ফেসবুক
– ছানার জিলিপি খাওয়াবে আজ?
মোবাইলে অর্পণের গলায় আবদার। চমকে গেল সুপর্ণা। সন্ধ্যাবেলা কস্মিনকালেও ফোন করেনা অর্পণ। ‘পিপিই’ ধরাচুড়ো পড়ে একবার আইটিইউ-তে ঢুকে পড়া মানে মোবাইলের সঙ্গে সম্পর্কহীন। অতএব বিনা কারণে ফোন করেনি অর্পণ। আন্দাজেই ঢিল ছুঁড়ল সুপর্ণা–
– কী ব্যাপার, চার নম্বরের ফিমেল পেশেন্ট স্টেবল হল?
ওদিক থেকে এককলি গান ভেসে এল অর্পণের গলায়।
গোঁফ ব্যাপারটা ডাক্তার অর্পণ চক্রবর্তীর নেশা থেকে শ্লাঘায় পরিণত হয়েছে। সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের কিংবদন্তি কার্ডিয়াক সার্জন, ডাক্তার সরকারের টিমের অন্যতম সদস্য সে। কৈশোরে বাবাকে হারিয়ে, শুধুমাত্র মায়ের অদম্য আগ্রহে মেধাবী অর্পণ আজ পৌঁছেছে এই জায়গায়। যেসব রোগীদের হৃদয়, ফুসফুস কাজ করতে চায় না, অর্পণরা তাদের বাঁচিয়ে রাখে যন্ত্রে। দেখভাল করে। তারপর একদিন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রকে ঠেলে শরীর নিজেই সচল হয়ে ওঠে। ভেন্টিলেশন থেকে বার হয়ে আসে। কাজটা প্রচণ্ড কঠিন, কারণ এটা টিমওয়র্ক।
সেই বোঝাপড়া পরিবারেও থাকতে হয় বৈকি। সমস্ত রোগীর মনিটরিং করে রাতদুপুরে বাড়ি ফেরে অর্পণ। সুপর্ণা খাবার বেড়ে বসে থাকে। হাতে পছন্দের বই। ক্লাসিক থেকে শুরু করে হালফিলের বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য সব প্লেটের উপরে সাজিয়ে দেয়। সুপর্ণা সুগৃহিনী। ঘরকে কীভাবে স্বর্গ করে তুলতে হয় তার ফর্মুলা জানে। অর্পণের ব্যাঙ্ক থেকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট সব শক্তহাতে দেখাশোনা করে। হয়তো সেই সুখাবেশের প্রেক্ষিতেই অর্পণ গভীর মনোযোগ দিতে পারে রোগীদের এবং গোঁফকে।

ভেন্টিলেশনের রোগীরাও ঠিক গতানুগতিক রোগী নয়। একেবারে নিস্পন্দ। সাড়াশব্দ নেই, চোখের পিটপিটানি নেই। যে কোনও মানুষ হঠাৎ দেখলে ভাববে মৃত। গুজব ছড়ায়ও খানিকটা সেই কারণে। “মৃত মানুষকে ভেন্টিলেশনে ভর্তি করে রেখেছে” ইত্যাদি ইত্যাদি। জীবন-মৃত্যুর মাঝখানেও যে একটা অতীন্দ্রিয় সময় আছে সেটা একমো স্পেশালিস্ট (ECMO) অর্পণের মতো গুটিকয়েক ডাক্তার উপলব্ধি করেন। কী সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সেই লক্ষণরেখা! কখন যে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়বে স্বয়ং ভগবানও বোধহয় জানেন না। জানেন যম।
সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের কিংবদন্তি কার্ডিয়াক সার্জন, ডাক্তার সরকারের টিমের অন্যতম সদস্য সে। কৈশোরে বাবাকে হারিয়ে, শুধুমাত্র মায়ের অদম্য আগ্রহে মেধাবী অর্পণ আজ পৌঁছেছে এই জায়গায়। যেসব রোগীদের হৃদয়, ফুসফুস কাজ করতে চায় না, অর্পণরা তাদের বাঁচিয়ে রাখে যন্ত্রে। দেখভাল করে। তারপর একদিন কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্রকে ঠেলে শরীর নিজেই সচল হয়ে ওঠে। ভেন্টিলেশন থেকে বার হয়ে আসে। কাজটা প্রচণ্ড কঠিন, কারণ এটা টিমওয়র্ক।
ইদানিং যমের সঙ্গে আঁতাত করেছে নতুন এক স্যাঙাত। কোভিড। ফটাফট ভরে যাচ্ছে ভেন্টিলেটর বেড। সদ্য মা হওয়া এক তরুণী চার নম্বর বেডে। কোভিড পজিটিভ। বাচ্চাটা নিওনেটাল ওয়ার্ডে। মায়ের দুধ পায়নি, কিচ্ছু না। তরুণীর স্বামী, বাবা, মা নিয়মমাফিক কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। হিমশীতল আইটিইউ-এর ভিতরে আজ নিয়ে পাঁচদিন হল রোগিনীর জন্য সব কিছু একহাতে করে চলেছে অর্পণ। কী এক অদ্ভুত আতঙ্কে ভুগছে গোটা পৃথিবী। এই বুঝি এল করোনা। হবে কিন্তু সবারই । কেউ পার পাবে না। ফেসবুকে হাস্যকর প্যানিক ঝড়। ‘আমার একশো মিটারে কোভিড রোগী, মরে যাব‘। আইটিইউ-এর কিছু কিছু ট্রেনড স্বাস্থ্যকর্মীও আতঙ্কের আবহে কাজে আসছে না। স্যালাইন পাল্টানো থেকে কৃত্রিম শ্বাসনল বদলানো, এমনকী রোগিনীর মলমূত্র সাফ, সব করতে হচ্ছে অর্পণকে। আইটিইউ-এর পৃথিবী একদম আলাদা। অসম লড়াই যমে চিকিৎসকে।
প্রেমিকা থাকতেই সুপর্ণার দাবি ছিল, গোঁফ ছাঁটা চলবে না। অর্পণ আগাগোড়া বদলেছে এই কুড়ি বছরে। বদলেছে তার চিকিৎসক সত্ত্বা, পিতৃসত্ত্বা। মেয়ের বাবারা বোধহয় একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়। কিন্তু বদলায়নি তার গোঁফ। চন্দনদস্যু বীরাপ্পনকে আজও মনে রেখেছে অর্পণ। গোঁফ আসলে একটা আইডেন্টিটি। তার ক্ষেত্রে দাম্পত্যের প্রশ্রয়। কিন্তু চার নম্বর পেশেন্ট ইমপ্রুভ করছে না কেন? দুদিন ঠায় দাঁড়িয়েও ঠাহর হয়না অর্পণের। সে ফেল করলে বাচ্চাটা চিরদিনের জন্য মা-হারা হবে। সব পরীক্ষায় পাশ করা মুশকিল। এই সময়টা ডাক্তারের জন্য নিদারুণ অসহায় মুহূর্ত। নিজেকে না-মানুষ এক ভিনগ্রহী মনে হয়। উন্নতির প্যারামিটারগুলো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। তরুণীর বর রোজ ফোন করে স্ত্রীর খোঁজ নেয়। সেই কাতর প্রশ্নের কী জবাব দেবে বুঝতে পারেনা অর্পণ।

কোভিড রোগীদের থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই পিপিই পরতেই হয়। কিন্তু আজ মেয়েটার চোখের মণি যেন বেশি নড়ছে! কিছু বলতে চায়? বুকে তরঙ্গ খেলে গেল অর্পণের। কুড়ি মিনিট ধরেও কিছু বুঝতে না পেরে অধৈর্য হয়ে মাস্ক খুলে ফেলল অর্পণ। মিরাকল ঘটল তখনই। রোগিনীর দুই হাত হঠাৎ নড়ে উঠল । ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি। দ্রুত খাতা পেন এনে দিল অর্পণ। কাঁপা কাঁপা হাতে কয়েকটা অক্ষর।
– ডাক্তারবাবু, বাঁদিকের গোঁফ ছোট কেন?
সকালে দাড়ি কামাতে গিয়ে বাঁদিকের গোঁফটা অসাবধানে ছোট হয়ে গেছিল । সেটাই যে তুরুপের তাস হবে ভাবতে পারেনি। সুপর্ণা জানাল, রোগিনী নাকি অর্পণের ফেসবুক ফ্রেন্ড। অনেকবার লাইক মেরেছে ডাক্তারের প্রোফাইল ফটোতে। হয়তো গোঁফের তারতম্য রোগিনীর অবচেতন মস্তিষ্কে উত্তেজনা এনেছে। ছানার জিলিপি এগিয়ে দিয়ে সুপর্ণা সেই কুড়ি বছর আগের হাসি হাসল।
– শোনো, আজ জুকারবার্গের জন্মদিন। ওঁকেও একটু ক্রেডিট দিও। ফেসবুকের আবিষ্কারক।
অর্পণ শুধু একটা ভবিষ্যত ছবি ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তরুণী মায়ের কোলে নবজাতক। বাঁদিকের গোঁফে তা দিতে গিয়ে নিজেই হেসে ফেলল হো হো করে।
জোড়াতালি
রাত আড়াইটের সময় মোবাইল বেজে উঠল তীব্র রিংটোনে।
– স্যার , একটা কাট থ্রোট ইনজুরি এসেছে।
– সে কী? এই তো ঘণ্টাখানেক আগে কথা হল তোর সঙ্গে!
– না স্যার, আপনি এলে ভাল হয়। ঠিক ভরসা পাচ্ছি না। বাইশ বছরের ইয়ং ছেলে, প্রচুর ব্লিড করছে…”
ইএনটি-র প্রফেসর ডাক্তার বোস তড়িঘড়ি মোবাইল রেখে মাস্ক, ক্যাপ নিয়ে দৌড়লেন। আরএমও রাজু মুখার্জি ফোন করেছে মানে কেস জটিল। যেতেই হবে। রাজুর হাত খাসা। দারুণ সেলাই করে। তাড়াহুড়োয় ফেসশিল্ড নিতেই ভুলে গেছিলেন ডক্টর বোস। কোভিডের ধাক্বায় লিফট ব্যবহার বন্ধ করেছেন। বোতাম টেপাটেপি থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা। তাঁরা ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে সমাজের জন্য। অগত্যা সাততলা কোয়ার্টার থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার উপরে উঠতে হল জিনিসটা আনতে।
অন্য সময় রাতেও মেডিক্যাল কলেজের চত্বর গমগম করে। দূর দূর থেকে আসা রোগীদের আত্মীয়স্বজন, অ্যাম্বুল্যান্স ড্রাইভার, ওয়ার্ডমাস্টার, ইন্টার্ন, হাউসস্টাফ, কেটলিতে করে চা নিয়ে ঘোরা হকার। করোনার জন্য ছবিটাই গিয়েছে বদলে। শুনশান হাসপাতাল চত্বর। গা ছমছমে। দূরে একটা রাতচরা পাখি টি টি করে ডাকছে। পিপিই পরে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার সময়েই কানে এল আর্তনাদ…
– আর বাঁচতে চাই না। ওফ, এবার মরতে দিন আমায়।
আরএমও রাজু প্রফেসরের চোখের দিকে তাকাল।
– সুইসাইড অ্যাটেম্পট স্যার। পুলিশ কেস।
রক্তে ভেসে যাচ্ছে গলা, বুক। ডক্টর বোস বুঝলেন এ সামান্য ইনজুরি নয়। বড় কোনও শিরা বা ধমনী কেটেছে।
– পাড়ার লোক বলল, কাটারির কোপ। ইন্টারনাল জুগুলার গেছে বোধহয় স্যার।
ওটি নার্স কল্পনা মিত্র উল্কার বেগে সেলাইয়ের সরঞ্জাম এগিয়ে দিচ্ছিলেন। প্রফেসর বললেন,
