রডরিগো গার্সিয়ার অসুবিধে বোঝা আমাদের মতো সাধারণ লোকেদের পক্ষে হয়তো অসম্ভব। তাঁর বাবা প্রবাদপ্রতিম লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা তাঁর অনুরাগী পাঠক। তাঁর জীবনী লেখা হয়েছে ইতিমধ্যেই। তাহলে? রডরিগো তাঁর বড়ো ছেলে। নিজে সিনেমার চিত্রনাট্য লেখক। খ্যাতিও আছে যথেষ্ট। কিন্তু বাবার সঙ্গে তুলনা এসে পড়ে স্বাভাবিকভাবেই এবং সেখানেই সমস্যা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজকে অতিক্রম করা তো দূরের কথা, কাছাকাছি মানের লেখাও সমসাময়িক লেখকদের কাছে স্বপ্নের মতো। মার্কেজ যেখানে নিজেই তাঁর বড়ো হয়ে ওঠার গল্প লিখে গেছেন, সেখানে এই বই লেখা এবং পাঠকের পক্ষে পড়া দুইই বেশ ঝুঁকির ব্যাপার।
কিন্তু রডরিগো গার্সিয়া এই কঠিন পরীক্ষাতেও সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁর লেখা ‘এ ফেয়ারওয়েল টু গ্যাবো অ্যান্ড মার্সিডিজ’ প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি আর সাড়া ফেলে দিয়েছে পাঠক মহলে- বিশেষ করে মার্কেজের অনুরাগীদের মনে।

মার্কেজ শেষ জীবনে ডিমেনশিয়াতে ভুগতেন। স্মৃতিভ্রংশ হয়েছিল তাঁর। সেই অবস্থায় সর্বদা তাঁর পাশে থেকেছেন স্ত্রী মার্সিডিজ় বারছা আর দুই ছেলে। সেই শেষ কিছুদিনের দিনপঞ্জি নিয়ে লেখা ‘এ ফেয়ারওয়েল টু গাবো অ্যান্ড মার্সিডিজ়’। মার্সিডিজ় মারা যাওয়ার সময় তিনি পাশে থাকতে পারেননি। মার্সিডিজ় মারা গেছেন কোভিড চলাকালীন। যেতে পারেননি রডরিগো। মায়ের শেষ সময়ে পাশে দাঁড়াতে পারেননি তিনি। মায়ের মৃত্যুর সময়টা তাঁর পক্ষে ধরা অসম্ভব ছিল। সে দুঃখের কথা লিখছেন এভাবে:
“Unable to travel, I saw her alive for the last time on the cracked screen of my phone, and again five minutes later, gone forever. Two brief live videos, separated by eternity, from which my capacity for storytelling has yet to recuperate.”
আমাদের অনেকের মতোই তিনিও আমেরিকা থেকে মেক্সিকো যেতে অসমর্থ হয়েছিলেন, প্লেন চলাচল বন্ধ থাকার জন্য। রডরিগো নিজের মায়ের কথা বেশি লিখে যেতে পারেননি, হয়তো পরে লিখবেন; কিন্তু এই স্মৃতিকথা থেকে এক সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় লাতিন আমেরিকার পরিবারের গঠন সম্বন্ধে। মার্সিডিজ় এই পরিবারের একবারে স্তম্ভের মতো ছিলেন- নাতনিরা যাকে ‘সুপ্রিম বস’ বলে ডাকত। এই বইয়ের পাতায় পাতায় ধরা পড়েছে গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের জীবনের শেষ কয়েকদিন- অকপট। ছোট ছোট পরিচ্ছেদ, একেবারে চুম্বকের মতো ধরে রাখে মেদহীন গদ্য। নিজে স্ক্রিপ্ট রাইটার হওয়ায় কী করে পাঠককে আটকে রাখতে হয়, রডরিগো গার্সিয়া জানেন।
