Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

গোলকিপার (পর্ব ১৮)

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

মার্চ ১৯, ২০২০

Episodic Novel Illustration ধারাবাহিক উপন্যাস
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

একসঙ্গে জনা কুড়ি লোকের ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ আরাম করে বসার ব্যবস্থা যে ঘরে, সেখানে একা বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন সুজাত। পড়ছিলেন, না সামনে কাগজ মেলে বসেছিলেন, বলা মুশকিল। সামনে রাখা পেয়ালায় চা জুড়িয়ে জল। একবারও ইচ্ছে হয়নি তাতে চুমুক দেওয়ার। রাতে অনেক ধৈর্য ধরেও ঘুম না-আসায় ওষুধ খেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সকালেও মন দিতে পারছেন না কোনও কিছুতে। যে মনঃসংযোগের জন্যে তাঁর এত সুনাম, আজ কিছুতেই তার হদিশ পাচ্ছেন না। অনেক ধাঁধার কোনও সমাধানই খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি–– কুর্চি কী জেনেছে, কতটা জেনেছে, কীভাবে জেনেছে! কিছু যদি না-ই জানবে, তাহলে তার ওই ফুটবলার বন্ধুর দুর্ঘটনার পরপরই সে বাবার ফোন ধরা বন্ধ করে দিল কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের অ্যাকাউন্টগুলো নিষ্ক্রিয় করে দিল কেন? বাড়ি ছাড়ল কেন? চিঠি পাঠালে তার হাতে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না কেন? সুজাতর লোকেরা কেউ কুর্চির কাছে পৌঁছতে পারছে না কেন? উত্তর নেই। একটা প্রশ্নেরও নির্ভুল উত্তর নেই তাঁর কাছে।

ভেবেছিলেন, এতকাল যেমন হয়ে এসেছে, অলোকেশ গুহ বিশ্বাসের কাছে তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর থাকবে। থাকবে সব ধাঁধার সমাধান। কিন্তু কাল রাতে অলোকেশ তাঁকে শুধু হতাশই করেননি, রীতিমত অবাক করেছেন। যাকে পায়ে মারার কথা, তাকে মাথায় বিপজ্জনক আঘাত করে বসায় গত কয়েক দিনে অলোকেশদাকে অনেক কথাই শুনিয়েছিলেন সুজাত। সেসব মুখ বুজে হজম করলেও কুর্চির কথা উঠতেই অলোকেশদা স্পষ্ট বলে দিলেন, কুর্চির ওপর নজর রাখার দায়িত্ব থেকে তিনি অব্যাহতি চান! কুর্চি কেন বাড়ি ছেড়ে গেল? যে সব কথা অলোকেশ আর সুজাত ছাড়া আর কারওই জানার কথা নয়, কুর্চি কি তার আন্দাজ পেয়েছে? সেটা কী ভাবে সম্ভব? জানলেও কুর্চি কতটা জানে– এরকম কোনও আলোচনায় ঢুকতেই চাইলেন না অলোকেশদা। অলোকেশ গুহ বিশ্বাস যে এভাবে তাঁর হাত ছেড়ে দিতে পারেন, সেটা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কখনও সুজাত। এও কি সম্ভব যে অলোকেশদা নিজেই কুর্চিকে কিছু বলেছেন? অথবা কাউকে দিয়ে কিছু বলে পাঠিয়েছেন? কিন্তু তাতে সুজাতর গায়ে যতটা কালি লাগবে, ততটাই তো লাগবে তাঁর নিজের গায়ে! তাহলে!

সব কথার শেষে সুজাত অলোকেশকে বলেছিলেন আজ সকাল আটটায় তাঁর বাড়িতে আসতে। যে অলোকেশদা ঘড়ির কাঁটা ধরে কাজ করার জন্যে বিখ্যাত, সাড়ে আটটা বাজিয়েও তিনি না দিলেন দেখা, না করলেন ফোন। সাড়ে নটার মধ্যে সুজাতর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা। অথচ উঠতে, বা কাজে বেরোতে ইচ্ছেই করছে না তাঁর। কুর্চি যে প্রজ্ঞান- মধুরার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে, সে কথা গতকাল জানিয়ে গিয়েছেন অলোকেশ। সঙ্গে দিয়ে গেছেন প্রজ্ঞানকাকুর ফোন নম্বর। কিন্তু তাঁকে ফোন করে কীই বা বলবেন সুজাত? তিনি যদি প্রশ্ন করেন, কুর্চিকে ফোন না করে আমাকে কেন? কোনও উত্তর তো নেই সুজাতর কাছে। উপায় একটাই। শান্তিনিকেতনে গিয়ে কুর্চির মুখোমুখি হওয়া। সরাসরি জিজ্ঞেস করা, আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করেছিস কেন, বল। কিন্তু সে কি সহজ কাজ? কুর্চির সঙ্গে তাঁর যে কী দুস্তর ব্যবধান তৈরি হয়ে বসে আছে, যেন এই প্রথম টের পেলেন সুজাত। সে ব্যবধান যে কী করে কমানো যায়, তার সামান্যতম হদিশও খুঁজে পাচ্ছেন না বলে একেবারে দিশেহারা লাগছে তাঁর।