– ট্র্যাকিওস্টোমি সেট দিন সিস্টার। ছোকরা গভীর ক্ষত করেছে শ্বাসনালীর।
ছিন্নভিন্ন শিরা জোড়া দিতে দিতেই এক ঘণ্টা। প্রচুর রক্তপাত হলে ক্ষতস্থানের কিচ্ছু দেখা যায় না। রোগীর পাড়ার লোকজন বেপাত্তা। অগত্যা ওয়ার্ডবয় দিলীপ নিজেই ছুটল রক্ত আনতে। ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে দু’ ইউনিট রক্ত না আনলে টগবগে ছেলেটা মরেই যাবে। ব্লিডিং নিয়ন্ত্রণে আসার পর আহত শ্বাসনালী মেরামত হল। বসল ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব। সেলাইয়ের শেষ ফোঁড় দিয়ে যখন ওঁরা বেরোচ্ছেন, পুবের আকাশ লাল। সাড়ে চারটে। ক্লান্ত দিলীপ ঘুমিয়ে পড়েছে ট্রলির উপর।

ডক্টর বোস তৃপ্ত। যাক একটা প্রাণ বাঁচল। এবার কোয়ার্টারে ফিরে স্নান টান করে একটা ঘুম দিতে হবে। বেলার দিকে রাউন্ডে এসে দেখতে পেলেন ফ্যালফ্যাল করে ওয়ার্ডের ছাদে তাকিয়ে আছে রোগী। রাজু হাসল।
– স্টেবল আছে স্যার। আশা করছি চব্বিশ ঘণ্টা পর ট্র্যাকিয়োস্টমি টিউব খুলে দিতে পারব।
কিন্তু রোগী বোধহয় কিছু বলতে চায়। ডক্টর বোস এমন বহু ঘটনার সাক্ষী। শ্বাসনালীর সার্জারি হলে কথা বলার ক্ষমতা চলে যায়। স্বভাবতই মানুষ অবসাদে ভেঙে পড়েন। দ্রুত টিউবের মুখ চেপে ধরলেন তিনি।
– এবার বলো, কী বলতে চাও।
– বলছি, বাঁচালেন কেন আমায়, হ্যাঁ? ঘরে মায়ের সুগার, বাবার হাঁপানি। একটা বড় শপিং মলে সিকিউরিটির কাজ করতাম, জানেন?
রোগী হাঁফিয়ে উঠেছে। উত্তেজিত হলে খারাপ। রাজু শান্ত করার চেষ্টা করল।
– চাকরিটা নেই!
ছেলেটা কঁকিয়ে উঠল ফ্যাঁসফেসে গলায়
– আওয়াজ ফিরে পেয়ে লাভ কী! আমাদের কথা কেউ শুনবে?
ড্রিপ দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঢুকছে। সেদিকে তাকিয়ে ছেলেটা হাহাকার করে উঠল,
– একমাস মা বাবার ওষুধ কিনতে পারিনি। ঘরে খাবার নেই।
– ঠিক আছে। এখন শান্ত হও। সেলাই খুলে গেলে ফের ব্লিডিং হবে।
– খুলুক। তার থেকে পেটে কিছু দিন আমাদের। এইভাবে জোড়াতালি দিয়ে বেঁচে কী লাভ?
ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো হাত ছিটকে এল ডক্টর বোসের। নিজের গলাটাই কেমন আটকে যাচ্ছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলছেন। কে যেন শক্তহাতে গলা চেপে ধরেছে। কে?
ছবি সৌজন্য: Indiatvnews, Unicef, Graphicmedicine
পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
One Response
Didi tomar lekha gulo khub pran chuye jaoya, amader sobar kosto eto sundar vabe, eto sohoj vabe bolecho tumi….