(Gour Kishore Ghosh) সময়টা সত্তরের দশক। প্রেসিডেন্সি জেল থেকে একটি পোস্টকার্ড এলো, প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক তপন সিংহের কাছে। তাতে লেখা “ভালো আছি, কিন্তু রাতে একটু কষ্ট পেতে হয়, উত্তর দিকে একটি মাত্র জানালা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আসে।” অরুন্ধতী অর্থাৎ তপন সিংহের স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে আলমারি থেকে একটা কম্বল বের করে দিলেন। স্বামীকে অনুরোধ করলেন নিজে গিয়ে দিয়ে আসার জন্য। তপন সিংহ প্রেসিডেন্সি জেলে কম্বলটি পৌঁছে দিতে এলেন।
“কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন?” জিজ্ঞেস করলেন কর্তব্যরত জেলার। তপন সিংহ বললেন “সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ।” নাম শুনে জেলর নিজে কম্বল পৌঁছে দিলেন বন্দীর কাছে। সেই কর্তব্যরত পুলিশকে তপন সিংহ জিজ্ঞেস করলেন “কেমন আছেন গৌরকিশোর?”। উত্তর এলো “জমিয়ে আছেন।” এমনই সাহসী, সংগ্রামী, মানবদরদী অথচ জীবনীশক্তিতে ভরপুর সাংবাদিক ছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ।
১৯২৩ সালের ২০শে জুন, গৌরকিশোর ঘোষের জন্ম। শৈশবের অল্প সময় বাংলাদেশের যশোরে কেটেছিল। তারপর পরিবারসমেত নবদ্বীপে চলে আসেন। বাবা স্বর্ণপদপ্রাপ্ত হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক গিরিজাভূষণ ঘোষ ছিলেন নবদ্বীপের ডাক্তার। ডাক্তার হিসাবে সুনাম, পসার দুই-ই ছিল। ছিল না শুধু অর্থ। গরিব রোগীরা পয়সা দিতে পারতেন না। ছোট থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়তে হয়েছে গৌরকিশোরকে।
মা ছিলেন অবস্থাপন্ন দেওয়ান বাড়ির মেয়ে। কিন্তু প্রখর আত্মসম্মানবোধ ছিল তাঁর। কখনও বড়লোক পিত্রালয়ের সাহায্য নেননি। আঠারো বছর বয়স থেকেই গৌরকিশোরকে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। আদর্শবাদিতা, সাহস আর মাথা না নোয়ানোর প্রাথমিক শিক্ষা পেয়েছিলেন মায়ের থেকেই।
ভিডিও: উলগুলানের বিরসা – জন্মদিনে শ্রদ্ধার্ঘ্য
১৯৫৩ সালে তাঁর সাংবাদিকতায় আসা। তবে এর আগে নানা কাজ করেছেন। কখনও জাহাজের খালাসি, কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, হোটেলের বেয়ারা কখনও বা শিক্ষকতা। সীমান্তে শুল্ক আদায় অফিসে কেরানির কাজ থেকে অবশেষে আসেন সাংবাদিকতায়। বুঝেছিলেন এটাই তাঁর পথ। সাংবাদিকতা আর গৌরকিশোর ঘোষ অবিচ্ছেদ্য হয়ে ওঠে। সত্যযুগ কাগজে হাতে খড়ি, সেখান থেকে আনন্দবাজারে কাজ শুরু করেন।
সাহসী, বলিষ্ঠ কলমের অধিকারী ছিলেন। আবার সেই কলমে থাকত মজার খোরাকও। সাংবাদিকতার সূত্রেই পাড়ি দিয়েছিলেন দুর্গম পথ। ১৯৬০ সাল তখন, দুই কন্যা ও সন্তানকে স্ত্রী ও মায়ের ভরসায় রেখে নন্দাঘুন্টি অভিযানে যান। সেই দুর্গম পথ ভ্রমণের কাহিনি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজারে। (Gour Kishore Ghosh)
স্ত্রী শীলা ঘোষ, প্রকৃত অর্থেই তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন। স্বামীর লড়াইয়ে সবসময় পাশে থেকেছেন। বাড়ির অমতে বিয়ে করেছিলেন। বন্ধু অরুণ কুমার সরকারের বাড়িতে বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হয়। ধার্য করা হয়েছিল প্রবেশ মূল্য। ঠিক হয়েছিল, যাঁরা আসবেন তাঁরা টিকিট কাটবেন এবং খাবেন। রাজশেখর বসু ১০ টাকা পাঠিয়েছিলেন টিকিটের মূল্য হিসেবে। বন্ধুদের উৎসাহে এবং সক্রিয়তায় এক যুগান্তকারী বিয়ে হয়েছিল। (Gour Kishore Ghosh)
ভিডিও: জনগণের কবি – জন্মদিনে কাইফি আজমি
সৎ, সাহসী এবং মানবদরদী এই সাংবাদিক বিরোধিতা করেছিলেন জরুরি অবস্থার। মত প্রকাশের অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদ করেন। জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে “গণতন্ত্রের মৃত্যু” আখ্যা দিয়ে মাথা কামিয়ে অশৌচ পালন করেছিলেন তিনি। (Gour Kishore Ghosh)
১৯৭৫ সালে ঠিক পুজোর আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁকে। জেলে প্রথম দিকে সাধারণ কয়েদীর মতো রাখা হলেও পরে মামলা করে রাজবন্দীর মর্যাদা আদায় করেন তিনি। (Gour Kishore Ghosh)
সাংবাদিক গৌর কিশোর ঘোষ ‘রূপদর্শী’ ছদ্মনামে অজস্র সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। সাংবাদিক হিসেবে তাঁর প্রখর অন্তর্দৃষ্টি ফুটে উঠেছে এইসব লেখায়। নিজেই বলতেন “দিন-রাত্তির সতর্ক চোখে ঘুরেছি, যা দেখেছি, যেটা ভালো লেগেছে, তুলে ধরেছি।” আনন্দবাজার পত্রিকার ক্রীড়া সাংবাদিক ব্রজনাথ রায়ের গুল গল্প নিয়ে গৌরকিশোর ঘোষের অনবদ্য সৃষ্টি ব্রজদার গুল্পসমগ্র। জীবনের ঝাঁকিদর্শনই ফুটিয়ে তুলেছে তাঁর কলম। (Gour Kishore Ghosh)
অনেক তরুণ সাংবাদিকের কাছে তিনি ছিলেন আদর্শ। রাজনৈতিক বিশ্বাসে ছিলেন হিউম্যানিস্ট অর্থাৎ মানবতাবাদী। সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। ১৯৭০ সালে আনন্দ পুরস্কার পান। ১৯৮১ সালে পেয়েছিলেন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। ৭৭ বছর বয়সে ২০০০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর এই আপোসহীন, মানবদরদী, সংগ্রামী সাংবাদিকের জীবনাবসান হয়। ‘বন্দে মানবম’, আজীবন এই মন্ত্রেই বিশ্বাস করেছেন। তাঁর জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Gour Kishore Ghosh)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।