একজন কবিকে চেনার বিবিধ উপাদান হাতের সামনে পাওয়া যায় প্রায়শই। কবিতার পাশাপাশি বেড়ে ওঠা, সমসময়, ব্যক্তিগত জীবন, কর্মকাণ্ড ইত্যাদির গুরুত্বও নেহাত কম নয়। বস্তুত, কবিকে সার্বিকভাবে বুঝতে ও কবিতার সঙ্গে সেতু প্রতিষ্ঠা করতে, পূর্বোক্ত উপাদানগুলির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে এর পরেও কিছু ‘রহিয়া যায়’। সেই থেকে যাওয়াই মূলত কবিতার সঙ্গে পাঠকের সংলাপ। সেখানে বাহ্যিক বিষয় নয়, মুদ্রিত শব্দই হয়ে ওঠে প্রকৃত টরেটক্কা। (Helal Hafiz)
জীবনস্ফূর্তির লেখক, বিস্ময়দীপ্তির কবি কমল – আর্যনীল মুখোপাধ্যায়
সদ্যপ্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের ক্ষেত্রেও এ-কথা প্রযোজ্য। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন, পেশা, যাপন ইত্যাদির সঙ্গে কবিতাকে জুড়ে (বা উল্টোটা) মোটামুটি মসৃণ এক চেহারা দাঁড় করানো অসম্ভব নয়। বস্তুত, কবির দেওয়া অসংখ্য সাক্ষাৎকারেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেসব উপাদান। সেগুলি থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখাও কঠিন। তারপরও, সনাতন পদ্ধতি মেনে শুধুমাত্র বইয়ের সঙ্গেই সম্পর্কস্থাপনের প্রয়াস এই লেখা। ফাঁকতালে অপরাপর তথ্যের অনুপ্রবেশও হয়তো ঘটবে, তবে আমাদের মূল লক্ষ্য তা নয়— এই ঘোষণাটুকু থাকুক প্রথমেই।
‘জনপ্রিয়’ শব্দটি বিতর্কিত, কিন্তু হেলাল হাফিজকে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সেটি এড়ানোর উপায় নেই। পূর্বোক্ত কবিদের মতো হেলাল হাফিজও একটি বইয়ের সূত্রেই সর্বাধিক জনপ্রিয়; কিন্তু বাকিদের সঙ্গে তাঁর তফাৎ হল, পরবর্তী তেত্রিশ বছর দ্বিতীয় কোনও মৌলিক বই প্রকাশ করেননি তিনি।
বাংলাভাষায় একটিমাত্র কবিতার বইয়ের সুবাদে খ্যাতি ও অমরত্ব— এ নিতান্ত বিরল নয়। অনেক কবিই বৃহত্তর পরিসরে পরিচিত একটি বইকে কেন্দ্র করেই (উদা. ‘ফিরে এসো চাকা’ ও বিনয় মজুমদার)। কিন্তু সেই বই পাঠকের মনে যে উচ্চাশার জন্ম দেয়, অধিকাংশ কবিই তা পরবর্তী বইগুলিতে ধরে রাখতে পারেন না। বা, মান উন্নত হলেও, ‘জনপ্রিয়’ হয় না তা। ‘জনপ্রিয়’ শব্দটি বিতর্কিত, কিন্তু হেলাল হাফিজকে নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে সেটি এড়ানোর উপায় নেই। পূর্বোক্ত কবিদের মতো হেলাল হাফিজও একটি বইয়ের সূত্রেই সর্বাধিক জনপ্রিয়; কিন্তু বাকিদের সঙ্গে তাঁর তফাৎ হল, পরবর্তী তেত্রিশ বছর দ্বিতীয় কোনও মৌলিক বই প্রকাশ করেননি তিনি। ফলে পাঠকের অপেক্ষা বেড়েছে, বেড়েছে কৌতূহল ও খিদে; হেলাল তা উপভোগও করেছেন। এ কি সাফল্য ও সংযমের উদাহরণ? নাকি ভয়— দ্বিতীয় বই যদি প্রথমটির মতো পাঠক-আনুকূল্য না পায়! আমরা তা জানি না। শুধু প্রবল বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকি তেত্রিশ বছরের ওই না-বই-কালখণ্ডের দিকে।

না-বই, কিন্তু প্রবলভাবে বই-বাহিত সেই কালখণ্ড। ১৯৮৫-র ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’, দ্বিতীয় মুদ্রণ জানুয়ারি ১৯৯৩— প্রায় আট বছর বাদে। অথচ ঠিক তিন বছরের মধ্যেই, ১৯৯৬-এ দশম মুদ্রণে পৌঁছে যায় তা। ২০১৮-য় ঊনত্রিশতম মুদ্রণ। একেক মুদ্রণের বইসংখ্যা আমাদের বর্তমান পশ্চিমবঙ্গীয় বাংলাবাজারের কবিতা বইয়ের গড় মুদ্রণসংখ্যার (২০০-৩০০) থেকে বহুগুণ বেশি, তা বলাই বাহুল্য। ফলে, অচিরেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বইটি। এবং সাম্প্রতিককালের সর্বাধিক বিক্রিত কবিতার বই— বাতাসে ঘোরাফেরা করে এমন তথ্যও।
লক্ষ্যণীয়, প্রথম মুদ্রণ ফুরোতেই লেগেছে আট বছর। সংখ্যাটি আমাদের অজানা, কিন্তু পরের তিন বছরের সঙ্গে তুলনা করলে (যেখানে আটটি মুদ্রণ নিঃশেষিত) ধীর লয়ের বিক্রিই বলতে হয়। এ-ও বোঝা যায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে বইটির প্রচার ও জনপ্রিয়তা এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়। এমন প্রবণতা আজকের দিনেও বিরল নয়। প্রকাশের বেশ কয়েক বছর পরে বই বিক্রির পরিমাণ বৃদ্ধি— বাংলা বইবাজারে কমবেশি দেখা যায় আজও। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির পরেও সংখ্যাটি চার অঙ্ক সচরাচর ছোঁয় না, যদি-না কবি অত্যন্ত জনপ্রিয় হন।
ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তি; নতুন করে কিছু প্রমাণের দায় আর নেই। দ্বিতীয় বইটিরও তিনমাসের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় প্রথম মুদ্রণ। কিন্তু একনিষ্ঠ হেলাল-পাঠক হিসেবে বিশ্লেষণ করতে বসলে মনে হয়, বইটি না-বেরোলেই ভাল হত। মানের দিক দিয়ে প্রথম বইয়ের ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারেনি সেটি।
অবশ্য হেলাল হাফিজ এসব সমীকরণে পড়েন না। ৩৭ বছর বয়সে (জন্ম ১৯৪৮) প্রথম কবিতার বই তাঁর। তার পরে তেত্রিশ বছর নতুন বইহীন। তাঁর জনপ্রিয়তার দিকে নজর আমাদের; কিন্তু সংযমটিকে আলোচনার বাইরে রাখি প্রায়শই। প্রথম বইটি আকাশচুম্বী ‘সাফল্য’ পাওয়ার পর, সেই হাওয়া থাকতে-থাকতেই দ্বিতীয় মৌলিক বইটি বের করতে পারতেন তিনি। করলেন ২০১৯-এ এসে, ‘বেদনাকে বলেছি কেঁদো না’। ততদিনে তিনি বাংলা সাহিত্যে কিংবদন্তি; নতুন করে কিছু প্রমাণের দায় আর নেই। দ্বিতীয় বইটিরও তিনমাসের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় প্রথম মুদ্রণ। কিন্তু একনিষ্ঠ হেলাল-পাঠক হিসেবে বিশ্লেষণ করতে বসলে মনে হয়, বইটি না-বেরোলেই ভাল হত। মানের দিক দিয়ে প্রথম বইয়ের ধারেকাছেও পৌঁছোতে পারেনি সেটি। হেলালের কবিসত্তাও কি টের পায়নি তা?

সে-প্রশ্ন সরিয়ে আমরা বরং প্রথম ও কিংবদন্তি-হয়ে-যাওয়া বইটির ভেতরে নজর রাখি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৮৫— এই কালপর্বে লেখা ৫৬টি কবিতা। অধিকাংশই ১৯৮০ বা তার পরে লেখা। কবিতাগুলির মূল সুরের সন্ধান করলে, বিদ্রোহ ও প্রেমই প্রধান হয়ে ওঠে। অমর-হয়ে-যাওয়া পঙক্তি ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’, বস্তুত, এ-বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম লাইন। রচনাসাল ১৯৬৯। হেলাল প্রতিটি কবিতার শেষে রচনার সন-তারিখ দিয়েছেন, কবিতার পরে যা মিলিয়ে পড়লে, স্বাভাবিকভাবেই সময় ও কবির সম্পর্ক টের পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী অশান্ত পূর্ব পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী নবীন বাংলাদেশের স্বপ্ন ও বারুদ এ-বইয়ের কয়েকটি কবিতায় স্পন্দমান। আবার, পাশাপাশি নবীন যুবকের প্রেম-বিরহের উপস্থিতিও নেহাত কম নয়। কবিতার বই যে এক অর্থে ডাইরিও হতে পারে, ষোলো বছর ধরে কবিজীবন তথা কবিসময়ের খণ্ডাংশ ধরে রাখার মাধ্যমে সে-ইঙ্গিতই দেয় ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।

কবিতা কি সবসময় কবিজীবনেরই প্রতিফলন? না, এমন আবশ্যিক কোনও সমীকরণ প্রতিষ্ঠার আমরা বিরোধী। বিশেষত, কবিতার গূঢ় পথ এতই বিচিত্রগামী যে, ব্যক্তি-কবির সঙ্গে তাকে মেলানোর চেষ্টা কিছুক্ষেত্রে অনুচিতই। আবার, বেশ-কিছু কবিতাভঙ্গি আয়নার মতো ফুটিয়ে তোলে কবির চিন্তাকেই; কবি সেখানে কথক নন, রক্তমাংসের ব্যক্তি। খানিক বর্ণনাধর্মী ও উচ্চকিত কবিতার মধ্যে দেখা যায় এ-ধরনের বৈশিষ্ট্য। হেলালের কবিতাও এ-গোত্রেরই। সূক্ষ্মতা নয়, তীব্রতাই তাঁর অস্ত্র। আবেগ ও দক্ষতার মিশ্রণে তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছিল একটা প্রজন্মের ভাষ্য। দীক্ষিত পাঠক তাতে গভীরতা হয়তো পাবেন না, কিন্তু কবিতাবিমুখ কাউকে কবিতার দিকে টেনে আনতে হেলাল হাফিজ অমোঘ। তাঁর একাধিক কবিতার ছন্দোবদ্ধ উপস্থাপনা নবীন পাঠককে পেড়ে ফেলতে সক্ষম। সমসময়ে প্রেম ও দ্রোহের ভাষা হয়ে ওঠার পাশাপাশি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরেও ছড়িয়ে গেছে সেইসব উচ্চারণ। একজন কবির ‘সাফল্য’ বোধকরি এটাই।
প্রথম বইয়ের সূত্রেই তিনি কিংবদন্তি। উচ্চকিত আবেগ ও তার উপস্থাপনা প্রায়ই সাধারণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। মহাকালের বিচার সেখানে গৌণ। আর ঠিক সেখানেই জিতে গেছেন হেলাল।
আর এই সূত্রেই হেলাল হাফিজের কবিতা ভবিষ্যতে আরও আলোচিত হওয়া উচিত। বহুপ্রজ কবি তিনি নন, কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন আলস্যকে। সেইসঙ্গে তিনি চেয়েছিলেন, মানুষের মুখে-মুখে ফিরুক তাঁর পঙক্তি। বলা বাহুল্য, প্রথম বইয়ের হাত ধরে তা সফলও হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যে কবিতা তিনি লিখেছেন, তা তত তীব্র অভিঘাত আনতে পারেনি (দ্বিতীয় বইটি তার প্রমাণ)। তারপরও, প্রথম বইয়ের সূত্রেই তিনি কিংবদন্তি। উচ্চকিত আবেগ ও তার উপস্থাপনা প্রায়ই সাধারণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণে সক্ষম হয়। মহাকালের বিচার সেখানে গৌণ। আর ঠিক সেখানেই জিতে গেছেন হেলাল। বিপুল পাঠকপ্রিয়তা তাঁকে সমসময়ের একজন উল্লেখযোগ্য কবির স্বীকৃতি দিয়েছে। প্রায় সম্পূর্ণ জীবন একটিমাত্র বইয়ের জন্যেই তিনি আলোচিত হলেন— এ নেহাত কম অর্জন নয়। এ-ও সত্য যে, হেলাল হাফিজের কবিতা— বড় পরিসরে ভাবলে, তাঁর ঘরানার কবিতা পাঠককে সহজে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। তা বাণিজ্যসফল হওয়ার সম্ভাবনাও স্বাভাবিকভাবেই বেশি। কিন্তু এই প্রবণতা কি সামগ্রিকভাবে বাংলা কবিতার সাধারণীকরণের জন্যেও দায়ী নয়? যে-কবিতা আবেগের উচ্চস্বর নয়, বরং বোধের গভীরতা-নির্ভর, তাকে কি কোণঠাসা করে দেয় না প্রবণতাটি? এ-সংশয় ও জিজ্ঞাসার যে জন্ম, তা-ই হয়তো প্রকৃত হেলাল-তর্পণ।
তাঁর লেখা বাংলা কবিতাজগতের প্রবেশদ্বার হোক, অন্দরমহল নয়!

তন্ময় ভট্টাচার্য
জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।