এই ছোট ছোট পরিচ্ছেদগুলোতে ধরা পড়েছে কখনও গভীর মনখারাপ, কখনও সন্তানের স্মৃতি, কখনও বা কিছু মজার কথা, কখনও বা পুরনো গল্প। সত্যি কথা বলতে কি, মার্কেজ় মারা যাবার সাত বছর পরেও এই বই যেন সাহিত্যপ্রেমী এবং মার্কেজ়ের অনুরাগী পাঠকদের আবার মনে পড়িয়ে দেয় সেই মহান লেখককে। স্মৃতি এতটাই সুস্পষ্ট, যেন মনে হয় চোখের সামনে সিনেমার মতো দেখছি। অসাধারণ লিখনশৈলী ছাড়া এ অসম্ভব ছিল।
যদিও বইয়ের নাম ‘ফেয়ারওয়েল টু গ্যাবো অ্যান্ড মার্সিডিজ’, রডরিগো গার্সিয়ার বইয়ের সিংহভাগই বাবার মৃত্যুর সেই কয়েকদিনের দিনলিপি। ভীষণ যত্ন করে সেই সময়টা লিপিবদ্ধ করেছেন তিনি। এই বই লেখার কোনও পরিকল্পনা ছিল না, ডায়রি লিখেছিলেন রডরিগো নিজের এবং ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য। সেই শেষ সময়ে পৃথিবীর অন্যতম সেরা লেখকের সবচেয়ে ব্যক্তিগত স্মৃতি- এক সন্তানের স্মৃতি তাঁর বাবা মায়ের মৃত্যুর সময়ের। ডিমেনশিয়ায় ভোগা বাবার শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে, সেই অবস্থায় যেন বাড়ির সবাই এক নিশ্চিত মৃত্যুর জন্যে প্রতীক্ষারত- গোটা পৃথিবীর অগুনতি মার্কেজ়ভক্তের বিপ্রতীপে অবস্থান তাঁর পুত্রের।

একাকী বাগানে চিন্তা করছেন “nothing betrays the fact that a person’s life is ending in an upstairs bedroom”। মাঝে মাঝে যখন ভালো থাকতেন তখন নিজের মনেই বলতেন “ আমি সব ভুলে যাচ্ছি, একটাই সান্ত্বনা যে আমি ভুলে যাচ্ছি যে আমার মনে থাকছে না।” ডিমেনশিয়ার জন্য নিজের প্রতিটা বই আবার, বারবার পড়তে হতো মার্কেজ়কে, নিজের লেখা প্রতিটি বই। কখনও কখনও নিজেরই লেখা ‘একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’ পড়ে আনন্দিত হতেন, কখনো চূড়ান্ত হতাশ। নিজেকেই প্রশ্ন করতেন অগুনতি চন্দ্রাহত পাঠকের মতো, “কোত্থেকে এলো এসব গল্প?”
শেষ জীবনে বাড়িতেই ছিলেন মার্কেজ। হাসপাতালের মতো একটি শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। দু’জন নার্স, ওষুধপত্র আর অক্সিজেন সিলিন্ডার- নোবেলবিজেতা বিশ্বখ্যাত লেখকের জন্য মেক্সিকো সরকার এই কাজ করেছিল অনায়াসে। সমস্ত ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মার্কেজের সেক্রেটারি। দক্ষহাতে পরিচালনা করছিলেন সঙ্গীতপরিচালকের মতো। গার্সিয়া মার্কেজ়কে যে তিনজন সবচেয়ে ভালো করে চিনতেন, তার মধ্যে অন্যতম নিশ্চিতভাবে তাঁর সেক্রেটারি। মার্কেজ়ের দেখাশোনার সমস্তকিছুর দিকে এই ভদ্রমহিলার ছিল অসম্ভব নজর। তাঁর সেক্রেটারির স্মৃতিচারণ:
বাগানে দাঁড়িয়েছিলেন মার্কেজ। সেক্রেটারি গিয়ে জিগ্যেস করলেন “কী করছেন স্যর?”
“কাঁদছি, কিন্তু আমার চোখে জল নেই। বুঝতে পারছ না আমার মাথা একেবারে ঘেঁটে গেছে (Don’t you realise that my head is now shit?)”? স্বল্পবাক সেক্রেটারির মন্তব্য “আপনার বাবার এটাই বৈশিষ্ট্য। কুৎসিত জিনিসগুলোও এত সুন্দর করে বলতে পারতেন!

