Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গোলকিপার (পর্ব ১৬)

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

মার্চ ১০, ২০২০

Episodic Novel Illustration ধারাবাহিক উপন্যাস
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

গেটের একপাশে নিম আর অন্যপাশে কাঞ্চন। গেট থেকে বাড়ি পর্যন্ত খালি জায়গাটা এখন এই ফাল্গুনের মাঝামাঝি খয়েরি রঙের খসা নিমপাতা আর স্কারলেট রঙের ঝরা কাঞ্চন ফুলে মিলেমিশে লাবণ্যময়ী প্রাচীনার মতো মায়াময়। গেটের দুই পাল্লা জুড়ে একটা তালাসুদ্ধু শিকল এমনভাবে জড়ানো যে মনে হতে পারে গেটে তালা ঝুলছে। কিন্তু অভিজ্ঞ চোখ সহজেই বুঝে নেয়, শিকল নামালেই গেট খুলে যাবে। ভেতরে ঢুকে কুর্চি দেখল, সদর দরজা বাইরে থেকে হুড়কো টেনে বন্ধ। অথচ তাতে তালা লাগানো নেই! এভাবে কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় নাকি? অবাক কুর্চি ভেতরে না-ঢুকে সেখানে দাঁড়িয়েই “দাদু-উউ, দিম্মা-আআআ” বলে ডাকাডাকি করল বার দু’য়েক। কোনও সাড়া না-পেয়ে ফিরে যাবে কিনা ভাবছে, এমন সময় দোতলা থেকে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “কে? নিচে কেউ এসেছে নাকি?”

দু’পা পিছিয়ে কুর্চি এমন জায়গায় দাঁড়াল, যাতে দোতলার গ্রিল-ঘেরা বারান্দা থেকে তাকে সহজেই দেখা যায়। তা সত্ত্বেও প্রজ্ঞান-দাদুর তাকে চিনতে অসুবিধে হচ্ছে দেখে নিজেই বলল, “দাদু, আমি কুর্চি।”

– দরজায় তালা দেওয়া নাকি? জিজ্ঞেস করলেন প্রজ্ঞান।

না, তবে হুড়কো টানা।

খুলে ওপরে চলে আয়।

দোতলায় উঠেই বসার ঘর। কুর্চি সেখানে পৌঁছনোর আগেই প্রজ্ঞান-দাদু সেখানে বসে পড়েছেন তাঁর আরাম কেদারায়। হাতলের ওপর বই, খবরের কাগজ। কুর্চি উঠে আসতেই অনুযোগের সুরে তিনি বললেন, “খুব ডানা গজিয়েছে তোর। বুড়োবুড়িকে মুখ দেখাতে আর ইচ্ছে করে না।”

কুর্চি প্রণাম করে উত্তর দিল, “ওমা! এই তো ক’দিন আগেই এসেছিলাম।”

– ওই উত্তরায়ণে পম-তোতার গানের পরে তো? ওটাকে আবার আসা বলে নাকি? গাড়ি করে আমাদের নামিয়ে দিতে এলি, এসে দশ মিনিটও বসলি না। সেও দু’তিন সপ্তাহ আগে।

কুর্চি হাসতে হাসতে বলল, “দু’তিন সপ্তাহ না, মাত্র দিন দশেক আগে। কিন্তু বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে রাখলে কেউ আসবে কী করে তোমাদের কাছে?”

ওঃ, ওটা মেনকার কাজ। বাজার-টাজার যেতে আর ইচ্ছে করে না। ও-ই ওসব করে। প্রত্যেক দিনই ওর এটা ফুরোচ্ছে, সেটা ফুরোচ্ছে, আর দোকানে ছুটছে। দোকান-বাজারে এতবার দৌড়লে দরজা খোলা-বন্ধ করবে কে? কে দোতলা থেকে অতবার সিঁড়ি ভেঙে উঠবে নামবে? তুই তো সকালের দিকে আসিস না আজকাল, তাই দেখিসনি। সকালের দিকটা এই ব্যবস্থাই চলে। দূরে কোথাও গেলে চাবি দিয়ে যাও, কাছেপিঠে গেলে চাবি দেওয়ারও দরকার নেই। আর, সারাক্ষণ ফোনে বকবক। আমি বলে দিয়েছি, ফোন নিয়ে দোতলায় আসা চলবে না।

প্রজ্ঞান-দাদুর কথার মধ্যেই ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা মধুরা-দিম্মার গলা পেল কুর্চি। “কে এসেছে? কার সঙ্গে কথা বলছ?”

ওই। মহারানির প্রশ্নবাণ শুরু হল। কারুর সঙ্গে দুটো কথা বলার উপায় নেই!

– কুর্চি এসেছে, কুর্চি। বলেই আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে খবরের কাগজটা খুলে মুখ ঢাকলেন প্রজ্ঞান।

– বুঝেছি, বলল কুর্চি। তোমাদের ঝগড়া হয়েছে। সেইজন্যেই আজ তোমার মেজাজ বিগড়ে আছে। বলে, শোবার ঘরের দিকে এগোচ্ছিল। ততক্ষণে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন তার মধুরা-দিম্মা। তাঁকে প্রণাম করতেই কুর্চির থুতনিটা ধরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন মধুরা। তারপর কুর্চির একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে রে? আমার কুচো-সুন্দরীর মুখখানা আজ এমন শুকনো কেন?”

এই কটা শব্দে কী যে ঘটে গেল কুর্চির মনের মধ্যে! তার দিম্মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে শুরু করল থরথর করে। জলের বন্যা নামল দু’চোখ বেয়ে। মধুরা তাকে নিয়ে ধীর পায়ে ফিরে গেলেন শোবার ঘরে।

মধুরা এবং প্রজ্ঞান মিশ্র দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত আইএএস এবং একই ব্যাচের। মধুরার পিতৃকুল ছিলেন ভদ্রকবাসী। প্রজ্ঞানের পৈতৃক ভিটে কটকে। অবসর জীবনের ঠিকানা হিসেবে দেশের এত জায়গা থাকতে তাঁরা যে শান্তিনিকেতনকেই বেছে নিয়েছেন, তার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ যদি হয় প্রকৃতি-প্রেমী এই দু’টি মানুষের রবীন্দ্রনাথ, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, সঙ্গীতে আন্তরিক অনুরাগ, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই কুর্চির ঠাকুর্দা-ঠাম্মার সঙ্গে তাঁদের গভীর সখ্য। তৃতীয় কারণ, সেটাও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, আদতে ওড়িশার মানুষ হলেও, তাঁরা দুজনেই বাংলা সাহিত্যের আগ্রাসী পাঠক। একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে দুজনেই সুখশ্রাব্য বাংলায় কথা বলে যেতে পারেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। উচ্চশিক্ষিত দুই সন্তান তাঁদের। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। মেয়ে বড়, তার স্বামী মার্কিনি। ছেলের স্ত্রী কানাডিয়ান। সকলেই থাকে পশ্চিম গোলার্ধে এবং বহুদিন ধরেই সেখানকার নাগরিক। তিনটি নাতি-নাতনির কেউই কোনও ভারতীয় ভাষায় কথা বলতে পারে না। তবে মাঝেমধ্যেই তারা শান্তিনিকেতনে আসে।

অশীতিপর প্রজ্ঞানের অবশ্য এখন কুর্চির প্রয়াত ঠাকুর্দার ওপর খুব রাগ। প্রায়ই বলেন, তাঁর ওপরে যাওয়ার এত তাড়া আছে জানলে প্রজ্ঞান কিছুতেই শান্তিনিকেতনে বাড়ি করতেন না। মধুরার অবশ্য সেরকম কোনও ক্ষোভ নেই। কুর্চির ঠাম্মা মংলি তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন মধুয়ার প্রিয়তম বন্ধু।

এক ঘণ্টারও বেশি সময় পার করে মধুরা যখন কুর্চিকে নিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরোলেন, প্রজ্ঞান তখন তাঁর আরাম কেদারায় ঘুমিয়ে কাদা। মধুরা তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে বললেন, “উঠে এসে সোফায় বোসো। জরুরি কথা আছে।” একবার স্নানঘর থেকে দ্রুত ঘুরে এসে বাধ্য ছেলের মতো সোফায় এসে বসলেন প্রজ্ঞান। উল্টদিকের সোফাতে কুর্চিকে পাশে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মধুরা। প্রজ্ঞান এসে বসতেই ঘোষণা করলেন, “কুর্চি ওর সংসার নিয়ে আমাদের কাছে চলে আসছে।”

মধুরা প্রায়ই বলেন, প্রজ্ঞান ইদানিং কানে কম শুনছেন। কথাটাকে আদৌ কোনও গুরুত্বই দিতে চান না প্রজ্ঞান। কিন্তু আজ তাঁর নিজেরই সন্দেহ হল, ঠিক শুনলাম কি? অনিশ্চিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “সংসার নিয়ে… মানে?”

মানে কুর্চি এখন থেকে এ বাড়ির একতলায় থাকবে, যতদিন ওর ইচ্ছে। ওর কুকুরদের নিয়ে আসছে। তাছাড়া, কৃষ্ণা আসবে, সারাদিন থাকবে, যেমন থাকত এতদিন মংলির বাড়িতে। ওর ছেলেমেয়েরা বিকেলে এখানে পড়াশোনা করে রাতে মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফিরে যাবে। বসন্ত আসতে চাইলে সেও আসবে। কিন্তু সে এলে পার্থদের বাড়ির আউটহাউসটা ভাড়া পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। আমার মনে হয়েছে, কুর্চি যতদিন থাকে ততদিন তো আমাদের নিজের বাড়িতে তালাবন্দী হয়ে থাকতে হবে না! এবার বলো, তোমার কী বলার আছে, শুনি।

প্রজ্ঞান এখনও ঠিক গোটা ব্যাপারটার খেই ধরতে পারছেন না। বিস্মিত স্বরে বললেন, “কিন্তু কুর্চি নিজের বাড়ি ছেড়ে আমাদের কাছে আসছে কেন? সুজাত কি ওর বাপের তৈরি বাড়ি বিক্রি করতে চায়?” কুর্চি মুখ খুলল এতক্ষণে। বলল, “না। বাবাকে না-জানিয়েই আমি বাড়ি ছাড়তে চাইছি। কেন, সেটা দিম্মাকে বলেছি। তোমাকে না হয় আর একদিন বলব। তুমি তো এক্ষুনি রাগ করছিলে আমি মুখ দেখাই না বলে। এবার বড্ড বেশি দেখা যাচ্ছে বলেও রাগ করতে পারও।”

– অনেক ভেবেচিন্তে, ঠান্ডা মাথায় এসব ঠিক করেছিস তো? জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে উদাসী গলায় বললেন প্রজ্ঞান। আশা করি তোর দিম্মা তোকে ঠিক রাস্তাই দেখাচ্ছেন। আমার আবার এই বয়সে বেশি লোভ করতে ভয় হয়।

Author Dhurbajyoti Nandi

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস