পাহাড় নদী ঝর্না জঙ্গল ইত্যাদি সম্পৃক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সবসময়ই উপভোগ্য। নীল আকাশের নীচে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা অন্য এক মাত্রা পেয়ে যায় যখন দিশাহীন বাতাস কখনো ধীর লয়ে কখনও আবার প্রবল বেগে বইতে শুরু করে। সোনা রোদ ছড়ানো আকাশ এখানে হঠাৎ করেই কালো মেঘে ছেয়ে যায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে। বিকশিত হয় প্রকৃতির অন্য এক রূপ। রোদ-বৃষ্টি, আলো-ছায়া, শীত-গ্রীষ্ম নানানরূপে ফুটিয়ে তোলে মেঘালয়ের প্রাকৃতিক বৈচিত্র। প্রকৃতির অপার বাহার নিয়েই বেঁচে আছে মেঘালয়ের গারো, খাসি ও জয়ন্তিয়া পাহাড় এবং সংলগ্ন মালভূমি-সমভূমি। আর প্রকৃতির বৈচিত্রকে পুরোপুরি আত্মস্থ করে এগিয়ে চলে স্থানীয় জনজাতির প্রাণোচ্ছল জীবনযাপন। শিল্পী-কবি-সাহিত্যিক এখানকার প্রকৃতি আর জনজীবন অবলোকন করে মোহিত হয়ে গড়ে তোলেন আপন সৃজন। এমনকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ। তিনবার শিলং ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তাঁর স্মৃতিতে এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে ১৯২৭-এ তৃতীয় এবং শেষবারের মতো শিলং থেকে ফিরে যাওয়ার কিছুদিন বাদে যখন বাঙ্গালোরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছেন তখনই রচনা করেন শেষের কবিতা । বাঙ্গালোরে আসার আগে অসুস্থ অবস্থায় কলম্বোয় বসে লেখা প্রথম খসড়া ১৯২৮-এর ২৫-শে জুন চূড়ান্ত রূপ পেল। শিলং-এর স্মৃতি উজাড় করে লেখা শেষের কবিতার সতেরোটি পরিচ্ছেদের মধ্যে তেরোটিতেই শিলং-এর বর্ণনা চিত্রিত। রক্তকরবী নাটক এবং উপন্যাস যোগাযোগ তো তাঁর শিলং বাসেরই ফসল।

প্রযুক্তিবিদ এখানকার নদী-ঝর্না, অফুরান রবিরশ্মি থেকে খুঁজে পায় বৈদ্যুতিক শক্তির উৎস। ভূতাত্ত্বিকের দক্ষ দৃষ্টি অনুসন্ধান করে মাটির গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্পদ। এখানকার কমলালেবু আর অরণ্য থেকে সংগৃহীত মধু বহুদিন ধরেই বাণিজ্যিক পণ্য। নীল আকাশের নীচে চরাচরব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বর্ণময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সহজ সরল জনজীবন হয়ে যায় পর্যটন শিল্পের মূল উপকরণ। এইরকম আরও কত ভিন্ন পেশার মানুষ পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সম্পদের খোঁজখবর করে। এহেন নিবিড় সমীক্ষাই তো বাজারের নিরিখে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও এই বিষয়ে সজাগ ছিল। ১৮২৪-এর প্রথম ইঙ্গ-বার্মিজ যুদ্ধের পর থেকেই জয়ন্তিয়া, খাসি ও গারো পাহাড়ের অন্দরে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় দিন গুনছিল বিদেশি বণিক। কোম্পানির তরফে অনেককেই সমীক্ষা করতে পার্বত্য এলাকায় পাঠানো হল। তবে এলাকাটির জনবসতি তেমন ঘন নয় বলে রাজস্ব আদায়ের বিষয়ে সংশয় দেখা দেয়। পাহাড়ি জমির নীচে কী কী প্রাকৃতিক সম্পদ থাকতে পারে তা-ও জানা নেই। কাজেই এখনকার মেঘালয়ের বিষয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে ব্রিটিশ কোম্পানি তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ১৮২৬-এ অহোম রাজ্য (এখনকার গুয়াহাটি থেকে শুরু করে ডিব্রুগড় হয়ে তিনসুকিয়া পর্যন্ত সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা) আয়ত্ত্বে আসার পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুঝতে পারে যে বর্মার সঙ্গে শান্তি চুক্তি হলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে সীমান্ত এলাকায় কড়া নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। কাজেই ফৌজের যাতায়াত ব্যবস্থা মসৃণ করার জন্য অসম থেকে সিলেট পর্যন্ত একটি পাকা সড়ক গড়ে তোলা অপরিহার্য। একই সঙ্গে এই রাস্তা বাণিজ্য প্রসারেও কাজে লাগানো যাবে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সিল্ক, তুলো, মোম, মধু প্রভৃতি সুরমা উপত্যকার সিলেটে পৌঁছে দিতে পারলে তা সারা বাংলায় সহজেই ছড়িয়ে দিতে অসুবিধা হবে না। রাস্তার জন্য জমি দরকার। কিন্তু স্থানীয় জনজাতির সঙ্ঘবদ্ধ আপত্তিতে কিছুতেই লক্ষ্য পূরণ হচ্ছিল না। ডেভিড স্কট তখন এই এলাকার প্রশাসক। ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে সদ্য কৈশোর পেরোনো ডেভিড স্কটের ভারতে আগমন। ১৮০২ নাগাদ তিনি উত্তর পূর্ব ভারতের বিভিন্ন এলাকায় প্রশাসনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বেশ কয়েক বছর পর তিনি হলেন রংপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর কর্মকুশলতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যারপরনাই সন্তুষ্ট। রংপুর তো ছিলই এবার কাঁধে চাপল গোয়ালপাড়া জেলা। তারপর গারো পাহাড়। অবশেষে ১৮২৩-এ হয়ে গেলেন বাংলার উত্তর পূর্ব সীমান্ত এলাকার প্রধান প্রশাসক বা গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি অর্থাৎ পলিটিক্যাল এজেন্ট।

দীর্ঘ দুই দশক ধরে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অবাধ বিচরণের সুবাদে স্থানীয় লোকজন, সমাজ, সংস্কৃতি, সামাজিক রীতিনীতি ইত্যাদি ডেভিড স্কটের আয়ত্ত্বে এসে গেছে। প্রশাসকের পোশাকে শুরু হল কূটনৈতিক জীবন। স্কট জানতেন যে খাসি, জয়ন্তিয়া, গারো সমাজে রাজতন্ত্র অনুপস্থিত। এখানে গ্রামই হল সমাজের প্রাথমিক স্তর। সাধারণত একই বংশ বা ক্ল্যানের মানুষের কোনও নির্দিষ্ট গ্ৰামে বসবাস। নির্বাচিত গ্রাম প্রধান গ্রাম এবং ক্ল্যানের প্রশাসন পরিচালনা করেন। কয়েকটি ক্ল্যান নিয়ে তৈরি হয় রেইড। দুই বা আরও বেশি ক্ল্যানের মধ্যে বিবাদ হলে তার বিচারের দায়িত্ব পালন করেন রেইড-এর প্রধান। কয়েকটি রেইড মিলিয়ে তৈরি হয় সিয়েম (syiem)। এখানকার সমাজে এবং প্রশাসনে সিয়েমই শেষ কথা বলার অধিকারী। ক্ল্যান, রেইড এবং সিয়েম-এর প্রধান কিন্তু বংশানুক্রমিক পদ নয়। রীতিমতো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত পদ। এখানকার সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হলেও ক্ল্যান প্রধান নির্বাচনে শুধুমাত্র ক্ল্যানের বয়স্ক পুরুষরাই অংশ নিতে পারতেন। নির্বাচিত গ্রাম প্রধান কিন্তু এককভাবে কোনও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। গ্রামসভা বা দরবার স্বনং-এ (durbur sbnong) গ্রামের সকলের উপস্থিতিতে সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। একই রীতিতে চলত রেইড এবং সিয়েম। প্রতিটি সিয়েম স্বাধীন, সার্বভৌম এবং স্বতন্ত্র। সিয়েম কোনও প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সমস্ত ক্ল্যান, রেইড প্রধানদের নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে হত। একটি প্রাচীন জনজাতির সমাজের এমন গণতান্ত্রিক আচরণ দেখে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তাব্যক্তিরা বিস্মিত না হলেও বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। প্রতিবেশী আহোম রাজের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রশাসন পরিচালনা সম্পর্কে ব্রিটিশের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু সেখানেও আহোম রাজার সঙ্গে কথা বললেই কাজ হয়ে যায়। প্রয়োজনে আহোম রাজা তাঁর মন্ত্রিসভা এবং আমাত্যদের সঙ্গে আলোচনা করে নিজেদের মতামত জানাতে পারেন। কিন্তু খাসি, জয়ন্তিয়া, গারো সমাজে তা সম্ভব নয়। যে কোনও নতুন প্রস্তাব সমস্ত সিয়েম একত্রিত হয়ে আলোচনা করতেন। দরবার হিমা নামে পরিচিত সেই আলোচনাসভার জন্য এখনকার সংসদ ভবনের মতো কোনও নির্দিষ্ট জায়গা বা বাড়ি ছিল না। বিভিন্ন গ্রামে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রয়োজন মতো আয়োজিত হত দরবার হিমা।

দায়িত্ব পাওয়ার পর ডেভিড স্কট বুঝতে পারলেন এখানকার গোষ্ঠিপতিদের অর্থাৎ সিয়েমের সর্বসম্মত সম্মতি না পেলে জমি পাওয়া যাবে না। পুরো এলাকায় তখন অন্তত পঁচিশ-ছাব্বিশটা সিয়েমের রাজত্ব। পাহাড় জঙ্গল ঘেরা দুর্গম এলাকায় অবস্থিত প্রতিটি সিয়েমে পৌঁছনো রীতিমতো কষ্টকর এবং সময়সাপেক্ষ। ১৮২৬-এ অহোম রাজ করায়ত্ত করার পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর সময় নষ্ট করতে রাজি নয়। চল্লিশ বছর বয়সের ডেভিড স্কট তখন গুয়াহাটি থেকে সিলেট হয়ে ঢাকা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য জমির সন্ধানে পাগলের মতো ছোটাছুটি করছেন। কিছু একটা না করতে পারলে কোম্পানির মুখরক্ষা করা যাবে না। একই সঙ্গে পুড়বে নিজেরও মুখ। হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে সমগ্র উত্তর পূর্ব ভারতের প্রশাসন। অবশেষে নিজের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত দক্ষতা এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় ডেভিড স্কট খুঁজে পেলেন রাস্তা নির্মাণের রাস্তা।
আগের পর্ব – জোয়াই (পর্ব ৪)
প্রশিক্ষিত প্রযুক্তিবিদ ও পরিচিত পরিকল্পনাবিশারদ। পড়াশোনা ও পেশাগত কারণে দেশে-বিদেশে বিস্তর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। তার ফসল বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় বই। জোয়াই, আহোম রাজের খোঁজে, প্রতিবেশীর প্রাঙ্গণে, কাবুলনামা, বিলিতি বৃত্তান্ত ইত্যাদি।