ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে অরিত্র অভ্যেসমতো বারান্দায় এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে সুমিত্রা তার মাথায় পুজোর ফুল ঠেকিয়ে বললেন, “রক্ষা করো, করুণা করো, মার্জনা করো।” অভ্যেস মতোই বসলেন ছেলের পাশের চেয়ারে।
ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম হলেও সুমিত্রার বিয়ে হয়েছে হিন্দু বাড়িতে। তবু তাঁর পুজো আর প্রার্থনা এখনও একটু অন্যরকম। তাঁর ঠাকুরঘরে কোনও ঠাকুরের মূর্তি বা ছবি থাকে না, থাকে পেতলের একটা পাত্রে কয়েকটা ফুল। প্রতিদিন সামনে সেই ফুল রেখে চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে কিছুক্ষণ কী যেন ভাবেন সুমিত্রা! এটাই তাঁর পুজো, আর সে পুজোর ব্যাপারে তাঁর যথেষ্টই নিষ্ঠা।
মাথায় পুজোর ফুল ঠেকিয়ে মায়ের এই আশীর্বাণী অনেক দিন ধরে, প্রায় ছোটবেলা থেকে শুনে আসছে অরিত্র। আজই তার জানতে ইচ্ছে হল, “আচ্ছা মা, রক্ষা করো, করুণা করো তো বুঝলাম, কিন্তু মার্জনা করো কেন? কী অন্যায় করেছি আমি, যার জন্যে মাফ চাইতে হবে?”
সুমিত্রা হেসে উঠলেন। “মার্জনার ওই একটা মানেই জানিস তুই, না? মার্জনার আর একটা মানে হল ঘষে মেজে ঝকঝকে করা, জানতিস না?”
– ওঃ মা, জানতাম। ঠিক সময়ে রিলেট করতে পারিনি। কিন্তু আমার কোন জিনিসটা আরও ঝকঝকে দেখতে চাও তুমি? চেহারা, না ইনকাম?
– উফ, তোর মাথাটা বিলকুল গেছে! ব্যাঙ্কে চাকরি করিস, ইনকাম তো বাড়বেই। আর যখন আমার মতো বয়সে পৌঁছবি, তখন চেহারাও খারাপ হবে। ও নিয়ে ভেবে কী হবে? একসময় চাইতাম তোর মাথাটা ঝকঝকে হোক, পড়াশোনায়…
কথা শেষ করতে দিল না অরিত্র, মার মুখে পড়শোনা শব্দটা শুনেই চেঁচিয়ে উঠল, “দাদার সঙ্গে আমার কম্প্য্যারিজন কিন্তু একদম আনফেয়ার, মা। দাদা কি আমার মতো ফুটবল খেলতে পারে?”
– চুপ কর। আমার মাথা খারাপ হয়নি যে, তোর আর বেণুর মধ্যে তুলনা করতে যাব। ও হ্যাঁ, বেণু কাল ফোন করেছিল, তুই শুয়ে পড়ার পর। তোকে আজকের খেলার জন্যে বেস্ট উইশেজ জানিয়েছে।
– দাদার কি কোনও কাজ নেই? অ্যালবার্টাতে বসে খবর রাখছে, কবে আমার খেলা? কী করে যে পারে, কে জানে!
– না পারার কী আছে। আমি তো বেণুকে বলেছি কাগজে আজকাল তোর খেলার প্রশংসা বেরোচ্ছে! যেদিন তোর খেলা থাকে, তার পরের দিনের সব বাংলা কাগজ যেন নেট থেকে পড়ে নেয়। আর, কোথাও তোর নাম বেরোলে যেন আমায় জানায় কী লিখেছে।
– মা! তুমিও কাগজে আমার নাম খোঁজো?
– তুমিও মানে! আর কে খোঁজে?
