মণিমালিকা আবাসন এই পাড়ায় প্রথম বহুতল। পাড়াটি এমনি শান্ত। পাড়াতে গেল পঞ্চাশ বছরে বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। পুরনো একতলা দোতলা ভেঙে বহুতল ওঠেনি। যা ছিল তাই আছে, শুধু কাকলি গানের বাড়ি মণিমালিকা হয়ে গেছে। তার নবম তলে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে অবসর সময়ে বসে থাকে নীলমাধব পাল। পাড়ার লোকজন, কে যায় কে আসে সব নিরীক্ষণ করে। দূরবীন আছে তার। না হলে অত উঁচু থেকে দেখবে কীভাবে? আমাদের মাঝে মাঝে নেমতন্ন করেন নীলমাধব। এমনিই ডাকে। আমরা যাই, আমি, সঞ্জয়বাবু, অমলেন্দু, বিমল, অমল, কার্তিক দত্ত, সকলে। এই নেমন্তন্ন আড্ডার।
নীলমাধবের মস্ত ফ্ল্যাট। দুটি জুড়ে একটি। আবাসনের সব ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। নীলমাধব এবং তার দূরবীন নিয়ে আমাদের কানে কয়েকটি কথা এসেছিল। নীলমাধব নাকি দূরবীনে চোখ দিয়ে উল্টোদিকের বা দু’ধারের ফ্ল্যাটের ভিতরে প্রবেশ করে। নজর রাখে। এই নিয়ে একবার চঞ্চলচন্দ্রর সঙ্গে কথা হয়েছিল এক ফ্ল্যাটের কয়েক তরুণীর। ওরা ভাড়ায় মেস করে থাকত, ওদের অভিযোগ ছিল প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে। নীলমাধবের বয়ান ছিল, ওদের উসকেছিল চঞ্চলচন্দ্র। লোকটা এক নম্বরের হারামি। সেই মেয়েরা ভাড়া ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে গেছে। নীলমাধব বলে, কোনও কারণ ছিল না। ওরা জানালা বন্ধই করে রাখত বেশিরভাগ সময়।
সপ্তমতলের লোক, চঞ্চলচন্দ্রকে একদিন আমরা দেখলাম আবাসনে প্রবেশ করার সময়। পাঞ্জাবি, পায়জামা, কাঁধে একটি কাপড়ের সাইড ব্যাগ। উনিও রিকশা থেকে নামলেন। নীলমাধব আমাদের জন্য দাঁড়িয়েছিল বাইরে। বলেছে সারপ্রাইজ আছে। লোকটি চলে গেলে আমরা অপেক্ষা করতে লাগলাম বিমলের জন্য। বাইরে দাঁড়াতে বলেছেন বিমল রায়। উনি কেরানি থেকে জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছিলেন। ওঁর স্থান আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কতরকম গল্প করেন। মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী… কতরকম অভিজ্ঞতা তাঁর। কোন মন্ত্রী সজ্জন অতি, কোন মন্ত্রীর কী দোষ দেখেছেন, এসব বিমলবাবু বলেন। বলেন, একটি আত্মজীবনী লিখলে হত, বই ভালোই কাটত, কিন্তু সব কথা তো লিখতে পারবেন না, তাই লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অফার আছে এক প্রকাশকের।
বিমল আসার আগে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ওই যিনি ঢুকলেন, তিনিই কি সিসিসি?
– হ্যাঁ, তিনিই চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্র, লোকটা অত্যন্ত অভদ্র, অহঙ্কারি। মন্তব্য করলেন নীলমাধব।
– কেন কী হল? বিমল রায় জিজ্ঞেস করলেন।
– আরে কথাই বলে না! একদিন চা খেতে ডেকেছিলাম, বলেছিল সময় হবে না। অথচ ঘরেই তো থাকে! একা ঘরে থেকে কী করে? নীলমাধব ক্ষুব্ধ গলায় বলেছিল।
– অনেকে আত্মমগ্ন হন, একা থাকতে ভালোবাসেন, তোমার তাতে কী? আমি বললাম।
– আমার বাড়িতে তো থাকে। নীলমাধব বলল।
আরও পড়ুন: সন্দীপন চক্রবর্তীর কবিতা: স্পর্শাতীত
মনে মনে হাসলাম, সেই আমার কাকলি গানের বাড়ি নিশ্চিহ্ন করে এই আবাসন। সব ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েও নীলমাধব কী করে বলে তার বাড়িতে থাকে লোকটা, চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্র? সিসিসি? গুনগুন করছে নীলমাধব। বলছে, মনে হয় জুড়ান রায় চুকলি কেটেছে।
– কী হবে? আমি মন্তব্য করলাম।
– জুড়ান রায় কী বলল তাতে তোমার কী মাধব? সঞ্জয় ঘোষ বললেন।
– জুড়ানের মাথা খারাপ। সমস্ত জীবন একভাবে কাটিয়ে গেল, অভাব আর অভাব। নীলমাধব বলল।
– অভাবের কথা কি আপনাকে বলেছে? বিমলবাবু জিজ্ঞেস করলেন। বড় লিফটের ভিতরে আমাদের কথা হচ্ছিল।
– না, বলেনি। কিন্তু বুঝতে পারি তো। বলল নীলমাধব। ডি গ্রুপের চাকরি, কত আর মাইনে?
– আপনি কি জানেন সত্যিই জুড়ান রায় কিছু বলেছে? কী বলবে? বলার কী আছে? বিমল বললেন। নীলমাধব ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
– কর্পোরেশনের কথা ছেড়ে দিন। ইনি একা থাকতে ভালবাসেন। আপনার অনেস্টি আছে। আপনি কথা অস্বীকার করেন না। আর আপনি কী করেছেন কর্পোরেশনে তা শুনে যদি আপনার প্রতিবেশী আপনার সঙ্গে কথা না বলেন, তিনিই গোলমেলে! একটা জায়গায় এসে সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে মিশতে হয়। বিপদে-আপদে প্রতিবেশী সহায়।
বিমল রায় আশ্বস্ত করতে লাগলেন নীলমাধবকে। নীলমাধব মাথা দোলাল:
– হুঁহ…অসুখ-বিসুখ হলে আমিই তো সাহায্য করব। কিন্তু তার জন্য মিশতে হবে।
লোকটা একা থাকে কেন, বউ কোথায় গেল, ডিভোর্স হয়েছে না মারা গেছে বউ, তা নীলমাধব জানে না। অবিবাহিত হতে পারে। আসলে কার কী ইতিহাস তা আবাসনে থেকে জানা সম্ভব না। আবাসনের এক একটি ফ্ল্যাট এক একটি দ্বীপের মতো। নীলমাধব জুড়তে চাইছে, কিন্তু কেউই তার কাছে আসছে না। চঞ্চলচন্দ্র তার থেকে দূরত্ব রক্ষা করলেও নীলমাধবের যেন দূরবীনের চোখ। চোখে চোখে রাখে। কখন বের হয়, কখন ফেরে, কখন বাজারে যায়, কখন একা একা ঘোরে। চঞ্চলচন্দ্র সকালে দ্রুত বাজার সারেন। একদিন অন্তর বাজারে যান। মাঝে মধ্যে রিকশাবাহিত হয়ে মেট্রোরেলের দিকে একা চলে যান। ফেরেন কখন আমরা কেউ জানি না। কী করে জানব, সন্ধের পর আমরা কেউ বাইরে তেমন থাকি না। যদি থাকি তো নীলমাধবের ফ্ল্যাটে, নেমন্তন্নে, সারপ্রাইজে।
যে পার্কে আমাদের এক সঙ্গে আড্ডা, যে পার্কে চমৎকার একটি প্যাগোডা আছে। সকালে প্যাগোডার নিচে নামসঙ্কীর্তন হয়, নকুলদানা বিলি হয়, কপালে চন্দনের ফোঁটা দেওয়া হয়। একজন কর্কশ গলায় গীতা পাঠ করেন, সকলে তা ভক্তিভরে শোনে। সেই পার্ক বিকেল থেকেই কমবয়সী প্রেমিক প্রেমিকাদের দখলে চলে যায়। তারা যে প্রেমিক-প্রেমিকা তেমন বলা যায় না। যুবক যুবতীরা আসে একটু কাছাকাছি হতে। শরীর যে তা চায়। মন নাই কুসুম? না নেই, সব নষ্ট হয়ে গেছে। শরীর বাদে মন কোথায়? শরীর যে চায় এই রকম।
আরও পড়ুন: দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়ের দোলের কবিতাগুচ্ছ
এই চাওয়া পাওয়া নিয়ে আমাদের বুড়োদের ভিতরে খুব রাগ। দেশ শেষ হয়ে গেছে। নীলমাধব পাল এই বিষয়ে খুব কট্টর। আর কট্টর সঞ্জয় ঘোষ। দুর্গাপুর স্টিলে বড় চাকরি করতেন, অনেক টাকা নিয়ে শহরে ফিরেছেন। তিনিই এক মাত্র নীলমাধবের সমকক্ষ হতে পারেন। দু’জনেই খুব রাগ করে, তাঁদের কম বয়স অন্যরকম ছিল। সঞ্জয় ঘোষ যদিও মেনে নিতে পারেন সন্ধ্যায় চুম্বনের শব্দ বা অন্ধকারে হুটোপুটি, নীলমাধব একদম নয়। কেন এসব হবে? আমরা এসব করিনি, আমাদের সময় প্রেম অন্যরকম ছিল। আমি বলি:
– না, তা ছিল না, সব একইরকম, ভিতরে বদলায় না কিছু, বাহিরে বদলায়।
– আলাদা ছিল, এত সেক্সের বাড়াবাড়ি ছিল না। নীলমাধব বলে।
– কী ছিল, কী ছিল না, তা মনে করে দেখতে হবে। ওরা ওদের মতো থাক না কেন?
নীলমাধব বলে, কাউন্সিলরের কাছে অভিযোগ করবে, সন্ধের পর পার্কে তালা দিতে বলবে। আমি বলি:
– আমরা ভিক্টোরিয়ায় যেতাম, যেতাম কি না? বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতাম, যেতাম কি না?
– রূপবাণী সিনেমা হল উঠে গেছে। তার ওয়ালসাইডে যুগলে কি বসতাম না? তুমি বসনি মাধবভাই কুণ্ডু ডাক্তারের মেয়ে চন্দনাপাখিকে নিয়ে? তুমি কী সব গল্প করতে ঘুরে এসে, তা কি ভুলে গেছ? কার্তিক দত্ত বলেন।
নীলমাধব সবটাই অস্বীকার করে। সে কখনও এইসব করেনি।
– কার্তিক তুমি কার কথা কার ঘাড়ে চাপাচ্ছ?
কার্তিকের সঙ্গে নীলমাধবের সম্পর্ক আগাগোড়াই রয়েছে। কার্তিকদের জুতোর দোকান। আগে ছিল ছোট। এখন অনেক বড়। ব্র্যান্ডেড শু রাখে সেই দত্ত লেদার হাউস। আমরা ছোটবেলায় পুজোর সময় কোলাপুরি চপ্পল কিনতাম দত্ত লেদার থেকে। সেই চপ্পল মাস দুইয়ের ভিতরে হারিয়ে ফেলতাম খেলার মাঠে। তারপর খালি পায়ে চল। কার্তিক দত্তর দোকানে এখন তার ছেলে বসে। কার্তিক মাঝে মধ্যে যায়। অবসর নিয়েইছে বলা যায়। তবে পুজো কিংবা ঈদের সিজনে কার্তিক দোকানে গিয়ে বসে। নীলমাধব একটু বাদে আবার মুখ খোলে:
– কার্তিক আমি কোনওদিন ওসব করিনি।
– তাহলে ওই বয়সে করেছ কী? কার্তিক বলে। নীলমাধব হেসে বলে,
– আমরা সেক্সের ম্যাগাজিন পড়েছি, কত ম্যাগাজিন, বুকস্টলে ছেয়ে থাকত, সুন্দরী, সুন্দর জীবন, জীবন যৌবন, নরনারী, উদ্দাম যৌবন… ভুলে গেছি সব নাম।
