(Gopal Bhar)
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় বহু জ্ঞানী-গুণী, পণ্ডিত কবি গায়ক ইত্যাদি ছিলেন। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ও ছিলেন তাঁর সভাসদ। তাছাড়া বহু গুণী ব্যক্তিবর্গ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজসভায় প্রতিদিনই আসতেন। এক কথায় বলা যেতে পারে তাঁর রাজসভা অলংকৃত থাকত। গোপাল অশিক্ষিত হয়েও আপন বুদ্ধির সাহায্যে সেই সভায় নিজের স্থান পাকা করে নিয়েছিলেন। কখনই গোপালকে বুদ্ধির প্রতিযোগিতায় কেউ হারাতে পারেনি। তাই সকলেই তাকে ভালোবাসত আবার হিংসাও করত। কিন্তু গোপাল কাউকে হিংসা করতেন না। (Gopal Bhar)
সের যোগান দিয়ে আসছে তা যেমন আনন্দের তেমনি স্মরণীয়। বর্তমানের অত্যন্ত আধুনিক সময়ে গোপালের হাস্যপ্রসঙ্গ যথেষ্ট ঈর্ষনীয় ও জনপ্রিয়তার তুঙ্গে আছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ হাস্য সাহিত্য হয়ে উঠেছে গোপালকেন্দ্রিক গল্পগুলি। গোপালের গল্পগুলিতে বিন্যস্ত হয়েছে তৎকালীন বঙ্গজীবনের সমাজচিত্র। এই সমাজচিত্রে ফুটে উঠেছে ঘটনাবহুল সামাজিক শ্রেণি সংস্কার-সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও দৈনন্দিন জীবনের দ্বন্দ্ব। চিত্রিত হয়েছে মূল্যবান দলিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর জনপ্রিয় গল্পগুলিতে। (Gopal Bhar)
আরও পড়ুন: ‘আমি আর লীনা হেঁটে চলেছি’: বুক শুকিয়ে আসছে- মানস চক্রবর্তী
গোপালকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গল্পগুলি যিনি বা যারাই লিপিবদ্ধ করেছেন তারা এতে সাহিত্যের বদ মিশ্রণটি দেননি বা দেবার প্রয়াসও করেননি তাই গল্পগুলির চরম বাস্তবতা ও সময় ক্ষুণ্ণ হয়নি আবার দীর্ঘ সময় মানুষের মুখে মুখে থাকতে থাকতে গোপালের গল্পে কোথাও কোথাও একটু-আধটু পরিবর্তনের আশংকা থাকলেও গল্পগুলির মূল ভরকেন্দ্র যা ছিল তাই আছে বলেই মনে হয়েছে। (Gopal Bhar)
নদিয়া জেলার খ্যাতনামা গ্রাম ‘ঘূর্ণি’। এই গ্রামেই গোপাল ভাঁড় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গোপালের পিতার নাম ছিল গোবিন্দ শীল ও মাতার নাম ছিল দীপালি। জাতিতে এরা নাপিত ছিল। বাবা ও মায়ের নাম একত্রে করে দাদু নাম রেখেছিলেন শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে নাড়ুগোপাল। বাল্যকালে গোপাল নাদুসনুদুস দেখতে সুন্দর ছিল।(Gopal Bhar)
গোপালের পারিবারিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। দারিদ্র্যতার কারণে পড়াশোনা বিশেষ করতে পারেননি। বিশেষত গ্রামে ক্ষৌরকার্য ও টুকিটাকি করে সংসার প্রতিপালন করতেন তাঁর পিতা। গোপালের যখন আট বছর বয়স তখন গোপালের পিতার মৃত্যু হয়। গোপাল ছোটোবেলা থেকেই খুব চালাক চতুর ও রসিক ছিলেন। তাছাড়া, তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত প্রখর। শাস্ত্রে একটা কথা আছে ‘নরাণাং নাপিত ধূর্তঃ’। গোপালের মধ্য দিয়ে এই শাস্ত্রবাক্য প্রমাণিত হয়েছিল বাল্যকাল থেকেই। গোপাল রসিক এবং ধূর্ত ছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর এই ধূর্ততার দ্বারা তিনি কাউকে প্রতারিত করেননি। তাঁর প্রতিটি কাজ কর্মের মধ্যে দেখা যায় মানুষের কল্যাণ আর ছিল দুষ্টের উচিত শাস্তি। এইভাবেই তিনি তাঁর বাকি জীবন কাটিয়ে দিয়েছিলেন। ভাঁড় চরিত্রকে গোপাল সততা দান করে যে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন সুদূর ভাবীকালের বঙ্গীয় পুরুষদের জন্যে।(Gopal Bhar)
“যখন জানোই না তখন কি আর বলব! যাদের বলব তারা এত মূর্খ হলে চলে কী করে? পরের রবিবার শ্রোতারা যখন বলল জানি কী শোনাবে তখন গোপাল উত্তরে বলেন, —সবাই যখন জেনে ফেলেছে, তাহলে তো আমার আর কিছু বলার নেই।”
গোপাল একদিন একটি চোরকে উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে ধরে ফেলেছিলেন, সেই চোরটি মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ি থেকে চুরি করে আসছিলেন। গোপাল তা জানতে পেরে অনেক কষ্টে চোরটিকে ধরেন। এই ঘটনা মন্ত্রী ও সেনারা দেখেন এবং ধূর্ততার খবর পেয়ে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র গোপালকে তাঁর সভায় ডেকে পাঠান। সুযোগ পেয়ে গোপাল তাঁর অসাধারণ বুদ্ধির সাহায্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় মহারাজের মন জয় করে ফেলেন।(Gopal Bhar)
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অতি কাছের জন হয়ে উঠেছিলেন গোপাল। তার রসসঞ্চারে রাজসভায় যেমন রসের সঞ্চার ঘটেছিল তেমনি রাজার বহু বিপদকে তিনি তাঁর বুদ্ধি দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন।(Gopal Bhar)
গ্রামীন আসরের যে বৈঠকি আড্ডা-মজা-মস্করা তারই এক চালচিত্র ফুটে উঠেছে ‘গ্রামের আসরে গোপাল’ গল্পে। গ্রামের মানুষ গোপালের কাছে ‘তত্ত্বকথা’ শুনতে চায়। গোপাল প্রথম রবিবারে তাদের পালটা জিজ্ঞাসা করে যে, তারা কি জানেন কী শোনাব, শ্রোতারা উত্তর দেয় জানি না। গোপালের উত্তরটি মজার— যখন জানোই না তখন কি আর বলব! যাদের বলব তারা এত মূর্খ হলে চলে কী করে? পরের রবিবার শ্রোতারা যখন বলল জানি কী শোনাবে তখন গোপাল উত্তরে বলেন, —সবাই যখন জেনে ফেলেছে, তাহলে তো আমার আর কিছু বলার নেই। অবশেষে তৃতীয় রবিবারে, অর্ধেক শ্রোতা হ্যাঁ বলল, অর্ধেক শ্রোতা না বলল তখন গোপাল তাদের বলল যারা জানে তারা বলুক ও যারা জানে না তারা শুনুক। এই বলে গোপাল বাড়ি চলে গিয়েছিলেন।(Gopal Bhar)
“অষ্টাদশ শতকে হিন্দু সমাজে বৈষ্ণব এবং অবৈষ্ণবদের মধ্যে যে ভয়ংকর দ্বন্দ্ব ছিল তার মূলে দর্শনের প্রাধান্যর চেয়ে সংস্কারের আচার-বিচারের প্রাধান্য অনেক বেশি ছিল। এর একটি অসামান্য সামাজিক চিত্র পাওয়া যায় ‘বৈষ্ণব জামাইয়ের কীর্তি’ গল্পটিতে।”
অষ্টাদশ শতকে হিন্দু সমাজে বৈষ্ণব এবং অবৈষ্ণবদের মধ্যে যে ভয়ংকর দ্বন্দ্ব ছিল তার মূলে দর্শনের প্রাধান্যর চেয়ে সংস্কারের আচার-বিচারের প্রাধান্য অনেক বেশি ছিল। এর একটি অসামান্য সামাজিক চিত্র পাওয়া যায় ‘বৈষ্ণব জামাইয়ের কীর্তি’ গল্পটিতে। এই গল্পটিতে প্রচণ্ড অহংকারী দাম্ভিক বৈষ্ণবদের উচ্চ সংস্কারজনিত মানসিকতাকে পদাঘাত করেছেন গোপাল। এক গোঁড়া বৈষ্ণব যিনি গোপালের প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি জানতে পারেন যে, গোপাল একদিন নন্দীগ্রামে যাবে শুনে গোঁড়া বৈষ্ণব এসে বলল, ‘নন্দী গ্রামের পরম বৈষ্ণব ত্রিলোচনের ছেলে বটুকের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিয়েছি’… ‘গোঁড়া বৈষ্ণব বংশের ছেলে ভালো না হয়ে যায় কোথায়? অনেক বেছেই তো মেয়েকে ওখানে বিয়ে দিয়েছি’। গোপাল ফিরে আসতেই প্রতিবেশী গোঁড়া বৈষ্ণব জিজ্ঞাসা করে তাঁর জামাই ও তার পরিবার সমন্ধে। গোপালের উত্তরগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ— (Gopal Bhar)
গোপাল— আপনার জামাই খুবই ভালো তবে…
—তবে কি গোপাল? গোঁড়া বৈষ্ণব ওরা।
গোপাল— একটু পেঁয়াজ খায় আরকী।
—বলো কি গোপাল, পেঁয়াজ খায়। ওর বাবা গোঁড়া বৈষ্ণব…
গোপাল— রোজ কী খায় তা বলে? মাঝে মাঝে খায়, যখন একটু মাংস-টাংস খায়।
—কি বলছ গোপাল! আমার জামাই মাংস খায়…
গোপাল— এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই, রোজ কি আর মাংস খায় নাকি যখন একটু টানে তখনই খায়…
—টানে মানে? সে তামাক খায় নাকি?
গোপাল— …সবার সামনেই কি আর মদ টানে, লুকিয়ে লুকিয়ে টেনে আসে।
“গোপালকে ঘিরে বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজের অন্ধকার জাতিদম্ভ ও সংস্কারের আলোর প্রবেশ করেছে এবং গোপাল নিজেই পরতে পরতে পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং আলোকিত করেছেন।”
এইভাবে গোপাল তাঁর প্রতিবেশী গোঁড়া বৈষ্ণবকে জানায় একটু একটু করে তাঁর গোঁড়া বৈষ্ণব জামাইটি যাকে নিয়ে প্রতিবেশী বৈষ্ণবের খুবই অহংকার যিনি কথায় কথায় ‘গোঁড়া বৈষ্ণব’ বলতে ভালোবাসেন তাঁর জামাই বাবাজি আসলে শুধুমাত্র মদ টেনেই ক্ষান্ত দেন না বেশ্যা পাড়াতেও তাঁর বেশ সাবলীল যাতায়াত আছে।(Gopal Bhar)
গোপালকে ঘিরে বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজের অন্ধকার জাতিদম্ভ ও সংস্কারের আলোর প্রবেশ করেছে এবং গোপাল নিজেই পরতে পরতে পর্দা উন্মোচন করেছেন এবং আলোকিত করেছেন। (Gopal Bhar)
‘আগে কি খাব’ এই গল্পটিতে দারিদ্র্যতার অতি জনপ্রিয় তৎকালীন এককথায় প্রকাশ ‘পোড়া মুখ’। গোপাল ও রাজামশাই একদিন একত্রে খেতে বসে ভাতের থালার পাশে নানারকম ব্যঞ্জন দেখে গোপালকে জিজ্ঞাসা করেন— ‘আগে কি খাব বলো তো?’ গোপাল উত্তর দেয়— ‘মহারাজ! আগে বেগুনপোড়া খেয়ে নিন। তারপর দেখবেন পোড়ার মুখে সবই ভালো লাগবে।’ গোপাল যেন নিজেই দারিদ্র্যতার প্রতীক হয়ে উঠেছে, যে তার অন্তঃস্থল থেকে তুলে এনেছেন শ্লেষ ব্যঙ্গাত্মক খিদেই ভরা পেটের হাহাকার। তৎকালীন সমাজের হাজার হাজার নিরন্ন মানুষের প্রতিনিধি গোপাল বলতে চেয়েছেন মহারাজ আপনার ভাতের পাশে কতরকম তরকারী কিন্তু গরিবের ভাতের থালার পাশে থাকে কেবল ছ্যাঁচড়া-পোড়া, আলুপোড়া, বেগুনপোড়া…। মহারাজের অজান্তে গোপাল যেন অতি সন্তর্পণে দারিদ্র্য প্রজাদের আর্থিক অনটনের বিষয়টিকে মেলে ধরেছেন। (Gopal Bhar)
“পিসিমার বাড়িতে খেতে বসে গোপাল তার ধুতিতে লুকিয়ে চিংড়ি ভাজা লাউ ঘণ্টতে মিশিয়ে দেন। পিসিমা যখন জিজ্ঞাসা করেন কোন পদটি গোপালের ভালো লেগেছে তখন গোপাল লাউ চিংড়ির কথা বলে।”
‘কৃপণ পিসি জব্দ’ গল্পে আমরা পাই মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এক বিধবা পিসিমার বিষয়। পিসি নিঃসন্তান হলেও অগাধ বিষয়-সম্পত্তির মালিক। কিন্তু বুড়ি হাড় কৃপণ। বেশি খেলে পয়সা খরচ হবে তাই কম খেতো। একটা মাত্র ঝি তার দেখাশোনা করত। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র-র গোপালকে পরীক্ষা করার জন্য বলেন যে গোপাল যদি তার বিধবা ও কিপটে পিসির কাছ থেকে টাকা আনতে পারে যে কোনো উপায়ে তাহলে মহারাজ তাকে দ্বিগুণ টাকা দেবেন। গোপাল পিসিমাকে তাঁর বাক্যজালে পর্যুদস্ত করে একদিন দ্বিপ্রহরিক আহার গ্রহণের সম্মতি আদায় করেন। পিসিমার বাড়িতে খেতে বসে গোপাল তার ধুতিতে লুকিয়ে চিংড়ি ভাজা লাউ ঘণ্টতে মিশিয়ে দেন। পিসিমা যখন জিজ্ঞাসা করেন কোন পদটি গোপালের ভালো লেগেছে তখন গোপাল লাউ চিংড়ির কথা বলে। পিসিমা অবাক ও ভয় পান কেননা বিধবাদের আঁশটে পেঁয়াজ রসুন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সমাজের লোকেরা সমাজ থেকে সমাজচ্যুত করবে, গঞ্জনা সহ্য করতে হবে এই অসহায় সামাজিক ব্যাধির কাছে সমর্পিত পিসিমা গোপালকে টাকা দিতে বাধ্য হন। (Gopal Bhar)
তৎকালীন হিন্দু বিধবাদের জীবন যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে হাস্যরসের মধ্যে। বিধবাদের খরচ করার অধিকার ও সুযোগ সামাজিকভাবে বিভিন্ন সংস্কার ও বিধি প্রয়োগ করে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল তাই স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন বিধবারা কমবেশি কৃপণ স্বভাবের হতেন। বিধবাদের জীবনযাত্রা ও তাদের প্রতি তৈরি করা সংস্কার আসলে কত মিথ্যা ছিল তা গোপালের চিংড়ি মাছ লাউঘন্টের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়ায় মধ্যে উন্মোচিত হয়েছে।(Gopal Bhar)
বঙ্গীয় সমাজ জীবনে আজও অন্যতম জনপ্রিয় প্রবাদ হচ্ছে এককথায় প্রকাশিত ‘অনামুখো’ আজও আছে তখনও ছিল অর্থাৎ কত প্রাচীন এই ‘নামাঙ্কন’— ‘অনামুখো’। মানুষ মানুষের কতটা করে সাথে, ঘৃণার সাথে, অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় নীচতার সাথে, তুলনা করত তবেই না এই ছোট্ট অথচ ঘৃণার তীব্র প্রকাশের অনুভূতি ‘অনামুখো’। অর্থাৎ যাদের মুখ দর্শনে দিন ভালো যায় না লোকসান হয় ক্ষতি হয় তারাই হচ্ছে অনামুখো। (Little Magazine)
“অষ্টাদশ শতকে বাংলার নবাবী আমলের মধ্যপর্বের নবাবদের নানারকম বদ খেয়ালের একটি চিত্র পাই ‘খট্টাঙ্গ পুরাণ’ গল্পে। এর মধ্যে আছে ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ মিশ্রিত ইতিহাস।”
‘অনামুখো কে’ গল্পে দেখা যায় মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র অনামুখোদের একদম পছন্দ করতেন না। কোনো একদিন ঘটনাক্রমে গোপালকে রাজবাড়ির অতিথিশালায় থাকতে হয়েছিল। সকালবেলাতে মহারাজ গোপালের মুখ দর্শনের ফলে, নাপিতের কাছে নখ কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে যায়। মহারাজের এই বিশ্বাস জন্মায় সকালবেলাতে গোপালের মুখ দর্শনের ফলেই এটা ঘটেছে। তাই মহারাজ গোপালের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন তখন গোপাল মহারাজকে বলে যে, ‘সে আগে মহারাজের মুখ দর্শন করেছে তাই মৃত্যুদণ্ড হচ্ছে তাহলে বেশী অনামুখো কে?’ এরপরেই রাজা লজ্জা পান ও তিনি গোপালকে মুক্তি দেন। গোপাল এই শ্রেণি বৈষম্যের অবসান ঘটান। তার তীব্র প্রতিবাদ ঝলসে উঠেছে গোপালের ঐ উক্তিতে। (Gopal Bhar)
অষ্টাদশ শতকে বাংলার নবাবী আমলের মধ্যপর্বের নবাবদের নানারকম বদ খেয়ালের একটি চিত্র পাই ‘খট্টাঙ্গ পুরাণ’ গল্পে। এর মধ্যে আছে ঐতিহাসিক অনুষঙ্গ মিশ্রিত ইতিহাস। (Gopal Bhar)
নবাবের নবাবী খেয়াল চেপেছে মাটির নীচে কী আছে তা জ্যোতিষ পণ্ডিত দ্বারা গণনা করিয়ে নিতে হবে এর জন্যে নবাব পণ্ডিতকে একহাজার আশরফি পুরস্কার দেবেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র কয়েকজন দরিদ্র জ্যোতিষ পণ্ডিতকে নবাবের কাছে পাঠান। কিন্তু ঐসব পণ্ডিতদের গণনায় নবাব সন্তুষ্ট হননি তাই তাদের কারাবাসের নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র গোপালের শরণাপন্ন হন। গোপাল নবাবের কাছে যান মহাপণ্ডিত সেজে এবং গোপাল সাথে নিয়ে যান ভাঙা খাটের একটি পায়াকে চৌদ্দ পর্দা শালুর কাপড় জড়িয়ে। নবাবের সামনে তিন পর্দা সরিয়ে সংস্কৃতে শ্লোক আওড়ান ও শ্লোকের অর্থ নবাব জানতে চাইলে গোপাল বলেন, ‘হুজুরালি, অষ্টাদশ পুরাণের সার এই খট্টাঙ্গ পুরাণ। এতে বলছে মাটির নীচে কি আছে— তা কোন হিন্দুপণ্ডিতই গণনা করে বলতে পারবে না।’… ‘যবন বা শ্লেচ্ছ ভূতলগণনং শক্যং। হিন্দু পণ্ডিতা পৃথিবী বা তদুর্ধ্বং।’ অর্থাৎ যবন বা শ্লেচ্ছগণকে মরবার পরে মাটির নীচে কবর দেওয়া হয়, অতএব তারা ভূতল গণনা করে বলতে পারবে মাটির নীচে কী আছে। হিন্দুদের মরবার পরে দাহ করা হয় তাই তারা উপরের আকাশে কী আছে সহজেই বলে দিতে পারে। আপনি অনর্থক কতকগুলো হিন্দু পণ্ডিতকে কারাগারে আটকে রেখে কষ্ট দিচ্ছেন।(Gopal Bhar)
“বাংলার সামাজিক জীবনে জামাই-শাশুড়ি সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা বহু চর্চিত ও বর্তমানেও আছে। এই সম্পর্ক হচ্ছে মিঠে-কড়া, অম্ল-মধুর। “
খট্টাঙ্গ পুরাণ আমাদের জানায় এক নতুন প্রকরণের নিটোল কাহিনি। মূল দুটি চরিত্র গোপাল ও নবাবের সংলাপের মধ্যে যে রুদ্ধশ্বাস ভয় এবং চমৎকৃতি আছে অসাধারণ পর্যবেক্ষণশক্তি গোপালের। হিন্দু পণ্ডিতদের জব্দ করার নবাবী মানসিকতাকে তিনি উলটোভাবে নিয়ে গেছেন। গোপাল মুসলিমদের মৃত্যুর পর কবরস্থ করার বিষয়টিকে হাতিয়ার করেছে তবে পাশাপাশি মুসলিমদের শুধু যবন ‘আখ্যা’ দিয়েই তৎকালীন বাংলার হিন্দু সমাজ তাদের ঘৃণাভরে ‘শ্লেচ্ছ’ আখ্যায়িত করেছিল তা জানা যায়। অতি সূক্ষ্মভাবে খট্টাঙ্গ পুরাণের মধ্য দিয়ে নবাবী শাসন হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উদ্ভাসিত হয়েছে।(Gopal Bhar)
বাংলার সামাজিক জীবনে জামাই-শাশুড়ি সম্পর্ক বিষয়ক আলোচনা বহু চর্চিত ও বর্তমানেও আছে। এই সম্পর্ক হচ্ছে মিঠে-কড়া, অম্ল-মধুর। শাশুড়িদের জামাই প্রীতি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। চটুলতা ঘিরে আবর্তিত হয়েছে ‘জামাই আনার এত ধূম কেন’ গল্পে।(Gopal Bhar)
পাড়া-পড়শী অনেকের বাড়িতেই মেয়ে-জামাই বেড়াতে এসেছে দেখে গোপালের স্ত্রীও একদিন গোপালকে জামাই আনার আব্দার জানায়। উত্তরে গোপাল বলে জামাই আনা কি চাট্টিখানি কথা! খরচ বলো তো? অবশেষে গোপাল তাঁর স্ত্রীর কথা মেনে নেন অনেক তর্ক ও খুচরো ঝগড়াঝাটির পরে। জামাই আসার পরে একমাস হয়ে গেলেও জামাই ফেরার নাম নেয় না। শ্বশুর গোপালের কাছে জামাই পোষা না হাতি পোষা। তাই ফন্দি এঁটে গোপাল একদিন সন্ধ্যাতে লেবু চোর ধরার জন্যে জামাইকে পাঠিয়ে দেন লেবু তলায় পরে খেতে বসে গোপাল তাঁর স্ত্রীকে লেবু আনার জন্যে লেবু আনতে পাঠান। জামাই ঘাপটি মেরে বসে অপেক্ষায় থাকে চোরকে ধরার জন্যে এবং অবশেষে শাশুড়িকে চোর ভেবে জামাই জাপ্টে ধরে। চিৎকার চেঁচামেচিতে লন্ঠন হাতে গোপাল পৌঁছে ঐ দৃশ্য দেখে মন্তব্য করেন নিজের স্ত্রীর প্রতি, ‘জামাই আনার এত ধূম কেন’। (Gopal Bhar)
“‘গোপালের বৈদ্য নির্বাচন’ ভারতীয় চিকিৎসাক্ষেত্রে একটি বিশেষ মাইলস্টোন বলেই মনে করি…”
কৌতুকময় এই ঘটনার তৎকালীন সমাজের অভাব অনটন দারিদ্র্যতার সাথে সাথে শ্বশুরের অন্ন ধ্বংস করার মানসিকতা একশ্রেণির জামাইদের মধ্যে ঐ সময়ে ছিল। সেই চরিত্র দেখা যায় গোপালের জামাইয়ের মধ্যে তাই ধান্দাবাজ মানসিকভাবে সস্তাশ্রেণির নির্লজ্জ জামাই যে সরলমতি শাশুড়ির ভালোবাসাকে মোটেই শ্রদ্ধা না করে সরলতার সুযোগকে অন্ন ধ্বংসের কাজে লাগিয়েছিল। গোপাল সমাজের সকল জামাইদের উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। (Gopal Bhar)
‘গোপালের বৈদ্য নির্বাচন’ ভারতীয় চিকিৎসাক্ষেত্রে একটি বিশেষ মাইলস্টোন বলেই মনে করি কেননা ভারতীয় সমাজ জীবনে বিশেষত অষ্টাদশ শতক শুধু নয় বর্তমান সময়েও বহু আলোচিত বিষয় যে, কে চিকিৎসক কে চিকিৎসক নয় কাকে চিকিৎসক বলব ও কাকে চিকিৎসক বলব না গোপাল আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন এবং দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। (Gopal Bhar)
“অনেক ক্ষেত্রে নবাবী আমলে হিন্দু সংস্কৃতি আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুধর্মীয় সংস্কারকে তারা আমল দিতেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘বৃষোৎসর্গের ষাঁড়’ গল্পে।”
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র একজন রাজবৈদ্য নির্বাচন করবেন। বহু নামকরা ও সাধারণ কবিরাজগণ নিজ নিজ প্রশংসায় পঞ্চমুখ। গোপালের ঘাড়ে মহারাজ এই অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব তুলে দেন। গোপালের উক্তি চিরস্মরণীয়— হাজার হাজার রোগী না মারলে রাজবৈদ্য হওয়া যায় না। তখন উপস্থিত কারিগরগণ ফিরিস্তি দিতে থাকে কে কতজন রোগীকে মেরেছে। একজন বৈদ্য ফিরে যাচ্ছিল গোপনে। গোপাল তাকে ডেকে জানতে পারে তার হাতে রোগী মৃত্যুর হার অনেক উপস্থিত বৈদ্যদের থেকে সর্বনিম্ন অতএব তাকেই রাজবৈদ্যরূপে মনোনীত করা হয়। গোপালের বৈদ্য নির্বাচনের মাধ্যমে তৎকালীন বঙ্গীয় চিকিৎসা সংক্রান্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। (Gopal Bhar)
অনেক ক্ষেত্রে নবাবী আমলে হিন্দু সংস্কৃতি আক্রান্ত ও লুণ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুধর্মীয় সংস্কারকে তারা আমল দিতেন না। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ‘বৃষোৎসর্গের ষাঁড়’ গল্পে। মহারাজের পিতৃশ্রাদ্ধের বৃষোৎসর্গের ষাঁড়টিকে নবাব মীরজাফর নিয়ে যান তার মাংস খাবেন বলে। বিশেষত ষাঁড়টির নধরতায় নবাব আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরে ঐ ষাঁড়টি উদ্ধার করতে গিয়ে গোপাল নবাবকে জানায় যে, ঐ ষাঁড়টি মানুষের মল খায় শুধু তাই নয় মাঠে কেউ মলত্যাগ করতে বসলেই শিং দিয়ে গুঁতিয়ে মল বের করে খায়। পাশাপাশি ধর্ম নিরপেক্ষ মানসিকতা দিয়ে গোপাল বলে শুয়োরের মাংস ভালো শুয়োর তো মল খায় সেটা খান। নবাব বুঝতে পারে গোপাল কি বলতে চাইছে। নবাব ষাঁড়টিকে অব্যাহতি দেন। (Gopal Bhar)
আরও পড়ুন: ‘আমি আর লীনা হেঁটে চলেছি’: কবিতা— ছাগলের তৃতীয় সন্তান- জাজরা খলিদ
গোপালের গল্প ঘিরে তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজের খাদ্যসংস্কৃতি বিষয়টি উঠে এসেছে খুব সুন্দরভাবে। যেমন জনপ্রিয় পদ ছিল ভাত ও অন্যতম জনপ্রিয় পদ সুক্তো এবং পৌষ মাসে পিঠে-পায়েস ও দোকানে পাওয়া যেত কলাই ডালের কচুরী। আলুর তরকারী, লাউ ঘণ্ট, নলেন গুড়ের পায়েস। সন্দেশ ছিল জনপ্রিয় মিষ্টি এছাড়া রসগোল্লা। খাদ্যকেন্দ্রিক গল্পগুলি এই ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য যাতে বাঙালির খাদ্য গ্রহণের সুন্দর বিবরণ বিবৃত হয়েছে। যেমন— ‘গোপালের পরকালের পথ’ এতে দারিদ্র্য ব্রাহ্মণরা আতপ চালের ভাত ও শাক খেতেন জানা যায়। ‘কৃপণ পিসি’, ‘গুরুর মতো চেলা’ গল্পে স্ব-পাক রান্না এবং বড়ো বড়ো মাছ বাটিতে দই রাবড়ি পুঁই শাক আছে। ‘গোপালের সন্দেশ খাওয়া’, ‘সবটাই গা চাটাচাটি ব্যাপার’ প্রভৃতি গল্পগুলি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।(Gopal Bhar)
ধর্মীয় প্রক্রিয়ায় হিন্দু সমাজে শ্রাদ্ধ বিশেষ জনপ্রিয় ও আবশ্যিক একটি ক্রিয়া। কিন্তু এই শ্রাদ্ধতে খরচের বহরকে গোপাল ব্যাঙ্গ করেছেন তীব্রভাবে। কেননা ধনীরা শ্রাদ্ধ করতেন ঘটা করে তৎকালীন সময়ে নাম কেনার জন্য এবং প্রশংসা পাওয়ার জন্য। এইরকম একটি লোক শ্রাদ্ধের পরে গোপালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন— কি ভাই গোপাল! কেমন ঘটা করে বাপের শ্রাদ্ধ করলুম দেখলে তো? গোপাল তাকে উত্তরে বলেছে, তবে কি জানেন টাকা থাকলে ভূতের বাপেরও শ্রাদ্ধ হয়। (Gopal Bhar)
“যিনি কোনোমতেই নিজের শ্রেণিকে অস্বীকার করেননি বরং তার সাম্যবাদী মানসিকতা থেকে উৎসারিত হয়েছে মানবতাবোধ। গোপাল সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন— ‘সবটাই গাঁ চাটাচাটির ব্যাপার’ গল্পে।”
গোপালের সাময়ে সমাজে মহাজনী করবার ও সুদে টাকা ধার দেওয়া এবং টাকা নেওয়া আর্থিক বিষয়টি প্রচলিত ছিল। এছাড়া দোকান ব্যবসা বিশেষত মুদি ব্যবসার বিবরণ পাওয়া যায়— ‘টাকা দেবে গৌরী সেন’, ‘গোপালের কানামাছি খেলা’ গল্পে। (Gopal Bhar)
সামাজিকভাবে তামাক সেবন, হুকা সেবন যেমন ছিল তেমনি মানুষ মানুষকে সুযোগ পেলেই মিথ্যে কথা বলে ঠকাত। চুরি-ডাকাতির বিবরণ পাওয়া যায়। গোপাল পার্শ্বস্থিত হিন্দু সমাজে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ‘শান্ত’ মতাবলম্বী ছিলেন ও তিনি শাক্ত পূজার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুসলিম সমাজ সম্পর্কে শ্রদ্ধা ছিল বিশেষ।(Gopal Bhar)
তৎকালীন বঙ্গীয় সমাজজীবনের ভয়ংকর শ্রেণি বৈষম্যের অনবদ্য চিত্র রচিত হয়েছে— ‘সবটাই গা চাটাচাটির ব্যাপার’, ‘স্বগোত্রের অন্ন’, ‘দেড় হাত মাত্র’, ‘ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়’, ‘গোপালের মুখ দেখা’, ‘আমিই তো আগে যাব’ প্রভৃতি গল্পগুলিতে অন্য গোপালকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই গল্পগুলিতে গোপাল যতটা ভাঁড় তার চাইতে অনেক বেশি শ্রেণি সচেতন গোপাল। যিনি কোনোমতেই নিজের শ্রেণিকে অস্বীকার করেননি বরং তার সাম্যবাদী মানসিকতা থেকে উৎসারিত হয়েছে মানবতাবোধ। গোপাল সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির প্রতিনিধি হয়ে উঠেছেন— ‘সবটাই গাঁ চাটাচাটির ব্যাপার’ গল্পে। এই গল্পে গোপাল শ্রেণি চেতনায় এতটাই সমৃদ্ধ ছিলেন বলেই তিনি অচ্ছ্যুত শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিলেন তাঁর শতকে। গোপাল একজন ভাঁড় তাই তাকে সম্বোধন করতে গিয়ে রাজকীয় উচ্চশ্রেণির সুরে ঝরে পড়েছে অবহেলা। এই তুচ্ছতা গোপাল নামক নিম্নবর্গীয় শ্রেণির প্রতি।(Gopal Bhar)
“গোপাল জানায় যে, একই ধরনের স্বপ্ন সেও দেখেছে তবে রাজামশাই যেখানে শেষ করেছেন গোপালের স্বপ্ন তারপরেও বেশ খানিকটা গড়িয়েছে যেটা রাজামশাইয়ের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় জন্য দেখতে পাননি।”
গোপালকে নাজেহাল করার উদ্দেশ্যে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রাজসভাতে বসে সকলের সামনেই গোপালকে ডেকে বললেন— ওহে গোপাল কাল রাতে তোমায় নিয়ে এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। …গল্পের সারমর্ম এই যে, মহারাজ স্বপ্নে বেড়াতে গিয়েছেন গোপালকে সঙ্গী করে এবং বেড়াতে বেড়াতে রাজামশাই পড়ে গিয়েছেন ক্ষীরের সরোবরে এবং গোপাল পড়ে গিয়েছিলেন গুয়ের সরোবরে এরপরই মহারাজের ঘুম ভেঙে যায়। গল্পের বিবরণে রাজাসভায় তুমুল হাসির রোল উঠল। সকলেই বলল গোপাল এবার রাজা মশাইয়ের কাছে বেশ জব্দ হয়েছে।(Gopal Bhar)
এই স্বপ্নের বিবরণে গোপাল থেমে থাকেননি সে তার শ্রেণিগত অবমাননার উত্তর দিয়েছেন জুতসই করে রাজকীয়ভাবে। গোপাল জানায় যে, একই ধরনের স্বপ্ন সেও দেখেছে তবে রাজামশাই যেখানে শেষ করেছেন গোপালের স্বপ্ন তারপরেও বেশ খানিকটা গড়িয়েছে যেটা রাজামশাইয়ের ঘুম ভেঙে যাওয়ায় জন্য দেখতে পাননি।—(Gopal Bhar)
“‘স্বগোত্রের অন্ন’ গল্পটিতে গোপাল তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন।”
‘গোপাল তখন মুখ কাঁচুমাচু করে বলল— আমি আরও দেখলাম— আপনি ক্ষীরের সরোবর থেকে উঠে পড়েছেন, তার কিছু পরে আমিও গুয়ের সরোবর থেকে উঠেছি। গায়ে চটচটে আঠালো পদার্থ লেগে থাকায়, আমরা উভয়েই অস্বস্তি বোধ করছিলাম। কিছু দূর এগিয়ে দেখলাম কোথাও জলের চিহ্ন নেই। তখন আপনি প্রস্তাব করলেন— এসো গোপাল, আমরা পরস্পরের গা চাটি।(Gopal Bhar)
তারপর?
তারপর হুজুর, সবটাই গা-চাটাচাটির ব্যাপার। আপনি আমার গা চাটতে লাগলেন। আমি আপনার গা চাটতে লাগলাম।’
‘স্বগোত্রের অন্ন’ গল্পটিতে গোপাল তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন। একদিন গোপাল ও মহারাজ একই সঙ্গে আহার করেছেন। আহার শেষে অবশিষ্ট ভাত মহারাজ কুকুরকে দিল। মহারাজের দেওয়া ভাত কুকুর খেলেও গোপালের দেওয়া ভাত খাওয়া দূরে থাক, শুঁকেও দেখল না। মহারাজ গোপালকে জব্দ করতে চেয়ে উক্তি করেন— ‘গোপাল তুমি এতই অপাংক্তেয় যে, তোমার পাতের ভাত কুকুরেরা খাওয়া দূরে থাক, শুঁকেও দেখে না পর্যন্ত! ছিঃ ছিঃ ছিঃ।’(Gopal Bhar)
“‘দেড়হাত’ গল্পে শ্রেণি সচেতন গোপাল সমাজের উচ্চশ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণির মধ্যে প্রকৃত দূরত্ব কতটা তা আমাদের জানিয়েছেন।”
মহারাজের কথা শুনে গোপাল বলল— মহারাজ এতে ছিঃ ছিঃ করার কিছু নেই। কুকুর জাত বড়োই নিষ্ঠাবান।
—তার মানে, গোপাল?
—মহারাজ ওরা স্বগোত্রের অন্ন ছাড়া, অন্য গোত্রের অন্ন স্পর্শ পর্যন্ত করে না।
‘দেড়হাত’ গল্পে শ্রেণি সচেতন গোপাল সমাজের উচ্চশ্রেণি ও নিম্ন শ্রেণির মধ্যে প্রকৃত দূরত্ব কতটা তা আমাদের জানিয়েছেন। মানসিকভাবে দাম্ভিক কৌশলী রসিক রাজা তাঁর রাজকীয় পরিচয় ও উপস্থিতি বুঝিয়ে দেবার জন্য গোপালকে রাজসভায় বললেন— কি গোপাল! আজ তোমার আসতে দেরি হল যে, কাল তোমাকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি আসতে, এত দেরি করে এলে কেন? এবার থেকে কথার অমান্য কোরো না। আমাকে সমীহ করে চলবে। তোমাতে আমাতে কত তফাৎ তা জানো?(Gopal Bhar)
“গোপালকে ঘিরে তৎকালীন সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণির অবস্থানের একটা সুন্দর চিত্র পাওয়া যায়। বিশেষত সমাজে ব্রাহ্মণদের ছিল গভীর সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব তেমনি ব্যক্তিজীবনে ছিল অত্যন্ত কূট কৌশলী দাম্ভিক অহংকারে পরিপূর্ণ নিম্ন রুচির মানসিকতায় পর্যবসিত।”
গোপাল সঙ্গে সঙ্গে নিজের আসন থেকে মহারাজের আসন মেপে চললে— খুব বেশি তফাৎ নয় হুজুর— মাত্র দেড় হাত।
‘সেদিন ভুল ভাঙল’ গল্পে নারী সম্পর্কে রসিক গোপালের ধারণা এবং মানসিকতা অতি সম্মানীয় স্বচ্ছ তবে শ্রেণি বিভাজনে উচ্চশ্রেণি কতৃক অবমাননায় নিম্ন শ্রেণির নারীরাও বাদ যান না তার প্রমাণ মেলে। —‘মহারাজ গোপালকে ঠকাবার উদ্দেশ্যে রহস্য করে বললেন— গোপাল! গোপাল তোমার স্ত্রী নাকি পরমা সুন্দরী? গোপাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলে— আজ্ঞে আমারও সেটাই ধারণা ছিল মহারাজ! কিন্তু মহারানীকে যেদিন দেখলাম, সেদিন ভুল ভাঙল। উপযুক্ত উত্তর পেয়ে মহারাজ নিরুত্তর হয়ে রইলেন।(Gopal Bhar)
গোপালকে ঘিরে তৎকালীন সমাজে ব্রাহ্মণ শ্রেণির অবস্থানের একটা সুন্দর চিত্র পাওয়া যায়। বিশেষত সমাজে ব্রাহ্মণদের ছিল গভীর সামাজিক ও ধর্মীয় প্রভাব তেমনি ব্যক্তিজীবনে ছিল অত্যন্ত কূট কৌশলী দাম্ভিক অহংকারে পরিপূর্ণ নিম্ন রুচির মানসিকতায় পর্যবসিত। গোপালের সাথে ব্রাহ্মণ শ্রেণির সম্পর্ক বেশ তিক্ত ছিল। সমাজে তৎকালীন ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবকে গোপাল তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন। গোপাল এবং ব্রাহ্মণ সম্পর্ক কেন্দ্রিক গল্প থেকে তা জানতে পারা যায়। ব্রাহ্মণদের গোপাল যে সহ্য করতে পারতেন না বেশিরভাগ সেটাই প্রমাণিত হয়েছে। যেমন— ‘আপনিও তো আমার পিছনে’ গল্পে— একদিন মন্দিরে ঢুকছে গোপাল, এমন সময় এক ব্রাহ্মণ পেছন থেকে এসে বলল, কুকুর নিয়ে মন্দিরে ঢুকছ কেন?(Gopal Bhar)
“গোপাল জানত ব্রাহ্মণের যত অহং ঐ টিকিতে তাই সে তক্কে তক্কে তার টিকি কেটে নেয়। এইভাবে প্রাথমিকভাবে তাকে জব্দ করেন গোপাল।”
গোপাল বলল— কৈ কুকুর! কোথায়?
—ঐ যে! তোমার পেছন পেছন আসছে!
—ওটা আমার কুকুর নয়।
—কিন্তু, তোমারই তো পেছন-পেছন আসছে।
—তুমিই তো আমার পেছন পেছন আসছ।
‘গোপালের ঘরে চুরি’ গল্পে মহারাজ রাজসভায় বসে বললেন এমন কেউ কি আছে যে গোপালের ঘর হতে যা কিছু চুরি করে আনে তাহলে তাকে পুরস্কৃত করবেন। কেউ রাজি না হলেও এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ রাজসভায় বসেছিল। ব্রাহ্মণ পণ্ডিত জ্ঞানী ও গুণী কেবল দারিদ্র্যদোষী তাকে লোভী করে তুলেছিল। ঐ ব্রাহ্মণ পুরস্কারের লোভে গোপালের ঘরে সিঁদ কেটে চুরি করতে ঢোকে। গোপাল জানত ব্রাহ্মণের যত অহং ঐ টিকিতে তাই সে তক্কে তক্কে তার টিকি কেটে নেয়। এইভাবে প্রাথমিকভাবে তাকে জব্দ করেন গোপাল।(Gopal Bhar)
“এমন এক সময় ছিল যখন বড়োলোকদের একজন মোসাহেব বা ভাঁড় না হলে চলত না। গোপালকে ভাঁড় হিসাবে পেতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। ভাঁড় হিসেবে গোপালের ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা ছিল।”
গোপালের সময়ে বাংলার সমাজ জীবনে জমিদার শ্রেণির ভাষণ ও ভয়ংকর প্রভাব ছিল। তারা প্রজাবৎসল হলেও তাদের অত্যাচারী রূপ ছিল পীড়াদায়ক। পাশাপাশি ছিল অদ্ভুত জীবন যাত্রা। ঐ জীবনযাত্রা দেখে প্রজারা যেমন খুশী হতেন তেমনই অখুশীও হতেন তাদের চালচলন নিয়ে প্রজাদের মধ্যে বিস্তর আলোচনা হতো। (Gopal Bhar)
এমন এক সময় ছিল যখন বড়োলোকদের একজন মোসাহেব বা ভাঁড় না হলে চলত না। গোপালকে ভাঁড় হিসাবে পেতে অনেকেই আগ্রহী ছিলেন। ভাঁড় হিসেবে গোপালের ঈর্ষনীয় জনপ্রিয়তা ছিল। স্থূল মস্তিষ্কের বড়োলোক এবং জমিদার এই ধরনের ভাঁড়দের কাছ থেকে অনেক পরামর্শ পেতেন যা তাদের অনেক উপকারে লাগত। অনেক ভাঁড় মন্ত্রীদের সমপর্যায়ভুক্ত ছিল। ভাঁড়দের মূলমন্ত্র হচ্ছে মোসাহেবী করা। একবার এক জমিদারের ভাঁড় নির্বাচন করার দায়িত্ব বর্তেছিল গোপালের উপরে তখন ভাঁড়দের মাপকাঠি হিসাবে গোপাল নিজেই ‘মোসাহেবী’ নামক কর্মটিকে ‘মূলমন্ত্র’-রূপে স্থান দেন এবং একটি যোগ্য ভাঁড় নির্বাচন করতে সক্ষম হন। গোপালের প্রশ্নটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য— কি হে, জমিদারের মোসাহেবী করতে পারবে?(Gopal Bhar)
কৃষ্ণনগরের হলধর সিংহ মস্ত বড়ো জমিদার। তিনি নিজেকে খুব চালাক চতুর এবং সবজান্তা ভাবতেন। একদিন গোপাল তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। জমিদার মশাই তাঁর স্বভাবসিদ্ধ রসিকতা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি গোপালকে কাছে ডেকে বললেন, ও হে গোপাল, কোথায় যাচ্ছ? আচ্ছা, তোমার নামই গোপাল না! কোথাও গরু চরাতে বলে তোমার ওই নাম হয়েছে? যদিও এরপরে গোপাল ওই জমিদারকে ভীষণভাবে জব্দ করেছিলেন এবং গোপালের প্রতিশোধ নেওয়া সার্থক হয়েছিল।(Gopal Bhar)
“আসলে তখনকার জমিদারদের তেল চকচকে স্থূল শরীরকে গোপাল তাঁর ব্যঙ্গ-বাক্যবাণে নামাঙ্কিত করেছেন। আসলে জমিদার শ্রেণির প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ রসালোভাবে করেছেন।”
হাতির পিঠে চেপে এক জমিদার যাচ্ছিলেন। রাস্তার দু’পাশে মানুষ দাঁড়িয়ে দেখছিল। গোপালের মায়ের প্রশ্নের উত্তরে গোপাল বলেন কোন হাতি দেখব! আসলে তখনকার জমিদারদের তেল চকচকে স্থূল শরীরকে গোপাল তাঁর ব্যঙ্গ-বাক্যবাণে নামাঙ্কিত করেছেন। আসলে জমিদার শ্রেণির প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ রসালোভাবে করেছেন।(Gopal Bhar)
গোপালের সময়ে সমাজে নারীর অবস্থানের খণ্ডচিত্র পাওয়া যায় গোপালকে ঘিরে। ‘গুরুদেবের মুখটা চেলভার’ গল্পে গরিব চাষির বউ তার ভক্তি এবং আতিথ্য তার গুরুর প্রতি যেভাবে দেখিয়েছেন তা গুরু উপলব্ধি করতে না পারায় তাই সে চাষিকে নালিশ করে এবং চাষি তার গুরুর কথা শুনে নিজের বউকে পেটাতে থাকে। নারীদের গঙ্গা স্নান ছিল আত্মিকভাবে বড়োই পবিত্র প্রক্রিয়া। গোপালের স্ত্রী অথবা মহারাজের মহারানি এরা গঙ্গাস্নান করতেন তাঁর বিবরণ পাওয়া যায়। নব বধূদের সৌন্দর্য তাদের সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতা অতি শিক্ষণীয়।(Gopal Bhar)
গোপাল সর্বহারা-রিক্ত-দৈন্য-নিপীড়িত নামহারা মানুষদের জন্য কথা বলেছেন। ভয়ংকর তাঁর বাস্তববোধ। লোকায়ত ভাষায় জীবনকে উপস্থাপন করার কলা-কুশলী জাদু একমাত্র জানতেন গোপাল। তাঁর মোহময়ী আকর্ষণে তিনি জীবনভোর বহু মানুষকে টেনে নিয়ে গিয়েছেন সময় এবং যুগের বিপরীতে। স্বচ্ছ-সরল ছোটো ছোটো বাক্যের কি দূর্বার গতি! যা প্রবাহিত হয়েছে বিবেকের ও চেতনার ঝরনাধারায়। আশ্চর্য প্রসাদগুণমণ্ডিত বাক্যে দেশজ আঞ্চলিক কথ্যশব্দ ধারা গোপালকে রসিক করে তুলেছে, দিয়েছে অন্যমাত্রা। গোপাল কখনও ব্যবহার করেছেন উপমা-প্রবাদ, কুশলী বাক্যবন্ধন কথার মারপ্যাঁচ ও কুহকীয় সম্ভার। জীবনে সত্যতার দলিল লিখেছেন গোপাল।(Gopal Bhar)
আরও পড়ুন: আমি আর লীনা হেঁটে চলেছি পত্রিকার, নভেম্বর ২০২১ সংখ্যার সম্পাদকীয়
স্পর্ধা দেখিয়ে গিয়েছেন গোপাল সমাজের সকল মন্দ বিষয় ও মন্দ মানুষ, অহংসর্বস্ব মানুষ এবং ধর্মীয় কুসংস্কার প্রভৃতির প্রতি। সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাননি গোপাল যে, সমাজের যে মহারথীই হন না কেন। জীবনকে নিরীক্ষণ করার অভিনব পদ্ধতির গুণেই এবং আশ্চর্যরকম দক্ষতায় তিনি বঙ্গীয় সমাজে তাঁর অবস্থান প্রথম সারিতে নিয়ে গিয়েছেন। যারা উচ্চস্বরে গর্বভরে নিজেদের ব্যক্তিসুখের বিলাসেই মশগুল থেকে লম্ফঝম্ফ করে চলেছে; তাদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন একটানে। গোপালের প্রখর জীবন-সংবেদীতায় চিত্রিত হয়ে ওঠা ঐ জীর্ণ-ক্লিন্ন প্রান্তিক জীবনের করুণ সব জ্বলন্ত ছবি গোপালকে ঘিরে উদ্ভাসিত হয়েছে।(Gopal Bhar)
গোপাল শুধু বঙ্গীয় জীবন নয় তথা ভারতীয় জীবনে তিনি একমাত্র যতটা ভাঁড়— তার চাইতে অনেক বেশি প্রতিবাদ-জাগ্রত বিবেক তদানীন্তন সমাজ ও যুগের সময় পেরিয়ে বর্তমানেও তিনি সদা জাগরুক রয়েছেন আমাদের হৃদয়ে।(Gopal Bhar)
(বানান অপরিবর্তিত)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।