অরিত্র অফিস থেকে বেরোবার তোড়জোর করছিল, কুর্চির ফোনটা এলো তখনই।
– সেদিন একটা শিওর গোল বাঁচাতে দেখলাম, কিন্তু কোনও কাগজ গোলকিপারের কথা লিখল না কেন?
– কেন আবার, কোনো কাগজে কুর্চি গুপ্তর মতো ফুটবল রিপোর্টার নেই বলে। কিন্তু সত্যিই তুমি অনেকগুলো কাগজ ঘেঁটেছ নাকি?
– কাগজ ঘাঁটিনি, তবে নেট ঘেঁটেছি। নেটে তো আজকাল সব কাগজই পাওয়া যায়।
– সেদিন খেলা ছিল মোহনবাগানের সঙ্গে! তাদের কোন প্লেয়ার কেমন খেলল লোকে সেটাই বেশি জানতে চায়। সেই সব খবরের পরে আর আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের জন্যে জায়গা থাকে নাকি? সেদিন যদি আমরা জিততাম, এমনকি ম্যাচ ড্র রাখতেও পারতাম, একটা চান্স ছিল। সেরকম তো হয়নি। দু-একটা গোল বাঁচিয়েছি বটে, কিন্তু দু-দুটো গোল তো হজম করতেও হয়েছে।
– তা অবশ্য ঠিক। আজ বিকেলে গোলকিপারের কি প্র্যাকটিস ছিল, না আজ অফিস?
-গোলকিপার আজ হেড অফিসের ছোটবাবু, লোকটি বড় শান্ত। কুর্চি তাকে ফোন করবে, হায় যদি সে জানত!
– কেন? জানলে গোলকিপার কী করত?
– সেজেগুজে গায়ে গন্ধটন্ধ মেখে তৈরি থাকত। কিন্তু গোলকিপারের কথা থাক, আজ কুর্চি দেবীর কী প্রোগ্রাম? দুষ্মন্ত-শকুন্তলার সঙ্গে সান্ধ্য ভ্রমণ কি হয়ে গেছে?
– না, ওটা বসন্তদার ওপর ছেড়ে দিতে হয়েছে আজ ফুরসত পাওয়া যায়নি। কাজের চাপ ছিল, ভবন থেকে ফিরেছি একটু আগে। এখুনি আবার বেরোচ্ছি ‘ডাকঘর’-এর একটা মণিপুরী অ্যাডাপ্টেশন দেখতে। মণিপুর কলাক্ষেত্রর দুর্দান্ত নাটক, যেখানে অমল হচ্ছে মণিপুর, তার সংলাপ মণিপুরি ভাষায়। আর কবিরাজ থেকে মোড়লমশাইরা সব রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতীক, তারা কথা বলে হিন্দিতে। খুব হৈচৈ এখানে, দেরি হলে লিপিকাতে আর বসার জায়গা পাব না! এদিকে সঙ্গে যাবে এক বন্ধু, তার আসতে দেরি হচ্ছে বলে ভাবলাম টেনশন না করে গোলকিপারের কাছে একটা জিনিস জেনে নেওয়া যাক।
– কী?
– দক্ষিণীর পরের খেলা কবে?
– সামনের শুক্কুরবার।
– তার পরের খেলা?
– সে তারিখটা তো এখনও জানি না।
– জানতে পারলে জানিও তো আমাকে।
– কেন, তুমি আবার আসবে নাকি মাঠে?
– সেটা আমার ছুটির দিন হওয়া চাই, তবে তো।
– ঠিক আছে, তাহলে দেবুদাকে বলছি এখন থেকে দক্ষিণীর খেলার দিন ঠিক করার আগে কুর্চির সঙ্গে কথা বলে নিও।
– উফ, এত বাজে কথা শোনার সময় নেই আমার। এখন রাখছি, এসে গেছে আমার বন্ধু, এবার বেরোতে হবে।
কুর্চি আবার আসবে তার খেলা দেখতে! ভাবতে ভাবতে যেন ডানা মেলে উড়ে চলল অরিত্র। আর এরকম ভাসতে ভাসতেই তার কেটে গেল কয়েকটা দিন। প্র্যাকটিসে মনোযোগ তো বাড়লই, মাঠে আর জিমে এক্সারসাইজের সময়ও বেড়ে গেল কয়েক গুণ। শুক্রবার ম্যাচের দিন সকালে অরিত্রর ফোনে কুর্চির শুভেচ্ছা এল। কুর্চি এখন অরিত্রর মনের অনেকখানি জায়গা জুড়ে বসেছে। মাঝে মাঝে ভাবার চেষ্টা করে অরিত্র, তার কথা কুর্চিও কি এতটাই ভাবে? নাকি, শুধু তার খেলাতেই কুর্চির যাবতীয় আগ্রহ? এসবের পাশাপাশি একটা আশ্চর্য সমাপতনে ইদানিং সে খেলছেও দারুন। ম্যাচের সময় প্রতিপক্ষ ফরোয়ার্ডদের মুভমেন্ট থেকে অরিত্র এমন সব ইঙ্গিত পেতে শুরু করেছে, যা আগে কখনও পেত কিনা নিজেরই সেই সন্দেহ হয়।
কাস্টমসের সঙ্গে শুক্রবারের ম্যাচটা কোনো গোল না খেয়েই দক্ষিণী জিতল এক গোলে। অরিত্রর দুর্দান্ত পারফর্মান্সের প্রশংসাও হল দু-একটা কাগজে। উচ্ছ্বসিত কুর্চি তাকে আবার ফোন করল। কিন্তু অরিত্র এখনও জানে না লিগে তাদের পরের ম্যাচের তারিখ। অফিসের হয়ে একটা ম্যাচ খেলতে তাকে যেতে হল শিলিগুড়ি। সেখান থেকে ফিরল বেস্ট প্লেয়ারের পুরস্কার নিয়ে। ফেরার পথে তার অফিস টিমের কোচ কিশোর সেন এক ফাঁকে খুব আন্তরিকভাবে জানালেন, তাঁর কাছে খবর আছে অরিত্র এবার বেঙ্গল খেলবে। তবে বেঙ্গল টিম তো! যতক্ষণ না ফাইনাল লিস্ট প্রেসের কাছে যাচ্ছে, ততক্ষণ কিচ্ছু বলা যায় না।
পিয়ারলেসের নীল মাইতি থাকতে আমি! কথাটা এ-কান দিয়ে ঢুকিয়ে ও-কান দিয়ে বার করে দিতেই চেয়েছিল অরিত্র। কিন্তু দেখল কাজটা মোটেই সহজ নয়। ওর সেদিনের খেলায় খুশি হয়েছে বলেই দুম করে কথাটা বলে দেওয়ার মতো লোক তো কিশোরদা নয়। কোচ যেমনই হোক, লোকটার ব্যক্তিত্বের ওজন আছে। ঠিক জায়গায় ঠিক যোগাযোগ না থাকলে কলকাতার ময়দানে এতটা আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায় না। কিন্তু সত্যিই কোথাও যদি অরিত্রকে নিয়ে কোনো কথা হয়েই থাকে, সেটা তো সবচেয়ে আগে দেবদীপের জানার কথা। দেবুদা কিছু বলেনি কেন? অবশ্য ইদানিং তাকে কোন কথাটাই বা বলেছে দেবদীপ?
দেবুদার ব্যবহারে আজকাল একটা আশ্চর্য বদল দেখছে অরিত্র। সবই দেখছে-শুনছে দেবুদা, কিন্তু এতদিন যে সবচেয়ে বেশি হৈচৈ শুরু করত অরিত্রকে নিয়ে, সে-ই এখন সবচেয়ে চুপ। যখনই দেখা হচ্ছে আজকাল, একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে তার দিকে। ভুরু দুটো তোলা, চোখের তারায় একটা কৌতুক, ঠোঁটে যেন হাসি চাপার একটা আভাস। এক একবার সে হাসির এক একরকম মানে করছে অরিত্র। কখনও মনে হছে, মুখে কিছু না বলে দেবদীপ বলতে চাইছে, এসব কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে, আমি কি জানি না ভাবছিস? আবার কখনও যেন, চালিয়ে যা, দেখি কদ্দিন চালাতে পারিস! তবে দেবদীপের চোখ আর ঠোঁটে হাসির আবছা আভাসে একটা প্রশ্রয়ের ছোঁয়া যেন লেগে থাকে। তাই উদ্বেগের কোনও কারণ দেখেনি অরিত্র।
কিন্তু কিশোরদার কাছে এই বেঙ্গল টিমে ঢোকার কথাটা শুনে চোখে ঘুমই আসতে চাইছিল না রাতে। কেন তাকে স্রেফ গাঁজাখুরি একটা কথা বলতে যাবে কিশোরদা? আবার, কথাটা সত্যিই যদি হবে, তাহলে দেবুদা কিছু বলেনি কেন? দেবুদা হঠাৎ চুপ মেরে গিয়েছে কেন ইদানিং?
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে অরিত্র স্বপ্ন দেখল, একটা খুব লম্বা বাড়ির উঁচুতলার কোনো লবিতে তার দিকে একটা বল ছুঁড়ে দিল দেবুদা। বলটা ধরতে অরিত্র যেই কয়েক পা দৌড়েছে, ওমনি লিফটের দরজা খুলে ঢুকে পড়ে দেবুদা অদৃশ্য হয়ে গেল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল, ফেরার নাম নেই। আর কত অপেক্ষা করা যায়? নিচে নেমে এল অরিত্র, কিন্তু নিচেও তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না দেবুদাকে! বুঝতেও পারছে না এ কোন জায়গায় তাকে এনেছে দেবদীপ। আশপাশে কাউকে দেখতেও পাচ্ছে না যে জিজ্ঞেস করবে!
আগের পর্বে পড়তে হলে https://banglalive.com/goalkeeper-an-episodic-novel-on-relationships-and-social-norms-7/
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।