Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গোলকিপার (পর্ব ১৫)

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

মার্চ ৫, ২০২০

Episodic Novel Illustration ধারাবাহিক উপন্যাস
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

সুমিত্রার কাছে দেবদীপের ফোন এলো সকাল এগারোটা নাগাদ। “বলেছিলাম, যেদিন ভিজিটর অ্যালাও করবে, সেদিনই আপনাকে নিয়ে আসব। আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি ঠিক চারটের সময়। আপনি আর আমি আজ একসঙ্গে অরিত্রকে দেখতে যাব।” 

মাঝের তিনটে দিন সুমিত্রাকে সত্যিই নিয়ম করে অরিত্রর খবর দিয়ে গেছে দেবদীপ। সুমিত্রা জানেন অরিত্রর অবস্থা স্থিতিশীল, চিকিৎসায় ভালোই সাড়া দিচ্ছে সে। তবু সারাটা রাস্তা এলেন দুরুদুরু বুকে। নার্সিং হোমে পৌছে লবির সামনে দেবদীপ অপেক্ষা করছে দেখে আরও যেন  বেড়ে গেল তাঁর বুকের কাঁপুনি। লিফট থেকে নেমে আইসিইউ-এর দিকে যেতে যেতে বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বছর চারেক আগে হাসপাতালে তাঁর স্বামীর শেষ কয়েকটা দিনের দৃশ্য। ভয় হচ্ছিল, চনমনে ছেলেটা যন্ত্রের ঘেরাটোপে কী জানি কী কষ্টের মধ্যেই না আছে! যত এসব কথা ভাবছেন, ততই যেন পা অসাড় হয়ে আসছিল তাঁর। টকটকে লাল হয়ে উঠেছে তাঁর মুখ। দেবদীপকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করছিল, “আপনি গিয়ে দেখে এসে আমাকে বলুন। আমি আর পারছি না, এখানেই বসছি।”

দেবদীপ কি তাঁর মনের কথা শুনতে পেল? আঙুলের ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে শক্ত করে ধরল তাঁর বাঁ হাত। অনেকটা ভরসা পেলেন সুমিত্রা। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইন্টেনসিভ কেয়ারের দরজা পেরোলেন। সারি সারি বেডের মধ্যে শুয়ে থাকা রোগীদের মধ্যে অরিত্র, তাঁর ছোটুকে, কোথাও দেখতেই পেলেন না যতক্ষণ না দেবদীপ তাঁকে দাঁড় করাল একটা বেডের পাশে।

চোখ বুজে শুয়ে আছে ছেলেটা, শরীরে কত যে নল ঢোকানো তার! বোঝারও শক্তি নেই তিন দিন অধীর অপেক্ষার পর তার উদ্বিগ্ন মা এসে দাঁড়িয়েছে তার পাশে। চোখ উপচে জল আসছে সুমিত্রার, নিজেকে যথাসম্ভব সামলে তিনি হাত রাখলেন অরিত্রর বাহুতে। দেবদীপ ততক্ষণে একটা টুল এগিয়ে দিয়েছে তাঁর দিকে। অরিত্রর হাতে হাত বুলোতে বুলোতেই সুমিত্রা বসলেন। আর, ঠিক তখনই চোখ খুলল অরিত্র। কিছুক্ষণ পরে মাথাটা নাড়াল একটুখানি, চোখে কি একটা হাসির আভাস? সুমিত্রা দেখলেন ঠোঁট নড়তে শুরু করেছে অরিত্রর। কোনো শব্দ নেই, শুধু ঠোঁট নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে একজন নার্স পৌঁছে গেলেন অরিত্রর কাছে। মুখ খুলিয়ে খানিকটা জল ঢাললেন অরিত্রর গলায়। গলা ভেজানোর পর  থেমে থেমে ক্ষীণস্বরে অরিত্র বলল, “ভালো আছি … আমি ভালো আছি।” সুমিত্রা হাত বাড়িয়ে তার মাথায় হাত রাখলেন। দেখতে পেলেন না, ওইটুকুতেই হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দেবদীপের মুখ। নার্স বললেন, আজ সকাল থেকে দু-বার ‘মা মা’ বলে ডেকেছে।

নার্স যখন এসব বলছেন, ততক্ষণে আবার বন্ধ হয়ে গেছে অরিত্রর চোখ। দেবদীপ কয়েকবার ডাকাডাকি করল। একবার চোখ তুলে তাকানো ছাড়া আর কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না অরিত্রর কাছ থেকে। সুমিত্রা জানতে চাইলেন, “কষ্ট হচ্ছে তোর?” তারও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। চোখ বেশির ভাগ সময়েই বন্ধ, খুলছে অনেকক্ষণ পরপর। মার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে অরিত্রর। যদি তাঁরা থাকতে থাকতেই আবার কিছু বলে অরিত্র, অপেক্ষা করতে করতে সুমিত্রা হঠাৎ দেবদীপকে জিজ্ঞেস করলেন, “সেদিন যে মেয়েটাকে দেখেছিলাম…”

দেবদীপ বলল, “কুর্চি?”

সুমিত্রা বললেন, “নাম কি বলেছিল সেদিন? মনে পড়ছে না তো…”

দেবদীপ বলল, “সেদিন অরিত্রর যে বন্ধুকে দেখেছেন তো? তারই নাম কুর্চি।”

সুমিত্রা জানতে চাইলেন, “সে আজ আসবে না?”

দেবদীপ হতাশ গলায় বলল, “আমি একদম বলতে পারব না। কদিন ধরে আমার সঙ্গে একদম যোগাযোগ নেই। আমিও অবশ্য একদিকে মাঠ আর অন্যদিকে অরির চিকিৎসা নিয়ে এমন ব্যস্ত আছি যে কুর্চির খবরাখবর ঠিক নিতে পারিনি।”

অরিত্রর ঠোঁট হঠাৎ আবার নড়ে উঠল। চোখ বন্ধ করেই কিছু একটা বলল, ঠিক বোঝা গেল না। দেবদীপ তাড়াতাড়ি জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলছিস?”

চোখ খুলল অরিত্র, আগের মতোই ক্ষীণস্বরে বলল, “ফোন করেছিল।” তারপর চোখ বন্ধ হয়ে গেল আবার।

“কে? কুর্চি?” উদ্গ্রীব হয়ে জানতে চাইল দেবদীপ। কিন্তু কোনও সাড়াই পাওয়া গেল না অরিত্রর কাছ থেকে।

বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল দেবদীপ। তারপর সুমিত্রাকে বলল, “আপনি একটু বসুন ওর কাছে, আমি এখুনি আসছি।”

বসে রইলেন সুমিত্রা। হাত বুলিয়ে দিতেই থাকলেন অরিত্রর হাতে। অরিত্র এক সময় আবার কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু জড়ানো কথা ঠিক বুঝতে পারলেন না সুমিত্রা। একবার মনে হল, দাদা শব্দটা শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, “বেণু আসতে চাইছিল, আমি বারণ করেছি। বলেছি, বাচ্চা হওয়ার ঠিক আগে টেসাকে একা ছেড়ে দেশে আসতে হবে না।” কিন্তু অরিত্র কোনও সাড়া না দিয়ে আবার চুপ করে গেছে দেখে কথা না বাড়িয়ে ছেলের মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলেন সুমিত্রা।     

কিছুক্ষণ পরে দেবদীপ ফিরে এসে জানাল, “ভিজিটিং আওয়ার শেষ। এবার যেতে হবে।”

সুমিত্রা জানতে চাইলেন, “কবে এখান থেকে বার করবে বলছে?”

দেবদীপ বলল, “সব কিছু ঠিকঠাক চললে সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে ক্যাবিনে নিয়ে যাওয়া যাবে বলে আশা করছেন ডাক্তার কর।” শুনে কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে মাথা নাড়লেন সুমিত্রা। দেবদীপ ততক্ষণে অরিত্র্রর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলছে, “কাল আবার আসব রে অরি। তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ, অনেক কাজ বাকি আমাদের।” বলে, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক সেকেন্ড কী যেন ভাবল। তারপর ধীরেসুস্থে সুমিত্রাকে নিয়ে বেরিয়ে এল নার্সিং হোম থেকে।

এর মধ্যে দেবদীপ অবশ্য মেট্রনস অফিস থেকে জেনে এসেছে, আজ সকালেই অরিত্রর খবর নেওয়ার জন্যে ফোন এসেছিল এক মহিলার। রিসেপশন থেকে ট্রান্সফার করা ফোন যে নার্স ধরেছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল পেশেন্টের কোনও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ফোন করছেন। অরিত্রর খবর নেওয়ার পর সেই মহিলা অনুরোধ করেছিলেন, সম্ভব হলে অরিত্র মিত্রকে তাঁর নাম করে জানাতে যে তিনি ফোন করেছিলেন। সেটা পেশেন্টকে জানানোও হয়েছিল, তবে কোনও রেসপন্স পাওয়া যায়নি। যে নামটা বলেছিলেন ওই মহিলা, সেটা একটা কাগজে লিখে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সে কাগজটা তো রেখে দেওয়া হয়নি। আবার সেই নামটা যে কী, তাও কিছুতেই মনে করতে পারলেন না কেরলের সেই তরুণী সেবিকা।

সুমিত্রাকে নিজের গাড়িতে তুলে দিয়ে অ্যাপ ক্যাবের জন্যে অপেক্ষা করতে করতে দেবদীপ ভাবছিল, কুর্চির হলটা কী? অরিত্রর মাকে বলে দিল বটে ব্যস্ততার জন্যে খোঁজখবর নিতে পারিনি, কিন্তু সেটা তো পুরোপুরি সত্যি নয়। সেদিন রোইং ক্লাবে কথা হওয়ার পর থেকে কুর্চিকে অন্তত চার বার ফোন করেছে দেবদীপ। কিন্তু কুর্চি দেবদীপের ফোন ধরছে না, আবার নিজেও ফোন করছে না।

তবে এটাও ঠিক যে গত তিন দিন সাংঘাতিক ব্যস্ত কেটেছে দেবদীপের। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্লাবে গিয়েছে সাত সকালে, সেখান থেকে নার্সিংহোম, মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্যে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের অফিস, আবার নার্সিং হোম, সেখান থেকে আবার ক্লাব – এই সব করে বাড়ি ফিরতে রোজই বেশ দেরি। বাড়িতে কারও সঙ্গে কথা বলার মতো ফুরসতই হয়নি গত কদিন। আজও কি হবে? সম্ভাবনা কম। আনোজি-অরিত্রর সংঘর্ষ নিয়ে আজ অ্যাসোসিয়েশনের কাছে রেফারির রিপোর্ট জমা পড়ার কথা। কাল এনকোয়ারি কমিটির মিটিং ডাকা হয়েছে। এদিকে পরের খেলা পরশু, সেদিন মাঠে যেতে হবে। এখন রোজই এরকম ব্যস্ততা। ভাবতে ভাবতে দেবদীপ ঠিক করল, আজই তাহলে ক্লাবে যাওয়ার আগে একবার ইনসাইট ডিটেকটিভ এজেন্সি ঘুরে আসা যাক। দেখা যাক, সেখানে কুর্চির কোনও খবর কেউ জানে কিনা।

বেলভেডিয়ার নার্সিং হোমের গেটে দাঁড়ানো অ্যাপ-ক্যাব ড্রাইভার তখন দেবদীপকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, “কোথায় আছেন?”

Author Dhurbajyoti Nandi

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস