কথা ছিল জার্মানিতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাবেন। দেশ ছাড়বার আগে বেড়াতে গেলেন শান্তিনিকেতনে। ব্যাস, জীবনের মোড় ঘুরে গেল। আকৃষ্ট হলেন শান্তিনিকেতন আর রবীন্দ্রনাথে। সালটা ছিল ১৯৬১। রবীন্দ্রজন্মশতর্ষ। বাতিল হল জার্মানি যাত্রা। এরপরে যখন শান্তিনিকেতন গেলেন, তখন থেকে রাঙামাটির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে উঠলেন। সেখানেই থাকলেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। রবীন্দ্রসংগীত জগতের অন্যতম বিশিষ্ট মানুষ ছিলেন। ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীতভবনের অধ্যক্ষ। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে শুনেছি গোরা সর্বাধিকারী ছিলেন একজন অসম্ভব ধৈর্যশীল মাস্টারমশাই। ১৯৬৫ সালে তাঁর যোগাযোগ হয় রবিগানের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। এরপর থেকে গোরা সর্বাধিকারী তাঁর প্রিয় মোহরদির সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন। কথা ছিল কল-কবজা নিয়ে কাজ করার। শুরু করলেন সুরের চর্চা।
গানের পাশাপাশি গোরাদার আরও একটা জগত ছিল, সেটা আধ্যাত্মিকতার। অ্যান্ড্রুজ পল্লির অদূরে সাধুবাবার আশ্রমে ছিল যাতায়াত। অবসর সময়ে আধ্যাত্মিক বই পড়ে সময় কাটত। বাইরে থেকে তাঁর চেহারা দেখে হয়তো অনেকেই ভাবতেন মানুষটা দাম্ভিক। কিন্তু তাঁর অন্তরটা ছিল একদমই অন্যরকম। খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন। গুরুগম্ভীর মানুষটা কবে যে আমার প্রাণের গোরাদা হয়ে উঠলেন, বুঝতে পারিনি। একটা সময় ছিল যখন দক্ষিণ ভারত, উত্তরবঙ্গ, সিকিম, কেরালা সহ বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতে গেলে গোরাদা ছিলেন আমাদের সবসময়ের সঙ্গী। তাঁর সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামি সবকিছুই চলত অনায়াসে। কোথাও ঘুরতে গেলে সেখানকার স্থানীয় খাবারের খোঁজে হাঁটতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যতক্ষণ না পেতেন, ক্লান্ত হতেন না। গোরাদা মানেই জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া আর নানা বিষয় নিয়ে গল্প, যার মধ্যে প্রধান ছিল ভুতের গল্প, যেগুলো শুনে পাশের ঘরে যেতে গা ছমছম করত। ভীষণ ভালোবাসতেন ফুটবল এবং ক্রিকেট। তাঁর গল্প কখনও গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত না। গোরাদাকে কেন্দ্র করে কত যে মজার সব ঘটনা, তা বলে শেষ করা যাবে না তাও তার মধ্যে কয়েকটি বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

একবার গোরাদার সঙ্গে দক্ষিণ ভারত থেকে ফিরছি। ট্রেনে আমাদের নির্ধারিত কামরায় শুয়ে আছি। মাঝরাত থেকে শুরু হল ছারপোকার উপদ্রব। তৎক্ষণাৎ গোরাদা বললেন ট্রেন কন্ডাকটর বা টিকিট পরীক্ষককে জানাতে। আধো ঘুমন্ত-আধো জাগ্রত অবস্থায় ভুলে গিয়েছিলাম ছারপোকার ইংরেজি নাম, কারণ দক্ষিণ ভারতীয় টিকিট পরীক্ষকের কাছে ছারপোকার নামে অভিযোগ জানাতে গেলে তিনি বিন্দু-বির্সগও বুঝতে পারবেন না। গোরাদা ছারপোকার ইংরেজি নাম নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করলেন। পেরিযে যেতে থাকল একটা পর একটা স্টেশন। এরকম করে খানচারেক স্টেশন পেরিয়ে যাবার পরে গোরাদা এক সময় হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে টিকিট চেকারের কাছে গিয়ে বললেন বাগস-এর প্রবলেমে আমরা ঘুমোতে পারছিনা তাই জায়গা পরিবর্তন করে দিলে ভালো হয়। গোরাদার মুখে তখন যুদ্ধজয়ের হাসি।

আর একবার বিজয়ওয়াড়া স্টেশনে ট্রেন পাল্টানোর জন্য আমাদের থাকতে হয়েছিল বেশকিছু সময়। আমাদের সঙ্গে সেই যাত্রায় ছিলেন পূর্ণদাস বাউল। রিটায়ারিং রুমের ঘরে মধ্যহ্নভোজনের পরে একটু বিশ্রামের উদ্দেশ্যে শোওয়ার পরে আমাদের দু’জনের মাঝে পূর্ণদাকে আমি এবং গোরাদা পাশবালিসের সম্মান দিয়ে দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লাম। সেদিন পূর্ণদা আমাদের মাঝখান থেকে কখন কীভাবে উঠে পরের ট্রেন ধরার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন, তা আজ আর মনে নেই।
গোরাদার কাছে শোনা কয়েকটা গল্পের থেকে এবার বলি। সত্যজিৎ রায় তাঁর ছবি ‘আগন্তুক’-এর শুটিংয়ে গেছেন শান্তিনিকেতন। যাঁরা ছবিটা দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে সেই দৃশ্যের কথা যেখানে ভাগনি অনিলা তাঁর মামা মনমোহনের অভিমান ভাঙাতে শান্তিনিকেতনের অদূরের সাঁওতাল গ্রাম বনেরপুকুরে গিয়ে তাঁর অনুতাপের কথা জানাবেন। একদিন সেই দৃশ্যের প্রসঙ্গ তুলে সত্যজিৎ স্বয়ং গোরাদাকে ডেকে বলেছিলেন ওই বিশেষ দৃশ্যের জন্য একটা কোনও রবীন্দ্রসংগীতের কথা ভাবতে। গোরাদা অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঠিক করেছিলেন, ‘কার মিলন চাও বিরহী’ গানটি। যখন সত্যজিৎ রায়কে তিনি সে কথা বলেন, তখন রায়মশাই বলেছিলেন যে তিনি প্রথমে গানের কথা ভাবলেও সেই চিন্তা থেকে সরে এসেছেন কারণ তাঁর মনে হয়েছে ওই দৃশ্য যখন ছবির দর্শকেরা দেখবেন তখন তাঁদের ভেতরে একটা টানটান উত্তেজনা, মানে কী হয় কী হয় ভাব থাকবে, কিন্তু এরই মাঝে যদি গান থাকে তাহলে দৃশ্য থেকে দর্শকের মনোযোগ সরে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকবে।

আর একটা ঘটনার কথা গোরাদা প্রায়ই বলতেন, সেটা হল হরিদ্বারের গঙ্গাতীরে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর স্বামী বিশ্বভারতীর প্রাক্তন গ্রন্থাগারিক বীরেনদার সঙ্গে বসে দিলীপকুমার রায়ের কণ্ঠে ‘সেই বৃন্দাবনের লীলা অভিরাম সবই, আজও পড়ে মনে মোর, পড়ে কী কেবলই মনে’ গানটি শোনার অভিজ্ঞতা। অন্যদিকে ময়রা স্ট্রিটে উত্তমকুমারের বাড়িতে গান শেখাতে যাওযার কথা শুনে রোমাঞ্চ অনুভব করতাম। গোরাদা অনেক গানই গেয়েছেন কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তাঁর গলায় ‘চিরসখা, ছেড়ো না’, গানটি খুব ভালো লাগত।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘কালমৃগয়া’ নৃত্যনাট্যে গোরাদা-র গানের রেকর্ড আজও শুনি। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে ‘বাজাও তুমি কবি’ গানটিও আমার বড় প্রিয়। তাঁর গলা হয়তো ব্যারিটোন ছিল না, কিন্তু এমন একটা বিশেষত্ব ছিল যে রবীন্দ্রসংগীতের প্রাণ প্রকাশ পেত তাঁর কণ্ঠে। এবার বলব গোরাদার সঙ্গে ভূত দেখার বা ভৌতিক পরিবেশে কাটানোর মতো একটা ঘটনা।
