দরজা বন্ধ করে দোতলায় বারান্দা-লাগোয়া টিভির ঘরে গিয়ে বসতেই অস্বস্তির কাঁটাটা আবার খচখচ করে উঠল কুর্চির মাথায়। কেউ কি তাকে দেখছে? সেই ঠাম্মার আমল থেকেই টিভির ঘরের বড় বড় জানলায় পর্দা টানা হয় না। টিভি দেখতে দেখতেই ঠাম্মা বারবার আকাশের দিকে চাইতেন। টের পেতে চাইতেন কখন সন্ধে হল, কখন মেঘ করল, বৃষ্টি নামল। কিন্তু এখন এই টিভি ঘরে এসে বসা কুর্চির দিকে কে তাকাতে যাবে? দোতলার এই ঘরটা থেকে বাড়ির সামনের রাস্তা বেশ খানিকটা দূরে। তাছাড়া রাস্তায় কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে তো এখান থেকেও দেখা যাবে। যদি না অবশ্য সে বাগানের কোনো বড় গাছে চড়ে বসে থাকে! যুক্তি দিয়ে ভেবেও অস্বস্তিটা মন থেকে সরাতে না পেরে শকুন্তলা-দুষ্মন্তকে নিয়ে কুর্চি ঢুকে পড়ল তার নিজের পর্দা টানা ঘরে।
কাল গিয়েছিল কলকাতায়। মোহনবাগানের সঙ্গে অরিত্রদের খেলা ছিল কল্যাণী স্টেডিয়ামে। খেলার পর সেখান থেকে কলকাতায় গিয়ে বাড়িতে রাত কাটিয়ে আজ আবার ফিরেছে শান্তিনিকেতনে। বাংলা খবরের কাগজে দু’বার অরিত্রর তারিফ পড়ে ওর খেলা দেখার ইচ্ছে হয়েছিল কুর্চির। খুচখাচ কিছু কেনাকাটাও করার ছিল। ভেবেছিল অরিত্রকে চমকে দেওয়া যাবে। আবার কেনাকাটা সেরে নিয়ে এক ঢিলে দুটো পাখি শিকারও করা যাবে। খেলার শেষে দক্ষিণী সম্মিলনীর প্লেয়ার্স রুম খুঁজতে গিয়ে দেবুদার সঙ্গে দেখা। কুর্চিকে দেখে খুব একটা খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। কিন্তু মুখে বলল, “খেলা দেখতে আসবি তো আমাকে বলিসনি কেন? পাস রেখে দিতাম তোর জন্যে।” এমনকি অরিত্রর সঙ্গে কুর্চি দেখা করতে চায় জেনে তাকে সঙ্গে সঙ্গে খবর দেওয়ার ইচ্ছেও দেবুদার ছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু এক সপ্রতিভ তরুণী যে অরিত্রকে খুঁজছে সে কথা দেবদীপের অজান্তেই পৌঁছে গিয়েছিল অরিত্রর কানে। সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসেছিল অরিত্র। পাঁচ মিনিট যেতে না যেতেই দেবুদা অবশ্য সবাইকে টিম বাসে ওঠার জন্যে তাড়া দিতে শুরু করে। আর কুর্চির তো তেমন কিছু বলারও ছিল না। টেলিফোনে কথা তো হয়েওছে দু’চারবার। কল্যাণী থেকে শান্তিনিকেতনের চেয়ে কলকাতা অনেক কাছে বলে খেলার পর চলে গিয়েছিল ডোভার রোডের ফ্ল্যাটে। কিন্তু আজ বিকেলে কলকাতা থেকে গাড়ি চালিয়ে ফেরার সময় থেকে বারবার মনে হচ্ছে কে যেন তাকে দেখছে! অস্বস্তিটাকে বাড়তে না-দিয়ে কালই কেনা নতুন একটা বইতে চোখ ডোবাল কুর্চি।
রাত আটটা নাগাদ কৃষ্ণাদিকে ডেকে খাবার দিতে বলার সঙ্গে সঙ্গে পেছনের দরজায় ঠকঠক। এই দরজা দিয়েই যাতায়াত করে বসন্ত এবং সে-ই এসেছে। আর বলছে, ডাক্তারবাবুর চিঠি নিয়ে কে নাকি এসেছে কলকাতা থেকে।
বাবার চিঠি! অবাক হল কুর্চি। এই তো কয়েক ঘন্টা আগে সে এসেছে কলকাতা থেকে। কাল রাতে খেতে বসে বেশ কিছুক্ষণ কথাও হল বাবার সঙ্গে। তার খেলা দেখতে যাওয়ার গল্পে বাবার অবশ্য বিশেষ আগ্রহ ছিল না। আজ সকালেও হাসপাতালে যাওয়ার আগে বাবার সঙ্গে দেখা করল কুর্চি। কিছু বলার থাকলে বাবা তো তখন মুখেই বলতে পারত। পরে মনে পড়লে ফোন করতে পারত। সেসব কিছু না-করে লোকের হাত দিয়ে চিঠি পাঠানো! কুর্চি বুঝেই উঠতে পারছে না ব্যাপারটা কী। দেখি চিঠিটা, বলে হাত বাড়িয়ে বসন্তর হাত থেকে মুখবন্ধ খামটা নিল কুর্চি। বাবার ডাক্তারির প্যাডের উল্টোদিকে ইংরেজিতে লেখা ছোট্ট চিঠি। “শান্তিনিকেতন থেকে যা সব খবরাখবর পাচ্ছি, তাতে আমার উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। বসন্তর বয়স বেড়েছে। একা তার পক্ষে ওই বাড়ি এবং তোমার নিরাপত্তা সামলানো আর সম্ভব নয়। তাই দেবাশিস নাথ নামে এই ছেলেটিকে রাখলাম। গাড়ি চালাতে পারে, সব সময় তোমাকেই ড্রাইভ করতে হবে না এরপর। আউটহাউসে বসন্তর পাশের ঘরে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিও। অনেক ভালোবাসা, বাবা।”
আশ্চর্য! নতুন পাহারাদার পাঠাচ্ছে, সেটা নিয়ে কুর্চির সঙ্গে আলোচনার কথা কাল রাতে কি আজ সকালে একবারও মনে হল না বাবার! সবচেয়ে বড় কথা, সপ্তাহে একবার কি দু’বারের বেশি ফোন করার সময় যে পায় না, সারা বছর যার শান্তিনিকেতনে আসার ইচ্ছেই হয় না, তার উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো হঠাৎ কী ঘটল এখানে? রাগ, বিরক্তি আর অভিমানে মুখ লাল করে কুর্চি কোনওমতে বলল, “বলে দাও চিঠিটা আমি রাখলাম। কিন্তু এখন তো কিছু করা যাবে না। কাল সকাল আটটার সময় আসুক। তখন দেখব।”
বলে, ছুটে দোতলায় এসে নিজের ঘরের আলো না-জ্বালিয়েই কুর্চি দাঁড়াল জানলার ধারে। পর্দাটা সামান্য ফাঁক করে তাকিয়ে থাকল ওদের বাড়ির গেটের দিকে। লোকটা বেরোল কিছুক্ষণ পর। বসন্তর সঙ্গে কী যে সব কথা বলল, কে জানে! তারপর ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগল। বসন্ত গেটে তালা দিয়ে চলে যেতেই লোকটা লম্বা লম্বা পা ফেলে ঢুকল দেবুদার বাড়িতে। দেবুদারা কেউ এসেছে নাকি? কই, এখান থেকে তো একটা ঘরেও আলো জ্বলতে দেখা যাচ্ছে না। কুর্চির ইচ্ছে ছিল দাঁড়িয়ে থাকে আরও খানিকটা। কিন্তু খেতে বসার জন্যে কৃষ্ণাদি তখনই একতলা থেকে এমন ডাকাডাকি শুরু করল যে সরে আসতেই হল।
সকাল আটটার আগেই অবশ্য তৈরি হয়ে ছিল কুর্চি। বাড়ির ভেতরে নয়, পেটানো চেহারার দেবাশিস নাথের সঙ্গে দেখা করল একতলার বারান্দায়। বলল, “খুব অসুবিধে হল বোধহয় কাল রাতে।” জিজ্ঞেস করল, “ছিলেন কোথায়?” লোকটা গদগদ হয়ে উত্তর দিল, “কোথায় ঠিক বলতে পারব না। বড় রাস্তায় পৌঁছতেই টোটো পেয়ে গেলাম। যে চালাচ্ছিল, সে-ই পৌঁছে দিল একটা আস্তানায়। দুশো টাকা নিল, অসুবিধে হয়নি।”
কুর্চি বলল, “কিন্তু আমি যে খবর পেলাম আপনি কাল রাতে উল্টো দিকের বাড়িতে ঢুকেছেন? সেখান থেকেই বেরিয়েছেন আজ সকালে। ভুল খবর বোধহয়। যাক গে, আপনাকে এখন আমাদের দরকার হবে না। যখন হবে, বাবাকে জানাব। আপনার মিথ্যে হয়রানি হল। বাবা নিশ্চয়ই সেটা দেখবেন। আর, এই চিঠিটা আপনি বাবার কাছে পৌঁছে দেবেন প্লিজ?”
মুখবন্ধ খামে ভরা সেই চিঠিতে কুর্চি লিখেছে, ইংরেজিতেই, “আমার বা শান্তিনিকেতনের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগের কোনও কারণ খুঁজে পেলাম না। আপাতত দেবাশিস নাথকে দরকার হচ্ছে না। হলে নিশ্চয়ই জানাব। তোমার কুর্চি।”
লোকটা চলে যেতে দু’হাতে মুখ ঢেকে বারান্দাতেই অনেকক্ষণ বসে রইল কুর্চি। রোদ্দুর নিম গাছের ফাঁক দিয়ে বারান্দার রোয়াকে সবে উঁকি দিচ্ছে। শীত চলে গেছে, কিন্তু সকালের দিকটা এখনও যথেষ্ট ঠান্ডা। ফ্যান চালানোর দরকারই পড়ে না। আজ আবার সকাল থেকেই একটা দখিনা বাতাস বইছে। গাছের ফাঁক দিয়ে হাওয়ার সরসর শব্দ ছাড়া কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। শুধু দু’টো ঘুঘু জারুলের কোন ডালে লুকিয়ে একটানা ডাকছে তো ডাকছেই। বেশ কিছুক্ষণ এডালে-ওডালে তাকিয়ে তাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করল কুর্চি। না-পেয়ে শেষ পর্যন্ত উঠেই পড়ল বিরক্ত হয়ে।
(পরবর্তী পর্ব আগামী সোমবার)
আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।