চিঠিটা বাবার হাতে পৌঁছেছে তো? দু-দিন কেটে যাওয়ার পরেও বাবার কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে একটু ধন্দে পড়ে গেল কুর্চি। দু’দিন ধরে সে বারবার ভেবেছে, বাবা ফোন করবে। প্রচণ্ড হম্বিতম্বি করবে ওই মিথ্যুক পাহারাদারটাকে ফিরিয়ে দেওয়া নিয়ে। কোনও কিছু পছন্দসই না হলে বাবা সবার ওপরেই যেটা করে থাকে। কিন্তু বাবা যে এরকম চুপ করে যাবে, সেটা কুর্চি ভাবতেই পারেনি। বাবা কি তাহলে দুঃখ পেল? অভিমান করল? ভাবতে ভাবতে ইউনিভার্সিটি থেকে খুব মনখারাপ নিয়ে ফিরল কুর্চি। কয়েকটা ফোন আর কিছু রুটিন কাজকর্ম সেরে পড়তে বসল। কিন্তু বারবার যে খেই হারিয়ে যাচ্ছে তার। টিভি চালাল খবর দেখবে বলে। কিন্তু গোটা একটা মিনিট পার হওয়ার আগেই টিভির খবর অসহ্য হয়ে উঠল তার কাছে। বাবাকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে খুব, কিন্তু বাবার তো এই সময় হয় সার্জারি নয় কনসাল্টেন্সিতে ব্যস্ত থাকার কথা। শেষ পর্যন্ত ফোনটা করল রাত সাড়ে নটা নাগাদ।
-বাবা, তুমি কি রাগ করেছ? দু-একটা কথার পরেই নরম গলায় জিজ্ঞেস করল কুর্চি।
সুজাত গুপ্তর উত্তরটা কিন্তু তত নরম গলায় এলো না। গলা উঁচুতে উঠল না, তবে বিদ্রুপের সুরটা বেশ যত্ন করেই স্পষ্ট করলেন তিনি। বললেন, “না, রাগ করব কেন? আমি তোমার ভালোর কথা ভেবে একটা ব্যবস্থা করেছিলাম। তুমি জানিয়ে দিয়েছ, সেটা তোমার পছন্দ নয়। আমি একটা লোক পাঠিয়েছিলাম, যে একই সঙ্গে ড্রাইভার আর গার্ডের কাজ করত। তুমি তাকে তাড়িয়ে দিয়েছ। তুমি অতি বুদ্ধিমতী, অতি শিক্ষিত মেয়ে। বড় হয়েছ, একা থাকো, নিজের ভালো নিজেই বোঝো। আমাকে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছ। এতে রাগ করার কী আছে?”
প্রথমে আমল দিতে না চাইলেও বিদ্রূপটা ক্রমশ গভীরে বিদ্ধ করল কুর্চিকে। থেমে থেমে কোনোমতে বলতে পারল, “এগুলো তো রাগেরই কথা, বাবা। কিন্তু এই বাড়িতে একটা লোক রাখার আগে তুমি আমার পছন্দ-অপছন্দ, সুবিধে-অসুবিধের কথা জানতে চাইবে, এরকম আশা করা কি খুব অন্যায়?”
এটুকু বলতে বলতেই গলা ধরে গেল তার। তবু জোর করেই চেষ্টা করল তার কথা শেষ করতে। বলল, “আগের দিন রাতে, আমরা যখন খেতে বসেছিলাম, তখনই তো এই কথাটা বলতে পারতে তুমি। তাহলে এই সমস্যাটাই তৈরি হত না।”
ফোনের অন্য প্রান্তে সুজাত গুপ্ত চুপ করে গেলেন। কুর্চির ভারি নিঃশ্বাস আর গলার ভাঙা আওয়াজে তিনি বুঝেছেন, কুর্চি কাঁদছে। তাকে ধাতস্থ হতে একটু সময় দিয়ে বললেন, “কুর্চি শোন। সারা দিনে এমন অনেক সিদ্ধান্ত আমাকে একা নিতে হয়, যার ওপর মানুষের বাঁচা-মরা নির্ভর করে। দিনের পর দিন এরকম করতে করতে এই বদভ্যেসটা একদম আমার রক্তের মধ্যে ঢুকে গেছে। আই অ্যাম সরি, আই অ্যাম রিয়েলি ভেরি সরি। আমার নিশ্চয়ই উচিত ছিল আগে তোর সঙ্গে কথা বলে নেওয়া।”
খানিকটা সময় পেয়ে কুর্চিও প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে নিয়েছে। গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক করে বলল, “ঠিক আছে বাবা, এবার একটু সময় করে এখানে এসে দুটো দিন কাটিয়ে যাও তো।”
– আমিও তাই ভাবছিলাম রে। ভাবছি শিগগিরই যাব, আর এবার দেবাশিসকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাব। আগে থেকে জানিয়ে রাখলাম। এবার আর তোর আপত্তি নেই তো?
বাবা ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে! নড়বে না কিছুতেই! বেশ বিরক্ত হয়েই সমস্যার বাস্তব চেহারাটা বাবাকে বোঝাতে চাইল কুর্চি। বলল, “কী মুশকিল, সে লোকটা থাকবে কোথায়? বসন্তদার পাশের যে ঘরটার কথা তুমি বলেছ, ওটা এখন কৃষ্ণাদির ছেলে আর মেয়ের পড়ার ঘর। স্কুল থেকে এসে ওরা সোজা ওখানে গিয়ে ঢোকে। সুরুল থেকে রুমা আসে ওখানে ওদের পড়াতে। রাত ন’টা বাজলে কৃষ্ণাদির বর ওর টোটো চালিয়ে এসে সবাইকে বাড়ি নিয়ে যায়।”
– ওঃ, এটা কোনো সমস্যাই না। আমি কাছাকাছি কোথাও ওদের পড়াশোনার জন্যে একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
বাবা সমস্যাটা বুঝতেই চাইছে না দেখে কুর্চি ক্রমশ পায়ের নিচে তর্ক করার জমি খুঁজে পাচ্ছে। ভুরু বাঁকিয়ে বলে উঠল, “আবার কিন্তু তুমি একতরফা সিদ্ধান্ত নিচ্ছ বাবা। ওরা আমার খুব প্রিয়, খুব আদরের দুটো বাচ্চা। প্রত্যেক দিন সারা বিকেল বাগান জুড়ে হুটোপুটি করে, আর আমার মনে হয় অনেক দিন পরে আমাদের বাড়িটা আবার হাসছে। ঠাম্মাও ওপর থেকে দেখছেন আর খুশি হচ্ছেন।”
– কুর্চি, আউটহাউসের ঘরটা ওদের ছেড়ে দেওয়াটা কিন্তু তোমার একতরফা সিদ্ধান্ত। আর একদম ইমোশনাল সিদ্ধান্ত।
কী আশ্চর্য! এত করে বোঝানোর পরে, এতবার আপত্তি করার পরেও বাবা এরকম চাপ দিয়ে যাচ্ছে? কুর্চি কঠিন গলায় উত্তর দিল, “হতে পারে ইমোশনাল, কিন্তু সিদ্ধান্তটা পাল্টাচ্ছে না বাবা। কোনো অচেনা বাইরের লোককে আমি চাই না এ বাড়িতে।”
– এবার কর্তৃত্ব কে ফলাচ্ছে?
বাবার ইচ্ছের শক্ত দেওয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে মরিয়া হয়ে কুর্চি বলল, “এটা আমার বাড়ি। আমি একা এখানে থাকি। এটুকু কর্তৃত্ব আমি ফলাতে পারি না?”
– তোমার বাড়ি কুর্চি! তোমার বাড়ি!! তুমি ওনারশিপের কথা বলছ। আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছ, ওই বাড়িটা তোমার ঠাম্মা আমাকে নয়, তোমাকে দিয়ে গেছেন। কিন্তু ওখানকার সমস্ত খরচ কি আমি দিই না? শুধু খরচ কেন, ঠাম্মা মারা যাওয়ার পর থেকে তোমাকে সাপোর্ট করার ব্যাপারে কোন দায়িত্বটা আমি পালন করিনি? বলতে চাও, তার পরেও তোমার ভালোমন্দ নিয়ে আমার কিছু বলারই কোনো অধিকার নেই? রিডিকিলাস। বুঝতে পারছি না, কে তোমার মাথায় এসব ঢোকাল!
সুজাত গুপ্তর গলা থেকে এতক্ষণের সমস্ত স্নেহ, সব মমত্ব উধাও। বেরিয়ে এল একটা রুক্ষ ঝাঁঝালো স্বর। কুর্চির মনে হল, তার বাবা নয়, ভয়ঙ্কর একটা রাক্ষসের মুখ থেকে আগুনের একটা হল্কা আর অনেক ধোঁয়ার সঙ্গে এই কথাগুলো বেরিয়ে এল।
“আমার আর কিছু বলার নেই। রাখছি।” বলে ফোন কেটে দিয়ে আআআ– বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠল কুর্চি। কিন্তু পাঁচ সেকেন্ড হয়েছে কি হয়নি, আবার বেজে উঠল তার ফোন। স্ক্রিনে বাবা লেখা দেখে ফোনটা ধরবে কি ধরবে না দু-বার ভাবল কুর্চি। তারপর গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ধরল ফোনটা। “শোনও, বুধবার তো তোমার ছুটি, সেদিন আমি যাচ্ছি তোমার কাছে। দেবাশিসকে নিয়েই যাচ্ছি। কোনও চিন্তা কোরো না, কৃষ্ণার ছেলেমেয়েদের পড়ার একটা জায়গাও আমি করে দিয়ে আসব। ঠিক আছে?” সুজাত গুপ্তর গলা আবার যথাসম্ভব নরম।
কিন্তু কুর্চি উত্তর দিল রীতিমত তেতো গলায়। বলল, “একদম ঠিক আছে। তোমার সাপোর্টেই যখন আছি আমি, তখন নিশ্চয়ই ঠিক আছে। তবে কৃষ্ণাদির ছেলেমেয়েকে সরিয়ে এ বাড়িতে কোনও বাইরের লোকের থাকার ব্যবস্থা হলে আমি কিন্তু সেই মুহূর্তেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। তখন বোলো না, আগে বলোনি কেন। আর, আমার ছুটির কথা ভেবে তোমাকে বুধবারেই আসতে হবে না। কারণ আমাকে কলকাতা যেতে হবে এই বুধবার। অন্য যেদিন তোমার সুবিধে, সেদিনই এসো। এক-আধদিন ছুটি নিতে আমার কোনও অসুবিধে নেই।”
কান্নার দলাটা আবার উঠে আসতে চাইছে কুর্চির গলায়। আর একটা কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না তার। বাবা উত্তর দেওয়ার আগেই তাড়াহুড়ো করে কেটে দিল ফোনটা। তারপর অনেকক্ষণ ধরে গুম হয়ে ভাবতে লাগল, তার জীবনের ছন্দটা যে তছনছ হয়ে যাচ্ছে, সেটা বাবা বুঝতে পারছে না কেন? মা-ও কি এইজন্যেই কি বাবাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল?
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।