শতবর্ষে পা দিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক শংকর ঘোষ। বাংলা তথা ভারতীয় সাংবাদিকতার আধুনিক যুগের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। তাঁর লেখায় কোনওদিনই কোনও গ্ল্যামারের ঝলকানি বা রাজনৈতিক উস্কানিমূলক মন্তব্য থাকত না। থাকত এক শান্ত সৌন্দর্য, ধৈর্যবান পর্যবেক্ষণ আর ভারসাম্যময় বিশ্লেষণ। সব মিলিয়ে অর্ধ-শতাব্দী ব্যাপী কর্মজীবন নিয়ে তিনি যেন সাংবাদিকতার এক খোলা পাঠ্যপুস্তক। তাঁকে বাংলা সাংবাদিকতার শিক্ষক বললে এতটুকু অত্যুক্তি হয় না। ১৯৪৫ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় যোগদান। তারপর নানাভাবে তা প্রবাহিত থেকেছে গত শতাব্দীর একেবারে শেষ পর্যন্ত। সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’, ‘হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড’, ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় সব সংবাদপত্রে। নতুন পথ দেখিয়েছেন ‘ওভারল্যান্ড’ সম্পাদনা করতে এসে। স্পষ্ট, অকম্পিত বাচন বরাবর তাঁর পছন্দ। নিজের কলমেও এর প্রকাশ অবিচল থেকেছে। এর জন্য বহু উঁচু পদ ও নানা সুযোগসুবিধা হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু বদলাননি শংকর ঘোষ। তাঁর বিপুল রচনারাজি পড়লে আজ তাঁকে এক একক ‘ক্রুসেডার’ মনে হয়। যেন সময়-পথের একলা অভিযাত্রী। এক নির্ভীক মেধাবী বাঙালি, এক সত্যদ্রষ্টা বিশ্বজনীন ভারতীয়ের ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে।
যে নিবন্ধ বাংলালাইভ পুনঃপ্রকাশ করতে চলেছে, তার প্রথম প্রকাশকাল ছিল ডিসেম্বর ১৯৭৩। এটি তাঁর দ্বিতীয় সোভিয়েত সফর। প্রথমবার গিয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। তখন ভারতে নেহরু শাসনের স্বর্ণযুগ। আর শংকর ঘোষ আনন্দবাজার পত্রিকা ও হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের প্রতিনিধি হিসাবে দিল্লিতে। নেহরুর সঙ্গে বান্দুং সম্মেলন রিপোর্ট করে সবে কলকাতায় ফিরে আনন্দবাজার দফতরে অশোক সরকারের সঙ্গে দেখা করতে গেছেন। অশোকবাবু জানালেন, নেহরু সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে যাচ্ছেন, শংকরকে যেতে হবে ওঁর সঙ্গে।
সেই পাঁচের দশকে, স্তালিনের মৃত্যুর পর নেহরুই প্রথম আন্তর্জাতিক নেতা, যিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছিলেন এবং যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। সেটা ক্রুশ্চেভ ও বুলগানিনের যৌথ নেতৃত্বের আমল। সোভিয়েত সফরের ওপরে প্রাত্যহিক রিপোর্ট ছাড়াও শংকর ছটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকায়। এর দীর্ঘ ১৮ বছর বাদে, ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে ফের তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে যান সরকারি অতিথি হিসাবে। ১৯৭৩ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখায় তাই বারবার ১৯৫৫ সালে দেখা সোভিয়েত ইউনিয়নের কথা লিখেছেন তিনি, তুল্যমূল্য বিচার করছেন। তাঁর চোখে দেখা দুটি ভিন্ন সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিন্ন দুটি চেহারা পাঠকের চোখের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। আর এখানেই রিপোর্টার শংকর ঘোষের কলমের গুণ। তাঁর স্ত্রী ও সুলেখক শ্রীমতী আলপনা ঘোষের বদান্যতা ও প্রশ্রয়ে এই দুষ্প্রাপ্য লেখাদুটি পুনরুদ্ধার ও পুনঃপ্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। তাঁকে বাংলালাইভের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা।
১৯৫৫ সালের পর আবার সোভিয়েট ইউনিয়নে। সেবার জওহরলাল নেহরুর সহযাত্রী হিসাবে রুশ নেতাদের কাছ থেকে দেখায়, দু’একজনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। ক্রুশভ, বুলগানিন, মালোটভ, মালেনকভ তখন জাতীয় নেতৃত্বের শিখরে। তাঁদের প্রতিকৃতি সর্বত্র, লেনিন ও স্টালিনেরও। লেনিন স্মৃতিসৌধে লেনিনের পাশে তখন স্টালিন শয়ান। এখন লেনিন ছাড়া সকলের প্রতিকৃতিই অপসারিত। কিন্তু বর্তমানের নেতারা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত হননি। ব্রেজনেভ, কোসিগিন, পদগর্নির প্রতিকৃতি ক্বচিৎ চোখে পড়েছে। ব্রেজনেভের প্রতিকৃতির সংখ্যা কিছু বেশি; কাগজপত্র, কথাবার্তায় সমকালীন নেতাদের মধ্যে। তাঁর বক্তৃতা ও প্রবন্ধ থেকেই উদ্ধৃতি সবচেয়ে বেশি। তিনি সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক।
সোভিয়েট ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির স্থান সর্বাগ্রে, হরত দলের প্রধান হিসেবে বর্তমানের ত্রয়ী নেতৃত্বে তাঁর প্রাধান্য; তিন সমানের মধ্যে তাঁর স্থান প্রথমে। আমাদের চোখে এ-ব্যবস্থা অভিনব, সোভিয়েট ইউনিয়নে নয়। সেখানে এক সময় মালোটভ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রের নিয়ামক ছিলেন দলের প্রধান স্টালিন। চীনেও তাই। মাও সে তুং কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি, সরকারের সঙ্গে তাঁর কোন আনুষ্ঠানিক যোগ নেই।
এবারও প্রথম উঠেছিলাম সোভিয়েটস্কায়া হোটেলে। আঠাশ বছরে বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়েছে দেখলাম না— না হোটেলের পারিপার্শ্বিক, না অভ্যন্তরে। মনে হয় সেই পুরনো আসবাবপত্র, মায় লাল কার্পেট পর্যন্ত সযত্ন সংরক্ষণে ও নিত্য তত্ত্বাবধানে এখনও উজ্জ্বল। হোটেলের কক্ষে অবশ্য বড় একটি পরিবর্তন চোখে পড়ল— একটি টেলিভিশন সেট। আগেরবারে দেখেছিলাম টেবিলঘড়ি আকারের একটি লাউড স্পিকার; কী শুনবেন, কখন শুনবেন, আদৌ কিছু শুনবেন কিনা, তা কোন অদৃশ্য হস্ত স্থির করত। সব হোটেলেরই যে ঘরে ঘরে টিভি তা নয়। হোটেল পিকিং-এ একদিন ছিলাম। সে কক্ষে টিভি তো দূরের কথা, লাউডস্পিকারও নেই। বলে রাখা ভাল, হোটেল পিকিং-এর নাম ছাড়া আর কিছুই চিনা নয়।
১৯৫৫ সালে নেহরুর সোভিয়েট সফরের মাত্র এক বছর পরে সোভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্টালিন-নীতি বর্জন করে। নেহরু বলেছিলেন, তাঁর সফরের সময়ই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সোভিয়েট ইউনিয়নের তদানীন্তন যৌথ নেতৃত্বই স্টালিনের নীতিতে আস্থাবান নন, তাঁরা সঙ্ঘর্ষের নীতির বদলে সহাবস্থানের নীতি অনুসরণে ইচ্ছুক। নেহরু সোভিয়েট ইউনিয়নে যে বিপুল সংবর্ধনা পেয়েছিলেন, তা এই নীতি বদলের উপক্রমণিকা হিসাবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। একটি অকমিউনিস্ট নিরপেক্ষ সরকারের নেতাকে আমন্ত্রণ ও অভ্যর্থনার মধ্য দিয়ে যে-ধারার সূচনা হয়েছিল, সে-ধারা এখনও অব্যাহত আছে। ক্রুশভের রাজনৈতিক নির্বাসনের পর যাঁরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, স্টালিন নীতির পুনরাবির্ভাবের পটভূমিকা প্রস্তুত হল, তাঁদের অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির বর্তমান সম্পর্কই প্রমাণ করে যে সোভিয়েট নেতৃত্ব সহাবস্থান ও সমাজতন্ত্রের শান্তিপূর্ণ উত্তরণের নীতিতে এখনও বিশ্বাসী।

রাজনীতিতে এই উদারপন্থী সহনশীলতা ক্রমে বৈষয়িক ক্ষেত্রেও বিস্তৃত হচ্ছে। বিদেশ থেকে পুঁজি আমদানিতে সোভিয়েট ইউনিয়নের এখন আর আগেকার একরোখা আপত্তি নেই। সাইবেরিয়ার গ্যাস আমেরিকায় চালান দেওয়ার জন্য আমেরিকান পুঁজি নিয়োজিত হচ্ছে। বিরাট কারখানায় বছরে ছয় লক্ষ গাড়ি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, বাকু থেকে জাপানকে তেল সরবরাহ করার জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত জাপানি সহযোগিতায় পাইপ লাইন বসানোর কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ১৯৫৫ সালের সোভিয়েট ইউনিয়নে সব বিদেশী মুদ্রাই ছিল অচল। এখন মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ স্টারলিং, জার্মান মারক, সম্ভবত সব মুদ্রাই চলে, এমন কি আমাদের টাকাও। তবে কেবলমাত্র বিদেশি মুদ্রায় কেনাবেচা হয় এমন দোকানে। যদিও ডলারের মূল্য নিম্নমুখী, তবু সোভিয়েট ইউনিয়নে ডলারের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি।
এসবই অকমিউনিস্ট দেশগুলির, বিশেষত আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রয়াসের লক্ষণ। সম্ভবত এই প্রয়াস ব্যর্থ হতে পারে, এই আশঙ্কায় ‘ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি’ ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিকসনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সোভিয়েট ইউনিয়ন নীরব। ওয়াটারগেট ঘটনা ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের ফ্যাসাদের খবর সোভিয়েট পত্রপত্রিকায় খুব ফলাও করে ছাপাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বুর্জোয়া ডেমোক্রাসীর আবিলতার একটি ‘জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত’ হিসাবে তারা সোভিয়েট জনসাধারণের সামনে এটিকে উপস্থাপিত করেনি। আমেরিকার অভ্যন্তরিক ব্যাপার, এই অজুহাতে তারা যে কোন রকম মন্তব্য থেকে বিরত আছে। এই বিরতির প্রকৃত কারণ, প্রেসিডেন্ট নিকসনের বিপত্তিতে সোভিয়েট ইউনিয়ন দুঃখিত, কিছু উদ্বিগ্নও বটে। সোভিয়েট ইউনিয়নে একথাও শুনেছি যে ওয়াটারগেটের ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বড় করে তোলার পিছনে আছে আমেরিকার অস্ত্রশস্ত্র প্রস্তুতকারকের দল। তাঁরা ভয় করছেন, প্রেসিডেন্ট নিকসন ও সোভিয়েট-মার্কিন সমঝোতা বজায় থাকলে যুদ্ধের সম্ভাবনা কমে যাবে, তাঁদের ব্যবসা গোটাতে হবে। তাই তাঁরা ওয়াটারগেটকে উপলক্ষ করে নিকসনকে পদচ্যুত করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন।
সোভিয়েট নীতি বিশ্লেষকদের কাছে শুনেছি, রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে এই সহাবস্থানের নীতি আদর্শবাদের ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হয়নি, কোনদিন হবে না; আদর্শবাদের লড়াই চলছে, চলবে। আমার এবারের সোভিয়েট সফর নভোস্তি প্রেস এজেন্সির আমন্ত্রণে; সেই এজেন্সির এশিয়া বিভাগের প্রধান সম্পাদক, আলেকসি পুশকভ, আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, আমরা বিশ্বাস করি শান্তিপূর্ণ উপায়ে সারা পৃথিবীতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। যদি তা না হয় তাহলে সঙ্ঘর্ষ ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না। এই প্রসঙ্গে ভারত মহাসাগরে সোভিয়েট নৌবহরের উপস্থিতির কথা উঠেছিল। পুশকভ বললেন, ভারত মহাসাগরে মার্কিন নৌবহরের অনুপ্রবেশের জন্য সোভিয়েট ইউনিয়নও তার নৌবহর পাঠাতে বাধ্য হয়েছে। এই উপস্থিতির জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন দুঃখিত, কিন্তু ভারত মহাসাগরে যতদিন মার্কিন নৌবাহিনীর টহল চলবে ততদিন সোভিয়েট ইউনিয়নকেও পাল্টা টহল চালাতে হবে।
ভারত-সোভিয়েট মৈত্রী ও সহযোগিতার ভিত্তিও এই সহ-অস্তিত্বের উপর আস্থায়। শ্রীমতী গান্ধী যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটিকে প্রকৃত সমাজতন্ত্র বলে সোভিয়েট ইউনিয়ন স্বীকার করে না। তিনি যে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, সোভিয়েট ইউনিয়নের মতে তা গণতন্ত্র নয়, বুর্জোয়া গণতন্ত্র। তা সত্ত্বেও ভারত-সোভিয়েট সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হচ্ছে। কারণ সোভিয়েট ইউনিয়ন মনে করে, শ্রীমতী গান্ধী অপুঁজিবাদী পথে ভারতের অগ্রগতির জন্য চেষ্টা করছেন। এই পথের শেষে সমাজতন্ত্র অবধারিত— যে সমাজতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছেও গ্রাহ্য। তাই সোভিয়েট নীতি হল শ্রীমতী গান্ধীকে তাঁর স্বনির্বাচিত পথে চলতে দেওয়া ও তাতে সাহায্য করা।
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে এদেশের বামপন্থী দলগুলির কর্তব্য কী, সে বিষয়ে মস্কোয় ‘ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিস’-এর পাঁচজন ভারত-বিশারদের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ হয়েছিল। তাঁরা হলেন, ইনস্টিটিউটের ভারতীয় বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ কোটোভসকি, ভারতীয় বিভাগের বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত শাখার প্রধান, ডঃ ডানিলভ, ভারতীয় বিভাগের ইতিহাস শাখার প্রধান, ডঃ কোমারভ ও ভারতীয় বিভাগের গবেষক, ডঃ চিচেরভ ও ডঃ কোলিরালোভা। তাঁদের মতে আজকের ভারতবর্ষে কংগ্রেস বিরোধিতা বামপন্থা বা প্রগতির লক্ষণ নয়। ডঃ কোটোভস্কি পরিষ্কার বললেন, ভারতে কংগ্রেসের সোলঝেনিৎসিনের সঙ্গে সম্ভব (লেখক সম্ভবত ‘সমঝোতা’ বোঝাতে চেয়েছিলেন) না হলে বিক্ষুব্ধ লেখকদের বিরুদ্ধে কোন প্রগতিপন্থী জোট সম্ভব নয়। কংগ্রেসের মধ্যে একটি বৃহৎ প্রগতিশীল শক্তি আছে এবং শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের এই অংশের সঙ্গে বামপন্থী দলগুলির হাত মেলানো প্রয়োজন। কংগ্রেসকে যে কোনওভাবে হঠানোর স্লোগান অর্থহীন। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবাংলার যে বামপন্থী সরকার গঠিত হয়েছিল, তার পরিণতি দেখেই বোঝা যায় এই ধরনের কংগ্রেস বিরোধিতার ফল কী। এখন ভারতের পক্ষে প্রয়োজন, বামপন্থার দিকে ঝোঁক; শ্রীমতী গান্ধী তা বোঝেন এবং সেজন্যই তাঁর একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে। শ্রীমতী গান্ধী উন্নয়নের যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তা খুবই ভাল। কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ সময়সাপেক্ষ। বিশেষজ্ঞরা যা বললেন, তাতে স্পষ্ট যে সিপিআই কংগ্রেসের যতই সমালোচনা করুক না কেন, কংগ্রেস বিরোধিতার, কংগ্রেসের সঙ্গে বর্তমান সম্পর্ক ছেদের সিদ্ধান্ত কখনও নেবে না; বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির ঐক্যের জন্যও নয়। এমন কি পশ্চিমবাংলাতেও কংগ্রেস ও সিপিএম-এর মধ্যে বেছে নিতে হলে সিপিআই কংগ্রেসকেই বেছে নেবে।

