আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪]
অনেকক্ষণ ধরে সাম্পানের ছাদে সময় কাটানোর পর নীচে নেমে এলাম। লোহার ফ্রেমের খোলা জানালা থেকে হাওরের জলের ঢেউ হাত-ছোঁয়া দূরত্বে চলে এল। তন্ময় হয়ে দেখছি। মাঝে মাঝে কিছু যাত্রী-নৌকা দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে। খানিক পর বেশ কয়েকটি গ্রাম এল। উঁচু থেকে দেখলে জীবনের অনেক দৃশ্যপট চোখের আড়ালেই থেকে যায়। দৃষ্টি অন্তর্ভেদী হয়ে ওঠে মাটির কাছাকাছি নেমে এলে। এক্ষেত্রেও ঠিক এমনই হল। ওঁদের সংসারের ইতিবৃত্ত চোখে ধরা পড়ছে। ঘরের ভিতর কাদা মাখামাখি সংসার। ইঁট দিয়ে যাবতীয় গেরস্থালির জিনিসপত্র উঁচুতে রাখা হয়েছে। বালির বস্তা দিয়ে সাময়িক বাঁধ বানানোয় পুরুষেরা ব্যস্ত। মন খারাপ হয়। ইচ্ছে করে ওঁদের সঙ্গে হাত লাগাই। বিশ্ব নাগরিক হিসেবে ভেসে যাওয়া সংসারকে পোক্ত গিঁটে বাঁধবার দায়িত্ব তো আমারও। — ভাই, টাওয়ার আইতাসে। সঙ্গে জ্যাকেট আনসেন না? পইরা ন্যান। মিজানের কথা শেষ হতেই বরুণ ও করচের গাছ দেখতে পেলাম। সব গাছগুলি জড়াজড়ি করে জলের ওপর জঙ্গলমহল তৈরি করেছে। এমন দৃশ্য ছবিতে অনেকবার দেখেছি। আজ টাঙ্গুয়ার হাওরের এই বিশেষ জায়গায় পৌঁছে সেই স্বপ্ন পূরণ হল। — হ্যাঁ ভাই, যাচ্ছি। একটু সময় দাও।— আসেন আসেন। জলদি আসেন। আমাকে তাড়া দিয়ে মিজান ভাই সাম্পানের ছাদে চলে যায়। কিন্তু আমার ইচ্ছে করে না। আকাশের মেঘ আমার মনের গহীনে কালো ছায়া ফেলেছে। মানুষের ঘর বাড়ি ভাসিয়ে দেওয়া জলে নিজেকে আনন্দে ভাসাতে রাজি নই। অথচ কলকাতা থেকে নতুন লাইফ জ্যাকেট নিয়ে এসেছিলাম মাথায় ক্যামেরা বেঁধে জলের নীচে ডুব দেব বলে। অতল জলের নীচে যে সংসার বাস করে সে যে এখন চোখের সামনে।

আমার জীবন এমনই অদ্ভুত। প্রাপ্তির আনন্দ চূড়ান্ত মুহূর্তে পৌঁছলে আমি উদাসীন হয়ে যাই। বারবার কেন এমনটি হয় আমার সঙ্গে? জানা নেই, আর এইসব ভাবনার সময়ও এখন নয়। আগামী কিছু মিনিটে আমাকে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি পাখির চোখে দেখে নিতে হবে। অতএব নিজের শরীরটাকে টানতে টানতে নিয়ে হাজির করালাম সাম্পান লাগোয়া ওয়াচ টাওয়ারের প্রথম সিঁড়িতে। প্রায় চারতলা উঁচু থেকে টাঙ্গুয়ার হাওরকে দেখছি। মনে হচ্ছে আকাশ জলের সীমানা ছুঁয়ে ডুব মেরেছে। জলের রং পুরোপুরি গৈরিক। আমাদের বোট ছাড়াও আরও দু’টি বোট ভিড়েছে। মহিলা পর্যটক চোখে পড়ল না। পর্যটক দলের বেশিরভাগই কিশোর ও যুবক। লাইফ জ্যাকেট পরে জলে নেমেছে তারা। হুটোপুটির শব্দ বুঝিয়ে দিচ্ছে ঢলের পানি ভয় দেখিয়ে মানুষের উচ্ছ্বাসকে চাপা দিতে পারেনি। — একটা ফটো তোলেন। নিঃশব্দে নিয়াজ পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে ধরা ওর দামি অ্যাকশন ক্যামেরা। খুব প্যাশনেট ফটোগ্রাফার। কোনও মুহূর্তই বাদ দেয় না। — বেশ কয়েকটি স্ন্যাপ নিয়েছি নিয়াজ।— নিজের ছবি তো একটাও তোলেন নাই। সেলফি নিতে পারেন না?— পারি।— তা হইলে এখন একটা ন্যান। সাথে আমিও থাকি! আবার কবে দেখা হইব শুধু আল্লাহ জানেন। বুকের ভিতর ধক করে উঠল। সত্যিই তো। আবার কবে দেখা হবে! এই হাওর, দূরের মেঘালয় পাহাড়শ্রেণী, নিয়াজ অথবা দীপ বণিকের সঙ্গে আবার দেখা হবে তো? ওয়াচ টাওয়ারে এসে শুধু বাইরের রূপটুকুই দেখার চেষ্টা করেছি। ভিতরখানি অবহেলায় পড়ে ছিল। — নিয়াজ, তোমাকে ধন্যবাদ।— ক্যান ভাইয়া?— এমনি।

এই দীর্ঘশ্বাস হতাশার নয়, আশঙ্কার নয়। এক সময়ের নিজের দেশে আজকে পরদেশি হয়ে যাওয়ার চাপা কষ্ট। রাষ্ট্র নাগরিক-সুবিধা দিতে পারে, তবে উড়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ডানা দুটিকে কেটে নিজের কাছে গচ্ছিত রাখে। যাঁরা দেশভাগের যন্ত্রণা সহ্য করেননি তাঁদের কাছে হয়ত বাংলাদেশের জন্য আমার এই প্রবল টান আদিখ্যেতা মনে হতে পারে। কিন্তু কী করব বলুন? এই উচ্ছ্বাস, আবেগ যদি অন্যায় হয় তবে আমি হাজারবার অপরাধী হতে রাজি আছি। ছেলের দল জলে ঝাঁপাঝাপি করে সাম্পানে ফিরে এসেছে দেখে ওয়াচ টাওয়ার ছেড়ে নেমে এলাম। ঘাটে বাঁধা কাছি খোলা হল। চা, বিস্কুট বিক্রি করতে আসা ছোট পানসির দল তফাতে গেল। আলম ভাই সিগ্রেট ধরিয়ে বাঁশের লাঠি স্টিলের রেলিং-এ ঠুকে আওয়াজ দিল, — বোট ছাড় রে মিজান। মিজান নীচের ঘরে অদৃশ্য থেকে মোটর চালু করল। আওয়াজ তুলে সাম্পান ধীরে ধীরে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নিজের দূরত্ব বাড়াচ্ছে। মন বলছে, আরও একটু বেশি সময় থেকে গেলে হত না? ফিরে যাওয়া তো অমোঘ, তবু কিছু বিলম্বিত ফিরে যাওয়ায় মানুষ যদি আনন্দে থাকে তাতে দোষ কোথায়? সুনামগঞ্জে ফিরে আসার বর্ণনা দিতে পারব না। কারণ আমার কলমের কলিজা বড় নরম। দীর্ঘ পথ নিমেষে শেষ হচ্ছে অথচ জলের মোচড়ে, মেঘের আঁচড়ে হাওর মহলের দুর্বিষহ পরিস্থিতির ছবি আঁকছে। এত কষ্ট, এত কান্নাকে শব্দের রূপ দেওয়ার পন্থা আমার অজানা। দেখছি বাজার ডুবে গিয়েছে। শুধু দেখা যাচ্ছে টিনের চালা। আবার কোথাও দেখছি ঘোলা জলের ঘূর্ণিকে ঠেকিয়ে রেখে কোনওক্রমে কংক্রিট কালভার্ট আগামী শীতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। এক বৃদ্ধ পানসিতে নিজের নাতিকে বসিয়ে চলেছে হয়ত কোনও পড়শির ঘরে। টুকরো টুকরো সংসার ছড়িয়ে রয়েছে। আমি পাজল সল্ভ করবার মত কল্পনায় সম্পূর্ণ ছবি তৈরি করার চেষ্টা করছি। পেরেছি কতটা শুধু সময় বলতে পারবে। হাওর ছেড়ে সুরমা নদীতে এসে পড়ল সাম্পান। একটু পরেই দেখা গেল সুনামগঞ্জ শহরের পাকা ঘর-বাড়ি। এখন বোটের মাথায় সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যাত্রার সাফল্যের তুল্যমূল্য বিচারে। আলম ভাই এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার আমার দিকে নজর ঘুরিয়ে বলল — সম্রাট ভাই, কথা কন না ক্যান? মন খারাপ লাগে?— হ্যাঁ, তা একটু লাগে।— ঘাটে আগেই নাইমা যাইবেন না। এক কাপ রং চা, চিনি ছাড়া। তারপর ছুটি। ঠিক আসে? দমচাপা ভাবটা কেটে গেল। কান এঁটো করা হাসি ফিরিয়ে দিয়ে আমন্ত্রণ স্বীকার করলাম। ঘাটে সাম্পান তার যাত্রা শেষ করে আজকের মতো শেষ ঘরঘর শব্দ তুলে স্থির হয়েছে। একে একে সবাই আলিঙ্গনে ও আবাহনে বিদায়ের বিষাদ মুহূর্তকে ভালোবাসার পরিপাটি যত্নে আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে শহরের ভিড় রাস্তায় হারিয়ে গিয়েছে। আলম ভাই গলায় ঝোলানো গামছায় মুখ মুছে আমার পাশে এসে বসল। — ওরে নাজিবুল, চা দে আমাগো। তোরাও আয় এহানে। ভাই এইবার একটা সিগ্রেট ন্যান।

ওর বাড়ানো সিগ্রেট হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিই। হৃদয় পোড়ে তো পুড়ুক। অন্তরের ধোঁয়া তামাক-পোড়া গন্ধে না হয় নেশার মৌতাত নিয়ে আমাকে বিশ্রাম দিক। — বুঝলেন, বত্রিশ বছর মাঝিগিরি করি। হাওর ভয় দেহায় ঠিক কিন্তু ডুবায় না। — ভয় লাগে না? — লাগে। রাইতে চলতে ভয় লাগে। পানি নামলে ভয় খায় না এমন বান্দা কেউ নাই। তবে… — তবে? — ভয় অভ্যাস করসি। এই ভয় নিয়া তিন ছেলে কলেজ পাশ করসে। শুরুতে ছিল একখান ভাড়ার নৌকা, এখন তিনখান বোটের অংশীদারি। সবই আল্লাহর দান— মহব্বত। নাজিমুল চায়ের কাপ এগিয়ে দেয়। এই ছেলেটি বড় চুপচাপ থাকে। আমাকে ও বলেছিল ‘বাসার জন্য মন খারাপ করে’। নাজিমুলকে এই প্রথম হাসিমুখ নিয়ে কথা বলতে শুনলাম। — সম্রাট ভাই, আইজ বোটেই থাহেন। হোটেলে গিয়া সেই তো একলা থাকতে হইব।— নাহ নাজিমুল, সেই উপায় নেই। কত কাজ আমার। পরের বার থাকব।— গ্রামের বাসায় নিয়া যাব আপনারে। শীতের সময় আসবেন। আসবেন তো? উত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়াই। আলম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলি, — এবারের মতো যে উঠতে হয়।— হুঁ। যান ভাই। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।— করব। সাম্পান ছেড়ে ঘাটের সিঁড়িতে পা রাখি। ‘হোটেল আমন বাবা’ এখান থেকে খুব বেশি হলে এক কিলোমিটার। হেঁটেই যাব। একবার হাসন রাজার মিউজিয়ামের সামনে দাঁড়াতে হবে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মিউজিয়ামের মূল ফটকের সামনে পৌঁছলাম। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছি দেখে লালরঙা দাড়ি নিয়ে এক মুরুব্বি বলে, — এখন বন্ধ। কাইল আইসেন। — আমি ভিতরে ঢুকব না। ভিতরে ঢুকে কী দেখব আমি? আমি যে আসল অন্তঃপুরের বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি। মূল ফটক থেকে সরে এসে লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। আমার কানে কানে হাসন রাজা বলছেন—আমি না লইলাম আল্লাজির নাম | না কইলাম তার কাম | বৃথা কাজে হাছন রাজায় দিন গুয়াইলাম || ভবের কাজে মত্ত হইয়া দিন গেল গইয়া | আপন কার্য না করিলাম, রহিলাম ভুলিয়া || নাম লইব নাম লইব করিয়া আয়ু হইল শেষ | এখনও না করিলাম প্রাণ বন্ধের উদ্দেশ || নাজিমুল তোমাদের যেমন ভয় পাওয়া অভ্যাস আমার ঠিক তেমন একলা থাকার অভ্যাস। আমি হাজার নাজিমুলের ভিতরে বেঁচে থাকব। বারবার ফিরে আসব হাওরের উতল হাওয়ার পথ ধরে। আফালের ভয়ঙ্করী ঢেউয়ে সংসার ভাঙার যাবতীয় দুঃখ বুকে ধারণ করে থেকে যাব সুনামগঞ্জের আশেপাশে, অন্য নামে, অন্য শরীরে। মায়া লাগার আগেই আমাকে আবার অন্য দেশ, অন্য মানুষের বসত ভিটের খোঁজে এগিয়ে যেতে হবে। সঙ্গে থাকবে এক বুক অকূল হাওর। ছবি সৌজন্য: লেখক
সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।