ব্যাঙ্গালোরের উপকণ্ঠে হোয়াইটফিল্ড নামক জায়গায় সত্য সাঁইবাবার আশ্রমের অদূরে একটা হোটেলে আমরা রাতের জন্য আশ্রয় নিয়েছিলাম। পরেরদিন যশবন্তপুর রেল স্টেশন থেকে কলকাতায় ফেরার ট্রেন। যাইহোক, হোটেলে ওঠার বেশ কিছুক্ষণ পরে উপলব্ধী করলাম যে ওই হোটেলে আমরা কয়েকজন ছাড়া আর কোনও বোর্ডার নেই। একটা ঘরে আমি এবং আমার পরিবার আর অন্য ঘরে গোরাদা আর তাঁর এক মাসি। প্রথম রাত থেকেই একটা উদ্ভট শব্দ শুরু হল। প্রথমে খুব একটা পাত্তা না দিলেও পরে কিন্তু ওই শব্দটা আমাদের বেশ ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। কিছুক্ষণ পরে আমাদের দরজায় টোকা, প্রথমটা ভয় পেলেও গোরাদার গলার শব্দ পেয়ে দরজা খুলে দেখি তিনি দাঁড়িয়ে। মুখ গম্ভীর। আমাকে জিজ্ঞেসা করলেন শব্দটা শুনেছি কিনা? সহমত হওয়াতে দুজনে হোটেলের বিভিন্ন তলায় ঘুরে এলাম। তারপর শব্দটা উৎসস্থল আবিষ্কার করলাম ছাদ। কেউ যেন ভারী বুটজুতো পরে হেঁটে বেড়াচ্ছে।

ছাদে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে আর সাহস হল না। ভূতের ভয় পাই বলে আমার আবার একটা সুনাম রয়েছে। সেটা গোরাদাও জানতেন। তাই আর কথা না-বাড়িয়ে নিজের ঘর থেকে মাসিকে ডেকে তুলে আমাদের ঘরে শুতে বললেন যাতে ভূতের আক্রমণে আমাদের ম্যানপাওয়ারে টান না পড়ে। তারপর অন্য ঘরে একলাই রাতটা কাটিয়ে দিলেন। সেই শব্দ-রহস্যের সমাধান পরেও আমরা করতে পারিনি।
গোরাদার সম্পর্কে এত গল্প রয়েছে যে অনায়াসেই একটা চটি বই লিখে ফেলা যায়। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন, তাঁদেরই এইরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে মনে করি। একদম শেষ অধ্যায় অসুস্থতা এবং আরও কিছু ব্যক্তিগত কারণে আর দেখা হয়নি কিন্তু মনের অগোচরে যে গোরাদা ছিলেন, সেটা এখন বেশ উপলব্ধি করতে পারছি। একটা মজার ঘটনা বলে শেষ করব। কথাটা প্রদীপদার (প্রদীপ ঘোষ) কাছে শোনা। উনি ছিলেন গোরাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একবার গোরাদার শখ হয়েছিল শান্তিনিকেতনের বাড়ির বাগানে একটা ঘোড়া পুষবেন। ঘোড়া এসেওছিল, কিন্তু বেঁকে বসলেন মোহরদি। বললেন হয় ঘোড়া থাকবে, না হয় গোরা থাকবে। শেষ পর্যন্ত গোরাদাই থেকে গেলেন আর ঘোড়াই বিদায় নিল।
গোরাদা ছিলেন অনেকদিন আমাদের মধ্যে কিন্তু একদম শেষে কিছুটা যেন নিভৃতাবাসে। এবার বছর শুরুর কয়েকদিন পরেই শীতের সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের মাটিতেই মিশে গেলেন গোরাদা। কারণ এই যাত্রায় তো অন্যদের সঙ্গ দেওয়ার অনুমতি নেই। যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা গোরাদা…।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, আনন্দবাজার পত্রিকা, Youtube, Facebook
অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।
One Response
খুব ভালো লাগলো