Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

অনুবাদ গল্প: তিনটে আঙুল (দ্বিতীয় পর্ব)

তৃষ্ণা বসাক

জুন ২৮, ২০২৩

E-Santosh kumar Story translation part 2
E-Santosh kumar Story translation part 2
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

সেই সন্ধেয় আমরা সামান্য আগে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম আর দেখলাম সেই বৃদ্ধা মহিলা গাছতলায় একা বসে আছে। লোকের উন্মাদনা একটু মনে হল থিতিয়ে পড়েছে। পাগলের মতো চারদিকে দেখে, চেনা কেউ ধারেকাছে নেই সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে, মনাই ওঁর কাছে গেল। আমি নিশ্চিত জানতাম এই শহরে মনাইয়ের চেনা কেউ নেই। কেউ কোনওদিন অফিসে ওর খোঁজ অব্দি করতে আসেনি। কোনও ফোনও আসেনি। সে বলেছিল তার বাড়ি দক্ষিণের দিকে কোথাও। এইরকম কিছু ছোটখাট কাজ করে আর টিউটোরিয়াল কলেজে পড়িয়ে সে পেট চালায়। আমি কক্ষনও এই সবের সত্যতা যাচাই করার কথা ভাবিনি।

মহিলা পরেছিলেন হলুদ আলখাল্লা ধরনের পোশাক। গলায় তিন থাকের রুদ্রাক্ষের মালা। এছাড়া আর কোনও গয়না নেই। আমরা যখন গেলাম তাঁকে ধ্যানে মগ্ন মনে হল।

মনাইয়ের বাড়ানো হাতটা তিনি নিজের হাতে টেনে নিলেন। আমার মনে পড়ল, যখন আমি ওঁর হাত ছুঁয়েছিলাম কী অদ্ভুত ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি হয়েছিল। যেন একজন মরা মানুষের হাত ছুঁচ্ছি।  উনি একটা পালক নিয়ে মনাইয়ের হাতের রেখাগুলোয় বোলালেন। তারপর খুব আস্তে মনাইয়ের আঙুলগুলো টিপলেন। মনাই তার তিনটে আঙুলবিহীন বাঁ হাতটা কোলের ওপর রেখে বসে পড়েছিল।

‘আপনি বাসস্ট্যান্ড থেকে এখানে এসে বসেছেন, তাই না?’ আমি টুকটাক কথা বলতে চেষ্টা করলাম।

মনাইয়ের বাড়ানো হাতটা তিনি নিজের হাতে টেনে নিলেন। আমার মনে পড়ল, যখন আমি ওঁর হাত ছুঁয়েছিলাম কী অদ্ভুত ঠান্ডা শিরশিরে অনুভূতি হয়েছিল। যেন একজন মরা মানুষের হাত ছুঁচ্ছি।  উনি একটা পালক নিয়ে মনাইয়ের হাতের রেখাগুলোয় বোলালেন। তারপর খুব আস্তে মনাইয়ের আঙুলগুলো টিপলেন। মনাই তার তিনটে আঙুলবিহীন বাঁ হাতটা কোলের ওপর রেখে বসে পড়েছিল।

‘সন্ধের ঝড় আজকাল খুব হচ্ছে’ তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে হাসলেন। তাঁর মুখে অল্প কটা দাঁতই আছে। যেক’টা অবশিষ্ট আছে, বা ক্ষয়ে গেছে, তাতে পানের দাগ।

‘তোমার আঙুল অস্বাভাবিক লম্বা। ‘তিনি আস্তে আস্তে বললেন।

সত্যি কথা। তখনই আমি খেয়াল করলাম মনাইয়ের আঙুলগুলো খুব লম্বা।

‘তুমি একজন শিল্পী’— ঝোলানো কান নাড়িয়ে তিনি বলে চললেন। মনাই সে কথায় প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকল। হয়ত কারও কাছ থেকে কোনও প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষা ছিল না তাঁরও। মনাইয়ের তালুতে তিনি পালক বুলিয়েই চললেন।

‘কিন্তু তুমি বাঁচার জন্যে নানান ছোট কাজ করেছ। অ্যাকাউন্টেন্ট ছিলে, তারপর নথি-লেখক, রেকর্ড কিপার,। অবশ্যই বাচ্চাদের পড়িয়েছ। এত সব কাজ, কারণ শিল্পীর জীবনে কিছু সমস্যা হচ্ছিল।’ তিনি পালক ঘোরানো বন্ধ করলেন। ‘এর পরেও কেউ একজন তোমাকে আঁকার কাজে বাধা দিচ্ছে।’ তারপর আবার পালক ঘোরাতে শুরু করলেন। আমার মনে হচ্ছিল পালকটা একটা জীবন্ত কিছু।

Image 1

মনাই কোনও কিছুতেই কোনও উত্তর দিল না। আমরা ওঁর পাশে বসেছিলাম, একটু ঝুঁকে। একেকটা পর্যবেক্ষণের জন্য এত সময় নিচ্ছিলেন মহিলা যে আমি অস্থির হয়ে উঠছিলাম। এই সময় যেন ওঁর জিভের ডগায় বৃষ্টির ফোঁটার মতো কথা জন্মাচ্ছিল আর মাটিতে পড়তে সময় নিচ্ছিল। তিনি নিজের হাতের পাতায় পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছিলেন কিংবা এর ডগায় মাসাজ করছিলেন। পুরো সময়টা তিনি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন দেখে আমার অবাক লাগছিল।

বৃদ্ধা মহিলা মনাইয়ের হাতের পাতায় নিজের হাত দিয়ে চাপ দিলেন আর শুঁকলেন। এই কাজটা তিনি বেশ কয়েকবার করলেন। হঠাৎ যেন শিউরে উঠে তিনি হাতটা নামিয়ে দিলেন। তারপর নিজের পালক তুলে ঝুলিতে রাখলেন।

‘কী হল?’ এই প্রথম মনাই কথা বলল। ওর প্রশ্নের মধ্যে উদ্বেগ টের পাচ্ছিলাম।

‘কিছু না। এই সব…’ বৃদ্ধা বললেন। তাঁর চোখের পাতা খুলে গেল। আমি দেখলাম সাদা সূর্যের ডুবে যাওয়ার মতো তাঁর মৃত চোখের তারার অস্থির নাড়াচাড়া।

তিনি চুপ করেই থাকলেন দেখে আমরা উঠে পড়লাম। আমি টের পেলাম যখন তিনি মনাইয়ের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন তাঁর হাত কাঁপছিল।

রাস্তার আলো জ্বলছিল। আমরা ছুটন্ত গাড়ির হেডলাইটের আলোর পাশে পাশে হাঁটছিলাম। আমি যে খামগুলো সঙ্গে এনেছিলাম সেগুলো রাস্তার একটা ডাকবাক্সে ফেলে দিলাম। তারপর একটা ঠেলাওলার কাছ থেকে বাদামভাজা নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে লাগলাম।

‘তুমি খাও। আমি বাস ধরব।’ মনাই বলল ‘কাল দেখা হবে।’

চলে যাবার আগে আমি বললাম ‘তাহলে তুমি এখন হাত দেখায় বিশ্বাস কর?’

‘কিন্তু কী বিরাট কথাই বা তিনি বললেন?’ মনাই আমাকে হেসে বলল।

Image 3

পরের দিন মনাই অফিস এল না, জয়েন করার পর এই প্রথম। সন্ধেয় ফোন করে বলল, ও অসুস্থ। সকাল থেকে মারাত্মক মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। এটা ওর মাঝে মাঝে হত। কিন্তু অনেক দিন মাথার যন্ত্রণাটা হয়নি। মনাই ওষুধ খেয়েছিল আর ভেবেছিল পরের দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। সে পরের দিন আসবে বলে ফোন ছেড়ে দিল।

পরের দিনটা দেখা গেল আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। সেইদিন প্রথম আমার একটা ছোটগল্প ছাপা হল, তাও আবার বেশ জনপ্রিয় সাপ্তাহিক কাগজে। যেকোনও তরুণ লেখকের মতো আমার মনে হয়েছিল, জীবনে কিছু একটা করলাম। প্রাথমিক বাধা কাটিয়েছি, এবার আমার আত্মবিশ্বাসী লাগছিল যে এই জগতে আমি কিছু করতে পারব। আমি সাপ্তাহিকের একটা কপি কিনে অনেকবার পাতা ওল্টালাম। আমি বোঝার চেষ্টা করছিলাম কীভাবে পাঠক আমার গল্পের পাতাগুলো খুঁজে পেতে পারেন। কেউ সামনের দিক থেকে পাতা উলটে যেতে পারেন, আবার কেউ বা পেছনের দিক থেকে। আমি এও ভেবেছিলাম যে কিছু পাঠক সূচিপত্রে আমার নাম দেখে সোজা সেই পাতাটাই খুলবেন। এটা না বললেও চলে, যতবারই পত্রিকাটা খুলছিলাম, ততবার কেবল আমার গল্পটাই পড়ছিলাম।

কাছাকাছি আমার কোনও বন্ধু ছিল না, যাদের সঙ্গে আমি এই আনন্দ সেলিব্রেট করব। গোটাদিন অফিসের কাজেই আটকে রইলাম, কিন্তু নিজেকে নিয়ে বেজায় খুশি ছিলাম আমি। আর এই গোটা সময়টাই মনাই পাগলের মতো টাইপ করছিল। আমি তো ভাবছিলাম সে আগের দিনের সার্টিফিকেটগুলোও টাইপ করছে।

 

লাঞ্চব্রেকে আমি ওর টাইপ করা সার্টিফিকেটগুলো ডেসপ্যাচ করার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম। প্রথম ঠিকানাটা আমি একটা নোটবইতে টুকলাম। আমাদের বাইরের মেলের রেকর্ড এখানে রাখা হয়। জোসেফ মনাই, ৩০৩ কাল্লার লেন। ঠিকানাটা খানিক চেনা লাগল।

আমি পরেরটায় গেলাম। এ কি! একই ঠিকানা! আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মনাইয়ের টাইপ করা পুরো লটটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সমস্ত সার্টিফিকেটে মনাই একটাই নাম আর একটাই ঠিকানা টাইপ করেছে। সেটা তার নিজের নাম আর ঠিকানা। জোসেফ মনাই, বয়স ৪৬। আমি ভাবছিলাম এই লোকটার হল কী, এতদিনে এই লোকটা তো একটাও ভুল করেনি।

Image 2

মনাই সিটে ফিরে যাবার পর আমি কাগজগুলো তুলে নিলাম। সে খুব ঘামছিল আর কাঁপছিল। ওর মুখ গনগনে লাল হয়ে গেছিল।

‘কী হয়েছে মনাই?’ আমি সার্টিফিকেটের স্তূপ পাশে সরিয়ে রাখলাম। ‘তুমি ভীষণ ঘামছ।’

‘কিছু না, একদম কিচ্ছু না। প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা আমাকে ছাড়ছে না’

‘কোনও ওষুধ খাওনি?’

সে কোনও উত্তর না দিয়ে টেবিলে মাথা নামিয়ে বসে ছিল। আমি ঠিক করলাম কিছুক্ষণ ওকে ঘাঁটাব না।

‘ওই যে হাত দেখে…’ আমার দিকে ঘুরে মনাই বলল।

‘সেই বৃদ্ধা মহিলা? কেন, তাঁর কী হল আবার?’

‘না, মানে তেমন কিছু নয়। কিন্তু উনি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছেন’  মনাইয়ের স্বর কাঁপছিল। ‘আমি ওঁর পাশে গতকাল সমস্ত দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম, কখন ভিড় সরে যাবে সেই অপেক্ষায়। বলতে গেলে সারা দিন লোক ওঁকে ঘিরে ছিল।’

তাহলে মনাই সারাদিন ছুটি নিয়েছিল মহিলার সঙ্গে কথা বলার জন্যে? আমি ভাবছিলাম, লোকে সাধারণত যা ভাবে, চরম নাস্তিক শেষ অবধি সন্ন্যাসী হয়ে যায়। আমার মনে হল না উনি মনাইয়ের অতীত আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যা বলেছেন, তার মধ্যে কিছু সারবস্তু আছে। হস্তরেখা বিশারদ আর জ্যোতিষীরা তো এইরকম। তারা সবাইকেই শিল্পী বানিয়ে ফেলে। তারা বলবে রাস্তায় বাধা আছে। কোন জ্যোতিষী অস্বীকার করবে শ্ত্রুর অস্তিত্বের কথা? যখন উনি মনাইকে বলছিলেন কেউ ওকে বাধা দিচ্ছে, আমার এটাই মনে হয়েছিল। আমার মত হচ্ছে, এইসবকে নিছক মজা হিসেবেই নেওয়া উচিত।

‘শেষ অব্দি আমি তাঁকে একটু একান্তে পেলাম, আমি আমার হাত দেখালাম, তিনি যে আগে এই হাত দেখেছেন, সেটা না বলেই…’

‘আর তারপর?’

‘আমার হাত ছুঁয়েই উনি গালাগাল দিতে শুরু করলেন। ‘শুয়োর, শুয়োর’ উনি চিৎকার করে উঠলেন। ‘তুই আমার কাছে পরশু এসেছিলি তাই না? তুই ভেবেছিস আমি ভুলে গেছি? তোর দুর্গন্ধ হাত নিয়ে তুই চলে যা!’

Image 4

আমি শিউরে উঠলাম। ‘মনাই, তোমার হাতে কী আছে? সেইদিনও উনি বারবার হাত শুঁকছিলেন।’

‘সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। উনি আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন। আমার খুব খারাপ লেগেছে। জানো, আমার ডান হাতে কোনও সমস্যা নেই।’ সে নিজের লম্বা, শীর্ণ ডান হাতটা তুলল যেন নিশ্চিত হবার জন্যে। ‘এমনকি ওঁর কাছে যাওয়ার আগে আমি ভালো করে হাত ধুয়েছিলাম। তবুও উনি আমাকে অপমান করলেন। ওভাবে যখন চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন আশপাশের দোকানদার আর অটোওলা সব আমার দিকে তেড়ে এল।’

দেখলাম মনাই সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আমার মনে হল, এটা ভুল টাইপের ব্যাপারে কথা বলার ঠিক সময় নয়। সেই বান্ডিলটা আমি পাশে সরিয়ে রাখলাম।

‘যেতে দাও’— আমি প্রসঙ্গ বদলাতে চাইলাম। ‘আজ আমার জন্য একটা ভালো দিন’

মনাই আমার দিকে অনাগ্রহের সঙ্গে তাকাল। তার মাথায় এখনও ঘুরছে ওই হাত-দেখা মহিলা আর ওঁর যাচ্ছেতাই অপমানের পর ওকে ঘিরে ধরা লোকজনের কথা।

ওর হাতে সাপ্তাহিক পত্রিকাটা, যেটায় আমার গল্পটা বেরিয়েছে, সেটা দিলাম। ‘দেখ! এই পত্রিকায় আমার লেখা বেরিয়েছে।’

মনাই লাফিয়ে উঠল, যেন সে অদ্ভুত কিছু শুনেছে। সে পাতাগুলোর ওপর আঙুল বোলালো আর চরিত্রগুলোর ছবির দিকে চেয়ে রইল। দেখতে পাচ্ছিলাম তার মুখ আনন্দে ঝলমল করছে।

‘তাহলে তুমি একজন লেখক, আচ্ছা? আর আমি এতদিন তোমার পাশে বসে, একসঙ্গে কাজ করেও তা জানতে পারিনি!’

‘এ আর কী এমন বড় ব্যাপার? তাছাড়া এটাই আমার প্রথম প্রকাশিত গল্প’ — আমি বিনয় করে বললাম।

সে কয়েক মিনিটের মধ্যে পুরো গল্পটা পড়ে ফেলল। তারপর সে করমর্দন করে বলল ‘ভালো গল্প। এসব কখন লিখলে তুমি?’ 

‘অনেক আগে’ আমি বললাম, ‘এখানে আসার পর লেখাটা একটু মাজাঘষা করেছি।‘

‘তোমার লেখা চালিয়ে যাওয়া উচিত।’ উৎসাহ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল মনাই। ‘তুমি একটা গল্পের বই বার কর।’

Typewriter

ভুল টাইপ করা সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা অফিস বন্ধ হতে হতে আমার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। কিন্তু তালা দেবার পর আমি ওকে বিষয়টা বললাম।

‘মাঝে মাঝে আমার মনোযোগ চলে যায়। তারপর কী হয়, আমি একবার যেটা টাইপ করেছি সেটাই বারবার করতে থাকি। আমি কী করছি আমার জ্ঞান থাকে না’ — মনাই নির্দ্বিধায় নিজের ভুল স্বীকার করে নিল। ‘কী ভুল করেছি? খুব বেশি ভুল? কাল আমি আবার টাইপ করে দেব। প্লিজ এইবারটা মাফ করে দাও। এটা ইচ্ছা করে করিনি’

‘ঠিক আছে’— ভুল মেনে নেওয়ার জন্যে ওর প্রতি একটা ভালবাসা অনুভব করলাম আমি।

ওই সময়েও জ্যোতিষীর কাছে ভবিষ্যৎ জানার জন্য কিছু লোক অপেক্ষা করছিল। আমরা ওঁকে পাত্তা দিলাম না।

‘একটু চা খাওয়া যাক’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘চা? এতে চলবে? বিশেষ করে আজ, যেদিন তুমি একজন লেখক হলে?’ মনাই হেসে বলে চলল। ‘এখনও মাথা-ব্যথাটা জ্বালাচ্ছে। ভালো কথা, তুমি মদ খাও?’

‘একবার বিয়ার খেয়েছিলাম’ আমি বললাম।

‘তাহলে একটা বারেই বসা যাক। আমি কিন্তু বিয়ার খাই না…’ মনাই বলল।

রাস্তার শেষ প্রান্তে একটা ছোট বার ছিল আর আমরা সবচেয়ে নিরিবিলি একটা কোণ বেছে নিলাম। আমি দেখলাম, সে একটা সস্তা রাম অর্ডার দিল। আমি শুনেছিলাম, যারা প্রায়ই মদ খায়, তাদের পানীয় হচ্ছে রাম। মদের মধ্যে সবচেয়ে নিচু জাত।

‘আমি প্রায় দু’বছর পর মদ খাচ্ছি…’

‘ইন্টারেস্টিং!’ আমি এক চুমুক বিয়ার খেয়ে বললাম ‘যাই হোক, রোজ মদ খাওয়া উচিত না।’

‘সত্যি। আমার ডাক্তার আমাকে না খেতেই বলেছে।’ মনে হল সে এ নিয়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছুক না।

‘কিন্তু তোমার অসুখটা ঠিক কী?’ আমি জিজ্ঞেস করি। ‘তোমার কি হার্টের রোগ আছে?’

আমার কথার উত্তর না দিয়ে মনাই হাসল। মদ মনে হল ওকে উৎফুল্ল করে তুলেছে। ড্রিংক শেষ করে গ্লাসটা বেশ শব্দ করে টেবিলে রেখে মনাই বলল ‘আমি ভাবছিলাম, ওই মহিলা আমার কাছ থেকে কী গোপন করতে চাইছে?’ সে তারপর নিজের ডান হাত শুঁকতে লাগল।

‘কিন্তু আমি গেস করতে পারি…’ সে খুব আস্তে আস্তে বলল— ‘মাঝেমাঝে আমি নিজেও আমার হাত শুঁকি। অন্যদের মতো। আর প্রতিবারই আমি সেই গন্ধটা পাই…’

‘কীসের গন্ধ?’ আমি কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করি।

‘রক্ত!’ যেন একটা গোপন কথা বলছে এমনভাবে সে ফিসফিসিয়ে বলল।

আমি নিঃশব্দে ওর দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে রইলাম।

’কিন্তু আমি অবাক হইনি। রক্তের গন্ধ আমার চেনা।’ সে এক মুহূর্ত থেমে বাঁ হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

‘এখনও নোংরা রক্তের গন্ধ পাচ্ছ, তাই না?’

আমি বিয়ার মাগটা তুলেছিলাম চুমুক দেবার জন্যে, নামিয়ে রাখলাম।

‘কিন্তু জানো তো আমার এই হাতটা আমি দেখাইনি’

‘জ্যোতিষীরা সাধারণত মানুষের ডান হাত দেখে’

সে বাঁ হাত গুটিয়ে আমার দিকে চেয়ে রইল। সে দুহাত জোরে জোরে ঘসতে লাগল। বারের রহস্যময় লাল আলোয়, ওর বাঁ হাতের কাটা আঙুল তিনটের শূন্যতা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না।

Two men in pub

‘তোমার আঙুলে কী হয়েছে?’ আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম। এতদিন এটা নিয়ে প্রশ্ন করতে আমার ইচ্ছে করত না।

‘এগুলো?’ সে তার বাঁ হাতটা তুলল, তাতে মাত্র দুটো আঙুল ছিল। হালকা চালে বলল ‘সেরকম কিছু না। আমি ওগুলো কেটে ফেলেছি।’

আমার গলা থেকে যেন শব্দ কাটা পড়েছে মনে হল। মনে হল, ওই কাটা আঙুলের ক্ষত থেকে এখনও রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে।

আমার নীরবতায় সে একটুও বিচলিত হল না। সে গ্লাসে জল ঢেলে মুখ ভরতি করল, আর সমস্ত সময়টাই আমার চোখের দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে।

‘এর জন্যে একটা চওড়া ছেনি লেগেছিল’ সে তার ডানহাতের আঙুলগুলো ঘন মুঠি করে যেন ছেনির মাপ বোঝাতে চাইল।

আমি আবার বিয়ার মাগটা তুলে নিলাম। ঠোঁটে ছুঁইয়ে মনে হল আরও তেতো হয়ে গেছে।

‘কিছু অঙ্গ মানুষের কাছে বোঝা’ সে আরও এক পেগের অর্ডার দিয়ে আমাকে বলল ‘বিশেষ করে একজন শিল্পীর কাছে। এগুলো তোমার মনোযোগ নষ্ট করত।‘

শিল্পী! পামিস্ট এই শব্দটাই ব্যবহার করেছিল!

মনাই মনে হল আমার মনের কথা পড়ে ফেলেছে। ‘একসময় আমি কাঠ খোদাই করতাম। ওইসব ছেনি তখন আমার লাগত’— কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বলল মনাই।

আমি উত্তর দিলাম না। আমি ওর চোখের দিকে তাকাতে ভয় পাচ্ছিলাম।

‘তুমি ঠিক, বন্ধু, ওই বৃদ্ধার অন্তরদৃষ্টি আছে। আমি আর কোনও যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না। উনি যা বলেছেন ঠিক। আমি অনেক ছবি এঁকেছি।’

‘এখন আঁকো না?’

‘হ্যাঁ আঁকি। শুধু মনে মনে।’ সে বিষণ্ণভাবে হাসল। ‘ ডাক্তার আমাকে কাগজের ওপর আঁকতে নিষেধ করেছেন।’

আমি লক্ষ্য করলাম ডাক্তার শব্দটাতে এসে তার কথা কেমন আচমকা থেমে গেল।

‘একবার আঁকা শুরু করলে আমি আর থামতে পারি না। এটা একটা সিনড্রোম। মাঝে মাঝে একই ছবি আমি বারবার এঁকে চলি…’

‘সকালের সার্টিফিকেটের মতো, তাই না?’

সে আমার কথায় মাথা নাড়ল।

‘ওই বুড়ি একটা ডাইনি।‘ মনাই পরের পেগে চুমুক দিয়ে বলল ‘ও সব… সব জানে’

‘মনাই ছবি আঁকতে তোমার সমস্যা কী? ওঁর কথা কি মনে পড়ছে না?’

 

‘উনি একদম ঠিক বলেছেন। আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছে। সবাই জানে তা নাহলে আমি এঁকেই যাব, এঁকেই যাব। ওই ডাইনিবুড়ি আমার সমস্ত জীবন একটা বইয়ের মতো জানে।’

‘কেন তোমাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে?’ আমি আবার প্রশ্নটা করলাম

‘এটা এমন নয় যে কেউ আঁকা থামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি প্রতিকূল ছিল’ সে নিচু গলায় বলে চলল… ‘মেন্টাল অ্যাসাইলামে তুমি রং-তুলি ক্যানভাস কোথা থেকে পাবে?’

সে ড্রিংক করেই চলেছে, অন্যদিকে আমি এক বোতলেই থেমে গেছি। মনে হল মনাই সময়ের জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে আর সীমাহীন পান করে চলেছে।

*মূল কাহিনি: ই সন্তোষ কুমার

*অলঙ্করণ: মৃণাল শীল
*ছবি সৌজন্য: Wallpaperflare, Stockvault

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

Picture of তৃষ্ণা বসাক

তৃষ্ণা বসাক

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
Picture of তৃষ্ণা বসাক

তৃষ্ণা বসাক

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com