কল্যাণী থেকে ঈশ্বর গুপ্ত সেতু দিয়ে গঙ্গা পেরনো মাত্রই বাঁ দিকে তাকালে চোখে পড়ে আকাশপটে উঁকি দিচ্ছে কতগুলো অদ্ভুত দর্শন গম্বুজাকৃতি চুড়ো। সামনের রাস্তার মোড় থেকে গলিঘুঁজির মধ্যে দিয়ে পাক খেতে খেতে এক মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় একাধিক অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি খিলানযুক্ত এক সেকেলে রাজবাড়ির দোতলা তোরণ দ্বারের সামনে। দেওয়ালের গা থেকে খসে পড়েছে মলিন পলেস্তারা, ওপরের নহবতখানায় শেষ কবে সানাই বেজেছে কারুর মনে পড়েনা। সেখানে এখন শুধু গতজন্মের ঝুল আর ধুলোর পরত। ফটকের ওপারে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মুখে ঝুলে থাকা মালিন্যের মত দাঁড়িয়ে আছে বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ির পেল্লায় কাঠামোটা। আর রাজবাড়ি কমপ্লেক্সের বাইরে ঠিক ডানদিকের ফ্রেমে জুড়ে যেন কোনও ভিনদেশী কেল্লার মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঁশবেড়িয়ার হংসেশ্বরী মন্দির। অসংখ্য মোচাকৃতি চুড়ো-বিশিষ্ট এই মন্দিরের দিকে তাকিয়ে আপনার যদি হঠাৎ ডিজনিল্যান্ড বা ক্রেমলিন দুর্গের কথা মনে পড়ে যায় তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই মন্দিরের গঠনশৈলী যতটা না অদ্ভুত, তার চেয়েও অদ্ভুত এই গঠনশৈলীর কল্পনার পেছনের গল্পটা।
বাঁশবেড়িয়ার রাজা নৃসিংহদেব ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ পণ্ডিত মানুষ। ১৭৯০ সাল নাগাদ তিনি কাশী গিয়ে সেখানকার বহু সাধক ও পণ্ডিতের সঙ্গ লাভ করে তন্ত্রশাস্ত্র ও তান্ত্রিক যোগসাধনায় বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন। কয়েক বছর পর বাঁশবেড়িয়ায় ফিরে আসার পর তিনি বৈষয়িক ও জমিদারি সংক্রান্ত কাজকর্মে উদ্যম হারিয়ে ফেলেন এবং নিজের বাসভবনের কাছে একটা মন্দির নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই মন্দির আর পাঁচটা সাধারণ মন্দিরের মত হবে না। এর গঠনশৈলীতে থাকবে রাজা নৃসিংহদেবের গূঢ় তান্ত্রিক বীক্ষার অভিজ্ঞান। তন্ত্রভিত্তিক যৌগিক সাধনায় মানবদেহের ভেতরে বিভিন্ন স্থানে পাঁচটা প্রধান নাড়ি (ঈড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না, বজ্রাক্ষ ও চিত্রিণী) এবং তেরোটা চক্র (মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, সহস্রার ইত্যাদি) কল্পনা করা হয়ে থাকে। এই সমস্ত নাড়ি ও চক্রকে গূঢ় যৌগিক পদ্ধতিতে জাগিয়ে তোলা ও চলাচলের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর লাভ অর্থাৎ সিদ্ধি লাভের পথ প্রশস্ত হয় বলে বিশ্বাস। রাজা নৃসিংহদেব তান্ত্রিক কুলকুণ্ডলিনীর ধারণাকে মন্দিরের গঠনশৈলীতে শৈল্পিকরূপে ভাস্বর করে তোলার দুঃসাহসিক সংকল্প গ্রহণ করলেন। সেই মত রাজস্থান থেকে নিয়ে আসা হ’ল মন্দিরনির্মাণ শিল্পীদের। উত্তরপ্রদেশের চুনার থেকে নিয়ে আসা হ’ল উৎকৃষ্ট বেলেপাথর। প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয়ে তৈরি হল এমন এক মন্দির যে স্থাপত্য ভূভারতে বিরল। তবে দুঃখের কথা, রাজা নৃসিংহদেবের জীবদ্দশায় তাঁর এই স্বপ্নের মন্দির সম্পূর্ণ করা যায়নি। তিনি মারা যাওয়ার পর অর্থাভাবে বেশ কিছুদিন মন্দির নির্মাণ কাজ বন্ধ ছিল। পরে তাঁর স্ত্রী রাণি শঙ্করীদেবী স্বামীর অসম্পূর্ণ কাজ সমাধা করেন এবং ১৮১৪ সালে এই মন্দির সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।
সত্তর ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পাঁচ তকা হংসেশ্বরী মন্দিরে তেরোটা মোচাকৃতি শিখর বা রত্ন রয়েছে। কিন্তু সাধারণ রত্ন মন্দিরে যেমন ছাদের প্রতি কোণে একটা করে রত্ন বা শিখর থাকে এই মন্দিরের ক্ষেত্রে তেমনটা নয়। এই মন্দিরের আট কোণে আটটা, মাঝখানে চারটে এবং কেন্দ্রস্থলে একটা শিখর রয়েছে যা কুলকুণ্ডলিনীর এক একটা চক্রকে চিহ্নিত করে। আর প্রতিটি তল থেকে খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে এবং গর্ভগৃহ থেকে চুড়ো পর্যন্ত গোটা মন্দিরটাই ভিতরে ভিতরে অসংখ্য গোপন সিঁড়ি ও সংযোগপথ দিয়ে যুক্ত। ফলে মন্দিরের ভিতরটা আসলে এক গোলকধাঁধার মত যেখানে একবার ঢুকে পড়লে সঠিক পথ সন্ধান করে বেরিয়ে আসা মুশকিল। অর্থাৎ গুরু যদি পথ বাতলে না দেন তাহলে ষটচক্রভেদ করে এই যৌগিক গোলকধাঁধা থেকে মোক্ষের প্রকৃত পথ বের করা অসম্ভব। মন্দিরের ঠিক কেন্দ্রীয় শিখরের নিচের তলার এক গোপন প্রকোষ্ঠে শ্বেতপাথরের সদাশিব উপবিষ্ট রয়েছেন। যদিও এই প্রাচীন স্থাপত্যকে রক্ষা করার তাগিদে আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার তত্ত্বাবধানে বর্তমানে মন্দিরের উপরিতলে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবে মন্দিরের চারিদিকের ইট বাঁধানো চত্বর সর্বসাধারণের জন্য খোলা।
মন্দিরের একতলার প্রধান গর্ভগৃহে অধিষ্ঠাত্রী দেবী হংসেশ্বরী সম্পর্কে দু-একটা কথা বলা প্রয়োজন। তন্ত্রশাস্ত্রে বলা হয়, মানুষের নিঃশ্বাসের সময় ‘হং’ শব্দ এবং প্রশ্বাসের সময় ‘সঃ’ শব্দ দুটি ক্রমাগত নির্গত হয়। এর নাম হংস মন্ত্র বা অজপা মন্ত্র। এই মন্ত্র আলাদা করে উচ্চারণ করতে হয়না, মানুষের জীবদ্দশায় নিজে থেকেই ক্রমাগত উচ্চারিত হতে থাকে। তাই ‘হংস’ স্বয়ং মহাশক্তি কুলকুণ্ডলিনী ভগবতী। আর সেই মন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন হংসেশ্বরী মাতা, যিনি প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ে সর্বদা অধিষ্ঠান করেন। আর সে কারণেই হংসেশ্বরী মন্দিরের গর্ভগৃহে দেখা যায় সহস্রদল নীল পদ্মের উপর শায়িত মহাকালের হৃদয় থেকে উত্থিত দ্বাদশদল পদ্মের উপর এক পা মুড়ে অবস্থান করছেন দেবী হংসেশ্বরী। দেবীর গাত্রবর্ণ নীল, বামহাতে খড়গ ও নরমুন্ড, এবং ডানহাতে অভয়মুদ্রা ও শঙ্খ। দেবীর প্রধান বাৎসরিক পুজো হয় কার্ত্তিক অমাবস্যায় দীপান্বিতা তিথিতে। বছরে ৩৬৪ দিন দেবীর শান্ত মূর্তি, কেবল বাৎসরিক পুজোর দিন রাতে এলোকেশী উগ্র মূর্তি। ওই দিন রাতে দেবীকে পরিয়ে দেওয়া হয় রূপোর মুখোশ ও সোনার জিভ।
হংসেশ্বরী মন্দিরের ঠিক পাশেই রয়েছে অনন্ত বাসুদেব মন্দির, যা রাজা নৃসিংহদেবের পিতা রাজা রামেশ্বর রায় ১৬৭৯ সালে নির্মাণ করান। চারচালা কাঠামোর উপর একরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরের গায়ের পোড়ামাটির কারুকাজ আজও সাধারণ দর্শকের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। আর শুধু সাধারণ দর্শকই নয়, শোনা যায় রবীন্দ্রনাথ এই মন্দির দর্শন করতে এসে মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার কাজ দেখে এতই বিমোহিত হয়েছিলেন যে তিনি শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়ে তাঁর প্রিয় ছাত্র নন্দলাল বসুকে এখানে পাঠান এবং নন্দলাল প্রায় এক মাস এখানে থেকে সমস্ত টেরাকোটার কাজের সহস্তে ছবি এঁকে নিয়ে যান। এই সমস্ত টেরাকোটার কাজগুলির মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবী ও পৌরাণিক কাহিনীর শৈল্পিক প্রকাশ লক্ষ করা যায়। যদিও কালের নিয়মে বেশ কিছু টেরাকোটা প্যানেল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ও ধ্বংস হয়ে গেছে, তবু যা অবশিষ্ট রয়েছে তাকে পোড়ামাটি নির্মিত মহাকাব্য বললে অত্যুক্তি হয়না।
এই মন্দির সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২:৩০টা এবং বিকেল ৪টে থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। মন্দিরের কাছে খাবারের সুবন্দোবস্ত নেই তবে কেউ মন্দিরের ভোগ প্রসাদ দিয়ে মধ্যাহ্নভোজ সারতে চাইলে সকাল ১০:৩০-এর মধ্যে পৌঁছে ৪০/- টাকার কুপন কিনে খেতে পারেন।
হুগলির চুঁচুড়ার বাসিন্দা শঙ্খশুভ্র ইতিহাসের খোঁজ করতে ভালোবাসেন। হুগলি জেলার ইতিহাসের চর্চা এবং সেখানকার স্থাপত্যের সংরক্ষণের কাজে তিনি যুক্ত। বিভিন্ন সংস্থার হয়ে প্রচারমূলক শর্ট ফিল্ম তৈরি করা শঙ্খর পেশা।
One Response
হংসেশ্বরী মন্দিরে ফটোগ্রাফি করা যায়?