দ্বিজেন্দ্রতনয় দিলীপকুমার রায় তাঁকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন— “তোমাকে দু-একটি গান শেখাতে এত ইচ্ছে করে, কিন্তু জানি তুমি শিখবে না। তবু ইচ্ছে করে প্রায়ই তোমার মুখে ভালো গান শুনতে।”
এই চিঠি আমাদের কৌতুহল জাগিয়ে দেয়! কে এই সুধাকণ্ঠী যাঁকে দিলীপকুমার গান শেখাতে চাইছেন, অথচ গায়িকা নিস্পৃহ? এর উত্তর দেওয়ার আগে শুনে নেওয়া যাক আগের কিছু কথা।
১৮৮৭ সালে এমিল বার্লাইনার নামে এক ৩৬ বছর বয়স্ক জার্মান-আমেরিকান তরুণ সৃষ্টি করলেন থালার মতো দেখতে গ্রামোফোন রেকর্ড। এই রেকর্ডের সৃষ্টি সত্যি অর্থে এক বিপ্লব ঘটাল।
[the_ad id=”266918″]
ডিস্ক রেকর্ডের আগমন খুলে দিল অনেকগুলো সম্ভাবনা। সংগীত, বাচিক ও অভিনয় শিল্পকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখার এই উপায় এক অসীম ব্যবসায়িক সাফল্যের রাস্তা খুলে দিল— ভারতের মতো বিচিত্র সংস্কৃতির এত বড়ো দেশ সে লক্ষ্যপূরণের সুবর্ণভূমি যেন।
এরই পাশাপাশি গ্রামোফোনে নিজেদের কীর্তিকে চিরস্থায়ী করে রাখতে শিল্পীরাও আকৃষ্ট হলেন ‘রেকর্ডে গান দেওয়ার’ জন্য। প্রথম প্রথম গৃহস্থ বাঙালির রেকর্ডে গান গাইতে কুণ্ঠা ছিল। কুণ্ঠার কারণ সামাজিক। যে কারণে প্রথম যুগের গ্রামোফোন রেকর্ডে শিল্পীর নামের আগে ‘অ্যামেচার’ কথাটা লেখা থাকত সমাজের কটাক্ষ এড়াতে।
আমাদের আজকের কথা যে সময় নিয়ে, সে সময়ে অবস্থা পালটেছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মেয়েরাও তখন পারিবারিক ঘেরাটোপের মধ্যে থেকে গ্রামোফোনে গান গাইতে এগিয়ে আসছেন। প্রথম যুগে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের অনুজা অমলা দাশ রেকর্ডে গান গাইছেন মিস. দাস (অ্যামেচার) নাম নিয়ে। এমনকি বিখ্যাত সংগীতজীবী লালচাঁদ বড়ালের নামের আগেও ‘অ্যামেচার’ বসিয়ে বাজারে রেকর্ড বেরোচ্ছে। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকার প্রতিভা (রাণু) সোম (পরবর্তী কালে স্বনামখ্যাত প্রতিভা বসু) রেকর্ডে গান গাইছেন ‘অ্যামেচার’ বাদ দিয়েই।

রেকর্ডের আবির্ভাবের প্রথম যুগে, গ্রামোফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেডের পাশাপাশি আরও কয়েকটি কোম্পানির নাম রেকর্ডের ব্যবসায় শোনা গেলেও, ধীরে ধীরে গ্রামোফোন কোম্পানিই (যা ১৯১৬ সালের পর থেকে হিজ় মাস্টার্স ভয়েজ় বা HMV নামে গ্রামোফোন ও কুকুরের লোগো-সহ মধ্যবিত্ত ভারতীয় পরিবারের সদস্যে পরিণত হবে প্রায়) এই ব্যবসায় একচেটিয়া বাজার দখল করে। শুরুতে ‘কুন্তলীন’ তেলের স্বত্বাধিকারী, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর ভাগনে হেমেন্দ্রমোহন বসু ফ্রান্সের প্যাথি কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘প্যাথি এইচ বোস রেকর্ড’ বাজারে এনে ব্রিটিশ মালিকানাধীন গ্রামোফোন কোম্পানির একটা প্রতিস্পর্ধী উদ্যোগ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও সেটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। এইচএমভির সমান্তরালে দেশীয় উদ্যোগে যে দু’টি রেকর্ড কোম্পানি প্রথম মাথা তুলে দাঁড়াল সে দু’টিই বাঙালির তৈরি। ১৯৩২ সালে চণ্ডীচরণ সাহা ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ অ্যান্ড ভ্যারাইটিস সিন্ডিকেট লিমিটেড’ নামে ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে এবং জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ ৭১/১ হ্যারিসন রোডে ‘মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের বর্তমান লেখার সঙ্গে এই শুরুর ইতিহাসের যোগ রয়েছে।
[the_ad id=”266919″]
কোরানের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ যাঁর হাতে হয়েছিল, তিনি গিরিশচন্দ্র সেন (১৮৩৪/৩৫-১৯১০)। সে সময়ের ‘ঢাকা জেলার অন্তর্গত নারায়ণগঞ্জ মহকুমার রূপগঞ্জ থানার অধীন পাঁচদোনা গ্রামে’ গিরিশের জন্ম। গিরিশের ‘খুল্ল প্রপিতামহ দেওয়ান দর্পনারায়ণ রায় নবাব আলিবর্দি খাঁর সময়ে মোর্শেদাবাদের নবাব সরকারে একটি উন্নত পদে নিযুক্ত ছিলেন।’ আসলে দর্পনারায়ণ এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তোষনারায়ণ ও কনিষ্ঠ ইন্দ্রনারায়ণ সকলেই মুর্শিদাবাদের নবাবের চাকরিতে উচ্চপদে বহাল ছিলেন। ইন্দ্রনারায়ণের পৌত্র মাধবরাম ও তাঁর স্ত্রী জয়কালী দেবীর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান গিরিশচন্দ্র। গিরিশচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র ইন্দুভূষণ ও তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীময়ী দেবীর পাঁচ কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ কন্যাই আমাদের আজকের লেখার মুখ্য আকর্ষণ। দিলীপকুমারের উপরে উদ্ধৃত চিঠিটির উদ্দিষ্ট সেই কনিষ্ঠ কন্যা রাণু বা রেণুকা সেনগুপ্ত বা দাশগুপ্ত।
[the_ad id=”270084″]
ইন্দুভূষণের পরিবার খ্যাতিতে এবং কীর্তিতে মহান। ইন্দুভূষণের পিসতুতো ভাই স্যার কে. জি. গুপ্ত (কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত), আই.সি.এস. ভারত সচিবের কাউন্সিলে প্রথম ভারতীয় সদস্য। বিশিষ্ট গায়িকা সাহানা দেবীর পিতা সিভিল সার্জন ডাঃ প্যারীমোহন গুপ্ত, স্যার কে. জি. গুপ্তর অগ্রজ। সাহানার পিসি হেমন্তশশীর পুত্র কবি-গীতিকার-ব্যারিস্টার অতুলপ্রসাদ সেন। শৈশবে বাবা-মায়ের মৃত্যু হওয়ায় পিসি এবং পিসতুতো ভাই-বোনেদের সঙ্গে ইন্দুভূষণ বেড়ে ওঠেন। অসামান্য মেধা আর ছবি আঁকায় আগ্রহ ছিল সুধাকণ্ঠ্য ইন্দুভূষণের। এফ.এ. পাস করার পরে ঢাকা আর্ট কলেজে পড়াশুনা। কিন্তু পেশাদার চিত্রকর হওয়ার সাধ তাঁর পূর্ণ হয়নি। অল্প বয়সে আবগারি বিভাগের চাকরিতে ঢুকতে হয়। পরে এই বিভাগের ইন্সপেক্টর ও সুপারিনটেন্ডেন্ট পদে উন্নীত হন।