বলটা আর একটু হলেই সোয়ার্ভ করে গোলে ঢুকে যাচ্ছিল, কোনোমতে ফিস্ট করে বাইরে পাঠাল অরিত্র। বলল, “অ্যাদ্দিন ধরে কলকাতার মাঠে খেলছি, এক-আধটা ফ্যান তৈরি হবে না?” বলেই তার মনে পড়ল, তার একমাত্র মহিলা ফ্যানকে মেসেজ করে আজ মাঠে নামার কথা জানিয়ে রেখেছে। এবার তার ফোন আসতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। মাকে বলল, “আজ আমিই চা-টা বানাই মা?”
সুমিত্রা বললেন, “বোস এখানে, চা দিচ্ছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করলি, তোর কোন জিনিসটা ঝকঝকে দেখতে চাই, তার উত্তরটা শুনবি না?”
– ও হ্যাঁ, ভুলেই গিয়েছিলাম। বলো, বলো।
– তোর খেলা। মনে প্রাণে চাই, আরও ভালো খেল তুই। আরও নামডাক হোক।
– আমার আবার নামডাক কী? আমাকে কেউ চেনেটেনে না। খেলতে ভালো লাগে, তাই খেলি। যতদিন সুযোগ পাচ্ছি, খেলব। এর বেশি কিছু আশা কোরও না, মা।
– কী যে বলিস। মোহনবাগানের সঙ্গে খেলার দিন টিভিতে তোর কত প্রশংসা করছিল। কান জুড়িয়ে যাচ্ছিল আমার, চোখে জল এসে গিয়েছিল। ভাবছিলাম, তোর বাবা থাকলে কী খুশিই না হত এসব শুনে! টিভি, খবরের কাগজ তো এমনি এমনি কারুর প্রশংসা করে না।
মুখটা ইচ্ছে করে অনেকখানি হাঁ করে অরিত্র তাকিয়ে রইল মার দিকে। আর মনে মনে ভাবছিল, ওরে বাবা, ইনিই আদি মহিলা ফ্যান, অন্যজন তো দ্বিতীয়! অরিত্রর ভ্যাবাচ্যাকা ভঙ্গি করা দেখে মুচকি হেসে উঠে পড়লেন সুমিত্রা।
টিম বাসে দক্ষিণ কলকাতা থেকে ইস্টবেঙ্গল মাঠে পৌছনোর পথে কোচ সোমু ঘোষ সবাইকে পাখি পড়া করিয়ে দিলেন তাঁর পরিকল্পনা। অরিত্র আর জিয়ারুলকে মনে করিয়ে দিলেন ওদের বিশেষ দায়িত্বের কথা। একটা আবছা অস্বস্তির কাঁটা তবু বিঁধেই রইল অরিত্রর মনে। দেবদীপ কিছুতেই অরিত্রর চোখে চোখ রাখছে না কেন?
চোখাচোখিটা হল ফার্স্ট হাফ শেষ হওয়ার পর। খেলা তখনও গোললেস। জিয়ারুল দারুন শ্যাডো মার্কিং করে চলেছে গ্রাহামের তারকা স্ট্রাইকার মিলিন্দকে। তার মধ্যেই মিলিন্দের একটা হেড সেকেন্ড পোস্টে ডাইভ দিয়ে কোনোমতে কর্নার করে বাঁচিয়েছে অরিত্র। আর একটা হেড পোস্ট ছুঁয়ে বাইরে গেছে। সোমুদা নিচু গলায় বোঝাচ্ছেন, গ্রাহাম ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠছে। ডিফেন্ডার আনোজি এমনভাবে অ্যাটাকে উঠছে যে বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে ওদের ডিপ ডিফেন্সে। দেখাচ্ছিলেন, কী ভাবে সেই সুযোগটা নিতে হবে। সোমুদার কথা শুনতে শুনতে কাউকে বুঝতে না দিয়ে অরিত্র গ্যালারি মাপছিল। চেষ্টা করছিল খেলা দেখতে আসা হাজার দুয়েক লোকের মধ্যে কুর্চিকে খোঁজার। সামনে এসে দাঁড়াল দেবুদা। চোখে সেই অজানা মজা পাওয়ার ঝিলিক, সামান্য ছড়ানো দুটো ঠোঁটে একটা হাসি চাপার আভাস। হয়ত কিছু বলতও অরিত্রকে, কিন্তু ঠিক তখনই কে যেন ডাকল। তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেবদীপ এগিয়ে গেল সাইডলাইনের দিকে। অরিত্র আবার গ্যালারি মাপতে শুরু করল। প্রায় দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে মাথায় টুপি পরে বসা একটা আকাশ-নীল শার্ট আর জিন্স দেখতে পেয়ে ভাবল, ওটাই কি কুর্চি? মেম্বার্স গ্যালারিতে! ঠিক তখনই মাঠে ফিরতে শুরু করল টিম। অরিত্র এবার দাঁড়াবে মাঠের উত্তর প্রান্তের গোলপোস্টে।
সেকেন্ড হাফের শুরু থেকেই আনোজি ওভারল্যাপে আসা শুরু করে দিল। রাইট উইং দিয়ে পাঁইপাঁই করে দৌড়চ্ছে, মিলিন্দের সঙ্গে ওয়াল খেলে চলে আসছে বক্সের মাথায়। বল ছাড়াই চকিতে ঢুকে পড়ছে দক্ষিণীর ডিফেন্স ভেদ করে। অফসাইড। প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে দু’দু’বার। জিয়ারুল চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল অরিত্রর দিকে। একটা গোলকিকে বল বসাতে গিয়ে অরিত্র জিয়ারুলকে বলে এল, “তুই মিলিন্দের পেছনেই লেগে থাক। আনোজিকে আমি দেখছি।”
সোমুদার পরিকল্পনা কাজ দিল। সত্তর মিনিটের মাথায় কাউন্টার অ্যাটাকে গ্রাহাম ডিফেন্সের বিশাল ফাঁক গলে চকিতে গোল করে এল দক্ষিণীর ছটফটে তরুণ স্ট্রাইকার পাগত সিং, কলকাতার দর্শক ভালোবেসে যার নাম দিয়েছে পাগলু সিং।
গোল খেয়ে খেপে উঠল গ্রাহাম। গোটা টিম উঠে গেল মাঝমাঠ পেরিয়ে। নিজেদের পেনাল্টি বক্সের বাইরে দাঁড়িয়ে ছটফট করছে গ্রাহামের গোলকিপার। জিয়ারুলের তৎপরতায় একটা ডিফেন্স-চেরা থ্রুতে পা ঠেকালেও বলে গতি আনতে পারল না মিলিন্দ। বলটা বাউন্স করে এগিয়ে আসছে অরিত্রর দিকে, চোখের কোণে অরিত্র দেখতে পেল আনোজি তীব্র গতিতে ছুটে আসছে বলটা লক্ষ্য করে। ডাইভ দিয়ে বলটা ধরে অরিত্র দেখল গতি এতটুকু কমায়নি আনোজি। বলটা পেটে চেপে ধরে শরীরটাকে ঘুরিয়ে নেওয়ার একটা মরিয়া চেষ্টা করল অরিত্র। ততক্ষণে আনোজির বুটের ডগা সজোরে আঘাত করেছে অরিত্রর কানের পাশে।
রেফারি সঙ্কেত দিয়েছে কি দেয়নি না দেখেই স্ট্রেচার আর মেডিকাল টিম নিয়ে মাঠে ছুটল দেবদীপ। অচেতন অরিত্রকে দেখে পরীক্ষা করার আগেই তাকে মাঠের বাইরে আনার ব্যবস্থা করলেন দায়িত্বে থাকা ডাক্তার। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অরিত্রকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটল অ্যাম্বুলেন্স। তখনও সে অজ্ঞান হয়ে আছে।
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
One Response
অসাধারণ! আমিও একসময় গোলকিপার ছিলাম তো, তাই এই সিরিজের গল্পগুলো কেন যেন আমার নিজের গল্প হয়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকে!