে আমাকে বলেছিল তার বাড়ি কাছে নয়। প্রায়ই সে অনেক বেলা করে ফিরত। এইসব দিনে সে বিকেলে আর কাজ করত না। হয় কুঁজো হয়ে বসে থাকত, ন্য তো খুব ঘটা করে পান বানাত। সে এত এত পান চিবিয়ে যেত, যে অন্যদের কাছে মনে হতে পারে এটা অনন্ত একটা প্রক্রিয়া। একটার পর আরেকটা। পান খাওয়াটা তার খুব অদ্ভুত ছিল। এটা ঠিক সে রোজ করত না। মাঝে মাঝে সে কাজ বন্ধ করে বেরিয়ে যেত। অনেকক্ষণ পরে ফিরত। মাঝে মাঝে অফিস বন্ধ হবার মুখে ঘামতে ঘামতে সে ছুটতে ছুটতে ফিরত। যেহেতু সে তার কাজগুলো চটপট করে দিত, তাই এ নিয়ে আমি ঝামেলা করিনি। হয়তো বয়সের বিরাট তফাতের জন্যেই, আমাদের মধ্যে একান্ত কথাবার্তা খুব কমই হত।
একদিন বিকেলে মনাই আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘তুমি জ্যোতিষে বিশ্বাস কর?’
এক মুহূর্তের জন্যে আমি হকচকিয়ে গেলাম, যেহেতু প্রশ্নটা হঠাৎ এল, কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই।
‘এমনিই একটা প্রশ্ন, আর কিছু নয়’ মনাই বোঝাতে চেষ্টা করল। ‘এইরকম সময়ে লোকে সব বিশ্বাস করে—জ্যোতিষ, হাত দেখা… সব কিছু। বিশ্বাসীদের গায়ে ধাক্কা না খেয়ে তুমি হাঁটতেই পারবে না।’
‘এখন কোনও বিশেষ কারণ আছে এমন ভাবার?’
‘এর মধ্যে একটা চিত্তাকর্ষক ব্যাপার আছে।’ সে আমার দিকে বন্ধুত্বপূর্ণ চোখে তাকিয়ে বলল। তারপর সে টাইপরাইটার থেকে উঠে জানলার কাছে এল। নীচে কিছু একটার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল ‘এসে দেখ। আমি যা বললাম, এ এমন এক সময়, যখন লোকে সবকিছু বিশ্বাস করে। শুধু ভিড়টা দেখ!’

আমি বেশি উৎসাহ দেখালাম না, তবে উঠলাম। রাস্তায় ভিড় জমেছে। বেশ অস্বাভাবিক সেটা। একটা ঝাঁকড়া গাছের নীচে একজন গেরুয়া কাপড় পরা হস্তরেখা-বিশারদ, একজন মহিলা। কিন্তু সেটা বিস্ময়ের কারণ নয়। যখন এখানে প্রথম আসি, তখন থেকেই এঁকে দেখছি। বাসস্ট্যান্ডের প্রতীক্ষালয়ের ছাউনির নীচটায় উনি সাধারণত বসেন।
‘উনি সেই জ্যোতিষী, তাই না?’
সে বিস্মিত হয়ে বলল ‘ তুমি ওঁকে চেনো?’
‘নিশ্চয়। ওঁকে আমার হাতও দেখিয়েছি’
‘তোমার এসবে বিশ্বাস আছে?’ মনাই তার প্রথম প্রশ্নটা আবার করল। ভাবছিলাম, আমার বিশ্বাসের এত কীসের গুরুত্ব?
‘ওহ, স্রেফ মজার জন্যে।‘ প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে চাইলাম আমি।
‘উনি কী ভবিষ্যতবাণী করলেন?’ মনাইয়ের গলায় উত্তেজনা।
‘সে অনেক দিন আগের কথা। বেশি কিছু না। এই দু’তিনটে কথা।’ ‘একটা বলেছিলেন যে, আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাব…’
‘সে তো তোমার চুক্তি শেষ হলে যাবে বটেই। তাছাড়া, তুমি কমবয়সী, তোমার পক্ষে আরেকটা চাকরি পাওয়া সহজ’— মনাই তর্ক জুড়ল।
‘উনি বলেছিলেন আমি অন্য একটা শহরে আরেকটা চাকরিতে ঢুকব’
‘সেটাই স্বাভাবিক’
‘উনি এটাও বলেছিলেন যে এই কোম্পানিতে তালা ঝুলে যাবে।’

মনাই আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যে বোঝা গেল ও কিছুই বিশ্বাস করেনি। তবে এ নিয়ে আর কিছু বলল না ও। এই উত্তর ভারতীয় সংস্থা, যার গ্রাহকদের মধ্যে যথেষ্ট সুনাম আছে, পঞ্চাশ বছরের মজবুত ইতিহাস আছে, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে! এমন কথা বলতে অসাধারণ বুকের পাটা লাগে। আমিও এটা শুনে অবাক হয়েছিলাম।
মনাই চশমা মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল ‘এসব কবে বলেছিলেন?’
‘বেশ কিছুদিন আগে। মনে হয় আমার প্রথম আসার সময়।’
‘আমি এসবে বিশ্বাস করি না।’ মনাই বলল। ‘আমি এসবের বিরুদ্ধে বেশ কিছু সময় ধরে আন্দোলন করছি। যুক্তিবাদী আন্দোলনের একজন কর্মী আমি। আমি ওদের প্রকাশনায় সাহায্য করতাম। যাবতীয় ধ্যানকেন্দ্র আর প্রার্থনা-সভার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিবাদ আর বিক্ষোভে আমি অংশ নিয়েছি। আমি শবরীমালার মকর জ্যোতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদীদের একজন ছিলাম, একটা বিরাট আগুন জ্বালিয়ে… সেই সময়…’
আমি আমার চেয়ারে ফিরে এসে কাজ শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার টাইপরাইটারের খটাখট শোনা গেল।
‘কিন্তু কেউ কি আছে যে নিজের ভবিষ্যৎ জানতে আগ্রহী নয়?’ আমরা যেখানে শেষ করেছিলাম, তার রেশ টেনেই সে আবার বলতে লাগল। যেন খুব গোপন কথা বলছে, এমন নিচু স্বরে কথা বলছিল সে। ‘উনি যদি আমার কররেখা পড়তে প্রস্তুত থাকেন, আমি ওঁর কাছে যাব। বিশ্বাস করি আর না করি, আমি শুনব ওর কথা।’
‘উনি প্রস্তুত বলতে তুমি কী বলতে চাইছ?’ আমি প্রায় হেসে ফেললাম। ‘তোমাকে শুধু ওঁর কাছে যেতে হবে। ওঁর জন্যে এটা তো টাকা রোজগারের উপায়।’
‘ওই সব লোকের সামনে ওঁর কাছে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিতে আমার দ্বিধা আছে। আমি একসময় এইসবের বিরোধিতা করেছিলাম তো! এমনকি এখনও এটা স্রেফ কৌতূহল। বিশ্বাসের কোনও ব্যাপার নেই।’
‘এতে কিছু যায় আসে না। তোমার হাত দেখানোই উচিত। আমি নাহয় তোমার সঙ্গে যাব। আজ সন্ধেয় একটু আগে অফিস থেকে বেরব আমরা। সেই সময়ে বেশি ভিড়ও থাকবে না।’ আমি ওকে উৎসাহ দেবার চেষ্টা করলাম।
‘মনে হয় উনি সবার হাত দেখেন না। একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা হয়ে গেলে সেদিনের মতো বন্ধ করে দেন। ভিড়ের মধ্যে কে যেন বলছিল ওঁর দৈবী ক্ষমতা আছে।’ মনাই উপহাস করে বলল।
‘দৈবী ক্ষমতা! তা তো জানি না’ আমি কাজ করতে থাকলাম। ‘তবে একটা কথা জানি, ওঁর চোখে দৃষ্টি নেই।’
মনাই আচমকা টাইপ করা থামিয়ে আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে হাঁ করে তাকাল।
‘হ্যাঁ। এটাই সত্যি। উনি একটা পালক দিয়ে অথবা আঙুল ছুঁইয়ে হাত পড়েন’ আমি বললাম।
‘আরেহ। সেটা নির্ঘাত অভিনয়!’
‘এটা আমিও ভেবেছিলাম, কিন্তু…’ আমি গলা নামালাম আরও। ‘আমার কাছে এর প্রমাণ আছে। একদিন আমি ওঁকে খোলা জায়গায় উবু হয়ে পেচ্ছাপ করতে দেখেছিলাম। বেশ অন্ধকার তখন। ছেলেরা এমন করে। কিন্তু কেউ দেখার দূরতম সম্ভাবনা থাকলেও মেয়েরা এমন করবে না কক্ষনও। যতই বয়স হোক না কেন। তাই না! তিনি এটা করলেন এই ভেবে যে কাছাকাছি কেউ নেই। সত্যি বলতে কি তখনও ওখানে অল্প কজন লোক শেষ বাস ধরার জন্যে দাঁড়িয়েছিল।’
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।