এইচএমভির সমান্তরালে দেশীয় উদ্যোগে যে দু’টি রেকর্ড কোম্পানি প্রথম মাথা তুলে দাঁড়াল সে দু’টিই বাঙালির তৈরি। ১৯৩২ সালে চণ্ডীচরণ সাহা ‘হিন্দুস্থান মিউজিক্যাল প্রোডাক্টস্ অ্যান্ড ভ্যারাইটিস সিন্ডিকেট লিমিটেড’ নামে ৬/১ অক্রুর দত্ত লেনে এবং জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ ৭১/১ হ্যারিসন রোডে ‘মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের বর্তমান লেখার সঙ্গে এই শুরুর ইতিহাসের যোগ রয়েছে।
আবগারি বিভাগের কাজের দাবি মেনেই বিভিন্ন জায়গায় বদলি হওয়া ছিল ইন্দুভূষণ ও তাঁর পরিবারের রুটিন। কলকাতার অদূরে কোন্নগরে ইন্দুভূষণ পরিবার নিয়ে এলেন যখন, সেই ১৯১০ সালের ২২ অগস্ট তাঁর সর্বকনিষ্ঠ কন্যা রেণুকার জন্ম— আদরের নাম রাণু। ইন্দুভূষণের পরিবারে কবিতা-গানের চর্চা চলত। মেজ মেয়ে প্রিয়বালা বাবার সম্পর্কে লিখেছেন—“তিনি নিজে গান গাইতে ও গান তৈরী করতে পারতেন। বাবার বংশে বাবাই একমাত্র গায়ক ও গীত-রচয়িতা ছিলেন। (…খালি গলায় সবাই গান গাইতেন।)”
কাজেই এই পরিবারের কনিষ্ঠ কন্যা রাণু যে গলায় গান নিয়েই জন্মাবেন তাতে আশ্চর্য কী! জন্মের পরে কোন্নগর থেকে কলকাতায় পিসির বাড়ি এবং ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের বাড়ি হয়ে চললেন রাঁচিতে। সেখানেই বাবার চাকরি তখন। মেজদিদি প্রিয়বালার লেখায় পাচ্ছি—“ছোটো বোনদুটি স্কুলে পড়তে যেতো”। অর্থাৎ রেণুকার স্কুলে যাওয়া শুরু হয় রাঁচিতে থাকতেই। এরপর বাবা বদলি হন ভাগলপুরে। হঠাৎ (সম্ভবত) ‘সন্ন্যাস রোগে’ (সেরিব্রাল বা হার্ট অ্যাটাক) মারা যান ইন্দুভূষণ। রেণুকার তখন পাঁচ বছর। স্ত্রী লক্ষ্মীময়ী ফিরে গেলেন তিন মেয়ে (পুঁটু, টুনু, রেণুকা), এক ছেলে (মণিভূষণ) ও কয়েকজন পোষ্য নিয়ে ঢাকার “টিকাটুলি পাড়ায় ঘাস-জঙ্গলে ঢাকা তাঁর একতলা বাড়িখানায়।”

রেণুকা মানুষ হিসাবে বরাবর আত্মমগ্ন, অন্তর্মুখী। নিজের সম্পর্কে কিছু বলতেই তাঁর অনীহা ছিল। কম কথা বলা রেণুকার এই সময়ের কথা তাই প্রায় কিছুই জানা নেই আমাদের। তাঁর সম্পর্কে জানার প্রধান উৎস, তাঁর সম্পর্কে অন্য মানুষের স্মৃতিচারণ, পরিবারের স্মৃতি আর ইন্দিরা সংগীত শিক্ষায়তনের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী সুভাষ চৌধুরী মহাশয়ের নেওয়া একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার।
পুত্রবধূ শ্রীপর্ণা দাশগুপ্তের থেকে শুনেছি রেণুকা দাশগুপ্তের প্রথাগত পড়াশুনা আই.এ. পর্যন্ত। ১৯৩১ সালে বিয়ে হয় শিবপুরের বেঙ্গল এঞ্জিনিয়ারিং কলেজের উজ্জ্বল সিভিল এঞ্জিনিয়ার হীরেন্দ্রচন্দ্র দাশগুপ্তের (১৯০০-১৯৬৬) সঙ্গে। প্রথম সন্তান (কন্যা) মালবিকার জন্ম ১৯৪৪-এ, দ্বিতীয় সন্তান (পুত্র) অমিতাভ-র জন্ম ১৯৪৭-এ। হীরেন্দ্রচন্দ্রের মৃত্যু ১৯৬৬ সালে। স্বামীর মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্যানিটারি প্লাম্বিং কোম্পানি এইচসি দাশগুপ্ত কোম্পানির কাজকর্ম নিজের হাতেই বেশ কিছু দিন সামলেছেন। আস্তে আস্তে সে কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শেষের বেশ কিছু বছর নিভৃত অবসরেই জীবন কাটে তাঁর।

প্রচারবিমুখ রেণুকা বরাবরই থাকতে চেয়েছেন প্রচারের বাইরে। জীবনের শেষ প্রান্তে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন পড়াশুনায়— বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় অসংখ্য বই পড়তেন। বিশেষ পছন্দ ছিল অভিধান— বাংলা, ইংরেজি অভিধান পড়তেন নিয়মিত। আগাথা ক্রিস্টির গল্পের ভক্ত ছিলেন। রান্না করতে ভালোবাসতেন। শেষের বেশ কিছু বছর শরীর তাঁকে পীড়িত করেছিল— পাঁচ বার পেসমেকার বদল করতে হয়। ১৯৯১ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে কলকাতার সুরেন ঠাকুর রোডের বাস ভবনে ৮০ বছর বয়সে।
[the_ad id=”270085″]
এ তো গেল রেণুকার মোটামুটি জীবনকথা। এর বাইরে থেকে গেল তাঁর সংগীত জীবন— যে জীবন সম্পর্কে আমাদের কৌতুহল মেটার নয়। আগেই দেখেছি পারিবারিক সূত্রেই গান রেণুকার কাছে এসেছিল। তাঁর বাড়িতে গান, অভিনয়, আবৃত্তি, লেখাপড়ার চর্চা সবই ছিল। রেণুকার দিদি প্রিয়বালা তো রীতিমতো কবিতা, গান, গীতিনাট্য লিখেছেন। রেডিওতে ‘শকুন্তলা’, ‘শবরীর প্রতীক্ষা’, ‘ঊর্মিলা’ গীতিনাট্য অভিনীত হয়েছে। রেণুকাও গানের চর্চা করেছেন ছোটো থেকেই। গান নিয়ে যে বিখ্যাত হতে হবে তা নয়— গান ছিল জীবনযাপনের অংশ। রেণুকা টিকাটুলিতে থাকতে যে স্কুলে পড়তেন, তার একজন শিক্ষকের সহোদর হেম সেন যুক্ত ছিলেন এইচএমভির সঙ্গে। হেম সেন রেণুকাকে নিয়ে যান এইচএমভির ১৩৯ নম্বর বেলেঘাটা মেন রোডের স্টুডিওতে প্রথম রেকর্ড করানোর জন্য। তখন রেণুকার ১২/১৩ বছর বয়স।

রেণুকার স্মৃতিচারণায় জেনেছি, ওঁর সঙ্গে নাকি ঢাকার আর এক মেয়ে প্রতিভা (রাণু) সোমেরও গান রেকর্ড করা হয়েছিল (এটা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার যে দু’জনেরই ডাক নাম রাণু)। ১৯২২-২৩ সালে ইলেকট্রিক্যাল রেকর্ডিং ব্যবস্থা চালু হয়নি। টেবিলের উপর বসে একটা চোঙায় মুখ রেখে গান গেয়েছিলেন। ইলেকট্রিক্যাল রেকর্ডিং ব্যবস্থা আসার আগে সেটিই ছিল দস্তুর। দ্বাদশী/ত্রয়োদশী রেণুকার মনোযোগ গানের চাইতেও রেকর্ডিং-এর সময় স্টুডিওতে জ্বলে ওঠা লাল আলোর দিকেই বেশি ছিল। চারটি গান করেছিলেন। দু’টি শ্যামা সংগীত (“শ্যামা মা কি কালো রে” এবং “আমার উদাস করা সুরে”), দুটি হিন্দি ভজন (“ক্যায়সে যাওঅব বৃন্দাবনমে”, অন্য গানটির কথা জানতে পারিনি)। এই দু’টি রেকর্ড বাজারেও বেরিয়েছিল, কিন্তু তার সন্ধান এখনও কোনও সংগীতরসিকের কাছে পাইনি।
তখন রেকর্ডে গান করার অনুমতি পাওয়া গেলেও বাইরে গান করায় পরিবারের আপত্তি ছিল প্রবল। পরবর্তীকালেও আমরা দেখেছি রেণুকা কখনওই প্রকাশ্যে গান গাইতে খুব একটা পছন্দ করতেন না। ১৯২০-র শেষ দিকে ঢাকার কামরুন্নেসা গার্লস হাই স্কুলে গান শেখাতে শুরু করেন।

এর পরে ১৯৩২ সালে হিন্দুস্তান রেকর্ড সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে বেশ কিছু গান সেখানে রেকর্ড করেন। আগেই দেখেছি সম্পর্কে অতুলপ্রসাদ সেন তাঁর দাদা। অতুলপ্রসাদের কাছে অনেক গান শিখেছেন এবং তাঁর অভিভাবকত্বে রেকর্ড করেছেন স্বদেশি হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে। তাঁর গানের গুরুত্ব বোঝা যাবে একটা সামান্য তথ্যে। ১৯৩২-এ হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানি তৈরি হওয়ার পর প্রথম রেকর্ড বের হয় রবীন্দ্রনাথের (দ্বিতীয় রেকর্ড অতুলপ্রসাদ সেনের এবং তৃতীয় রেকর্ড রেণুকা দাশগুপ্তের (“যদি গোকুলচন্দ্র ব্রজে না এলো”/ “পাগলা মনটারে তুই বাঁধ”)। এর পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলামের কাছে দু’টি গান শিখে রেকর্ড করেন (“কোন রস যমুনার কুলে”/ “শুক সারি সম তনু মন মম”)। ১৯৩৬ সালে হিন্দুস্তান রেকর্ড থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড (“তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায়”। এর উলটো পিঠে ছিল অতুলপ্রসাদের “আমার পরাণ কোথা যায়”)। হিন্দুস্তান রেকর্ড কোম্পানির ক্যাটালগ অনুসারে এ গান তাঁকে শিখিয়েছিলেন বিখ্যাত গায়ক হরিপদ চট্টোপাধ্যায়।

১৯৩৮-এ বের হয় আরও দু’টি রবীন্দ্রসংগীত (“আমার কী বেদনা সে কি জান” / “কত কথা তারে ছিল বলিতে”)। পরে এইচএমভি থেকে অবশ্য আরও দুটি রবীন্দ্রগান রেকর্ড হয়। সন্তোষ সেনগুপ্তের আগ্রহাতিশয্যে ১৯৭০ সালে এইচএমভি থেকে আরও চারটি অতুলপ্রসাদের গানের এক্সটেনডেড প্লে রেকর্ড বের হয়। রেণুকার বড়দির কন্যা নীলিমা সেনগুপ্তর সঙ্গে অতুলপ্রসাদের গানও রেকর্ড করেছেন হিন্দুস্থান থেকে (“কত কাল রবে” / “কেন এলে তবে মানবের ভবে”)। অতুলপ্রসাদের গানই ছিল তাঁর জীবনের মূল অবলম্বন।

