১/
হর কি পৌরি ঘাট (Garhwal)। অর্থাৎ শিবের পায়ের ঘাট। উত্তরাখন্ড তো আসলে হিমালয়ের পাদদেশ। যুগ যুগ ধরে বাঙালিরা এসছেন, উমাপ্রসাদ থেকে শঙ্কু মহারাজ। কত কষ্ট করে এসছেন তাঁরা। আজও যেন এখানকার হাওয়ায় তাঁদের নাম খোদাই করা…সেই টানেই হাজির হলাম হরিদ্বার-হৃষিকেশ। মুসৌরি ঘোরার ইচ্ছেও ছিল মনে।
বুদ্ধদের গুহর চাপরাশ পড়ে এই জনপদের প্রতি আসক্ত হয়েছিলাম। কিন্তু ঘাটের সন্ধ্যা আরতিটা খানিক ফিকে লাগল। কোথাও যেন ছন্দপতন হয়েছে এখানে। বেনারাসের সন্ধ্যা আরতির জমায়েত আরও গমগমে।(Garhwal)

তবু প্রবল ভিড় ঠেলে গঙ্গার জলে পা ভেজালাম। হাতের ফুল আর প্রদীপ ভাসিয়ে দিলাম জলে। একসাথে সমস্বরে গর্জন ভেসে এলো ঈশ্বরের নামে। স্বর্গ আর মর্ত্যলোক কিছু কালের জন্য এক হয়ে গেল! (Garhwal)
সদ্য কলকাতার অনশন মঞ্চের দ্রোহের কার্নিভ্যালের জমায়েতের কথা মনে পড়ল। এমনই জমায়েত দেখে এলাম সেদিন। ছেলেমেয়েগুলো তখনও খায়নি। সমস্ত চিকিৎসকরা কর্মবিরতির ডাক দিচ্ছেন। সব খবরের আপডেট এসে ঢুকছে পরপর।
আরও পড়ুন: একটা ভাঙাবাড়ির মনখারাপের গপ্পো
মনটা কেমন এলোমেলো লাগছিল সন্ধ্যা আরতির শেষে। হাঁটছিলাম পাহাড়ি পথ দিয়ে। রোদ চলে গেছে তখন। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া৷ পুরোনো পুরোনো বাড়ি আর ধর্মশালাগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, এসব বাড়িতেই হয়ত যুগ যুগ ধরে কত তীর্থযাত্রী এসে থেকেছেন! না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শুধু হিমালয় আরোহণ করতে। (Garhwal)

মানুষের অনশন, মানুষের জমায়েত ফিরে ফিরে আসে সভ্যতায়… কোথাও রাগ, প্রতিবাদ তো কোথাও বিস্ময় আর কঠোর তপস্যা। পথ বাতলে দেয় তারপর আগামী জীবনের। মানুষ বড় সুন্দর। তাই, মানুষের উপর থেকে বিশ্বাস হারাতে নেই। জংলা বুনোফুলের গন্ধ আর হাজার বছরের প্রাচীন এক জনপদ এ বিশ্বাসেই নিয়ে গেল, আবারও। (Garhwal)
২/
ছোটবেলায় সবার একবার হরিদ্বার-হৃষিকেশ-মুসৌরি আসার স্মৃতি আছে। আমরা যে মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছি, সে সব পরিবারগুলোতে সাদামাটা ভাবেই এসব দিকে একবার আসা ছিল রেওয়াজ। সেসব ছবি এখন এলবামে ফ্যাকাশে সিল্যুয়েটে। সেসব আত্মীয়রাও অনেকে আজ প্রয়াত। (Garhwal)
বড় হয়ে এসব জায়গায় এলে, সেসব দিন মনে পড়ে। লছমনঝোলার কাছে ছোট্ট আমি-র মাথায় প্রবল আঘাত লেগে রক্তপাত হয়েছিল সেবার। ঝুলন্ত লোহার দোলনা এসে লেগেছিল। তারপর প্রবল কান্নাকাটি করি। গাড়ির চালক ডিজেল দিয়ে অদ্ভুত দ্রুততায় রক্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। (Garhwal)

হৃষিকেশের গঙ্গায় বিকেলে সন্ধ্যা আরতি হচ্ছে। সবুজ জলে পাহাড় থেকে সন্ধ্যা নেমে আসছে। অদ্ভুত আধ্যাত্মে চলে যাচ্ছে মন। এমন সময় আচমকা ফিরে এলো, সেই ছেলেবেলার মাথায় আঘাত লাগার স্মৃতি! মানুষের স্মৃতি বড় আজব এক জিনিস। কোথায় কখন কীভাবে যে ফিরে এসে চমকে দেয়…
পাহাড় ভালো নেই। তা মুসৌরি হোক বা দার্জিলিং। মানুষ পাহাড়কে নোংরা করে দিয়েছে। ইতিউতি প্লাস্টিকের বোতল ফেলে রেখে চলে যায়। খুব বেশি দিন উত্তরাখন্ড বা দার্জিলিং কালিম্পং আর সুন্দর থাকবে বলে মনে হয় না। মানুষ সুন্দরকে সুন্দর রাখতে দেয় না। যেমন মানুষের ছোটবেলাও চিরকাল থাকে না। মানুষের বয়স বাড়ে। মানুষ আর সুন্দর থাকে না। (Garhwal)