মার্কেজ মারা যান বৃহস্পতিবার। সেইদিন সকালবেলা একটা পাখি মরে পড়েছিল বাড়ির বাগানে। কাচের দেওয়ালে ধাক্কা লেগে। পরে মার্কেজ়ের এক বন্ধু রডরিগোকে মনে করিয়ে দেন যে একশো বছরের নিঃসঙ্গতার অন্যতম চরিত্র উরসুলা যেদিন মারা যান সেদিন এত গরম ছিল যে অনেকগুলো পাখি দেওয়ালে ধাক্কা লেগে শোওয়ার ঘরে মরে পড়েছিল। ম্যাজিক রিয়েলিজমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখকের মৃত্যুতে স্মৃতি তাঁকে ছেড়ে গেলেও, ম্যাজিক রিয়েলিজ়ম তাঁকে ছেড়ে যায়নি।
মার্কেজ় মারা যাওয়ার পর ঠিক কোন কোন সংবাদমাধ্যমকে খবর দেওয়া হবে, সামাজিক মাধ্যমে কখন এবং কীভাবে জানানো হবে- শুনে মনে হয় যেন প্রচণ্ড পেশাদারি ক্ষিপ্রতায় সিদ্ধান্ত নেওয়া চলছে। কিন্তু মার্কেজের মতো পৃথিবীবিখ্যাত লেখকের মৃত্যুর খবরে যে গোটা পৃথিবীতে শোকের ছায়া নেমে আসবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? তাঁর সমস্ত অনুরাগীদের তাঁর মৃত্যুর খবর যেন গুজবের মোড়কে না পেতে হয়। সারাদিন টিভিতে একই খবর, কয়েকশো লোক তাঁদের বাড়ির সামনে আর হাজার হাজার লোক মেক্সিকো সিটির ‘প্যালেসিয় দ্য বেলাস আরতেস’-এ জমা হয়ে যান শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য।

মার্কেজ পৃথিবীবিখ্যাত লেখক ছিলেন, সত্যি কথা বলতে কি সাহিত্যজগতের এক সেলিব্রিটি ছিলেন তিনি। তাঁর সম্মানে নাম রাখা হয় তারামণ্ডলের চুরানব্বই আলোকবর্ষ দূরের এক তারার- ‘মেলকুইদ দে মাকোন্দ’। কিন্তু এই বইকে কোনওরকমভাবেই এক সেলিব্রিটির জীবনী বলা যায় না। এ বই এত সুখপাঠ্য হবার প্রধান কারণ কিন্তু এক বিখ্যাত লোকের মৃত্যুর দিনপঞ্জি নয়, এক সন্তানের পিতা হারানোর গল্প।
এই দুঃখের মাঝেও ছোট ছোট মজার কিছু গল্প আসে। ভারতীয় হিসেবে আবার আমরা লাতিন আমেরিকার সঙ্গে নৈকট্য খুঁজে পাই। যেমন মিস্টার পরুয়ার আবির্ভাব। মিস্টার পরুয়া মেক্সিকোর বিখ্যাত প্রকাশনার সংস্থার মালিকের ছেলে। গাড়িতে করেই আসছিলেন তিনি। গাড়ি খারাপ হয়ে যাওয়ায় আর একজনের গাড়িতে করে আসেন। সহানুভূতিজ্ঞাপন করে কাঁচুমাচু মুখে মার্সিডিজ়কে আর্জি জানালেন যদি গাড়ি ঠিক করার শ’দুয়েক ডলার ধার দেন। সেই শোকের বাড়িতে মার্সিডিজ় এক কথায় ধার দেন এবং পরুয়া সাহেব সেই যে অন্তর্হিত হলেন, তাঁর আর দেখা পাওয়া গেল না। অন্যান্য বহু লেখকের মতোই মার্কেজেরও অবসেশন ছিল মৃত্যু, বিরহ, দুঃখ এবং মহামারী। তাঁর জীবনের আফসোস ছিল যে তিনি তাঁর নিজের মৃত্যু নিয়ে লিখতে পারবেন না। কিন্তু ছেলে রডরিগো গার্সিয়ার এই স্বল্পদৈর্ঘ্যের লেখা পড়লে অনুমান করতে পারি, তাঁর গর্বই হত।
গ্রন্থ: আ ফেয়ারওয়েল টু গ্যাবো অ্যান্ড মার্সেডিজ়
লেখক: রডরিগো গার্সিয়া মার্কেজ়
প্রকাশনা: হারপার ভায়া
প্রকাশকাল:জুলাই ২০২১
বিনিময়: ২৯৯ টাকা (হার্ডকভার ইংরেজি অনুবাদে)
*ছবি সৌজন্য: El Pais, New York Times, Goop
ডাঃ শুভায়ু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম আসানসোলে। সেখানে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করা। অতঃপর প্রবাসী। কর্মসূত্রে সুদূর স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা। স্কটল্যান্ডের অন্যতম বিখ্যাত অ্যাবার্ডিন রয়্যাল ইনফার্মারি হাসপাতালে মহিলা ও শিশুবিভাগে ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর। বইপড়া, বই সংগ্রহ বাতিক! লেখার অভ্যেস ছোট থেকেই। দেশ, আনন্দবাজার, সন্দেশ, সৃষ্টির একুশ শতক, কবিতীর্থ-তে লেখালিখি করেন। বই নিয়ে লিখতে ভালবাসেন।