এই প্রসঙ্গে সিপিএম-এর কথাও উঠেছিল। সিপিএম ১৯৭৯ সালে ভারত-সোভিয়েট শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতার চুক্তি সমর্থন করে, একথা বলায় বিশেষজ্ঞরা জানালেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও ভারতের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কে সিপিএম-এর অভিমত বদলেছে, বদলাচ্ছে। কোটভসকি বললেন, তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত এই যে, সিপিআই ও সিপিএম-এর মধ্যে একটি বোঝাপড়ার যে লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, তা খুবই অর্থপূর্ণ। জলন্ধরে সিপিআই-এর কিষাণ সম্মেলনে সিপিএম কিষাণ নেতা হরেকৃষ্ণ কোনারের যোগদান একটি খুব উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গত দশ বছরে সিপিআই সিপিএম-এর কাছে সহযোগিতার জন্য বারবার আবেদন জানিয়েছে, মনে হয় এতদিনে তার কিছু ফল হয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধ মিটে দুই কমিউনিস্ট পার্টির রাতারাতি পুনর্মিলন সম্ভব নয়। কিন্তু ভারতে বামপন্থী আন্দোলনের স্বার্থে দুই কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে বহু বিষয়ের মীমাংসা প্রয়োজন। কোটভস্কির আশা, আদর্শগত ও রাজনৈতিক সব মতভেদ সত্ত্বেও সিপিএম ভারতের বামপন্থী ও প্রগতিশীল শক্তিগুলির ঐক্যের জন্য সিপিআই-এর সঙ্গে সহযোগিতা করবে। দুই কমিউনিস্ট পার্টি ও কংগ্রেস সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা যে অভিমত প্রকাশ করলেন তার থেকে এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নয় যে কংগ্রেস বিরোধিতার নীতিতে সোভিয়েট ইউনিয়নের সায় নেই এবং সিপিএম যতদিন এই নীতিতে অটল থাকবে, ততদিন সিপিআই-এর সঙ্গে জোট গঠন তার পক্ষে সম্ভব হবে না।
ইন্দিরা সরকারের তথাকথিত ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সোভিয়েট বিশেষজ্ঞরা বামপন্থী দলগুলিকে যে সহনশীল মনোভাব অবলম্বনের পরামর্শ দিলেন, সেই সহনশীলতা সোভিয়েট ইউনিয়নের আচরণেও পরিস্ফুট। নোভস্তির পুশকভ আলোচনা প্রসঙ্গে বললেন, তিনি কখনও শোনেননি যে শ্রীমতী গান্ধী বলেছেন, দুই সুপার পাওয়ার যেন তুলনায় দুর্বল ও অনগ্রসর দেশগুলির মতামত উপেক্ষা করে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রবৃত্ত না হয়। শ্রীমতী গান্ধী এই মন্তব্য একবার নয় বারবার করেছেন— দেশে ও বিদেশে। এই সেদিনও নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন পশ্চিম এশিয়ার যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে সোভিয়েট-মার্কিন যুক্ত প্রস্তাবের উপর আলোচনায় শ্রীমতী গান্ধীর উক্তির প্রতিধ্বনি করেছেন। আমেরিকা ও সোভিয়েট ইউনিয়নের এই সমীকরণে সিপিআই তার পত্রপত্রিকায় উষ্মা প্রকাশ করেছে, শ্রীমতী গান্ধীর তীব্র সমালোচনা করেছে। পুশকভ বললেন, সিপিআই-এর এই প্রতিক্রিয়ার খবরও তিনি রাখেন না। তবে তিনি জানেন, চীনা নেতারা বলছেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন ও আমেরিকা পৃথিবীটাকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতে উদ্যত। ভারতের দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি চীনের এই ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রতিধ্বনি করছেন বলে তিনি জানেন, কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর তথাকথিত মন্তব্য সম্পর্কে তিনি কিছুই শোনেননি। স্পষ্ট বোঝা গেল, শ্রীমতী গান্ধীর উক্তিকে কেন্দ্র করে কোন বিতর্ক তুলতে সোভিয়েট ইউনিয়ন নারাজ। ভারতের সঙ্গে মৈত্রী নীতির স্বার্থে সোভিয়েট ইউনিয়ন এই ধরনের মন্তব্যকে উপেক্ষা করা স্থির করেছে। (চলবে)
*লেখকের ছবি: শ্রীমতী আলপনা ঘোষ
*অন্য ছবি: Tribune India, Banglalive.com
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।