না ঘর বাঁধলাম জঙ্গলে, না সখা হল হাতি। জীবন কেটে গেল ইট–কাঠ–পাথরে। বড় আক্ষেপ হয়। বনের ধারে ঘর। হরিণ, চিতাবাঘ, হাতি ছিল প্রতিবেশি। কেউ আপন হল না। সকলে ভাবে জঙ্গল নিয়ে কত না জানি। বন্যপ্রাণীদের কত না চিনি। জানা, চেনা কী অত সহজ? ঈর্ষা হয় পার্বতী বড়ুয়াকে। হিংসা হয় শিবচরণ রাভাকে। তাড়ো হেমব্রম, পটেক রাভা, মাঠে ডুকপা। ওঁরাই যেন জঙ্গলের সন্তান। বাইসন ওদের ভাই, চঞ্চলা–চপলা হরিণ ওদের বন্ধু।
পার্বতীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা তোর্সা নদীর পাড়ে। রাজকন্যা তিনি। অসমের গৌরীপুরের রাজপরিবারের মেয়ে প্রথম আতিথেয়তায় বলেছিলেন, ‘কী যে খেতে দিই আপনাকে? দুপুরবেলায় ভাত না খাইয়ে অতিথিসেবা হয় না। কিন্তু আমার ঘরে যে আজ শুধুই পান্তা আর শুঁটকি।’ হাতির সঙ্গে জীবনটা কাটিয়ে দিয়েছেন রাজা প্রকৃতীশ বড়ুয়ার কন্যা। একটা আরণ্যক জীবন কাটিয়ে দিলেন। বাবা প্রকৃতীশ (লালজি নামে খ্যাতি) গৌরীপুরের শেষ রাজা হলে কী হবে, তাঁরও তো জীবন কেটেছে বনেই। বছরে অন্তত সাত–আট মাস বনবাসী। বুনো হাতি ধরা এবং পোষ মানানোয় বিশেষজ্ঞ। তাঁর হাতি বন দফতরের কাজ করত। হ্যাঁ, তাঁর হাতি। আস্ত একটা হাতিশাল ছিল লালজির। রাজত্ব চলে গিয়েছিল আগেই। রাজন্য ভাতা বিলোপের পর হাতিই খাইয়েছে গৌরীপুরের রাজপরিবারকে। হাতি ভাড়া দিয়ে হাতি ধরে, প্রশিক্ষণ দিয়ে।
একমাস সতেরো দিন বয়সে পার্বতীর প্রথম বনযাত্রা। বাবার শিলং থেকে গৌরীপুর সদলবলে যাত্রায় অংশ নিতে হয়েছিল পার্বতীকে। পথে ক্যাম্পে রাত্রিবাস। এমনই জীবন ছিল লালজি পরিবারের। সপরিবার তো বটেই, সহযোগী, পরিচারক, রাঁধুনি, এমনকী লালজির সন্তানদের গৃহশিক্ষকদের নিয়ে প্রায় ৭০ জনের দল বনযাত্রায় বের হত। জঙ্গলেই বড় হওয়ার পাঠ। হাতে–কলমে প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয়, বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সখ্য, গাছগাছালির নিবিড় আশ্রয়ে মনের, শরীরের বিকাশ।

নাগরিক দুনিয়ায় বসবাসকারীর চেয়ে পার্বতীদের শিক্ষা কিন্তু কোনও অংশে কম হয়নি। জ্ঞানের ভাণ্ডার ছেঁচে আহরণ করেছেন। হাতি সম্পর্কিত তাঁর বেশকিছু বই সেই মেধার পরিচয় বহন করে। বয়স যখন সবে ১৪, যে বয়সে তখন মেয়েদের বিয়ে হয় বা পুতুল খেলে, পার্বতী তখন হাতি ধরে ফেললেন। দূর থেকে ছুঁড়ে দড়ির ফাঁস হাতির গলায় আটকে বশও করে ফেলেছিলেন। উত্তরসূরিকে সেদিন চিনতে ভুল করেননি লালজি। আপ্লুত বাবার গর্বিত উচ্চারণ ছিল ‘সাবাস বেটি।’
হাতি ধরা পেশা হলেও বিশালকায় এই প্রাণীটির প্রতি কী যে মমত্ববোধ, পার্বতীকে না দেখলে বোঝা যাবে না। দেখেছি অবলীলায় বুনো হাতির পেটের তলায় দাঁড়িয়ে পড়েন। গলায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। যেন হাতির ভাষা বোঝেন। হতাশ লাগে। হায় রে, হাতির সঙ্গে এমন বন্ধুতা কেন আমার হল না। যৌবন বয়স পর্যন্ত রায়ডাক জঙ্গলের অদূরে বসবাস করেও শহুরে পরিচয় ঘোচাতে পারলাম। আরণ্যক হওয়া দূরের কথা, অরণ্যের গন্ধও শরীরে লেগে রইল না। নিজেদের যতই প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশকর্মী, বন্যপ্রাণের প্রতি সহানুভতিশীল ইত্যাদি বলে বড়াই করি না কেন, আসলে এসব হওয়ার কোনও যোগ্যতা আমাদের নেই, কোনওকালে ছিলও না। শখের প্রকৃতিপ্রেম আমাদের। পার্বতী, শিবচরণ, পটেকরা ছিল বলে জঙ্গল বেঁচে ছিল। আমাদের নাগরিক লালসায় নিধন হওয়ার পরে এখনও যেটুকু বন টিঁকে আছে, সেটা ওঁদের জন্যই।
চলতি শতকের আটের দশকে যখন জঙ্গলে চোরাকারবারিদের নজর পড়েছে, শিবচরণ তখন যেন একাকী প্রহরী ছিলেন। শিবচরণদের মতো রাভা, ওঁরাও, মুণ্ডা, লোহার, নেপালি জনজাতির অনেককে বনসৃজনের উদ্দেশে ব্রিটিশ সরকার জঙ্গলে একচিলতে জমি দিয়েছিল, মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছিল। ডুয়ার্স, তরাইয়ে তৈরি হয়েছিল একের পর এক বনবস্তি। আলিপুরদুয়ার শহরের অদূরে জাতীয় সড়কের ধারে উত্তর পোরো গ্রামে শিবচরণের জন্ম। জঙ্গলের সঙ্গে তাঁর একাত্মতা বোঝা যায়, শিবচরণ যখন বলতেন, ‘১৬ সালে এই প্ল্যানটেশনটা যখন হয়েছিল, তখন আমার জন্ম।’ কোন ১৬ সাল, তিনি জানেন না। জানেন শুধু বাড়ির কাছে বনখণ্ডটা তাঁর সহোদর। এই সহোদরের সঙ্গেই তিনি বড় হয়েছেন। সেই
সহোদরদের রক্ষায় মৃত্যুর কিছুদিন আগেও শিবচরণ জাতীয় সড়কের ধারে গাছের ওপর টংঘর বানিয়ে লণ্ঠন জ্বালিয়ে পাহারা দিতেন, যেন বনের গাছ কেটে কাঠপাচার আটকানো যায়। তিনি তখন চোখে তেমন দেখতে পারতেন না। তবু এই দায়বদ্ধতা, জঙ্গলের প্রতি সহানুভূতি দেখে নিজেকে ধিক্কার দিতাম। কীসের আমরা প্রকৃতিকে রক্ষার বড়াই করি। শিবচরণ আমাদের বুঝিয়ে দিতেন, তোমরা শখের পরিবেশ বিপ্লবী।

উত্তর পোরোর শিবচরণের মতো দক্ষিণ পোরো বনবস্তির মোড়ল ছিলেন তিলেশ্বর রাভা। শেষ বয়সটায় সবসময়ই মন খারাপ থাকত। বাড়ির পাশে পোরো নদী। যেতে মন চাইত না তাঁর। বলতেন, ‘নদীটাকে মেরে ফেলেছে সবাই। কী দেখতে যাব। নদীর দিকে তাকালে মনে হয়, সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।’ তিলেশ্বরের ভাষায়, নদী আমাদের অভিভাবকও। জঙ্গলের মাঝে বর্ষা ছাড়া বছরভর ক্ষীণকায়া জলস্রোতকে যাঁরা সন্তান ভাবেন, অভিভাবকের মর্যাদা দেন, তাঁদের তো আমার ঈর্ষা হওয়ার কথাই। আমারও তো বাড়ির পাশে নদী ছিল। ধারসি নদী। ক্ষীণকায়া। বর্ষায় শুধু ভয়ঙ্কর। আমাদের শৈশবের খেলার সাথী। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে শারীরিক কসরত। ভেলায় চড়ে আমাদের গ্রাম থেকে তিন কিলোমিটার দূরের মেলায় যাওয়া। মহাকাল ধামের মেলা। জলপথে যাওয়ার আনন্দই আলাদা। নিজেরা যাত্রী, নিজেরাই মাঝি। অসতর্কতায় একবার গভীর জলে পড়ে গেলেও ধারসি কিন্তু আমাদের তিন ভাইকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি।

স্নান করতে নেমে তলিয়ে যাচ্ছিলাম ধারসিতে। আচমকা নদীপাড়ের বাসিন্দা প্রকৃতির এক সন্তান, আমাদের আদিবাসী বন্ধু জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের বাঁচিয়েছিলেন। এখন ঘটনাটি মনে হলে ভাবি, নদী সেদিন আমাদের মারতে চায়নি, প্রকৃতির সন্তানকে চেনানোর চেষ্টা করেছিল। আমাদের সেই চেনাটা হয়ে ওঠেনি। এই প্রসঙ্গে ফের পার্বতী বড়ুয়ার কথা উল্লেখ করা অন্যায় হবে না। পার্বতী নামকরণের মধ্যেও ছিল প্রকৃতির ছোঁয়া। পার্বতী মানে দেবী দুর্গা। গণেশের মা। এই গণেশের মাথাটি হাতির। সেই অর্থে হাতির মা দেবী পার্বতী। গৌরীপুরের রাজকন্যা পার্বতী আক্ষরিক অর্থেই হাতির মা। কাছে গেলে হাতিরা সর্বাঙ্গে তাঁর স্নেহের পরশ পায়। তাঁর মমত্ব অনুভব করে। এজন্যই মাত্র ১৪ বছর বয়সে বুনো হাতি ধরে বশে এনেছিলেন পার্বতী।
মাহুতদের প্রশিক্ষণ দিতে আজও ডাক পড়ে পার্বতীর। সেসব কর্মসূচিতে দেখেছি, কোন কায়দায় স্নান করালে হাতি আরাম পাবে, তা বাতলে দিতেন তিনি। হাতির সঙ্গে থেকে থেকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় বিশালাকায় প্রাণীটির মনও পড়তে পারেন লালজী বড়ুয়ার এই কৃতী কন্যা। তাঁর দিদি প্রতিমা বড়ুয়ার অনেক গানে অসম, উত্তরবঙ্গের নানা নদী ও হাতির উল্লেখ। গৌরীপুরের রাজবাড়ি যেন হাতিরই পরিবার। পার্বতীকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করেছিল বিবিসি। ‘কুইন অফ দি এলিফ্যান্ট।’ হাতির সঙ্গে দীর্ঘযাত্রার চিত্রায়ণ। পার্বতীর শর্ত ছিল, তাঁর সহ অভিনেতাদের হাতির সঙ্গে আরণ্যক পরিবেশে থাকতে হবে। শহরের বিলাসবহুল হোটেল কিংবা রিসর্টে নয়। তাঁর সঙ্গে সহনাগরিকদের হাতির পরিচর্যা করতে হয়েছে। হাতির বিষ্ঠাও পরিষ্কার করতে হয়েছে। নিখাদ এই হাতি প্রেম শৌখিন ছিল না কখনও। বন্যপ্রাণী, বন ছিল তাঁর রক্তে। সেখানে দূর থেকে ভালোবাসার বালাই ছিল না।

গত শতকের আশির দশকে একবার বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের জঙ্গলে অসম থেকে ওয়াইল্ড বাফেলো (বুনো মহিষ) এনে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। ততদিনে বক্সায় অবলুপ্ত হয়ে গিয়েছে প্রাণীটি। শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে পার্বতী বলেছিলেন, ‘না খেয়ে ওয়াইল্ড বাফেলো মরে যাবে।’ কেন? তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, প্রাণীটির প্রধান খাদ্য হোগলাপাতা আর বক্সার জঙ্গলে নেই। নির্দিষ্ট করে ডিমা বিটের একটি ফরেস্ট কম্পার্টমেন্টের উল্লেখ করে বলেছিলেন, ওই জায়গাতেই সামান্য যা হোগলা গাছ আছে। এরকম নিবিড়ভাবে জঙ্গল চেনেন পার্বতী, যেভাবে চেনেন বনের মানুষরা। বক্সা বনে জয়ন্তী নদীর কাছে পানবাড়ি বনবস্তির পটেক রাভাও দেখেছি, জঙ্গলের কোথায় কী গুল্ম, কোন লতাপাতা ইত্যাদি আছে, তা এক নিঃশ্বাসে বলে যেতে পারতেন। ভুটানঘাটের কাছে ময়নাবাড়িতে এক নেপালি বৃদ্ধের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আলিপুরদুয়ার নেচার ক্লাবের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, জঙ্গল অন্ত প্রাণ অমল দত্ত। দু’জনেই এখন প্রয়াত।
ওই নেপালিভাষি বৃদ্ধের নামটি এখন আর স্মরণে নেই। কিন্তু মনে আছে, জঙ্গলের প্রতিটি গাছ, লতাগুল্ম শুধু তিনি চিনতেনই না, সেসব কী কাজে লাগে, তা জেনেছেন নিজস্ব গবেষণায়। তখনও ওই এলাকায় তেমন স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছিল না। আধুনিক চিকিত্সার পরশ ছিল না। ওই বৃদ্ধ ছিলেন এলাকার ধন্বন্তরী। লতাপাতা, গাছের ছালে তৈরি হত তাঁর ওষুধ। অধিকাংশ সময় তাঁর দেখা মিলত জঙ্গলে কোনও উচু গাছের মগডালে বা নিবিষ্ট মনে কোনও গুল্মের গায়ে হাত বোলাতে।
একজন ওঁরাও জনগোষ্ঠীর মানুষ বাস করতেন আলিপুরদুয়ার জেলার শামুকতলার কাছে। জঙ্গল থেকে জ্বালানি কাঠ কুড়িয়ে শামুকতলা হাটে বিক্রি করে তাঁর পেট চলত। সত্তরের দশকে ওই এলাকায় সিপিএমের পার্টি সদস্য ছিলেন মাত্র সাত। তাঁদের অন্যতম ছিলেন এই আদিবাসী মানুষটি, সহরাই ওঁরাও যাঁর নাম। দলের শাখা কমিটির বৈঠক থাকলে তিনি সবার আগে এসে উপস্থিত হতেন। সেদিন তাঁর জঙ্গলে যাওয়া কামাই। ফলে ঘরেও হাঁড়ি চড়ত না। অবলীলায় জঙ্গলের কাঠ কেটে পাচার করে মোটা টাকা রোজগার করতে পারতেন। সে রাস্তায় যাননি কখনও। পেটের যতই তাগিদ থাকুক, বড় গাছে কখনও হাত দিতেন না। বড়জোর বড় গাছের ডালপালা, নাহলে ছোট ছোট গাছ কেটে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতেন। তাও কাটার আগে গাছের উদ্দেশে বলতেন, ‘ক্ষমা করে দিস আমাকে। তোর শরীর না কাটলে যে আমার পরিবার ভুখা থাকবে।’ তারপর বিড়বিড় করে প্রার্থনা শেষে কুড়ুলের কোপ বসাতেন।
পার্বতী বড়ুয়া থেকে শুরু করে সহরাই ওরাওঁ, এঁরাই আসলে প্রকৃতির সন্তান। এঁরাই বনের নায়ক–নায়িকা। কখনও এঁদের মতো হতে পারলাম না। বাকি জীবনে পারবও না। শহুরে বিষ মনের মধ্যে এখন। দূর থেকে জঙ্গল দেখে ‘আহা, কী সুন্দর’ বলে ক্যাপশন লিখে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিই। বনের হাতি নয়, কুনকির পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলি আর বাতেলা ঝাড়ি, এদের না জানি কত বুঝি আমি। বন আমার থেকে আসলে যোজন যোজন দূরেই রয়ে গেল।
ছবি সৌজন্য: Facebook, wbsfda.org, North Bengal Tourism
ভিডিও সৌজন্য: Youtube, Khabar Chauraha
কর্মসূত্রে কলকাতায় দীর্ঘদিন বসবাসের পর থিতু শিলিগুড়ি শহরে। নিজেকে ডুয়ার্সের সন্তান বলতে ভালোবাসেন। গ্রামের আদি বাড়ির একপাশে বোড়ো আদিবাসী বসত, অন্যপাশে সাঁওতাল মহল্লা। বক্সার রায়ডাক জঙ্গল গ্রামের কাছেই। শৈশব, কৈশোরে বাড়ির উঠোনে চলে আসতে দেখেছেন হাতি, চিতাবাঘ, হরিণ। জঙ্গলে কুল কুড়োতে কুড়োতে আর নদীতে ঝাঁপিয়ে বড় হওয়া। প্রকৃতি আর উপজাতিরাই প্রতিবেশী। যৌবনে এই পরিবেশে কিছুকাল বাউন্ডুলে জীবনের পর সিদ্ধান্ত, সাংবাদিকতা ছাড়া আর কোন কাজ নয়।