banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সার্কাস-গিরি-কান্তার-মরু: ইতিহাসের এক ঝলক

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Priyanath Bose প্রিয়নাথ বোস

“রামমোহন রায়ের নাতির যে সার্কাস ছিল সেটা জানতেন?” 

বক্তার নাম লালমোহন গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে জটায়ু। গোয়েন্দা ফেলুদার রহস্য উপন্যাস ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ গাড়ি করে হাজারিবাগ যেতে যেতে লালমোহনবাবু ‘বাঙ্গালীর সার্কাস’ নামে যে বইটা পড়ছিলেন, তা থেকেই এহেন নানাবিধ তথ্যের ছিটে এসে লাগছিল পাঠকের গায়ে। সেখানেই প্রথম জানতে পারি, ভারতের সিনেমা-থিয়েটার-গান-গপ্পের মতো সার্কাসেরও গোড়াপত্তন এক বাঙালির হাত ধরে। ‘বাঙ্গালীর সার্কাস’ বইয়ে যাকে ‘প্রফেসর বোসের গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। 

কিন্তু কে এই প্রফেসর বোস? তিনি কোন কলেজের প্রফেসর? আর প্রফেসরই যদি হবেন, তাহলে খামোকা সার্কাসের দল খুলতে গেলেন কেন? আর রামমোহন রায়ের মতো সমাজসংস্কারকের নাতিও কিনা খুলেছিলেন সার্কাসের দল? 

প্রফেসর বোসের পুরো নাম প্রিয়নাথ বসু। জন্ম ১৮৬৫ সালে উত্তর ২৪ পরগনার ছোট জাগুলিয়ায়। প্রিয়নাথের বাবা মনমোহন বসু ছিলেন কবি ও নাট্যকার। থিয়েটারে গান লিখতেন। খুব জনপ্রিয় ছিল সেইসব গান। ন্যাশনাল থিয়েটারে রমরম করে চলত থিয়েটার, আর তাতে মনোমোহিনী মনমোহনের গান। তবে জাতীয়তাবাদী চেতনা তখন যে কোনও নব্যশিক্ষিত বাঙালিকেই বহুল প্রভাবিত করত। মনমোহনও ব্যতিক্রম নন। তিনি জড়িয়ে পড়লেন হিন্দুমেলার সঙ্গে। 

হিন্দুমেলার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নবগোপাল মিত্র। তাঁর উৎসাহ ছিল বিবিধ। কলকাতায় তখন রমরমিয়ে খেলা দেখাচ্ছে ইয়োরোপের দল উইলসন্স গ্রেট ওয়র্ল্ড সার্কাস। তার ন্যাজ ধরে আরও কেউ কেউ। সে সব দেখতে দেখতে নবগোপালের ইচ্ছে জাগল, সার্কাসের দল খুলবেন। যেসব দুরাত্মা বাঙালিকে কর্মবিমুখ আলসে বলে দুর্নাম করেন, নবগোপাল মিত্রের জীবনী পড়লে তাঁদের মুখের কথা বন্ধ হতে বাধ্য। মাথায় আইডিয়া আসতেই নবগোপাল হইহই করে শুরু করে দিলেন সার্কাসের দল। নাম ন্যাশনাল সার্কাস। আপিস উত্তর কলকাতায়। গোড়ায় ঠনঠনেতে, পরে নবগোপালের কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতেই শামিয়ানা খাটিয়ে বাদ্য বাজিয়ে শুরু হয়ে গেল বাঙালির প্রথম সার্কাস। সালটা ১৮৭২। তবে সে সার্কাসকে ‘মাদারি কা খেল’ বললেও খুব একটা অত্যুক্তি হয় না, কারণ জিমন্যাস্টিকস জাতীয় ভারসাম্যের খেলাই ছিল তার মূল আকর্ষণ। জন্তুজানোয়ার বলতে ছিল সবেধন নীলমণি এক টাট্টু ঘোড়া। 