অসংখ্য গান নাকি তাঁকে শিখিয়েছেন দিলীপকুমার রায়। কিন্তু কিছুতেই সে গান গাইতে চাইতেন না। জীবনের উপান্তে জানিয়েছেন অকপটভাবে— দিলীপকুমার, কিংবা রবীন্দ্রনাথ বা কাজী সাহেবের গান তাঁর মেজাজ বা ক্ষমতার সঙ্গে মিলত না বলেই তা গাওয়ার অহেতুক চেষ্টা করেননি। যদিও দিনেন্দ্রনাথ ও শৈলজারঞ্জনের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছেন। রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁকে নিজের মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন। সন্তোষ সেনগুপ্ত তাঁর কণ্ঠে “নীলাঞ্জনছায়া” শোনার যে অভিজ্ঞতা শুনিয়েছেন তা হয়তো সে সময়ের অনেকেরই মনের কথা— “নীল্ বলে যে তানটি সাধারণতঃ দেওয়া হয়ে থাকে সেইটাই তিনি দিলেন। তাঁর অপরূপ কণ্ঠলাবণ্যের সঙ্গে তানটি এমন অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে গেল যে সর্বশরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। সারাজীবন ধরে এ-গান শুনেছি বহুতর শিল্পীর কণ্ঠে কিন্তু অমন মাধুর্যের সন্ধান আর পেলাম না।”

সুরসাগর হিমাংশুকুমার দত্তের কাছেও গান শেখার সুযোগ হয়, হিমাংশুকুমার নাকি দু’টো গানও নির্বাচন করে রেখেছিলেন রেকর্ড করাবেন বলে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর তা হয়নি। ভজন শিখেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে। রেকর্ডও বেরিয়েছিল (“আয়ে ভিখারিনী প্রেম নগর কি প্রীতম প্রীতম বোলে”)। কিন্তু সংগীতে রেণুকার মূল মুক্তির জায়গা ছিল অতুলপ্রসাদের গানেই। অতুলপ্রসাদ নাকি পছন্দ করতেন না গানের সঙ্গে বেশি যন্ত্রানুষঙ্গ। এমনকি তবলাও নয়। রেণুকার গানও আভরণহীন, গভীর, অতলান্ত। এই সংগীতবোধ তাঁকে নিমজ্জিত করেছিল আবদুল করিমের গানে। আবদুল করিমের গান তাঁর কাছে এক অবগাহনের তুল্য। আর ভালো লাগত সাবিত্রী ঘোষ, কনক দাশ, বিজয়া দাশ (রায়), সুপ্রভা রায়ের (সত্যজিৎ জননী) গান। কোনও দিন রেডিওতে গান করেননি। অতুলপ্রসাদের প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে রেডিওতে স্মৃতিচারণ করেছেন।
[the_ad id=”270086″]
রেডিও প্রসঙ্গে বিখ্যাত গায়ক সন্তোষ সেনগুপ্তের স্মৃতিকথার একটু অংশ তুলে দিলে প্রসঙ্গান্তর হবে না, বরং ব্যক্তি রেণুকাকে বুঝতে তা সহায়ক হতে পারে— “রেণুকা দাশগুপ্তকে রেডিওতে গান করাবার ব্যাপারে আমার বিশেষ আগ্রহ ছিল। কয়েকদিন ধ’রে বলা-কওয়ার পর উনি রাজি হলেন এবং কয়টি গান গাইবেন এবং তার সময় ইত্যাদি সব মহড়া দিয়ে নেওয়া হল। আমি রেডিও অফিসে গিয়ে রেণুকা দাশগুপ্তর প্রোগ্রামের ব্যাপার সব পাকা করে এলাম। প্রোগ্রামের দিন সকালে আমি একটি চিঠি পেলাম—তাতে লেখা রয়েছে—সন্তোষদা, ভেবে দেখলাম রেডিওতে গান গাওয়া আমার দ্বারা হবে না। আপনি দয়া করে কিছু মনে করবেন না। ইতি রাণুদি।”

জীবনের শেষ দিকে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন গানে অহেতুক শব্দ আর যন্ত্রানুষঙ্গের আতিশয্যে। তবু কখনও ভালো গান নাকি জলও আনত তাঁর চোখে। চিরদিন একটা উঁচু সুরে বাঁধা ছিল তাঁর জীবনের তার। সংগীতের বোধ যাঁর তৈরি হয়েছিল অতুলদার হাত ধরে, তিনি সারা জীবনে পারেননি সেই সুর নামিয়ে আনতে। আপস তিনি করেননি। দূরে সরিয়ে নিয়েছেন নিজেকে বাইরের জগত থেকে। কিন্তু সুরের জগতের সেই উচ্চ আসন থেকে নিজেকে নামাননি কোনও প্রলোভনেই। অসংখ্য স্মৃতিচারণায় রেণুকার অলোকসামান্য গানের স্মৃতি ধরা আছে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে রেণুকা বেঁচে থাকতে তাঁর কাছ থেকে তাঁর জীবনের কথা, গানের কথা আমাদের স্মৃতিতে ধরে রাখার তেমন চেষ্টা আমরা করিনি। দিলীপকুমার রায় রেণুকার কণ্ঠের ও গায়কীর ভক্ত ছিলেন। সেই ভালো লাগা ধরা আছে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রকাশিত তত্ত্বকৌমুদী পত্রিকার ‘অতুলপ্রসাদ সংখ্যা’য়— “রেণুকার ছিল খাঁটি কীর্তনের কণ্ঠ যেমন উদাত্ত তেমনি মধুর।”
সেই মাধুর্যের রেশ নিয়ে আমরা রেণুকার গান শুনি, শুনতেই থাকি। নির্মেদ পেলবতায় নির্ভার তাঁর গান!
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
রেণুকা দাশগুপ্তকে নিয়ে এই লেখা তৈরি করাই সম্ভব হত না যদি কিছু মানুষের অকৃপণ সাহায্য না পেতাম। তাঁদের নাম করলাম ঋণ শোধ করার জন্য নয়, স্বীকার করার জন্য।
শ্রীমতী শ্রীপর্ণা দাশগুপ্ত (রেণুকা দাশগুপ্তের পুত্রবধূ), শিঞ্জিনী দাশগুপ্ত (রেণুকা দাশগুপ্তের পৌত্রী), ইন্দ্রজিৎ সেন, রাহুল সেন, শ্রীকানাইলাল সুরভূমি, পার্থসারথি সিকদার, অভিমন্যু দেব, অধ্যাপক সর্বানন্দ চৌধুরী, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়। এর বাইরে কারও নাম ভুলে গিয়ে থাকলে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।
রাজীব চক্রবর্তী পেশায় ভাষাবিজ্ঞানী। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদে কর্মরত। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন অধ্যাপক। বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে দুই বাংলার উদ্যোগে প্রকাশিত 'প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ' (২০১১, দ্বিতীয় সংস্করণ ২০১২) এবং 'প্রমিত বাংলা ব্যবহারিক ব্যাকরণ' (২০১৪) সম্পাদনা করেছেন। এক সময়ে উত্তর ভারতীয় মার্গ সংগীতে প্রথাগত তালিম নিয়েছেন। উৎসাহের জায়গা পুরনো বাংলা গান এবং ৭৮-আরপিএম রেকর্ড সংগ্রহ ও তার বৈদ্যুতিনীকরণ। মূলত প্রাবন্ধিক। নিয়মিত লেখেন ভাষা, সংগীত নিয়ে। রম্যগদ্য লেখায় তাঁর সপ্রশ্রয় দুর্বলতা আছে।
14 Responses
চমৎকার। সমৃদ্ধ হলাম।
স্যার, আপনার ভালো লাগাটাই আমার পুরস্কার!
