ঋতুস্রাব মেয়েদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অথচ এখনও তা নিয়ে মৌলিক সচেতনতাটুকু নেই বহু মেয়ে এবং মায়েদের মধ্যে। ঋতুমতী মেয়েদের ও তাদের মায়েদের জীবন সহজ করতে কিছু টিপস দিলেন বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর প্রফেসর কল্পনা সরকার (মেম্বার অফ বিওজিএস)। শুনলেন কস্তুরী ভারভাদা।
মেয়ে হলেই সংসারে অমঙ্গলের ছায়া নেমে আসে, এ ধারণা থেকে সমাজকে বার করে আনতে কয়েকশো বছর সময় লেগেছে। যদিও এখনও তা সম্পূর্ণ হয়নি। এমন দেশে মেয়েদের শারীরিক পরিবর্তন ও বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে সচেতন করা পাহাড় ঠেলার সমান। কিন্তু কাজটা যতই কঠিন হোক, ধীরে ধীরে কাঁটাটা এগোচ্ছে।
মেয়েদের ঋতুমতী হওয়ার বয়স সাধারণত সাড়ে চোদ্দ বছর। এখন অবশ্য সেটা অনেকটাই এগিয়ে এসেছে। তার একাধিক কারণও রয়েছে। প্রধান কারণ হিসেবে হয়তো পরিবেশ দূষণ এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনকে দায়ী করা যেতে পারে। চিকিৎসকদর মতে, বেশি পরিমাণে প্রোটিন ও বাইরের খাবার খাওয়া এখন অনেক বেড়ে গেছে। ফলে চাইল্ডহুড ওবেসিটির সমস্যা বাড়ছে। কমছে ছোটাছুটি করে খেলাধুলো করার প্রবণতাও। বাচ্চারা বন্দি হয়ে থাকছে ভার্চুয়াল জগতে। ফলে পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসছে। বাচ্চাদের স্ট্রেস বেড়ে যাওয়াও তাড়াতাড়ি পিরিয়ড হওয়ার একটা বড় কারণ।
বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর প্রফেসর কল্পনা সরকার জানালেন, সদ্য ঋতুমতী মেয়েদের ও তাদের মায়েদের কর্তব্য বিষয়ে। তাঁর মতে, পিরিয়ডস হলেই মেয়েদের সে কথা মাকে খুলে বলা উচিত। আর মায়েদের উচিত মেয়ে বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছনোর আগে থেকেই কিছুটা এ বিষয়ে সচেতন করতে থাকা। সাধারণত যেটা দেখা যায় যে একটি মেয়ে হয়তো তার আগে যে মেয়েটির পিরিয়ডস হয়েছে, তার থেকে শোনে-জানে। কিন্তু সেই মেয়েটিরও তো অভিজ্ঞতা অল্প! ফলে অধিকংশ সময়েই নানা ভুল ধারণা, ভয়, অস্বস্তি মনে বাসা বাধে। কাজের কাজ কিছু হয় না।
মায়েরা মেয়েদের আগে থেকেই বুঝিয়ে দিতে পারেন যে পিরিয়ড একটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সব মেয়েদের হয়। এর মধ্যে কোনও ভয়ভীতিলজ্জার ব্যাপারই নেই। ডক্টর সরকারের মতে, “এক্ষেত্রে স্কুলের শিক্ষিকাদেরও একটি বিশেষ ভুমিকা আছে। কারণ অনেক সময়েই স্কুলে প্রথমবার পিরিয়ড হয়। মেয়েরা শিক্ষিকাদের বলতে সঙ্কোচবোধ করে। কিন্তু শিক্ষিকারা যদি ছাত্রীদের সঙ্গে সহজভাবে বন্ধুর মতো মেশেন তাহলে মেয়েরা মা ছাড়াও শিক্ষিকাদের সঙ্গে খুব আপন ভাবে সমস্ত সমস্যা আলোচনা করতে পারে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মেয়েটির বাড়ি হয়তো খুব রক্ষণশীল। মায়েরা ইচ্ছে থাকলেও বাড়িতে খোলাখুলি পিরিয়ড নিয়ে আলোচনা করার পরিবেশ পান না। সেক্ষেত্রে শিক্ষিকারা ছাত্রীদের অনেকটা কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারলে বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। এখন প্রায় প্রতিটি স্কুলে সেক্স এডুকেশন ও ঋতু সম্পর্কে বিভিন্ন সচেতনতা অনুষ্ঠান চালু হয়েছে। এটি খুব ভালো প্রচেষ্টা।”
আরও একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করান ডক্টর সরকার। সেটি হল, ঋতুমতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অপরিণত বয়সে গর্ভবতী হওয়ার একটি প্রবণতা দেখা যায়, সে সম্পর্কে মেয়েটিকে সচেতন করা। কোনও মেয়ে যদি অসাবধানতাবশতঃ গর্ভবতী হয়ে পড়ে, তবে তাকে ও তার পরিবারকে বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। ফলে একটি কিশোরী মেয়ের এ বিষয়টি জেনে রাখা জরুরি যে পুরুষবন্ধুর সঙ্গে কতখানি ঘনিষ্ঠতায় সে নিরাপদ থাকতে পারবে। কোনও সমস্যার আঁচ পাওয়ামাত্র সে যেন দ্বিধাবোধ না-করে মা বা শিক্ষিকাকে জানাতে পারে।
