হে পাঠক, মনে রেখ, এই একবারই তুমি মানুষ হয়ে জন্মেছ। যদি পরজন্ম বলে কিছু থাকেও, তাহলে পরের বারে তুমি ঠিক কী হয়ে জন্মাবে– তা কেউই জানে না। আর মানবজীবন অতি ক্ষণস্থায়ী। নিশীথ রাত্রির আকাশের তারাদের মতো মানুষের জীবনও যেন ‘এই আছি, এই নেই!’
সুতরাং এ বছর তোমার জীবনের ওপর দিয়ে যে বর্ষাকাল, মাতলা নদীর ধারার মতো কুলকুল ছন্দে বয়ে যাচ্ছে, জেনে রেখ, তা আর এ জীবনে কোনওদিনও বয়ে যাবে না। সময় পেরিয়ে যাবে। তাকে ধরে রাখা যাবে না। খাঁচার দরজা খোলা পেয়ে উড়ে যাওয়া বজ্জাত টিয়াপাখি কিংবা ভাড়াটের রামবদমাইশ ছেলের বেধড়ক প্যাঁদানি খেয়ে সাতদিন বেপাত্তা হয়ে যাওয়া গিন্নির পেয়ারের একচোখো-হুলো যদি বা ফেরত আসে– এ-বর্ষা কিন্তু আর তোমার জীবনে ফেরত আসবে না! তাই এই ঋতুটিকে ডেঁড়েমুষে উপভোগ করার জন্যে আমি তোমায় কিছু প্রয়োজনীয় টিপস এবং খাবারদাবারের কথা বলে দিচ্ছি।
অনুগ্রহ করে তা নিজের মধ্যেই রেখ। একে সোশাল মিডিয়ার মজা খালে ফিনাইলের মতো আলগোছে ছড়িয়ে দিও না।

তোমায় গোপনে জানাই, যে কোনও বর্ষাকালই হল নানান রোগের ডিপো। যদিও এতে ওই ঋতুটির কোনও দোষ নেই। আসলে বাইরেটা যেহেতু জলজলে, ভ্যাপসা, প্যাচপেচে, তাই ভেতরটা সবসময় ঝালঝাল, গরগরে, কষাকষা, মুখ ছেড়ে যাবে– এমন খাওয়াদাওয়া চায়। সোজা কথায়, এ সময় বাতাসে জলের দানার ভাগ বেশি থাকে বলে মানুষের শরীরেও সেই জোলোভাব ছড়িয়ে পড়ে।
শ্রাবণের বৃষ্টিধারার মতো জল ও বাতাসের বুক চিরে ভাইরাস আর ব্যাকটিরিয়া যেন টুপটাপ ঝরে ঝরে পড়ে। মানুষের হজম ক্ষমতা কমে যায়। ফলে গ্যাস, অম্বল, বুকজ্বালা আর চোঁয়া ঢেঁকুরের বদান্যতায় সে যেন হাঁসফাঁস করে।
তোমার আনন্দ যেন অন্যের দুঃখের কারণ না হয়ে ওঠে– এই প্রাচীন ও গ্রাম্য (মানে, শহুরে নয় মোটেই) প্রবাদখানিও যেন গ্লো-সাইনের মতো জ্বলজ্বল করতে থাকে মানুষের হাওয়া-বাতাস না-খেলা একফালি এসি লাগানো ফ্ল্যাটে।
তবে আর যাই কর না কেন, হে মানব, বর্ষাকালে খবরদার ডাক্তার দেখাতে যেও না। যতক্ষণ পারবে নিজের ওপর নিজেই চিকিৎসা চালিয়ে যাও। কারণ একবার ডাক্তারের সঙ্গে চোখাচোখি হলেই তিনি যা যা ইনস্ট্রাকশন দেবেন তাতে তোমার বাকি বর্ষাকালটা সঙ্গে সঙ্গে জেরুজ়ালেম হয়ে যাবে। কেন, তা একে একে বলছি, মন দিয়ে শোনও।

১. ডাক্তারবাবু প্রথমেই বলবেন, এই সিজনে তেল-ঘি একদম খাবেন না। এগুলো নাকি আমাদের যকৃতের ওপর চাপ তৈরি করে। তার মানে সুরভিত গোবিন্দভোগ চালের সঙ্গে খুদে খুদে সোনামুগডাল দিয়ে বানানো খিচুড়ির ওপর গাওয়া ঘিয়ের প্রপাত ঢালা চলবে না এবং খিচুড়ির সঙ্গে যে সব আনুষঙ্গিক অত্যাবশ্যক পদ, যেমন বেগুনভাজা, আলুভাজা, পটলভাজা, নারকোলভাজা, যেগুলি তেলেই ভাজা হচ্ছে, তাদের দিকে ফিরেও তাকানো যাবে না।
২. ডাক্তারবাবু এর পরে বলবেন, নদী বা সমুদ্রের মাছ বর্ষায় খাবেন না। খাবেন না মাছের ডিম বা তেল। এতে চূড়ান্ত অ্যাসিড হবে। বোঝো ঠ্যালা। বর্ষার রানী হচ্ছে ইলিশ। সে সমুদ্রের আবার নদীরও। তাকে ছাড়া কি বর্ষাকাল হয়? ডাক্তারবাবুর কথা শোনার মানেই হচ্ছে ইলিশমাছ ভাজা তুমি খাবে না। মাছ ভাজার লালচে তেলের সঙ্গে সামান্য নুন আর কাঁচালঙ্কা ডলে প্রথম পাতের ভাত দিয়ে গুরুসেবা তুমি করবে না। কফি দিয়ে ঝমঝম বৃষ্টির মধ্যে পুরুষ্টু পমফ্রেটের ফ্রাই– উঁহু তাও নয়।

বর্ষায় তো ট্যাংরা, কই, পারসে, খয়রা, আড়, বোয়াল– সব মাছের পেটই ডিমে ঠাসা হয়। সে সব তো ছেড়ে দাও, নিদেন কুচি করা পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা পোনামাছের ডিমের বড়া, যা কিনা তুমি বাপু দিনান্তে দু’মুঠো ঝরঝরে ভাত আর গরম গরম মুসুরির ডালের সঙ্গে কামড়ে কামড়ে খাবে– সেটার ওপরেও তো ‘টাচ মি নট’ বোর্ড ঝুলে যাচ্ছে।
৩. ডাক্তারদের পরের সাবধানবাণী– রাস্তাঘাটের ভাজা-পোড়া এড়িয়ে চলুন। কে না জানে ঝমঝম বর্ষার সন্ধে মানেই ছোটো ছোটো গুপ্তসমিতির মতো আলোআঁধারি তেলেভাজার দোকান। আলুচ্চপ, বেগুনি, ফুলুরি আর ডালবড়া ভর্তি তেলচপচপে কাগজের ঠোঙাটাকে লুকিয়ে সংগ্রহ করা মারণাস্ত্রের কায়দায় ঢোলা শার্ট বা ফতুয়ার নিচে পেটের ওপর লুকিয়ে চেপে ধরে, ছাতা আঁকড়ে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে হেঁটে আসা। তারপর সকলে মিলে সেগুলো বিছিয়ে বসে শুরু করতে হয় অনুশীলন সমিতির মতো রোমহর্ষক বৈঠক। আর বাড়িতে ভাজা মশলা পাঁপড়কে তো ভাজাভুজির মধ্যে ধরাই উচিত নয়।

৪. ডাক্তারবাবুদের এর পরের চেতাবনি– কাঁচা শাকসবজি থেকে বর্ষাকালে নিজেকে দূরে রাখুন। এগুলো নাকি হজম হয় না। থেকে থেকেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তাহলে বর্ষার বিকেলে, যে অমৃততুল্য আধসেদ্ধ মটরের ঘুগনি পাড়ার মোড়ে বিক্রি হয়, তার ওপরে যত কাঁচা পেঁয়াজ, কাঁচালঙ্কা আর ধনেপাতার কুচি ছড়িয়ে দেওয়া থাকে, সেগুলো কি ফেলে খাব? হরি হে, নরকেও তো স্থান হবে না আমাদের! ব্রহ্মহত্যার পাতকী হয়েই তো শেষ জীবনটা বেঁচে থাকতে হবে!

৫. ডাক্তারবাবুদের এর পরের নিদান– ভেজা জায়গায় জন্মানো বা বেড়ে ওঠা খাবারদাবারে বর্ষাকালে নানারকম ব্যাকটিরিয়া জন্মানোর সম্ভাবনা থাকে। ওসব ছোঁবেন না। তাহলে বর্ষার ভিজে ভিজে মাটি বা মজে যাওয়া আবর্জনার ওপর যে ব্যাঙের ছাতা বা মাশরুমের দল হৈ হৈ করে বেড়ে ওঠে, যাদের পেঁয়াজ, রসুন, ধনেপাতা, লঙ্কাকুচি দিয়ে ভেজেকষে রাঁধলে, একথালা ভাত ‘হোকাস ফোকাস’ বলে দু’সেকেন্ডে ভ্যানিশ হয়ে যায়– তার কী হবে? আর মফসস্লের মজা পুকুরের ধার থেকে এই বর্ষার রাতে, যত ধরনের গেঁড়ি-গুগলি ধরা পড়ে, তাদের ছাড়িয়ে, ধুয়ে, কষা কষা রান্না করে না খেলে কি বর্ষাকালকে প্রকৃত অর্থে উপভোগ করা যাবে?

৬. ডাক্তারবাবুরা বলেন, বয়স চল্লিশ পেরোলেই আর বর্ষাকালে আম-কাঁঠাল খাওয়া উচিত নয়। আর আমে নাকি ব্রণ-ফোঁড়া হয়। হাউইয়ের মতো হু হু করে ইউরিক অ্যাসিডের পারদ চড়ে। আরে, গোলাপখাস আর হিমসাগরের ওভার তো জষ্ঠিমাসেই শেষ। তারপর ফিল্ডে নামে বেনারসি ল্যাংড়া, কিষেনভোগ, চৌষা, দশেরি। এদের ‘বল’ কি তবে স্ট্রেট ব্যাটে খেলব না! শুধু কপিবুক দেখে ওয়াইডের জন্যে অপেক্ষা করে থাকব? শুধু শুধু কাঁঠাল খেলে গ্যাস আর বদহজম হয় বলে ডাক্তারবাবুরা মনে করেন। তাহলে ঘন ক্ষীরের মতো একবাটি দুধে, খান পনেরো কাঁঠালের কোয়ার রস, বেশ করে নিংড়ে, আঙুল দিয়ে ঘুলিয়ে, চুমুক দিয়ে খেলেই তো ঝামেলা মিটে যায়! তখন নো গ্যাস– নো কিচ্ছু।

পরিশেষে আবারও বলি, বর্ষাকালে কোনও ভাবেই ডাক্তার দেখানো উচিত নয়। তবে এজন্যে আবার ঘাবড়ে ‘ঘ’ হয়ে গেলেও চলবে না। একটু খেয়াল রাখলেই দেখতে পাবে, টিভিতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বহু ধরনের অ্যান্টাসিড আর এনজাইমের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে যাচ্ছে। নিকটাত্মীয়দের এড়িয়ে এমন তিন চারটের নাম ছোট্ট চিরকুটে কিংবা মোবাইলের মেমো প্যাডে সন্তর্পনে টুকে রাখো। তারপর টুক করে এক ফাঁকে ডাক্তারখানা থেকে কিনে এনে ঘরের কোনও গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে দাও। দরকার মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে টুকটাক জল দিয়ে গিলে ফেল। যদি একখানায় কাজ না হয়– তখন একসঙ্গে একজোড়া। ভরসা রাখো, রাধারানির কৃপায় এর একটা-না-একটা ঠিকই কাজে লাগবে।
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের জন্ম কলকাতায়, পড়াশুনো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, লেখালেখির শুরু নয়ের দশকে। বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিনে ছোটগল্প, কবিতা এবং নানা বিষয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন। কবিতার বইয়ের সংখ্যা দশ। প্রচ্ছদ এঁকেছেন তিরিশেরও বেশি বইয়ের। পেশায় চাকরিজীবী।
4 Responses
Khoma chaichhi prothome, tomar shekhano bangla horofe likhte parchhina, app ti ke uninstall korte hoyechhe, watsapp rokkha korte. Ki likhechho bhai, daktar er kachhe to jaboi na , ekhon tomar prescription onujayee agami din thekei cholbo bhabchhi, kichhu already hoye gechhe, bakita erpor. Tumi eirokom roshe boshe thako ebong amader eirokom poribeshon korte thako.
এই ডাক্তার তোমাকে কুর্নিশ জানাচ্ছে।দারুণ লিখেছো।
আর যেখানে যাও না রে ভাই
সপ্ত সাগর পার,
বর্ষাকালে বৈদ্য বাটি যেও না
খবরদার !
আর যেখানে যাও না রে ভাই
সপ্ত সাগর পার-
বর্ষাকালে বৈদ্য বাটি
যেও না খবরদার !