(Altitude Sickness)
ঘটনা ১
১৯৮৫ সালের জুন মাস। কেদারনাথ (৩৫৮৩ মিটার) অভিমুখে চলেছি। সঙ্গী চণ্ডীদা (কার্টুনিস্ট), বৌদি, তুলি (চণ্ডীদার মেয়ে) আর বন্ধু মানব। খুব মজা করে যাওয়া হচ্ছে। রাস্তার দু’পাশে জমে থাকা বরফ লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে মাথায় রেখে ছবি তুললেন চণ্ডীদা। সকালে যাত্রা শুরু করে বিকেলে কেদারনাথ। চণ্ডীদা বসে পড়লেন, “অশোক, একটু গা গুলোচ্ছে, সেরকম তো কিছু খাইনি…।”
“ঠিক আছে, শুয়ে পড়ুন।“ বলে বাইরে দোকান খুঁজে দু’কাপ গরম চা এনে চণ্ডীদাকে খাইয়ে দিলাম। ততক্ষণে ইমারসান হিটারে জল গরম হয়ে গেছে। উষ্ণ গরম জল পান করানো হল। “এবার একটু ভালো লাগছে।”
(Altitude Sickness)
ঘটনা ২
১৯৮৭ সাল। সেপ্টেম্বরের শেষ দিক। চলেছি ‘হর কি দুন‘ (৩৬০০ মিটার)। রুনুদা আর নিভাদি প্রথমবার পাহাড়ে ট্রেকিং-এ এসেছেন। ‘সীমা’তে (২৫৫০ মিটার) রাত কাটাবার পর, নিভাদির শরীর একটু খারাপ লাগছে। ওপরে যেতে বারণ করা হল। আমরা যাবার সময় বললাম, “কিছুক্ষণ দেখুন, ভালো বোধ না হলে রুনুদা আর আপনি ‘তালুকা’ নেমে যাবেন।’’ ফিরতি পথে জানলাম ওঁরা নেমে গিয়েছিলেন এবং ভালো আছেন।
রাস্তার দু’পাশে জমে থাকা বরফ লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে মাথায় রেখে ছবি তুললেন চণ্ডীদা। সকালে যাত্রা শুরু করে বিকেলে কেদারনাথ।
ঘটনা ৩
১৯৯২ সাল। নভেম্বর মাস। এভারেস্ট বেস ক্যাম্প, ‘কালাপাত্থর’ সেরে ‘প্যাংবোচে’ হয়ে ‘গোকিও’ যাচ্ছি। রাত্রিবাসের জন্যে থেমেছি ‘ফোরৎসে’ (৩৬৮০ মিটার)-তে। দেখি, এক ইতালীয় দম্পতি শুয়ে আছেন। জানা গেল, বাকি দল এগিয়ে গেছে গোকিওর দিকে। উচ্চতাজনিত অসুবিধে হওয়ায় এই যুবক থেকে গেছে। সান্ত্বনা দিলাম। “একদিন বিশ্রাম নিন। আমি একটা আইটিনারী বানিয়ে দিচ্ছি, অ্যাক্লেমাটাইজেশনের জন্যে বিশ্রামের দিন রেখে, এভারেস্ট বেস ক্যাম্প (৫৩৬৪ মিটার) ঘুরে আসতে পারবেন।”
পরবর্তীকালে ফিরতি পথে ‘লুকলা’ এয়ারপোর্টে দেখা হয়েছিল। ওরা ভালোভাবেই এভারেস্ট বেস ক্যাম্প ঘুরে আসতে পেরেছেন। (Altitude Sickness)
আরও পড়ুন: ঘর সাজাতে গাছের যত্ন নেবেন কীভাবে?
ঘটনা ৪
১৯৯৫ সাল। ‘কুলু পুমোরী’ (৬৫৫৩ মিটার) শৃঙ্গ অভিযান। ‘মানালি’ (২০৫০ মিটার) থেকে রেশন, মালবাহক বন্ধু ইত্যাদি যোগাড় করে বাসে করে রওয়ানা। ‘রোটাং পাস’ (৩৯৭৮ মিটার) পার হয়ে ‘বাতালে’ (৩৭১৯ মিটার)-তে নামা। পড়ন্ত বিকেল। রুক্ষ পরিবেশ। গাছপালা প্রায় নেই। শীতল মরুভূমি। কিছুক্ষণ বাদে জানা গেল দু’জন মালবাহক বন্ধু অসুস্থ বোধ করছে। পরীক্ষা করে বুঝলাম উচ্চতাজনিত কারণে এই অবস্থা। আশ্চর্য হলাম এরা পাহাড়ের বাসিন্দা, তবুও! রসুনের স্যুপ খাওয়ানোর পর, বিশ্রাম নিতে বলাে হল। এরপর, বেস ক্যাম্প পর্যন্ত নিরাপদেই আমাদের অভিযানের সঙ্গী হয়ে চলল।
অভিযাত্রী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মানিক (নাম পরিবর্তিত) দেখছি অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছে। পর্বতারোহণের অ্যাডভান্স কোর্স করা, এ গ্রেড প্রাপ্ত। পা ঠিকমত পড়ছে না মাঝে মাঝে। এলোমেলো। কথাবার্তাও বিশেষ বলছে না। যা বলছে সেটাও কিছুটা অসংলগ্ন। রক্তচাপ ইত্যাদিও ঠিক আছে। চোখে চোখে রাখছি। ট্র্যানজিট ক্যাম্পেও উন্নতির কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। রিস্ক নেওয়া যাবে না। একজন সুস্থ মেম্বারকে সঙ্গী করে নিচে নেমে যেতে বলা হল। পরে জানা গেল, উচ্চতা কমতেই ঠিক হয়ে যায়। (Altitude Sickness)

এই একই অভিযানে যাবার আগে মেডিক্যাল চেক আপে লক্ষ করলাম শ্বাসগ্রহণে(ডাক্তারি পরিভাষায় রনকাই) মানসের (নাম পরিবর্তিত) অল্প অসুবিধে আছে। জিজ্ঞেস করাতে অসুবিধার কথা পুরো অস্বীকার করল। তুখোড় পাহাড়ী। কি জানি। প্রথম দিনের শেষে এক নম্বর ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছল সবার শেষে, অথচ মানস অন্যতম ফিট অর্থাৎ সক্ষম অভিযাত্রী। এসেই বসে পড়ল, কাহিল। পরীক্ষা করে দেখি বুকে সাঁই সাঁই শব্দ। ওষুধ দিলাম। সুস্থভাবে অভিযান শেষ করল।
প্রথম দিনের শেষে এক নম্বর ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছল সবার শেষে, অথচ মানস অন্যতম ফিট অর্থাৎ সক্ষম অভিযাত্রী। এসেই বসে পড়ল, কাহিল।
ঘটনা ৫
২০১৮ সাল। বদ্রীনাথ (৩১০০ মিটার)। প্রচুর বরফ পড়েছে ১৬ ঘণ্টা ধরে। ঘরে বন্দি। কনকনে ঠাণ্ডা। রাত্রে বাথরুম থেকে ফিরেই অর্ধাঙ্গিনীর প্রবল শ্বাস কষ্ট। স্টেরয়েড এবং ব্রঙ্কোডায়লেটর ইনহেলার দিয়ে সেযাত্রা সামাল দেওয়া হল।
এই অবধি পড়ে অমরনাথদা জানতে চাইলেন, “ইদানিং দেখা যাচ্ছে, উচ্চতায় গিয়ে অনেকে অসুবিধের মুখে পড়ছেন। এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। ‘সন্দাকফু’-কে ধরা হয় আপেক্ষিক সহজ ট্রেকিং। অথচ সেখানেও হচ্ছে। এই নিয়ে প্রচুর চর্চা। শুনেছি, লাদাখে ঘুরতে গিয়েও অনেকে অসুবিধেয় পড়ছেন। কয়েকজন মারাও গেছেন বলে জানি। কী বলবে এদের নিয়ে?” (Altitude Sickness)
– “অমরনাথদা, এসব ঠাণ্ডা মাথায় যুক্তি দিয়ে বুঝতে হবে। মানুষ নশ্বর, তাই দেহত্যাগ করতেই হবে। যাঁরা উচ্চতায় যাচ্ছেন না, তাঁরাও মরণশীল। অর্থাৎ, যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁরা সবাই হয়ত উচ্চতাজনিত কারণে প্রাণ ত্যাগ করছেন না। তবে কেউ কেউ নিশ্চিতভাবে উচ্চতার জন্যে…”
– “হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। তুমি তাহলে উচ্চতার জন্যে অসুস্থতার বিষয়ে কিছু বল।”
– “ঠিক আছে, আমাদের আলোচনা হোক উচ্চতা জনিত শারীরিক অসুস্থতার ব্যাপারে, যার পোশাকি নাম High Altitude Illness (HAI)।
কনকনে ঠাণ্ডা। রাত্রে বাথরুম থেকে ফিরেই অর্ধাঙ্গিনীর প্রবল শ্বাস কষ্ট। স্টেরয়েড এবং ব্রঙ্কোডায়লেটর ইনহেলার দিয়ে সেযাত্রা সামাল দেওয়া হল।
উচ্চতায় আরোহণকালে স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায়, বায়ুচাপও কমে। যদি ধীরে ধীরে উচ্চতা বাড়ে, তাহলে শরীর তা মানিয়ে নিতে পারে। তা না হলে HAI হবার প্রবল সম্ভাবনা। কার ক্ষেত্রে অসুস্থতা দেখা দিতে পারে, তা নিয়ে অনেক সময়ই ভবিষ্যদ্বাণী করা যায় না। খুব স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিও হঠাৎ আক্রান্ত হতে পারে। আগে আক্রান্ত হননি এমন মানুষও অসুস্থ হতে পারেন। (Altitude Sickness)
স্যার এডমন্ড হিলারী, যিনি ১৯৫৩ সালে এভারেস্ট শৃঙ্গে আরোহণ করেন প্রথম মর্ত্যবাসী হিসেবে, তিনি পরবর্তীকালে মনস্থির করেন গঙ্গার মোহনা থেকে জেট নৌকায় গঙ্গার উৎস অবধি যাবেন, তারপর একটা শৃঙ্গ আরোহণ করবেন। প্রপেলারহীন জলের জেট নৌকায় এই অভিযান শুরু হয় ১৯৭৭ সালে, সঙ্গী ২২ বছরের পুত্র পিটার। এই বিশেষ ধরনের জেট নৌকা র্যাপিড আরোহণ করতে সক্ষম। যাত্রাপথে এক জলপ্রপাত দেখা দেওয়ায় জেট অভিযান সমাপ্ত হয়, তারপর শুরু হয় ট্রেকিং। এভারেস্ট জয়ী হিলারী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন মাত্র ৬০০০ মিটার উচ্চতায়। ওই দুঃসময়ের টানা সাত দিনের কোন স্মৃতি ওঁর স্মরণে নেই। হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েে কোনমতে প্রাণরক্ষ করা হয়। কে যে কখন উচ্চতাজনিত অসুস্থতার কবলে পড়বে তা অজানা। (Altitude Sickness)
সুতরাং সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে। ধীরে ধীরে উচ্চতায় চড়তে হবে, শরীরকে মানিয়ে নিয়ে (acclamatize)। সাধারণত দেখা যায় ৮.০০০ ফুট (২৫০০ মিটার) উচ্চতায় অ্যাক্লেমাটাইজ করার প্রয়োজন হয়, অর্থাৎ এই উচ্চতায় পৌঁছনোর পর একদিন বিশ্রাম নিয়ে আবার পরবর্তী উচ্চতায় যাওয়াই উচিত। তবে বিশ্রাম মানে শুয়ে থাকা নয়, চলাফেরা করা। এই কারণেই যাঁরা বিমানে লাদাখ যান, তাঁদের একদিন বিশ্রামে রাখা হয় কারণ তাঁরা উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন অল্প সময়ের ব্যবধানে, শরীর ঐ উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সময় পায়নি।
যাত্রাপথে এক জলপ্রপাত দেখা দেওয়ায় জেট অভিযান সমাপ্ত হয়, তারপর শুরু হয় ট্রেকিং। এভারেস্ট জয়ী হিলারী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন মাত্র ৬০০০ মিটার উচ্চতায়।
বিখ্যাত পর্বতারোহী ক্রিস বনিংটন, বহু কঠিন শৃঙ্গ অভিযানের দলনেতা। মনে দুঃখ হল, সবই হল, দলনেতা হওয়া সত্বেও কিন্তু এভারেস্ট জয় করা হয়নি। ১৯৮৫ সালে যোগ দিলেন নরওয়ে দলের সঙ্গেে। এভারেস্ট আইসফল অতিক্রম করে ওয়েস্টার্ন কুম। ততদিনে নিজেকে যথেষ্ট অ্যাক্লেমেটাইজ করা হয়েছে। নেমে এলেন ফেরিচেতে(৪৩৭১ মিটার)। দিন সাতেক সেখানে থেকে পেট পুরে খেয়ে এনার্জি সংগ্রহ করলেন। তারপর একটানা দৌড়। সেই দৌড় থামল এভারেস্ট চূড়ায়, ৫০ বছর বয়সে। তখনও অবধি সর্বোচ্চ বয়সে এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড। (Altitude Sickness)
চীন ভ্রমণকালে, লাসা যাওয়ার ট্রেন (Z 6801) ছাড়ল দুপুর ২.১০ মিনিটে। রোমাঞ্চ হচ্ছিল কারণ এই ট্রেন ‘টাঙ্গুল লা’ (Tangul La, ৫৫০০ মিটার) গিরিবর্ত্ম পার হয়ে লাসা যাবে। অর্থাৎ, এর উচ্চতা নেপালের এভারেস্ট বেস ক্যাম্পের কাছে কালাপাত্থর (৫৫৪৫–৫৫৫০ মিটার) শৃঙ্গের কাছাকাছি, যেখানে আমরা ১৯৯২ সালে গিয়েছিলাম। ওই উচ্চতায় যদি কেউ অসুস্থ বোধ করে, তার জন্যে ট্রেনের প্রত্যেক সিটের কাছেই আছে অক্সিজেন পাইপলাইন।
(Altitude Sickness) এতক্ষণে আমরা বুঝতে পেরেছি যে উচ্চতায় আরোহণকালে, প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন না করলে, অসুস্থতা (HAI) হওয়া সম্ভবপর। সেটা কমের দিকে থাকলে, acute mountain sickness (AMS) দেখা দিতে পারে। সাবধানতা অবলম্বন না করলে তা মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে — High-Altitude Cerebral Edema (HACE) অথবা High-Altitude Pulmonary Edema (HAPE)। সমতলের বাসিন্দাদের এই অসুস্থতা হওয়ার সম্ভাবনা শতকরা ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ, যদি তাঁরা ১০০০০ ফুট (৩০৫০ মিটার) উচ্চতায় ওঠেন। উচ্চতা যদি হয় ৮০০০ ফুট (২৫০০ মিটার) তবে সেই সম্ভাবনা প্রায় ২৫ শতাংশ। অসুস্থতার লক্ষণ সাধারণত দেখা দেয় ৬ থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে। তাই জানতে হবে এই অসুস্থতা শুরু হবার প্রাথমিক লক্ষণ এবং ঝুঁকি নির্দেশক ব্যাপারগুলো। (Altitude Sickness)
ঝুঁকি নির্দেশক (Risk Factor):
- যাদের অতীতে HAI হয়েছিল।
- শরীর উচ্চতার সাথে মানিয়ে নেবার আগেই অত্যধিক পরিশ্রম করা।
- অত্যধিক তাড়াতাড়ি বেশি উচ্চতায় আরোহণ (যেমন আকাশপথে লাদাখ) ।
- শ্বাসকষ্টজনিত অসুখ থাকা।
অভিযাত্রী যদি ৫০০০ ফুটের (১৫০০ মিটার) কম উচ্চতার বাসিন্দা হয়, তাহলে প্রথম দিনে ৯০০০ ফুট (২৪৫০ মিটার) উচ্চতার নিচে ঘুমানো বাঞ্ছনীয়।
আগেই যদি কিছু বিশেষ অসুস্থতা থাকে তাহলে, উচ্চতা আরোহণের আগে ডাক্তারদের পরমর্শ নেওয়া উচিত।
- মধুমেহ (diabetes) থাকলে এবং মাঝে মাঝে গ্লুকোজ মিটারে পরীক্ষা করলে সেই যন্ত্রের নির্মাতার সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন, কারণ অধিক উচ্চতায় যন্ত্রের রেজাল্ট সব সময় সঠিক সংখ্যা দেখায় না।
- অতীতে যদি হার্টের অসুখ থেকে থাকে।
- হাঁপানির অবস্থা সাধারণত খারাপ হয়না, তবে অত্যধিক ঠাণ্ডার কারণে হাঁপানির প্রকোপ দেখা দিতে পারে। ( উল্লেখ্য – ঘটনা ৫)
- Sickle cell disease
- ফুসফুসের অসুখ যেমন COPD, cystic fibrosis, pulmonary hypertension, sleep apnea।
- উচ্চ রক্তচাপ।
(Altitude Sickness)
HAI অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ:
- মাথা ব্যথা।
- দুর্বলতা অনুভব করা।
- মাথা ঝিম ঝিম করা, মাথা ঘোরা।
- ক্ষুধামান্দ্য অর্থাৎ ক্ষুধাবোধ হ্রাস হওয়া।
- ঘুম মাঝে মাঝে ভেঙে যাওয়া।
- গা বমি বমি ভাব/বমি। ( উল্লেখ্য – ঘটনা ১)

AMS প্রতিরোধের উপায়:
- ধীরগতিতে আরোহণ। সাধারণত বলা হয়ে থাকে
(Altitude Sickness) অভিযাত্রী যদি ৫০০০ ফুটের (১৫০০ মিটার) কম উচ্চতার বাসিন্দা হয়, তাহলে প্রথম দিনে ৯০০০ ফুট (২৪৫০ মিটার) উচ্চতার নিচে ঘুমানো বাঞ্ছনীয়। (Altitude Sickness)
- গন্তব্যস্থানের লক্ষ্য যদি ৯৮০০ ফুটের (৩০০০ মিটার) বেশি উচ্চতায় থাকে তাহলে প্রতিদিন ১৬০০ ফুট (৫০০ মিটার) উচ্চতার বেশি আরোহণ না করাই উচিত। প্রতি ৩৩০০ ফুট (১০০০ মিটার) উচ্চতা আরোহণ করার পর এক দিন বিশ্রামের প্রয়োজন।
- বেশি উচ্চতায় আরোহণ করে, নেমে এসে কম উচ্চতায় নিদ্রা যাওয়া। এতে শরীর ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে (অ্যাক্লেমাটাইজ)।
- মদ্যপান না করা বাঞ্ছনীয়।
- চা অথবা কফি পানে অভ্যস্ত হলে তা বন্ধ করা উচিত নয়। বন্ধ করলে অনেক ক্ষেত্রেই তা শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণের মত হয়ে দাঁড়ায় (Withdrawal Symptom)। তাই ভুল ধারণা হতে পারে।
- প্রচুর পরিমাণে তরল পান করা উচিত, স্যুপ, চা ইত্যাদির মাধ্যমে। রসুনের স্যুপ উপকারী বলা হয়। (Altitude Sickness)
পর্বতারোহণকালে অর্থাৎ পাহাড়ে চড়তে গিয়ে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন মেডিক্যাল কারণে। তাঁরা পাহাড়ে না গেলেও হয়ত একই পরিণতি হত।
ওষুধের ব্যবহার:
- Acetazolamide: উচ্চতায় যাবার একদিন আগে থেকে গ্রহণ করতে হবে। চলবে সর্বোচ্চ উচ্চতায় আরোহণ অবধি। এটি সালফা ওষুধ, তাই যাঁদের সালফার এলার্জি আছে তারা ডাক্তারের সাথে আলোচনা করে তবেই ব্যবহার করবেন।
- Dexamethason: যাঁদের Acetazolamide এলার্জি আছে, তাঁরা Dexamethasone ব্যবহার করতে পারবেন কি না তা ডাক্তারবাবুর সঙ্গেে কথা বলে জেনে নেবেন।
- Aspirin or Ibuprofen: মাথা ব্যথা হলে।
- Ondansetron: গা বমি ভাব/ বমি হলে। (Altitude Sickness)
যদি অসুস্থতা মারাত্মক আকার ধারণ করে।
High-Altitude Cerebral Edema (HACE):
এটা উচ্চতাজনিত অসুস্থতার এক মারাত্মক অবস্থা। মস্তিকের অভ্যন্তরে জল জমে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর লক্ষণগুলো হল:
- অল্পেতেই কাহিল হয়ে পড়া।
- ঝিমুনি ভাব, মানসিক বিভ্রান্তি, খিটখিটে বা তিরিক্ষি মেজাজ।
- সরলরেখায় অর্থাৎ সোজাসুজি পথ চলতে না পারা। মাতালের মত হাবভাব। (উল্লেখ্য – ঘটনা ৪)
(Altitude Sickness)
চিকিৎসা:
- তাড়াতাড়ি নিচে নামিয়ে আনা।
- সঙ্গে অক্সিজেন-এর ব্যবস্থা থাকলে, তা শুরু করা।
- Dexamethasone।

High-Altitude Pulmonary Edema (HAPE):
(Altitude Sickness) এটা এমনই আর একটা মারাত্মক উদ্বেগজনক অবস্থা যেখানে ফুসফুসে জল জমা হয়। এর লক্ষণগুলো হল:
- কাশি, গোলাপি ফেনাযুক্ত কফ।
- অল্প হাঁটলে এমনকি বিশ্রামের সময়েও শ্বাসকষ্ট।
চিকিৎসা:
- তাড়াতাড়ি নিচে নামিয়ে আনা।
- সঙ্গে অক্সিজেন-এর ব্যবস্থা থাকলে, সঙ্গে সঙ্গে তা শুরু করা।
- Nifedipine
ডিহাইড্রেশন রোধ করার জন্যে প্রচুর তরল পান করা, গরম পোশাক ঠিকমত ব্যবহার, এবং বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলেই আরোহণের পরিবর্তে অবতরণ।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, পর্বতারোহণকালে অর্থাৎ পাহাড়ে চড়তে গিয়ে কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন মেডিক্যাল কারণে। তাঁরা পাহাড়ে না গেলেও হয়ত একই পরিণতি হত। তবুও পাহাড়ে যেতেই হবে, প্রকৃতির টানে, নিজেকে উপলদ্ধি করার তাগিদে। কিন্তু অবশ্যই তা প্রাণের বিনিময়ে নয়। প্রাণ থাকলে আবার যাওয়া যাবে, দর্শনলাভও হবে। সাবধানতা অবলম্বন করলে, শরীরকে ঠিকমত মানিয়ে (অ্যাক্লেমাটাইজেশন) নিলে, নিয়ম মেনে চললে কোন অসুবিধেই বাধা হয়ে উঠবে না। (Altitude Sickness)
(Altitude Sickness) এত সব ফিরিস্তি শুনে অমরনাথদা বলে উঠলেন, “তাহলে মূল মন্ত্র হল ধীরে চলা, ডিহাইড্রেশন রোধ করার জন্যে প্রচুর তরল পান করা, গরম পোশাক ঠিকমত ব্যবহার, এবং বিন্দুমাত্র অসুবিধে হলেই আরোহণের পরিবর্তে অবতরণ। এখানে অবতরন হল পরবর্তী আরোহনের পথ করা। কথা শোনো, চলো হিমালয়ে। আবার উঠবে গেয়ে,
নির্ঝর ছুটিছে বক্ষে, জলদ ভ্রমিছে শৃঙ্গে,
চরণে লুটিছে নদী শিলারাশি ঠেলিয়া।
তোমার বিশাল ক্রোড়ে লভিতে বিশ্রাম সুখ
ক্ষুদ্র নর আমি এই আসিয়াছি ছুটিয়া।”
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
3 Responses
খুবই উপকার হল আমাদের যারা আমরা অল্পসল্প পাহাড়ে যাই। তবে ওষুধের ব্যবহারের অভিঞ্জতা না জানলে ব্যবহার করা মনে হয় উচিত হবে না।
বিস্তারিত বিবরণ, অথচ সুন্দর উপস্থাপনা।
ভীষন জরুরী তথ্যসমৃদ্ধ রচনাবলী। সঠিক পদ্ধতি অনুসরন করলে অনেক প্রাণহানি আটকানো সম্ভব। এই লেখনী যতো বেশি সম্ভব ছড়িয়ে দিতে পারলে আখেরে সাধারণ মানুষের অনেক উপকার হতে পারে…. বিশেষতঃ যারা অগ্র পশ্চাৎ না ভেবেই অনেক উচ্চতায় হঠাৎ যাত্রা করেন। লেখকের জন্যে রইলো অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। পরবর্তী নতুন কিছু লেখনীর অপেক্ষায় রইলাম।🌹🙏