কিন্তু এ তো গেল শহুরে সচেতনতা। গাঁ-গঞ্জের মেয়েরা কী করবে? ডক্টর সরকারের কথায়, “গ্রামের দিকে নিকটবর্তী যে কোনও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে তৎক্ষনাৎ যোগাযোগ করা উচিত। আমাদের দেশে অতি সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট রায় দিয়েছে যে, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ৪৯ দিনের মধ্যে ভ্রুণ মেডিকালি টার্মিনেট করা আইনের চোখে দণ্ডনীয় নয়। কিন্তু এর চেয়ে বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলে ভ্রুণ নিষ্কাশন সম্ভব নয়। কাজেই পিরিয়ড বন্ধ হলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভয় না-পেয়ে বাড়ির বড় কাউকে জানাতে হবে এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ আমাদের দেশে একটি অল্পবয়সী অবিবাহিতা মেয়ের পক্ষে সন্তানকে বড় করে তোলা অত্যন্ত কঠিন। সমাজ এবং অনেকক্ষেত্রেই বাড়ির লোকও শিশুটিকে অবাঞ্ছিত মনে করে। ধর্ষিতার সন্তানকেও সমাজ ভালো চোখে দেখে না। ফলে সেই সন্তান মেয়েটির বিকাশের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বিনা দোষে নষ্ট হয় একটি ভবিষ্যত, একটি জীবন। ছোট্ট একটা ভুল, কিছুটা অসাবধানতা, তারপর ভয়-সংকোচ, সচেতনতার অভাব, এই অপরিণত মেয়েগুলির জীবন সংঘাতে পরিপূর্ণ করে দেয়।”
আরও একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ঋতুমতী অবস্থায় সঠিক স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে নিজেকে পরিষ্কার রাখা। অর্থাৎ যাকে ইংরেজি পরিভাষায় বলে মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন। এই বিষয়গুলো কিন্তু একটি বাচ্চা মেয়ে মূলত মায়ের থেকে (বা বাড়ির আর কোনও মহিলা সদস্যের থেকে) সঠিকভাবে জানতে পারে। আমাদের দেশের জনসংখ্যার মধ্যে শতকরা ৭৫ জন থাকে গ্রামে। সেখানে এখনও সচেতনতার ঘোর অভাব। সচেতনতা প্রচারের কাজ খুবই দুরূহ এবং কষ্টসাধ্যও বটে।
এ ব্যাপারে ডক্টর সরকার বলেন, “গ্রামের মেয়েরা অধিকাংশক্ষেত্রে প্যাডের খরচ জোটাতে পারেন না। তাঁরা কাপড় ব্যবহার করেন। এই কাপড়ও আবার একবার ব্যবহার করে ফেলে দেন না। খরচ বাঁচাতে সেই কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে একাধিকবার ব্যবহার করতে থাকেন। যদিও সরকার থেকে বিনামূল্যে প্যাড দেবার ব্যবস্থা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই দূরত্বের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়েই উঠতে পারেন না মেয়েরা। সে ক্ষেত্রে ব্যবহৃত কাপড় সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকনোর পর যদি নিমপাতা দিয়ে ফোটানো জলে কাপড়টি ফুটিয়ে নেন, অনেকটাই জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া প্রত্যেকবার শৌচাগার ব্যবহার করার পর জল দিয়ে নিজের শরীর থেকে রক্ত ধুয়ে ফেলা অতি আবশ্যক। আর এই জল ব্যবহার সবসময়ে ওপর থেকে নিচের দিকে ঢেলে কাজ করা উচিত, কারণ এর উল্টোদিক থেকে জল ব্যবহার করলে বাহ্যদ্বারের জীবাণু যোনিতে সংক্রামিত হতে পারে। তার থেকে ইউটিআই-সহ একাধিক গুরুতর রোগের সূত্রপাত ঘটতে পারে।”
ডক্টর সরকার আরও জানান, “মেয়েরা এই সময় যে প্যান্টি ব্যবহার করে, সেটির উপর যদি একটু গরম ইস্ত্রি চালিয়ে নেয় তবে ওখানকার জীবাণুগুলি মরে যায়। এই সহজ ঘরোয়া পরিচ্ছনতার পাঠটুকু যদি গ্রামের (এবং শহরের) মেয়েদের দেওয়া যায়, তাহলে কিন্তু মাসের ওই কটা দিন আর মুখ ব্যাজার করে থাকতে হয় না। প্রয়োজনে স্কুলে স্কুলে মেয়েদের মেনস্ট্রুয়াল হাইজিন বিষয়ে বোঝানো উচিত, বিভিন্ন যোগদানমূলক ক্লাসের মাধ্যমে বিষয়টিকে সহজ করে তুলতে হবে। একটি কো-এড স্কুলে পড়া মেয়ে হঠাৎ ঋতুমতী হলে সে অত্যন্ত লজ্জায় পড়ে যায়। কিন্তু যদি আমরা ছেলেদেরও সহজ ভাবে বিষয়টা বুঝিয়ে দিতে পারি, তাহলে আর লজ্জার কোনও ব্যাপার থাকবে না। আসলে আমাদের দেশে এখনও ঋতুচক্র বিষয়ক সচেতনতা গড়ে তোলাটাই মুখ্য কাজ। সেটা ঠিক ভাবে করে যেতে পারলেই সমস্যার অনেকটা সমাধান সম্ভব।”
কস্তুরী ইতিহাসে এমএ পাশ দিয়েছেন। চাকরিও করেছেন বেশ কিছু কাল। এখন ফ্রিলান্স লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রিকায়। বেশ কিছু বছর আনন্দবাজার পত্রিকার "উৎসব" পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন। গান শুনতে আর সিনেমা দেখতে ভারী ভালবাসেন।