– তুমি সেই ম্যাগাজিন চন্দনাপাখিকে উপহার দিতে না? কার্তিক বলে।
– কী বলছ কার্তিক, তা হতে পারে? হা হা করে হেসেছিল কার্তিক দত্ত।
– তোমার খুব সাহস ছিল নীলমাধব। তুমিই পারতে, আমাকে ওয়াল সাইডে বসে সিনেমা দেখার কথা তো তুমিই বলেছিলে প্রথম। কিন্তু জুড়ি ছিল না তাই যাইনি।
– তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। নীলমাধব হেসে বলে।
তখন যেমন নকশাল আমল। বিপ্লব করতে ভাল ছেলেরা ঘর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। কলকাতায়ও খুনোখুনি লেগে থাকত। সেই বিপ্লব থেকে, প্রতিবাদ থেকে ছেলেদের দূরে রাখতে সেক্স ম্যাগাজিনের বড় আয়োজন করে দিয়েছিল যেন সরকারই। সরকারের মদত ছিল যে, তা এখন বুঝতে পারি। নকশাল আন্দোলন দমন হল, প্রচুর লাশ পড়ল, স্তিমিত হলো যুব বিদ্রোহ। আর সেই সব ম্যাগাজিন বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল। নীলমাধবের কথা শুনে কার্তিক বলল,
– মাধব, তোমার কালেকশন ছিল বহুত। আমি ফ্রি-তে পড়েছি কত।
– এখনও আছে, ইউটিউবে কত অডিও চ্যানেল আছে, শুনতে পার।
– ফালতু সব গল্প। একদিন শুনতে চেষ্টা করেছিলাম কানে কর্ড লাগিয়ে। ধুস, বরং ভূতের গল্প শুনতে বেশ লাগে। কার্তিক বলে।
আরও পড়ুন: দীপক রায়ের কবিতাগুচ্ছ: পঞ্চবাণ
নীলমাধব আর কথা বাড়ায় না। কিন্তু বুঝতে পারি নীলমাধব কমবয়সীদের সম্পর্কে যা বলে, নিজে তার বিপরীত কাজ করে। এসব সে জানল কী করে? হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম নিবেদন হয় ছবি দিয়ে। কেমন ছবি? সে আর বোলো না। কী যে হয়েছে সব! নীলমাধব ইন্টারনেট ভাল পারে। বড় অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করে। আমার অমন নেই। সস্তার অ্যানড্রয়েড ফোন। নীলমাধবের ফোন হলো আই ফোন। এ ব্যতীত তার আইপ্যাড আছে। ল্যাপটপ আছে। ট্যাব আছে। সব দিয়ে সে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। পয়সা থাকলে সব হয়।
আসলে নীলমাধবের ভালই লাগে কার্তিক দত্তর কথা। তার যৌবনকালের এইসব উচ্ছৃঙ্খলতা, ভোগের ইতিহাস জানিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে কত সুখ! পুরুষকারের চিহ্ন এসব। সে নিজে বলতে পারে না। কার্তিক বলছে, তাতে তার বুক দশ হাত হয়ে উঠছে। আমরা যারা তার প্রাতর্ভ্রমণের সঙ্গী, আমাদের এসব ইতিহাস আছে কিনা তা কে বলবে? তবে সব সময় ব্যক্তির ইতিহাস দিয়ে সমষ্টির ইতিহাস লেখা যায় না। যখন আমাদের পাড়ার হিরন্ময়, বাবুইদের পুলিশ তুলে নিয়ে হাপিস করে দিচ্ছিল, নকশাল করার দায়ে, তখনই নীলমাধব রূপবাণী সিনেমা হলে দেওয়ালের ধারে ঠেসে ধরেছে ডাক্তারের মেয়েকে। তিনি হোমিওপ্যাথি করতেন। পশার ছিল না।
অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।