বাড়িতে বসে অলোকেশ গুহ বিশ্বাসও ভাবনার তল খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সংবেদনশীলতার যেরকম অভাব সুজাতর, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার একশো একটা কারণ থাকতে পারে কুর্চির কাছে। বাবা-মেয়ের মধ্যে কী কথা হয়েছে না হয়েছে সব তো আর জানা সম্ভব নয় অলোকেশের পক্ষে। তিনি বিচলিত কুর্চির ছিটকে যাওয়ার সময়টা নিয়ে। মাঠের ওই ঘটনাটা যেদিন ঘটল, সেদিন সুজাত গিয়েছিলেন হায়দরাবাদ। কুর্চি কলকাতায় এল, নিজে গাড়ি চালিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের পিছু পিছু ছুটল হাসপাতালে, ফিরে এসে রাত কাটাল কলকাতায় তার বাবার বাড়িতে। পরদিন থেকে বাবার ফোন ধরা বন্ধ করে দিল। শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে নিজের বাড়ি-গাড়ি ফেলে রেখে কাজের লোকজন সঙ্গে নিয়ে উঠল গিয়ে তার ঠাকুরদা-ঠাকুমার বন্ধু এক বৃদ্ধ দম্পতির বাড়ি! কেন? তার বাবা সম্পর্কে কী জানল কুর্চি সেদিন মাঠের ওই ঘটনার পর? কে জানাল? হাসপাতালে সেদিন কুর্চি ছিল ঘণ্টা তিনেকেরও বেশি। মাঠের কিছু লোকও সেখানে ছিল সেদিন। কিন্তু তারাই বা কী বলতে পারে কুর্চিকে? আনোজি মেজাজ হারিয়ে অরিত্রকে মেরেছে। চাইলে থামা সম্ভব ছিল। কিন্তু না থেমে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। সেদিন এর চেয়ে বেশি বলার মতো আর কিছু তো ছিল না!

পরে রেফারির রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করে কলকাতার ফুটবল থেকে আনোজিকে আজীবন নির্বাসন দিয়েছে আইএফএ। হাওয়া খারাপ বুঝে ভারত ছেড়েছে আনোজি। অবশ্য তার ভিসার মেয়াদও আর বেশি দিন ছিল না। মাঠের লোকজন সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত এই সব নিয়েই আলোচনা করে চলেছে। কিন্তু তাতে কুর্চি ওর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবে কেন? কুর্চি হাসপাতালে সেদিন নিশ্চয়ই এমন কিছু শুনেছে বা জেনেছে যাতে এই ঘটনার পেছনে ওর বাবার হাতের ছায়া দেখতে পেয়েছে। সেটা কে দেখাতে পারে কুর্চিকে? অতি বিচক্ষণ অলোকেশের ক্ষুরধার বিশ্লেষণ বারবার এই নিরেট দেওয়ালে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। অথচ এ প্রশ্নের একটা গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত সুজাতর সঙ্গে দেখা করতেও পারছেন না তিনি। আনোজির সঙ্গে অলোকেশ নিজে যোগাযোগ করেননি। সেই যোগাযোগের জন্যে ছেলে দেবদীপের বৃত্তের কাছাকাছি থাকে এমন কাউকে ব্যবহার করার ব্যাপারেও কড়া নিষেধ ছিল তাঁর। শেষ পর্যন্ত কাজে নামানো হয়েছিল দুর্নীতির দায়ে সাসপেন্ড হওয়া এক পুলিশ কর্মীকে, যে ইদানিং আড়ালে থেকে অলোকেশের ডিটেকটিভ এজেন্সির কিছু কাজকর্ম শুরু করছে। অলোকেশ নিশ্চিত হয়ে নিয়েছিলেন সে দেবদীপকে চেনে না এবং দেবদীপও তাকে চেনে না। কারণ, তিনি চাননি এই ঘটনার দূরতম ছায়াও দেবদীপের ওপর পড়ুক।

কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, দেবদীপের সাহায্যই নিতে হবে তাঁকে। একেবারে শুরু থেকে দেবদীপ নিজে অরিত্রর চিকিৎসার তত্ত্বাবধান করছে। কুর্চির সঙ্গে হাসপাতালে সেদিন কারওর কথা যদি হয়েই থাকে, তাকে চিহ্নিত করে ফেলা দেবদীপের পক্ষে অসম্ভব হবে না। এই পর্যন্ত ভেবেই একটু থমকালেন অলোকেশ।

তিনি জানেন, কুর্চিকে যতটা স্নেহ করে দেবদীপ, ঠিক ততটাই অপছন্দ করে তার বাবা সুজাতকে। অলোকেশের কথায় সুজাত এক ফার্মা কোম্পানিকে দিয়ে দেবদীপের ক্লাব দক্ষিণীকে স্পনসর করাচ্ছেন। কিন্তু সেই কোম্পানি ইদানিং আর জার্সির হাতায় তাদের নাম নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে পারছে না। ক্লাবের নামের আগে তারা নিজেদের নাম বসাতে চাইছে। দল তৈরি থেকে কোচ বাছাই, মাঠ সংক্রান্ত অসংখ্য বিষয়ে তারা ক্লাব কর্তৃপক্ষের ওপর খবরদারি করছে। বিষয়টা নিয়ে সুজাতর সঙ্গে আলোচনা করে একটা যুক্তিসঙ্গত এবং সম্মানজনক রাস্তা খোঁজার চেষ্টা করেছিল দেবদীপ। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি তাতে। সুজাতর প্রশ্নহীন আনুগত্য ওই ফার্মা সংস্থাটির প্রতি। ফলে ক্লাব-অন্তপ্রাণ দেবদীপের সঙ্গে দক্ষিণীর প্রধান স্পনসরের একটা সংঘাত এখন একেবারে অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাহলে কি দেবদীপ? কী আশ্চর্য! এটা তাঁর আগে মনে হয়নি কেন?

সেদিন হাসপাতালে দেবদীপের সঙ্গে নিশ্চিতভাবে কুর্চির কথা হয়েছিল। সে কি সুজাতকে নিয়ে কথা? কিন্তু সেদিনের মাঠের ঘটনার সঙ্গে সুজাতর কোনও যোগের কথা তো দেবদীপের জানার কথাই নয়। অলোকেশের অঙ্কটা যেন মিলেও মিলছে না। দক্ষিণী সম্মিলনীই দেবদীপের ধ্যান-জ্ঞান-প্রাণ। সেই দক্ষিণীর ওপর দখলদারি চালাচ্ছে সুজাতর পেটোয়া ওষুধ কোম্পানি। অন্যদিকে কুর্চি হল সুজাতর চোখের মণি। সেই কুর্চিকে সুজাতর থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করল দেবদীপ!

দেবদীপের সঙ্গে কথা বলতে হবে অলোকেশকে। বলতেই হবে। কিন্তু কী বলবেন? আনোজিকে দিয়ে দেবদীপের নিজেরই ক্লাবের অতি প্রিয় খেলোয়াড় অরিত্রকে আঘাত করার যে ছক কষা হয়েছিল, সেটা তো দেবদীপকে জানানো সম্ভবই নয় তাঁর পক্ষে। আবার দেবদীপ কুর্চিকে সেরকমই কিছু একটা না-বলে থাকলে কুর্চি বাবার থেকে এরকম মুখ ঘুরিয়ে আছে কেন? ইস! একই বাড়িতে থাকেন তাঁরা। অথচ কতদিন দেবদীপের সঙ্গে, তাঁর সবচেয়ে সফল সন্তানের সঙ্গে দেখা হয়নি অলোকেশের! দেখা করবেনই বা কোন মুখে। তার প্রয়োজনের কথা ভেবে অকাতরে অর্থ সাহায্য করে গেছেন তিনি। সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন তার অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছনোর পথ মসৃণ করার। কিন্তু তার মনের কাছাকাছি পৌঁছতে কোনও চেষ্টা তো কোনও দিন করেননি অলোকেশ। তাহলে বাবা হিসেবে সুজাতর সঙ্গে কীই বা তফাত তাঁর? ভাবতে ভাবতে দু’চোখ ঝাপসা হয়ে এল অলোকেশের।

Author Dhurbajyoti Nandi

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।
Picture of ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

ধ্রুবজ্যোতি নন্দী

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস