(Rabindranath Tagore)
‘সংস্কৃত’ শব্দটিই বলে দেয় কোনও কিছুর পরিশুদ্ধ রূপ। এ এক ভাষার নাম। ভাষা দিয়ে গড়া হয় সাহিত্য, শাস্ত্র, রাজলেখ, বিজ্ঞপ্তি ইত্যাদি। তেমনই এই ভাষায় লেখা হয়েছে অজস্র বাঙ্ময় কলা। ভারত-সংস্কৃতির প্রতি স্তরেই এর নির্যাস। উনিশ শতকে যখন বাংলা সাহিত্য মূলতঃ কলিকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে, তখনই যেন পঞ্জিকা অপেক্ষা করছিল, ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ তারিখটার জন্যই। আবির্ভূত হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)। সমসাময়িক সারস্বত সংস্কৃতি তাঁর সৃজনী প্রতিভাকে পর্যাপ্ত আলো দিয়েছিল বটে। জোড়াসাঁকো, শিলাইদহ-শাহজাদপুর-পতিসর পেরিয়ে শান্তিনিকেতনের পর্বে এসে পৌঁছানোর সঙ্গেই তিনি সঞ্চয় করলেন প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ও সাহিত্য। তাই তাঁর নাটকগুলিতে এসে পড়ল যক্ষপুরী (‘রক্তকরবী’), ক্রৌঞ্চদ্বীপের (‘ডাকঘর’) অনুষঙ্গ বা ঋতুবৈচিত্র্য। তারই সঙ্গে একত্রিত হ’ল বৌদ্ধ সাহিত্য। ভারত-ঐতিহ্যের স্থান-কাল-পাত্রের নবনির্মিতি ঘটল তাঁর গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যে। সেই সঙ্গে প্রাচীন সংস্কৃত নাট্যের একটি মূর্ছনাও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল এই প্রযোজনাগুলিতে। রাজবাড়ির অন্তঃপুর, রম্য কানন, তপোবন, আশ্রম, গণিকালয়ের কথা ‘অভিজ্ঞানশাকুন্তল’, ‘বিক্রমোর্বশী’, ‘রত্নাবলী’, ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘উত্তররামচরিত’ প্রভৃতি নাট্যের স্বয়ংক্রিয় চরিত্র হয়ে উঠেছে, তেমনই রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) গীতিনাট্যে কখনও অরণ্যপথ, কখনও বা ঋষির আশ্রম, আবার কখনও পুষ্পশোভিত কানন, সরোবরের তীর, এমনকি কারাগারও প্রেক্ষাপটে স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে ‘রক্তকরবী’, ‘ডাকঘর’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘গৃহপ্রবেশ’-এ নাগরিক, প্রান্তিক বা শ্রমজীবীদের জীবনালেখ্য আঁকা হয়েছে। ‘বিসর্জন’, ‘তপতী’ নাটকে যদিও সেই আবহ রয়েছে, তবে তার কাহিনির গঠন অন্যরকম। তাই প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য, নাটকের যদি অনুকুল পরিস্থিতির নির্যাস রবীন্দ্রনাট্যে সন্ধান করতে হয়, তবে সেই গীতি-নৃত্যনাট্যগুলিরই দ্বারস্থ হতে হয়। (Rabindranath Tagore)
বদলের বিভিন্ন মাত্রা: রবীন্দ্রনাথ
তিনি মাত্র কুড়ি বছর বয়সে বিদ্বজ্জন-সমাগমের বার্ষিক অনুষ্ঠানের জন্য রচনা করলেন এক গীতিনাট্য– ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ (১৮৮১)। গীতিনাট্যের পথ চলা এখান থেকেই শুরু। এরপরেই আসে আরও দুটি গীতিনাট্য ‘কালমৃগয়া’ (১৮৮২) ও ‘মায়ার খেলা’ (১৮৮৮)। তবে এই পর্যায়ের শেষ এখানেই নয়। পরবর্তীকালে শান্তিনিকেতনে তাঁর পার্থিব জীবনকালের শেষ সম্পূর্ণ দশকের তিনটি নৃত্যনাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৮), ‘শ্যামা’ (১৯৩৯) অবিসংবাদী গীতিনাট্যও বটে। কলাকুশলীরা মঞ্চে নৃত্যাভিনয়ের মাধ্যমে গল্পকে দর্শকের কাছে তুলে ধরলেও নেপথ্যে গানের ভূমিকাকে কি অস্বীকার করা যায়? তাই নাটকীয় ভাব ও ভঙ্গিমায় একটি গীতিনাট্যও চলতে থাকে। তাই ‘মায়ার খেলা’র নৃত্যনাট্য সংস্করণটিকে ধরে তাঁর গীতিনাট্যের সংখ্যা হয় সাতটি। (Rabindranath Tagore)

ঠিক একই রকমভাবে বর্তমানে গীতিনাট্যগুলিও নৃত্যকলার মাধ্যমেই মঞ্চস্থ হয় বলেই নৃত্যনাট্যের সংখ্যাও সাতটিতেই এসে দাঁড়ায়। এছাড়াও আরও একটি প্রযোজনার কথা না বললেই নয়; তা ‘শাপমোচন’ (১৯৩১)। তবে এটি গীতিনাট্য বা নৃত্যনাট্য কোনওটিই নয়। একে রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন ‘কথিকা’। এখানে একজন কথক গল্প বলে যাচ্ছেন আর সেই গল্পেরই কিছু অংশ গানে উঠে আসছে। সেই গানেরই নৃত্যায়ন হচ্ছে মঞ্চে। তবে এ কথাও খেয়াল করার মতো যে ‘শাপমোচন’-এর পরিবেশনার আঙ্গিক বাকি নৃত্যনাট্যের সমরূপ। এমনটি নয় যে ভাষ্যপাঠের সময় মঞ্চ শূন্য থাকছে। সুরসভায় দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপ, সৌর সেনের মর্ত্যে নবজন্ম, বীণার সঙ্গে কমলিকার বিবাহ এবং অরুণেশ্বর-কমলিকার কথোপকথনের সবটুকুই সুচারুরূপে নান্দনিকতায় অভিনীত হয়। তাই এটিকেও ‘উপনৃত্যনাট্য’ বলা যেতেই পারে। তাই ‘শাপমোচন’কে নিয়ে আটটি নৃত্যনাট্যের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) অনুভব করেছিলেন প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের সৌরভ। (Rabindranath Tagore)
সুদূর মণিপুর থেকে আগত গুরু নবকুমার সিংয়ের পরিচালনায় মণিপুরি নৃত্যের সুষ্ঠু সুচারু রূপায়ন হয় এই নাটকের “আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো” গানে। নটীর চরিত্রে অভিনয় করেন নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী দেবী।
‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ ও ‘কালমৃগয়া’কে রামায়ণাশ্রিত গীতিনাট্য বলা হলেও তা পুরোপুরি সত্য নয়। আদি কবি বাল্মীকির “মানিষাদ…” শ্লোকের আবৃত্তিটুকুই বাল্মীকীয় রামায়ণের ঋণ। এছাড়া সরস্বতী তো রয়েছেই। তবে ব্রাহ্ম পরিবারে এখানে সরস্বতী ও লক্ষ্মীর কোনও দৈবী মহিমার বন্দনা নেই। কাব্যপ্রতিভার আদর্শ শুভ্রবসনা সরস্বতীর চিত্রকল্পটুকুই উঠে এসেছে “কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা” যা সাধারণত অলংকারশাস্ত্র জাতীয় গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে দেখা যেত; অন্যদিকে লক্ষ্মীর ভাবনায় মিশে রয়েছে সেই পৌরাণিক ধনসম্রাট কুবেরের অলকাপুরীর অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীমূর্তি। তাই লক্ষ্মী বাল্মীকিকে কেবলই অমিত ধনমাণিক্যের সন্ধান দিতে চেয়েছে। ঠিক তেমনই ‘কালমৃগয়া’য় যেভাবে রামায়ণের কথা গানে-গানে জমাট বেঁধেছে, সেখানে বৈদিক অরণ্যানী সূক্ত (ঋগ্বেদ, ১০।১৪৬) ও মহাকবি কালিদাসের প্রভাবকেও এড়িয়ে চলা অসম্ভব। এই গীতিনাট্যেই তিনি প্রথম বনদেবীদের চরিত্র এনেছেন। ঋগ্বেদে অরণ্যের দয়াময়ী দেবী অরণ্যানীর কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও ‘অভিজ্ঞানশাকুন্তল’, ‘উত্তররামচরিত’ নাটকেও বনদেবতা বা বনদেবীদের চরিত্র রয়েছে। সেখানে তারা মানুষের সুখে-দুঃখে অনুভূতিপ্রবণ হয়েছে। ‘রঘুবংশ’ মহাকাব্যের নবম সর্গ ‘মৃগয়াবর্ণনম্’-এ ‘কালমৃগয়া’র অনুরূপ ঘটনা পাওয়া যায়। অনুচরসহ রাজা দশরথের মৃগয়ার পোশাক পরিধান, তা দেখে বনদেবতাদের বিহ্বলতা, পশুশিকার, ভুলবশত মুনিকুমারের প্রতি বাণনিক্ষেপে মৃত্যু ও অভিসম্পাতের ধারাবাহিক ক্রম হুবহু মিলে যায় যা মূল রামায়ণে পাওয়া যায় না। এমনকি কৃত্তিবাসী রামায়ণের “যেথা তপোবনে বসি অন্ধক-অন্ধকী” (১। ২৮। ৪৪) থেকেই তপোবন ভাবনাটি রবীন্দ্রনাথ নিয়েছেন। এছাড়াও এই গীতিনাট্যের আসল প্রতিবেদন ছিল উপনিষদের ভাবনা। ‘ছান্দোগ্য’ উপনিষদের “বেদ ন পুত্র…” মন্ত্রে বলা হয়েছে যিনি জ্ঞানের গরিমা সন্তানের মৃত্যুশোককেও উপেক্ষা করতে পারেন, তিনিই একাত্মবাদের উপলব্ধি করতে পারেন। জীবনমৃত্যুর চক্রের এ এক ধ্রুববাণী। তাই শেষ দৃশ্যে “যাও রে অনন্তধামে” গানের আবেদন নাট্যটিকে এক ব্রহ্মাস্বাদের স্তরে উন্নীত করে।
‘মায়ার খেলা’ বসন্তকালের নরনারীর মোহ, উচ্ছ্বাস ও মোহভঙ্গের খেলা। এই ধরণের আখ্যান সংস্কৃতের ‘নাটিকা’য় দেখা যেত। শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’, বিহ্লণের ‘কর্ণসুন্দরী’, মদনকবির ‘পারিজাতমঞ্জরী’, বিশ্বনাথের ‘চন্দ্রকলা’ ইত্যাদি। সব নাটিকারই প্রথম অঙ্কে বসন্ত উৎসবের আবহ রচনা করে এক ললিত নায়কের লালিত তপ্তকামের ছবি আঁকা হত। বিবাহিত রাজা কোনও দ্বিতীয় নারীর প্রতি আসক্ত হত। এই নিয়ে রাজমহিষীর ক্রোধ ও শেষে মানভঞ্জন। এই ভাবনার প্রতিলিপিই রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) তৃতীয় গীতিনাট্যটি। এখানে রূপসী যুবতী প্রমদা সখীদের সঙ্গে কাননবিহার করে, একাধিক পুরুষ তার প্রণয়প্রার্থী। তবুও সে সহজে ধরা দেয় না। অন্যদিকে নিঃস্বার্থ প্রেমকে বুকের মধ্যে যত্ন করে রাখে শান্তা। প্রমদার দ্বিচারিতা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। শান্তা গ্রহণ করে অমরকে। (Rabindranath Tagore)
১৯২৬ সালে প্রতিমা দেবীর উৎসাহে ২৫শে বৈশাখের জন্য ‘পূজারিনী’ কবিতা সংলাপের রূপ পায়। হয়ে ওঠে নাটক ‘নটীর পূজা’। সুদূর মণিপুর থেকে আগত গুরু নবকুমার সিংয়ের পরিচালনায় মণিপুরি নৃত্যের সুষ্ঠু সুচারু রূপায়ন হয় এই নাটকের “আমায় ক্ষমো হে ক্ষমো” গানে। নটীর চরিত্রে অভিনয় করেন নন্দলাল বসুর কন্যা গৌরী দেবী। (Rabindranath Tagore)
বিদায়-অভিশাপ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এরপর ১৯৩১ সালে যখন ‘শাপমোচন’ মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ওঠে, তখন রবীন্দ্রনাথ আবারও ফিরে আসলেন বৌদ্ধ জাতকের কাহিনির দিকেই। পূর্বেই তিনি ‘কুশজাতক’-এর ছায়ায় লিখেছিলেন ‘রাজা’ নাটক (১৯১০)। এই নাটককে কথিকায় রূপান্তরিত করতে গিয়ে তিনি আরেকবার ঘুরে তাকালেন সেই প্রাচীন বৌদ্ধ আখ্যানের দিকেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই স্বীকার করেছেন
“যে বৌদ্ধ-আখ্যান অবলম্বনে রাজা নাটক রচিত তারই আভাসে শাপমোচন কথিকাটি রচনা করা হল।” খেয়াল করলেই বোঝা যায় তিনি ‘বৌদ্ধ-আখ্যান’টিকেই জোর দিয়েছেন; ‘রাজা’ নাটককে নয়। স্বর্গরাজ্যে অভিসম্পাত এবং মর্ত্যবাসের যে কাঠামো, তা অনেকাংশেই কালিদাসের ‘বিক্রমোর্বশী’ ত্রোটক এবং বাংলার মনসামঙ্গল কাব্যধারার ঊষা ও অনিরুদ্ধের আখ্যানের প্রভাব রয়েছে। ‘গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) ও আধুনিক ভারতীয় নৃত্য’-এ শান্তিদেব ঘোষ জানিয়েছেন যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর জন্য ‘বিক্রমোর্বশী’-র দ্বারা আচ্ছন্ন ছিলেন “…অন্যমনস্কতাজনিত ত্রুটির অপরাধে নটী অথবা সঙ্গতকারকে যে স্বর্গ থেকে বিচ্যুত করে কিছুকালের জন্য মর্ত্যে পাঠানো হয়েছিল তার উল্লেখ আমরা পাই প্রাচীন সংস্কৃত নাটক “বিক্রমোর্বশী”তে..”। আবার অভিশাপের বিষয়টিকেই যদি এখানে কেন্দ্রবিন্দু ধরা হয়, তবে এক্ষেত্রে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ এবং ‘অভিজ্ঞানশাকুন্তল’ নাটকের হয়ে ওঠাকেই বা কীভাবে উপেক্ষা করা যায়? ‘মেঘদূত’-এর প্রথম শ্লোকেই বলা হয়েছে “কশ্চিদ্কান্তাবিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ/শাপেনাস্তংগমিতমহিমা বর্ষভোগ্যেন ভর্তুঃ//”। রাজেন্দ্রলাল মিত্র সম্পাদিত ‘The Sanskrit Buddhist Literature of Nepal’-এ এই গল্পে অলিন্দা দেবীর অপরাধে দেবরাজ ইন্দ্রের অভিশাপে হতশ্রী কুশ রাজার জন্ম, কমলিকার পিতৃকুল মদ্রকরাজবংশীয়, বহু পুরুষের মধ্যে কমলিকার রাজাকে দেখা ও রাজার কুৎসিত রূপকে ধিক্কার “এদৃশো ছত্রধারো বিকৃতরূপো স্থূলোষ্ঠো স্থূলশিরো স্থূলপাদো মহোদরো কালো মষিরাশিবর্ণো” এবং কমলিকা শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করলে ক্লান্ত হয়ে রাজার কাণ্যকুব্জের এক গ্রামে বীণা বাজানো “তেন দানি রাজ্ঞা কুশেন তাদৃশী বীণা বাদিতা গীতকং গাযিতং যং সর্বো গ্রামজনো আরাধ্যতি”। এই প্রসঙ্গেই ‘শাপমোচন’-এ রয়েছে “মোর বীণা ওঠে” গানখানি।

তবে এও ঠিক যে রবীন্দ্রনাথ এখানে গান্ধার মহাজনপদের উল্লেখ করেছেন। এর অবস্থান বর্তমান আফগানিস্তান দেশের কান্দাহারে। রবীন্দ্রনাথ কাশীর বদলে এই জনপদের ব্যবহার কেন দেখালেন? এই শব্দের সঙ্গে ‘গন্ধর্ব’ শব্দের সংসর্গ রয়েছে যার অর্থ ললিত কলা। আবার মদ্ররাজকুল নামটির পরিবর্তন করেননি; তার কারণ এই শব্দে সংস্কৃত √মদ্ ধাতু রয়েছে যার অর্থ গর্ব। কমলিকার রূপের গর্ব এখানে ছত্রে ছত্রে অনুভূত। তাই মদ্র ও গান্ধার যেমন একদিকে প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনৈতিক ভাবনাকে প্রতিফলিত করেছে, তেমনই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে এই স্থানদুটির নামকরণ সঙ্গত হয়েছে। (Rabindranath Tagore)
মূল জাতককথায় পাওয়া যায় যে কাশীনরেশ কুশ জ্যোতীরত্নের প্রভাবে সুদর্শন হয়েছিল এবং সেই রূপের মোহেই সুদর্শনা তাকে পতিরূপে বরণ করে। রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) কোনওভাবেই এই বিষয়টিকে সাহিত্যে স্থান দেননি। বলা যায় অরূপসাধক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিমূর্ত সৌন্দর্যের তাপস। তিনি ব্রাহ্মধর্মের নিরাকার অনভিব্যক্ততেই পরম সত্যের সন্ধান পেতে চেয়েছিলেন। তাই রাবীন্দ্রিক দর্শনে এই ধরণের রত্নপ্রভার মোহান্ধতাকে তিনি সমূলে উচ্ছেদ করেছেন তাঁর রচনায় – “অসুন্দরের পরম বেদনায় সুন্দরের আহ্বান।” (Rabindranath Tagore)

এর রেশ ধরেই আসতে হয় ‘চিত্রাঙ্গদা’য় যাকে বলা যায় প্রথম স্বতস্ফূর্ত রবীন্দ্র-নৃত্যনাট্য। ১৮৯২ সালে তিনি মহাভারতের আদিপর্বের ২০৮নং অধ্যায় ‘অর্জুনবনবাস’ থেকে মণিপুরনৃপদুহিতা চিত্রাঙ্গদার কথাবস্তুর চয়ন করেছিলেন। একদা অর্জুন মণিপুরের রাজগৃহে আসে এবং রাজা চিত্রবাহনের সুন্দরী কন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখেই তাকে বিবাহের প্রস্তাব দেয়। চিত্রবাহনের বংশে তার পূর্বপুরুষ প্রভঙ্কর শিবের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন। তবুও চিত্রবাহনের এক কন্যা সন্তান জন্মালে যথাসময়ে রাজ্যভার নিজ কন্যাকে অর্পণ করার জন্যই তাকে পুরুষোপম শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলে। তাই মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা জন্মসূত্রেই ছিল “সুবর্ণকিরণে রঞ্জিত ছায়া” ও “বাহুবলে তিনি রাজা”; কিন্তু নাটকে তিনি রূপ ও গুণের একটি দ্বন্দ্ব উত্থাপন করলেন এবং মদনদেবের সেই বর্ষভোগ্য বরদানের কথাও জুড়ে দিলেন। একটি বছর হয় ছয় ঋতুর সমাহারে। কখনও তেজ, কখনও স্নিগ্ধতা, কখনও জড়ত্ব আবার কখনও বা চাঞ্চল্য। এ যেন মানবজীবনের প্রতিটি স্তর ও সংবেদনশীলতা। প্রতি অনুভবে অপরূপ মাধুরীর বা ঘোর কঠিন অভিশাপের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তার জন্যই এই আশীর্বাদ বা অভিশাপের অবতারণা “সুন্দরী যুবতী যদি অনুভব করে যে সে তার যৌবনের মায়া দিয়ে প্রেমিকের হৃদয় ভুলিয়েছে তা হলে সে তার সুরূপকেই আপন সৌভাগ্যের মুখ্য অংশে ভাগ বসাবার অভিযোগে সতিন বলে ধিক্কার দিতে পারে।” (Rabindranath Tagore)

এরপর আসে ‘পরিশোধ’ ও ‘চণ্ডালিকা’। প্রথমটি ‘শ্যামাজাতক’ ও দ্বিতীয়টি ‘শার্দূলকর্ণাবদান’ এর ছায়াতলে রচিত। এই ‘পরিশোধ’-এর নাম হয় ‘শ্যামা’। ভগবান বুদ্ধ কোনও এক জন্মে ছিলেন অশ্ববণিক বজ্রসেন। ঘটনাচক্রে তাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে প্রাণে বাঁচায় বারাণসীর সুন্দরীপ্রধানা গণিকা শ্যামা। তবে এর জন্য আরেক যুবককে নিহত হতে হয় শ্যামারই চক্রান্তে। সেই যুবকের কোনও নাম ছিল না জাতকের গল্পে। থেরগাথার তৃতীয় বর্গের শেষ গাথায় দেখা যায় ভগবান বুদ্ধকে চন্দ্রভাগা নদীতে পারাপার করতে সাহায্য করে এক কুমীর। বুদ্ধপ্রদত্ত কল্যাণেই ‘উত্তিয়’ নামে তার জন্ম হয়। আত্মত্যাগ ও দয়াপরশবতার গুণের জন্যই এই নামটি ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে সাদরে গৃহীত হয়েছে। নৃত্যনাট্যে কাশী নগরের উল্লেখ না থাকলেও ‘পরিশোধ’ কবিতায় তার সরাসরি উল্লেখ রয়েছে “অশ্ব বেশিবার তরে এসেছিল কাশী”। এছাড়াও বিভিন্ন গানে ‘সুবর্ণদ্বীপ’, ‘অলক্ষ্য অলকাপুরী নিবাসিনী’র উপমা দেওয়া হয়েছে। সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগর’-এ এই প্রাচীন সুবর্ণদ্বীপের কথা রয়েছে যা ছিল বাণিজ্যিক ঘাঁটি। অলকাপুরী সেই ‘সব পেয়েছির দেশ’ যেখানে ছয় ঋতু একসঙ্গে ফুল ফোটায়, কারোর মনে দুঃখ নেই, সকলেই বৃহদাকার অট্টালিকায় বাস করে ও কামনা চরিতার্থের বিলাসবৈভবেরও ঘাটতি নেই। তাই উত্তীয়ের মানসপ্রতিমা তথা শ্যামার উদ্দেশ্যেই এই কথা বলা। সেই যক্ষ যেমন তার প্রিয়াকে সর্বাঙ্গসুন্দররূপে কল্পনায় গেঁথেছিল, তেমনই এক ভাবনার মিল কবি দেখিয়েছেন। (Rabindranath Tagore)
মূল অবদানগল্পের এক পঞ্চমাংশের ব্যবহার করে এক অনন্য সামাজিক বার্তা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অবদানসাহিত্যে প্রকৃতির বাধ্যবাধকতা শুনেও আনন্দের জলগ্রহণের সময় শুধুমাত্র উক্তি ছিল “দেহি, পাস্যামি” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ তাকে প্রসারিত করেন
‘চণ্ডালিকা’র অংশটি দিব্যাবদানের ‘শার্দূলকর্ণাবদান’ গল্প থেকে নেওয়া। প্রকৃতি ছিল এক ‘মাতঙ্গদারিকা’ ও তার মা ছিল ‘মায়াবিদ্যাধরী’। শ্রাবস্তী নগরে একদিন ভিক্ষু আনন্দকে জলদানসহ প্রকৃতির মায়ের ইন্দ্রজালবিদ্যার ব্যভিচার পর্যন্ত ঘটনাটির এক রাবীন্দ্রিক তর্জমা তৈরি হয়েছে এই নৃত্যনাট্যে। মূল অবদানগল্পের এক পঞ্চমাংশের ব্যবহার করে এক অনন্য সামাজিক বার্তা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। অবদানসাহিত্যে প্রকৃতির বাধ্যবাধকতা শুনেও আনন্দের জলগ্রহণের সময় শুধুমাত্র উক্তি ছিল “দেহি, পাস্যামি” কিন্তু রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) তাকে প্রসারিত করে বললেন “যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা”। তারই সঙ্গে প্রাচীন উপরূপক জাতীয় নাট্যপদ্ধতির মধ্যে ঐন্দ্রজালিক নৈপুণ্য প্রকাশের এক বিশেষ দিকও এখানে দেখানো হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বভারতীর প্রযোজনায় এই অংশটি তালবাদ্য সহযোগে উপস্থাপিত হয়।
এছাড়াও বিশ্বভারতীতে পালিত হয়ে আসছে হলকর্ষণ, বর্ষামঙ্গল, বসন্তোৎসবের মতো অনুষ্ঠান। তিনিই লিখেছেন ‘ঋতুরঙ্গশালা’। এটিও প্রাচীন ভারতের এক নৃত্যানুষ্ঠান। অভিনবগুপ্তের ‘অভিনবভারতী’ টীকায় পাওয়া যায় যে সেই সময় ঋতুবর্ণনাধর্মী নৃত্তপ্রবন্ধের নাম ছিল ‘রামাক্রীড়’। তাই ‘ফাল্গুনী’, ‘বসন্ত’, ‘শ্রাবণগাথা’র মতো গানবহুল রচনাগুলিতেও এই পুরাতনী ধারার নবায়ন ঘটেছে। (Rabindranath Tagore)

তাই গীতিনাট্য-নৃত্যনাট্য এমনই এক রচনা যার রবীন্দ্রোত্তর কালে কোনও প্রতিযোগী নেই। নৃত্যনাট্যের অনেকখানি ধারণা তিনি ১৯২৭ সালে জাভাদ্বীপ ভ্রমণের সময় পেয়েছিলেন। পরে পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী, শান্তিদেব ঘোষ, নন্দলাল বসু, সুরেন্দ্রনাথ কর, গৌরী বসু প্রমুখের পূর্ণ সমর্থনে এক ধ্রুপদী সম্মাননা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের ভারত-ইতিহাসপ্রীতির প্রভাব পড়েছিল এই ধরণের রচনাগুলিতে। যদিও তিনটি নৃত্যনাট্যই তাঁর পূর্বের কোনও না কোনও কাব্যনাট্য, নাটক বা কবিতার পুনর্নির্মাণ, তাও একথা বলতেই হয় যে সেই ধরণের রচনাগুলিকেই নৃত্যনাট্যে রূপান্তরিত করা হয়েছে যেখানে ভারতের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ভিত্তি অমলিন। (Rabindranath Tagore)
ঋণস্বীকার
অবদান সাহিত্য ও রবীন্দ্রনাথ – কল্যাণীশঙ্কর ঘটক
রবীন্দ্রসঙ্গীতের নানাদিক – বীরেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্রসংস্কৃতির ভারতীয় রূপ ও উৎস – পম্পা মমজুমদার
সমীপেষু পেশায় বঙ্গবাসী কলেজের অধ্যাপক। টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে গবেষণা করছেন। গবেষণা করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও। তাঁর নেশা বাংলার ইতিহাস। কলকাতার কথকতা দলের অন্যতম সদস্য সমীপেষু ভালবাসেন এই বিষয় নিয়ে নতুন নতুন তথ্য অনুসন্ধান এবং লেখালিখি।