মুখোমুখি— এই শব্দটা শুনলেই একটাই ছবি মনে ঝিকিয়ে ওঠে বারবার। সারা জীবন চেয়েছি মুখোমুখি কখনও বসলে যেন সেই কাঙ্ক্ষিতকেই পাই জনম জনম। কিন্তু সত্যজিৎ রায় কেবল মাত্র একটি বারই তাঁকে শর্মিলা ঠাকুরের সামনে বসিয়ে ছিলেন, আমার সামনে নয়। কিন্তু সে ফ্রেম আমার মনের সমস্ত প্রেম ছাড়িয়ে ঠিক মধ্যিখানটায় বাঁধানো ঘাটের মতো স্থায়ী হয়ে আছে। এ স্থায়িত্ব কেবল মরণই হরিতে পারে। কত বার, কত কত বার শর্মিলা ঠাকুরের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে কতই না কথা বলাবলি, কথা কাটাকাটি, কথা চালাচালি, কথা না-বলাবলি করেছি।
আর কেমন ভাবে মুখোমুখি হতে হয়? যেমন ভাবে তার্কিকরা হতেন শাস্ত্র-অধ্যয়নের কালে? একে অপরের দিকে ছুড়ে দিতেন প্রশ্নবাণ, আর তার মোকাবিলা হত তর্ক আর প্রতি-তর্কে। রাগ প্রশমিত করে টিঁকে থাকতে হত তর্কের আওতায়। চোখের তারার চলন দেখে বুঝে নিতে হত প্রতিপক্ষের পারদ। সে মুখোমুখির লড়াই কেবল যুক্তির নয়, স্নায়ুরও বটে।
অবশ্য কোন মুখোমুখিই বা স্নায়ুর লড়াই নয়! প্রেমিকা হ্যাঁ বলবে কি না, কুস্তিতে প্রতিপক্ষকে ভূপতিত করা যাবে কি না, বস প্রেজেন্টেশনে খুশি হবে কি না, ছাত্র শিক্ষককে বেঁফাস প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে কি না, আজ কাজের মাসি ছেড়ে দেবে না তো? আসলে সব মুখোমুখিই একটা করে স্নায়ুযুদ্ধ। তার বাড়া-কমা থাকতে পারে, কিন্তু যুদ্ধবিরতি কখনই হবে না।
আর যে মুখোমুখি সম্ভবত কোনও দিনই জেতা সম্ভব নয়, তা হল জীবন নামক বড়দাটির। যিনি নিরন্তর চাল ফেলে যাচ্ছেন, আর আমরা, ধরাতলে আলটপকা ঝরে পড়া বুরবকগুলো কোনওটা অতি কষ্টে বাঁচাচ্ছি আর বাকিগুলো না-সামলাতে পেরে একদম মাঠের বাইরে। অন্যান্য যত মুখোমুখির মোকাবিলা করতে হয় জীবনে, বয়স আর অভিজ্ঞতার ঝুলি ঝেড়েঝুড়ে তার কয়েকটা প্যাঁচ-পয়জার আয়ত্ত করতে পারি, কিন্তু জীবন নামক অতীব প্যাঁচালো এই বস্তুটি কোনও দিকেই টাল সামলাতে দেয় না। হাসির সিনেমায় যেমন কেক উড়ে এসে পড়ে গোটা মুখ ক্রিম মাখামাখি হয়ে পুরোটাই ভেস্তে যায়, তেমনই জীবনের মুখোমুখি হতে হতে আমাদেরও ওই রূপ অবস্থাই হয়। অপারগতার ক্রিম সারা মুখে মেখে নাক-কান-চোখ-মুখ সব বন্ধ হয়ে গিয়ে দম আটকে হাপুসহুপুস করতে থাকি।
একটা ক্ষীণ ধারণা আছে কেবল সঙ্গী। জীবননানন্দ দাশ যে অন্ধকার বিস্তার করেছিলেন বনলতা সেন-এর জন্য, সেই অন্ধকারে সান্ত্বনা থাকে মুখোমুখি বসিবার।