Orey baba koreycho ki tumi toh hoi likhey pheyleycho.Khubyee tathyapurno jomati lekha.
আপনার পছন্দ হলে আমার কাজ করা সার্থক, অনিন্দ্যদা!
রাজিব বাবু রেনুকা দেবীর সম্পর্কে অনেক তথ্য পেলাম। রেনুকা দেবীর এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়া আমাকে আপনার এই articles এর লিঙ্ক পাঠান গত দুদিন আগে। আমি অতুল প্রসাদের একটি গান এবং ওই আত্মীয়ার লেখা কবিতা আমার youtube channel এ প্রকাশ করেছিলাম গত শুক্রবার। কথা প্রসঙ্গে আপনার এই লিঙ্ক আমাকে পোস্ট করেন। আমি আপনার এই লেখা আগামী শুক্রবার যদি পাঠ করি আপনার কোনো আপত্তি আছে কি না জানতে পারলে খুশি হবো। আমি পেশায় আইনজীবী কিন্তু ভালো লাগে এই ধরনের দৃষ্টান্ত মূলক ঘটনা পড়তে ও জনসমাজে তুলে ধরতে। আমার ইউটিউব channel এর link পাঠালাম https://www.youtube.com/c/JPBMOTIVATIONAL
Adv Jnan Prakash Bag
অনেকদিন পর একটি পাঠ্যসুখ প্রবন্ধ পড়লাম। এবং তেমনি তথ্যবহুল। এটা, সত্যি বলতে মুদ্রিত অবস্থায় থাকা প্রয়োজন বলে মনে হয় ।
ধন্যবাদ! আপনার মতামতের গুরুত্ব অপরিসীম আমার কাছে!
খুবই ভাল লাগল
ধন্যবাদ!
খুব সমৃদ্ধ লেখা — অনেক কিছু জানলাম— আর একটা বহুদিনের ঘুরঘুর করা প্রশ্ন আবার মাথা তুলল — এই যে মানুষেরা, এত প্রতিভা নিয়েও একলা থাকতে, আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন, কোন শৈল্পিক অভিমানে?
খুবই ভালো লাগলো – খুবই সম্বৃদ্ধ লেখা — একটা ভাবনা উশকে উঠলো — এই যাঁরা এত গুণী মানুষ – থেকে যেতে চান আড়ালে, সে কি তাঁদের শৈল্পিক অভিমান?…
খুবই মূল্যবান এই তথ্যসমৃদ্ধ লেখাটি। ইতিহাসের উজ্জ্বল উদ্ধার। সমস্ত দিক থেকে পরিপূর্ণ। আমি আপ্লুত।
প্রথম লাইনটাতেই আটকে গেলাম; দ্বিজেন্দ্রলাল তনয় দিলীপ কুমার রায় চিঠিতে লিখছেন, – তোমাকে দু একটি গান শেখাতে ইচ্ছে করে, কিন্তু তুমি শিখবে না……এটুকু পড়েই মনে প্রশ্ন জাগে- কে এই মানুষটি – যাকে দিলীপকুমার রায় শেখাতে চাইছেন, তিনি শিখবেন না..… এরপরই তরতর গতিতে পড়ে চললাম – এক আকর্ষণীয় কাহিনী – সঙ্গীত-
রসিকদের কাছে অবশ্যপাঠ্য এক ঐতিহাসিক সত্য অধ্যায়। মাটি-চাপা বিলুপ্ত শিল্পসম্ভার যেমন হঠাৎ আবিস্কৃত হয়, ঠিক তেমনি এখানে প্রকাশিত হয়েছেন প্রচারের বাইরে থাকা এক অনন্যা সঙ্গীতশিল্পী – যিনি নিজেও ছিলেন অনেকটাই আত্মমগ্ন। অসামান্য কুশলতায় লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন এই কাহিনী।
শ্রদ্ধেয়া রেনুকা দাশগুপ্ত সম্পর্কে জানবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য লেখককে অনেক ধন্যবাদ।