মনমোহন বসু ছিলেন নবগোপাল মিত্রের ঘনিষ্ঠ। আর মনমোহন বসুর ছেলে প্রিয়নাথ ছিলেন শরীরচর্চা-পাগল, যাঁকে আজকের যুগ হলে বলা হত ফিটনেস-ফ্যানাটিক! ছোট জাগুলিয়া থেকে কলকাতায় এসেছিলেন ব্যায়াম আর কুস্তি শিখতে। বাবার অমতেই প্রিয়নাথ সিমলে পাড়ার প্রখ্যাত কুস্তিগীর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায়ের কাছে নাড়া বাঁধলেন। একদিকে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলছেন কুস্তির আখড়া, পাশাপাশি চলছে জিমন্যাস্টিক শেখা, ঘোড়সওয়ারি শেখা, ট্রাপিজের খেলা শেখা। এহেন উদ্যমী পুরুষ প্রিয়নাথের নজর কি ছিল না নবগোপালের নবজাতক সার্কাসের দিকে? অবশ্যই ছিল। সেটা বোঝা গেল যখন ১৮৮৭-তে মুখ থুবড়ে পড়ল ন্যাশনাল সার্কাস আর সেই সুযোগে তার যাবতীয় জিনিসপত্র-ঘোড়া জলের দরে কিনে নিলেন প্রিয়নাথ। 

মনমোহন কিন্তু এদিকে খেপে উঠলেন ছেলের এই খামখেয়ালিপনায়। ছেলের পড়াশোনায় মন নেই দেখে আগেই মনমোহন তাকে আর্ট কলেজে দাখিল করিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পচর্চাতেও যে এ ছেলের ঝোঁক নেই! এ আবার কেমনধারা কথা? শিক্ষিত ভদ্রবাড়ির ছেলে কিনা ল্যাঙট পরে স্টেজে উঠে লম্ফঝম্প করবে? চলবে না। কিন্তু প্রিয়নাথকে রোখা তখন শিবের অসাধ্য। জাগলিং শিখছেন। প্যারালাল বার-হরিজন্টাল বারের উপর উঠে কসরত শিখছেন। শিখছেন জন্তু জানোয়ারকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পন্থা। বাবার কথায় তিনি পিছিয়ে আসবেন? পিত্রাদেশ ও পৈতৃক সম্পত্তিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গৃহত্যাগ করলেন প্রিয়নাথ। ১৮৮৭ সালেই পত্তন করলেন গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। ভারতীয় সার্কাসের ইতিহাসে প্ল্যাটিনামাক্ষরে আজও লেখা রয়েছে যার নাম। 

প্রথম প্রথম খুব টানাটানির সংসার। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। সম্বল তো সামান্য, কারণ মনমোহন একটি পাইপয়সা দিয়ে সাহায্য করেননি। বন্ধুবান্ধবই ভরসা। কিন্তু চেয়েচিন্তে আর কদ্দিন চলে? শুরু হল বড়লোকের বাড়ি বাড়ি খেলা দেখানোর বায়না নেওয়া। জেলায় জেলায় সার্কাসের দল নিয়ে ছুটতে লাগলেন প্রিয়নাথ। মঞ্চ নেই। তাঁবু নেই। গ্যালারির তো নামও শোনেনি কেউ। যাত্রাদলের মতো মাটিতে চাটাই পেতে বসা দর্শকের সামনে মশাল জ্বালিয়ে খেলা দেখাতে লাগল গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের দল। একটু একটু করে টাকা আসতে লাগল। প্রিয়নাথ সব টাকা ঢালতে লাগলেন দলে। তাঁবু কিনলেন। ডায়নামো বাতি কিনলেন। ভালো ভালো দু’একজন খেলোয়াড় রাখলেন। আর রাখলেন একজন অ্যাকাউন্টেন্ট। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। 

Photograph of Pyramid Act by Great Bengal Circus
এমন পিরামিডের কসরত দেখাতেন গ্রেট বেঙ্গলের খেলোয়াড়েরা