কারওয়া চৌথ ছিল সেদিন। গাড়োয়াল (Garhwal) পাহাড় তাই সেজেছে আবার। ভালোবাসার মানুষরা হাতের দিয়া নিয়ে সবুজ গঙ্গায় ভাসিয়ে দিল ভেলা । পুন্যকামনা ভাসতে থাকল। তারপর এক বুক আলোর ভেলা নিয়ে গঙ্গা বয়ে গেল এঘাট থেকে ওঘাটে।
৩/
প্রত্যেকটা ভ্রমণ নতুন কিছু মানুষ দেয়। জীবনকে নতুন ভাবে দেখার ভাবনা দেয়। ঘুরতে আসার আগের জীবন আর পরের জীবন তাই কিছুটা হলেও বদলায়। মুসৌরি আসার পথজুড়েই ছিল অরণ্য, ঝরনা আর পাহাড়। তার সাথে সঙ্গী হল কুয়াশা কিছু পর থেকে।এক গুহায় এক সাধুবাবার সাথে দেখা হল। তাঁর চোখ বড় তীব্র, তাঁকে মনে থাকবে। জীবন সম্পর্কে অনেক কথা বললেন তিনি। হোটেলের সেই ছেলেটিকে মনে থাকবে, যার ব্যবহারে খুশি হয়ে তাঁর মালিককে বলায়, তাঁর মাইনে বেড়ে গেল, তারপর সে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।

যে পরিবার হয়ত সারাক্ষণ ঝগড়া করে, এরকম সফরে এসে প্রত্যেকে নিজেদের নতুন করে খুঁজে পায়। গাড়িতে গান চালিয়ে গলা মেলায় সবাই। পাহাড়ে ছেলেবেলা লুকোনো থাকে। অনেক হারানো গন্ধ, স্মৃতি, রঙের সাথে পাহাড়ে এলে ফের দেখা মেলে। এবারেও তাদের দেখা পেলাম।

পাহাড়ের একটা ম্যাল চত্বর থাকে। মুসৌরিরও আছে। ভোরে আর সন্ধ্যায় গিয়ে সেখানে বসে পড়লেই হল।অদূরে গাছে ঢাকা সারি সারি রাস্তা। মুসৌরি বড় সুন্দর। শান্তির। হয়ত তাই রাস্কিন বন্ড আর ভিক্টর ব্যানার্জি এখানেই বাসা নিয়েছেন আজীবন। সন্ধ্যা হলেই পাহাড়ের গায়ে মনকেমনের আলো।
৪/
মুসৌরির পাহাড়ে ভোর হলেই আমি ম্যালে চলে আসি বরাবর। একটা চা, একটা সিগারেট আর আমি। পাহাড়ে সকাল শুরু হয় ধীরে ধীরে। রোদ ওঠে। নানা রকম মানুষ দেখি। কথা বলি। দার্জিলিং হোক বা মুসৌরি পাহাড়ের ভোর আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবেই। তারপর গাছে ঢাকা রাস্তা দিয়ে হেঁটে এসে দেখব অদূরে হিমালয়।দিনেরবেলা এই হিমালয় ঢেকে যাবেন ধোঁয়াশায়, একমাত্র ভোরেই তাঁর সাথে দেখা হবে।

অনেক কথা বলব পাহাড়ের সাথে তারপর। সারাদিনের কোলাহলে, ট্যুরিস্টদের ভিড়ে, যে কথাগুলো যে রং আর গন্ধগুলো হারিয়ে যাবে। পাহাড়ে এলে তাই, একা আসুন। পাহাড় স্তব্ধতার সংলাপের জায়গা, নিজের সাথে। ভোরবেলার এইসব কবিতা, সকালবেলার এইসব আলো শুধুমাত্র, নিজের সাথেই।
৫/
ঘোরার দিন যত ফুরিয়ে আসে তত কান্না পায়। সেই তো একঘেয়ে আবার শহুরে জীবনে ফিরতে হবে! প্যাঁচপ্যাঁচে কালো ছোট খুপরিতে ফিরতে হবে ভেবে কান্না পায়… যখন আকাশ, পাহাড় আর গাছপালার সাথে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে অজান্তেই।

আবার ফিরে আসবই পাহাড়ে। আবার দেখা হবেই হারিয়ে ফেলা জীবনের সব সুন্দরের সাথে। আবার গান চলবে সমস্ত পাহাড়ি পথজুড়ে। পাহাড়ি শিশুরা হাত নাড়বে আবারও ছোট্ট মোমোর দোকান থেকে। আবারও কাছের মানুষদের কথা মনে পড়বে, নতুন করে পড়তে পারব সম্পর্কগুলো পাহাড়ে এসে, তাই এই ফিরে যাওয়া ক্ষণিকের, আগামীতে আসার প্রস্তুতি…
মনে পড়ছে, অলোকরঞ্জনের সেই কথাটা আবার, পাহাড়ে ঘুরতে এসেছি শুনে ফোনে বলেছিলেন, ‘দেবর্ষি, একটা জরুরি জিনিস জানার, পাহাড়ে ঘুরতে গেছো বুঝলাম, সে পাহাড়ে কি রোদ উঠেছে…’
অলোকবাবু নেই। আজ বুঝি, প্রত্যেকটা ঘুরতে আসা আসলে চেতনায় রোদ ওঠা।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Flickr
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।