ক্রমেই ডালপালা মেলতে থাকল প্রিয়নাথের সার্কাস-সংসার। রংপুরের রাজবাড়িতে খেলা দেখিয়ে খুব নামডাক হল প্রিয়নাথের। কোষাগারও ভরে উঠল। এবার পাড়ি বাংলার বাইরে। ভাবনগর, জুনাগড়, কচ্ছ, কাঠিয়াওয়াড়, সুরাত, বরোদা, ইন্দৌর, মুম্বই, পুণে, গ্বালিয়র, ঝাঁসি, চিতোর, উদয়পুর, করাচি, পেশোয়ার, রাওয়ালপিন্ডি থেকে দক্ষিণে শ্রীলঙ্কা, জাভা, মালয় ইন্দোনেশিয়াতে ছুটতে লাগল গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস। সেই দেশ-বিদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা প্রিয়নাথ নিজেই লিখে রাখতেন। পরে ১৯০২ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয় এই স্মৃতিকথন। নাম ছিল – ‘প্রোফেসর বোসের অদ্ভুত ভ্রমণ বৃত্তান্ত।’ বাপের সঙ্গে সদ্ভাব না-থাকলেও মনমোহনেরই প্রকাশনা সংস্থা মনমোহন লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়েছিল সেই বই। সাম্প্রতিককালে কারিগর প্রকাশনা সংস্থা পরিমার্জন করে বইটি পুনর্মুদ্রণ করেছে।

এতদিন হাড় জিরজিরে টাট্টু ঘোড়া ছাড়া গ্রেট বেঙ্গলে আর কোনও জীবজন্তু ছিল না। ১৮৯৬ সালে রেওয়ার মহারাজা খেলা দেখে খুশি হয়ে প্রিয়নাথের দলকে উপহার দিলেন এক জোড়া বাঘ! এই বার কাজে লাগল প্রিয়নাথের পশু-প্রশিক্ষণের বিদ্যে। বাঘেদের নাম রাখা হল লক্ষ্মী আর নারায়ণ। আর এরাই এবার হয়ে উঠল গ্রেট বেঙ্গলের তারকা! 

সত্যজিতের ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ বাঘের ট্রেনার বীরেন্দ্র কারান্ডিকারকে মনে আছে? তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির সার্কাস-নায়ক সুরেশ বিশ্বাস। সুরেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল সিংহের মুখ হাঁ করে তারমধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেওয়া! উনিশ শতকের আশির দশকে লন্ডনে এই খেলা দেখিয়ে খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন সুরেশ। সে খেলাই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসের লক্ষ্মী-নারায়ণের হাতে, থুড়ি মুখে এবার জমে উঠল। প্রিয়নাথের মেজো ছেলে অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু বাঙ্গালীর সার্কাস নামে যে প্রামাণ্য বইখানা লিখে গিয়েছেন (পরে গাঙচিল থেকে পুনর্মুদ্রিত), সেখান থেকেই জানা যায়, প্রিয়নাথের দলে খেলা দেখাতেন প্রখ্যাত কুস্তিগির ও ব্যায়ামবীর বাদলচাঁদ। এই বাদলচাঁদই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে বাঘের সঙ্গে কুস্তি লড়তেন। আর ক্লাইম্যাক্সে বাঘের মুখ হাঁ করিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দিতেন। দর্শক উত্তাল। শো সুপারহিট! 

প্রিয়নাথের চমকের এখানেই শেষ নয়! এ বার সার্কাসের দলে নিয়ে এলেন মেয়েদের। সুশীলাসুন্দরী নামে বাঙালিনী খালি হাতে বাঘের খেলা দেখিয়ে গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসকে খ্যাতির চুড়োয় নিয়ে গেলেন। তাঁর বোন কুমুদিনীও এখানে খেলা দেখাতেন। তাঁরা তখন, যাকে বলে টক অফ দ্য টাউন! একদিকে বাঘের খেলায় অমিতবিক্রম, অন্যদিকে ট্রাপিজের দড়ি ধরে শূন্যে ডিগবাজি – সবেতেই দারুণ পারদর্শী দুই বোন। এদিকে দলে তখন ঢুকেছে হাতি। মৃন্ময়ী নামে এক বাঙালিনী শুরু করলেন হাতির পিঠে বসে বাঘের খেলা দেখানো। আর বুকে তক্তা পেতে তার উপর দিয়ে হাতি হাঁটানোর খেলা শুরু করলেন ভবেন্দ্রমোহন সাহা। বিখ্যাত ঘোড়সওয়ার মন্মথনাথ দে চোখ বেঁধে দাঁড়িয়ে উঠতেন ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠের উপর। আর ছিল জাদুর খেলা। ভারতীয় জাদুর প্রবাদপ্রতীম গণপতি চক্রবর্তী জাদু দেখাতেন প্রিয়নাথের সার্কাসে। ফলে অচিরেই গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস হয়ে উঠল বাঙালির গর্ব। আর প্রিয়নাথ এই সার্কাসের দলকে ব্যবহার করতে লাগলেন স্বদেশী চেতনার প্রসারে। প্রত্যেকদিন খেলার শেষে ইংরেজদের অত্যাচারে ধুঁকতে থাকা দেশকে জাগিয়ে তোলার উদ্দেশে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখতেন তিনি। আর তাঁবু ফুঁড়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি উঠত। ফলে স্বদেশী কাগজগুলো প্রিয়নাথ আর তার সার্কাসের দলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠতে লাগল। আর গা জ্বলে গেল ইংরেজে শাসকের। সার্কাসে সাদা চামড়াকে টেক্কা দেবে কালো নেটিভের দল? 

Book Cover of Abanindrakrishna Basu
অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসুর লেখা বাঙ্গালীর সার্কাস-এর প্রচ্ছদ

কিন্তু এর মধ্যেই প্রিয়নাথ হয়ে উঠলেন প্রফেসার প্রিয়নাথ। তাও আবার এক ইংরেজ সাহেবের কল্যাণেই! সাহেবও যে সে কেউ নন। খোদ বড়লাট! অবনীন্দ্রকৃষ্ণর বইতেই লেখা আছে সেই মজার গপ্পো। একবার গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস খেলা দেখাতে গেল বড়লাটের বাসভবনে। বড়লাট তখন লর্ড ডাফরিন। আখড়ার ছেলেপুলেদের সঙ্গে প্রিয়নাথ নিজেও পুরোদমে কসরত করছেন মঞ্চের উপর। হঠাৎ ডাফরিন প্রশ্ন করে বসলেন, “হু ইজ দ্যাট প্রফেসর?” সকলে হইহই করে গুরুর নাম জানায় সাহেবকে। আর সেই থেকে প্রিয়নাথ বসু হয়ে গেলেন প্রফেসার বোস। আর দলের নাম হল “প্রফেসর বোসেজ গ্রেট বেঙ্গল সার্কাস।” প্রিয়নাথের নিজেরও যে উপাধিখানা জব্বর মনে ধরেছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নইলে কি আর সে নামে বই লেখেন? 

এদিকে, একই সময়ে কলকাতার নব্য বাবুরা – রাজেন্দ্রলাল সিংহ, শ্যামাচরণ ঘোষ, দীননাথ ঘোষ, যোগীন্দ্রনাথ পাল – সকলেই সার্কাসে মহা উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। কারণ এঁরা সকলেই শরীরচর্চার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজেন্দ্রলালের উদ্যোগে শিয়ালদহে স্টেজ বানিয়ে শুরু হল দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস। কুচবিহারের মহারাজা থেকে শুরু করে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ডব্লিউ সি বোনার্জি, সকলেই আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমহার্স্ট স্ট্রিটের আলমস হাউজে থাকতেন প্রখ্যাত পশু-প্রশিক্ষক মিস্টার হগহার্টস। তাঁকে দলে ডেকে নিলেন রাজেন্দ্রলাল। ১৮৮৩-তে আরেক পশু-প্রশিক্ষক এস ও অ্যাবেল তাঁর সঙ্গী গোটা দুই ছোট ছোট সার্কাসের দল নিয়ে এসে যোগ দিলেন গ্রেট ইন্ডিয়ানে। জমে উঠল রাজেনবাবুর সার্কাস-ব্যবসা। তবে বাংলার বাইরে খুব একটা খেলা দেখাতে যেত না গ্রেট ইন্ডিয়ান। মেটিয়াবুরুজ, হাওড়া, শ্রীরামপুর, চুঁচড়োর মতো মফস্সলেই ছিল তাঁদের রমরমা। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সাদায়-কালোয় গোল বাধল। দলাদলি, খেয়োখেয়িতে ফাটল ধরল গ্রেট ইন্ডিয়ানের বুনিয়াদে। আর সেই সুযোগে রামমোহনের নাতি হরিমোহন রায় কিনে নিলেন রাজেনবাবুর সার্কাস। গ্রেট ইন্ডিয়ান সার্কাস নাম আর চেহারা বদলে হরিমোহনের দল বলে খেলা দেখাতে লাগল। 

কিন্তু সে দলও বেশিদিন টিঁকল না। হরিমোহনের ম্যানেজার যোগীন্দ্রনাথ পাল এবার কিনে নিলেন নাম-বদলানো গ্রেট ইন্ডিয়ানকে। এ বার কিঞ্চিৎ সুখের মুখ দেখল তারা। বিদেশ থেকে ডাক আসতে লাগল। গোপাল নামে বাঘের সঙ্গে খেলা দেখালেন ব্যায়ামবীর শ্যামাকান্ত। সেই দলেই খেলা দেখাতে এলেন রাজেন্দ্রলাল-প্রিয়নাথের সমসাময়িক আরও এক বাঙালি, জিমন্যাস্টিক ও শারীরিক কসরতে যিনি অসামান্য প্রতিভার পরিচয় রেখেছিলেন কলকাতাতেই।

আইকন-প্রিয় বাঙালি অবশ্য তাঁকে মনে রাখেনি। তাঁকে নিয়ে বইও লেখা হয়নি। ১৮৬৬ সালে আহিরিটোলায় জন্মেছিলেন এই ব্যায়ামবীর। নাম কৃষ্ণলাল বসাক। সে যুগের পয়সাওলা ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের বংশধর। ছোটবেলা থেকেই শরীরচর্চায় ছিল অদম্য আগ্রহ। সিমলেপাড়ার কুস্তির আখড়াতে যাতায়াত ছিল এঁরও। সম্ভবত প্রিয়নাথের সঙ্গে পরিচয়ও ছিল। কিন্তু গ্রেট বেঙ্গল সার্কাসে ইনি যোগ দেননি। মাত্র সতেরো বছর বয়সে শোভাবাজার রাজবাড়িতে কসরত দেখিয়ে নাম কেনেন কৃষ্ণলাল। তবে গোড়াতেই নিজে সার্কাসের দল না খুলে যোগ দিয়েছিলেন সাহেবদের সার্কাসে। সেখানে খুব নামডাক হল তাঁর। তারপর গ্রেট ইন্ডিয়ানে এসে ইয়োরোপীয় পশু-প্রশিক্ষক এস ও অ্যাবেলের কাছে শিক্ষানবিশি করলেন কিছুদিন। ১৯০০ সালে এক ইয়োরেপীয় সার্কাস দলের সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বেরলেন কৃষ্ণলাল। প্যারিসে খেলা দেখিয়ে তাঁর বিপুল খ্যাতি হল। জাগলিং, প্যারালাল বার, ফ্লাইং ট্র্যাপিজ, জাপানি টপ স্পিনিংয়ের এমন খেলা দেখে সাহেবদেরও চোখ কপালে ওঠার জোগাড়! 

আর পায় কে? দেশে ফিরে এসেই কৃষ্ণলাল খুলে বসলেন তাঁর নিজস্ব দল – ‘দ্য গ্রেট ইস্টার্ন সার্কাস’, যা ‘হিপোড্রোম সার্কাস’ নামেই বেশি বিখ্যাত হয়। তবে এই দলেরও মূলে কিন্তু ছিল সেই জাতীয়তাবাদী চেতনা। মতিলাল নেহরু কৃষ্ণলালের খ্যাতির কথা শুনে তাঁকে নিয়ে যান নিজের শহর এলাহাবাদে, খেলা দেখাতে। কৃষ্ণলালের কোষাগার ফুলে ফেঁপে উঠতে থাকে। তিনি একের পর এক নামীদামি খেলোয়াড়কে আনতে শুরু করেন নিজের দলে, যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত নামটি হল ভবানীচরণ সাহা ওরফে ভীমভবানীর। ভীমভবানী এর আগে রামমূর্তি নাইডুর দক্ষিণ ভারতীয় সার্কাসে কাজ করে প্রভূত নাম কিনেছিলেন। শোনা যায় ভীম নাকি দাঁত দিয়ে তিনটে মোটরগাড়ি টেনে নিয়ে যেতে পারতেন। চিৎ হয়ে শুয়ে বুকের উপর তুলতে পারতেন একসঙ্গে তিনখানা হাতি! এহেন ভীমভবানীকে নাইডুর সার্কাস থেকে হিপোড্রোমে ভাঙিয়ে আনলেন কৃষ্ণলাল। শুধু ভীম নয়, এ রকম অন্তত শ’দেড়েক বাঙালি যুবককে হিপোড্রোমে কাজের সুযোগ দিয়েছিলেন কৃষ্ণলাল। 

গ্রেট বেঙ্গলের মতোই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চষে ফেলতে লাগল হিপোড্রোম। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালাক্কা, জাভা, সুমাত্রা. চিন, জাপানে একের পর এক শো করতে লাগলেন কৃষ্ণলাল। ইয়োরোপ থেকে রোকোকো নামে এক ক্লাউনকে ভাড়া করে আনলেন। তখনকার দিনে তাঁর বেতন ছিল মাসে আটশো টাকা। বাংলা আর ইংরিজি মিশিয়ে এক খিচুড়ি ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে দর্শকদের মধ্যে হাসির হররা উঠিয়ে দিতেন রোকোকো। প্রিয়নাথের মতো কৃষ্ণলালও তাঁর বিদেশভ্রমণ নিয়ে একখানা অতি সরস বই লিখেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন, ‘বিচিত্র ভ্রমণ’। কিন্তু সে বই পুনর্মুদ্রিত হয়েছে বলে জানি না। কাজেই কৃষ্ণলালের অমর কীর্তি এখনও বাঙালির কাছে প্রায় অজানাই রয়ে গিয়েছে। 

তবে সুরেশ বিশ্বাসই হোন কিংবা প্রিয়নাথ, ভীম ভবানীই হোন বা কৃষ্ণলাল – সার্কাসের এই অদম্য আকর্ষণ কিন্তু বারবার বাঙালিকে ঘর ছেড়ে পথে নামতে বাধ্য করেছে। মেনিমুখো, কুঁড়ে, মেয়েলি, ন্যাকা, ভীতু বাঙালির যে ভাবমূর্তি সচেতন ভাবে গড়ে তুলেছিল উপনিবেশবাদ, এঁরা প্রত্যেকেই একেবারে তার গোড়ায় কুঠারাঘাত করেছেন। নদীমাতৃক শস্যশ্যামল বাংলার মাটি যে কেবলই পেলবতার জন্ম দেয় না, চড়ক-গাজনের প্রাচীন সার্কাস-ও যে তার প্রাণের জিনিস, তার এথনিক ঐতিহ্য, সে কথা বোধ করি এঁরা আমাদের ভুলতে দিতে চাননি। তাই কেবল ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে স্বদেশচেতনার কড়া নাড়া, এই একমাত্রিক দৃষ্টিতে বাঙালির সার্কাস-নায়কদের উত্থানকে দেখলে হয়তো কিছুটা অদেখাই রয়ে যাবে। এর মধ্যে অবশ্যই মিশে থাকুক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বাঙালির পৌরুষের ঘোষণা, আধুনিকতার উচ্চারণ এবং বাঁধন ছেঁড়ার উচ্ছাস। 

তথ্যসূত্র: 
বাঙ্গালীর সার্কাস। অবনীন্দ্রকৃষ্ণ বসু
প্রিয়লেখা ডট কম। রঞ্জুপ্রসাদ মণ্ডল
নেশন অ্যাট প্লে: আ হিস্ট্রি অফ স্পোর্টস ইন ইন্ডিয়া। রণজয় সেন
দ্য ট্রপিক ট্রাপিজ: সার্কাস ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া। অনির্বাণ ঘোষ
স্পোর্ট ইন দ্য পাবলিক স্ফিয়ার। শোধগঙ্গা  

 

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com