banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ক্ষণিক-প্রভা (ছোটগল্প)

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Short Story

আদৃতার দিন  

ভোরবেলার ঘুমটা পাতলা হয়ে আসছে। কী যেন স্বপ্ন দেখছিল শেষে। একদম স্পষ্ট স্বপ্নটা। এখনও ভেতরে একটা রিনরিনে ম্যান্ডোলিনের শব্দের মতো বাজছে। সুখ। কী দেখছিল সে? কী রকম যেন একটা আবছা পর্দার ওপারে চলে যাচ্ছে। যেন রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে গাড়ির জানলা থেকে বাড়িয়ে থাকা প্রিয় মুখ… বাড়ানো হাতের পাতায় পিছুটান- চলে যাচ্ছে স্বপ্নটা তাকে ছেড়ে ওভাবেই। জানলার দিক থেকে পাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুল ুআদৃতা। নাইটস্ট্যান্ডের ওপর ভেনেশিয়ান গ্লাসের একটা ছোট্ট নাইট ল্যাম্প। পাশে সারি সারি ওষুধ। ডিপ্রেশনের, মুড্ সুইংয়ের, ঘুমের, নার্ভ শান্ত রাখার, ভিটামিনস; তবে সব আয়ুর্বেদিক, অল্টারনেটিভ মেডিসিন। কেরালা থেকে আনানো। সে সবে চোদ্দো; মা তাকে কিছুতেই ডিপ্রেশনের ওষুধ দিতে রাজি হয়নি।

উঠতে হবে এবার; অ্যালার্ম বেজে গেল… এখনও ভেতরটাতে যেন মৃদু উষ্ণতার বুদ্বুদ ফুটছে টুপটাপ। কতকাল বাদে এরকম হালকা হয়ে আছে ভেতরটা। ব্লাইন্ডের মধ্যে দিয়ে আসা আলোর রেখাটা আরও একটু স্পষ্ট, কমফর্টারটা সরিয়ে উঠে পরলো অড্রি – ছবির মতো সাজানো ছোট্ট টাউনটার এই বোর্ডিং স্কুলে তার এই নামটাই চালু হয়ে গেছে। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট হলে হাজির থাকতে হয় সকলকে। কাবার্ড থেকে ইউনিফর্ম বার করে, বাথরুমে ঢুকে পড়ল সে । অন্যদিনের মতো টেনে হিঁচড়ে তুলতে হল না নিজেকে। কী হালকা লাগছে শরীরটা। রুটিনে বাঁধা সকাল শুরু হয়ে গেল। পরপর আছে ব্রেকফাস্ট, হাউস মিটিং, ফ্রেঞ্চ ক্লাস।

বেশিরভাগ দিন ব্রেকফাস্টে একটা জুস বা হেলথ ড্রিংক নিয়ে বসে থাকে। ফোনে নিউজ পড়ে বা পড়ার ভান করে। নিজে থেকে আজ, লিলি, সুহানা, জেসমিনের সঙ্গে গিয়ে বসল সে… খেল একটা গোটা টোস্ট, আপেল, জুস। হাউস থেকে স্কুলবিল্ডিং হাঁটার পথে, নিখুঁত ম্যানিকিওর্ড লনে, হ-থর্নের ঝাড়ে ঝলমল করছে রোদ। তার সোজা, চেস্টনাট বাদামি চুলে বাঁধা পনিটেল দুলছে হাঁটার ছন্দে। নিজের অজান্তেই মাথার পিছনে হাত চলে গেল…। না, পনিটেলটা নেই আর। আগের মাসে শুটিংয়ের জন্য ইংল্যান্ড এসেছিল মা মুম্বই থেকে। একটা উইকেন্ড কাটিয়েছিল তারা একসঙ্গে, একটা ব্রেড এন্ড ব্রেকফাস্টে। রাত্রে পাশে শুয়ে তার জট বাঁধা শুকনো চুলে দীর্ঘদিনের অযত্ন অবহেলা চিনে নিয়েছিল মার আঙুল। কিছু বলেনি, উদ্গত দীর্ঘনিঃশ্বাস শুনতে পেয়েছিল সে। পরের দিন একটা সালোঁতে গিয়ে চুল খুব সুন্দর করে কাটিয়ে আনল তারা। কোমর ছোয়াঁ জলপ্রপাতের মতো এক পিঠ চুল… আজ এতদিন বাদে তার হালকা হয়ে যাওয়া বুকের বুদ্বুদগুলোর মধ্যে একটা পিন ফুটল। কেন সে হারিয়ে ফেলছে সবকিছু, কেন খেয়ালই করে না কিছু। কেন ইচ্ছে করে না। ইচ্ছেটাই করে না… 

আর্ট ক্লাসের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ অনুভব করল কখন যেন ওই হালকা তুলোট মেঘের মতো ভাবটা আর কোথাও নেই… একটা ভিজে   স্যাঁতস্যাঁতে কম্বল যেন কেউ জড়িয়ে দিচ্ছে ভেতরে। আজ আর্ট ক্লাসে ক্লে মডেল বানানোর কাজ চলছে। সামনের টেবিলে ছড়ানো ক্লে, স্ক্যালপেল, টুথপিক, পেন্টব্রাশ… একটা মেয়ের প্রতিমূর্তি গড়ে উঠছিল আস্তে আস্তে, হাতে একটা প্রকাণ্ড সূর্যমুখী। কিন্তু না, ভালো লাগছে না কিছু আর। ঝলমলে রোদে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ, শুধু তার ভেতরটায় কেমন যেন মেঘলা ঠান্ডা বিকেল হয়ে যাচ্ছে। মোটামুটি শেপে চলে আসা মেয়েটাকে চেপে চেপে আকারবিহীন মাটির ডেলা করে ফেলে তার অন্যমনস্ক হাত। কী কম সময় থাকল ভালোলাগাটুকু। নিজের হাতের পাতার মতো চেনে এই প্যাটার্নটাকে। জানে এই ভিজে বিকেলটাই কালো অন্ধকার হয়ে চুঁইয়ে চুইয়ে ঢুকে পড়বে তার ভেতরে। চায় না সে, কিন্তু একটা বোবা ওজন চেপে বসবে তার ওপর। হাতের মধ্যে ধরে রাখা আকারবিহীন মাটির তালটাকে থাবড়াতে থাকে সে। 

ঘরে ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছিল লাঞ্চের পর। ফেরত যায়নি পরের পিরিয়ডে। ইউনিফর্মেই শুয়ে আছে কমফর্টারের ওপর। আজ প্রকৃতিও যেন তার সঙ্গে আছে তার, মন বদলে ফেলেছে। নীলচে, প্রায় চারকোল রঙা মেঘেরা দ্রুত ছেয়ে ফেলছে আকাশ।  

আকাশ চিরে ঝলসে উঠলো বিদ্যুৎ! চোখের পাতার পিছনে তীব্র আলোর ঝলকানি। 

চোখ খুলে গেল তার। আর স্বপ্নটা  ফিরে এল। ওই বিদ্যুতের মতো চোখ ধাঁধানো আলো; কিন্তু না, বিদ্যুৎ নয় ফ্ল্যাশের ঝলকানি। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট ফুলের মতো ফুটফুটে আদৃতা। ওই তীব্র আলোতেও, সম্পূর্ণ অভ্যস্ত চোখ, আর গোলাপকুঁড়ির মতো ঠোটে  মিষ্টি হাসি।

******

ক্যামেরাদের গল্প 

রাস্তাটা খুব ছোট। ওপারে একটা বিরাট বড়ো গেট। বাইরে অপেক্ষা করতাম আমরা। আলাদা সাইজ আমাদের, আলাদা লেন্স, আলাদা অ্যাপারচার চেঞ্জিং মোড, শাটার স্পিড। কিন্তু একসঙ্গে আমরা, একটা বাহিনী প্রায়। রাস্তায়, সিঁড়ির ধাপে, গাড়ির ওপরে দাঁড়ানো ফটোজার্নালিস্টদের হাতে হাতে…। অপেক্ষা করতাম আমরা কখন ওই প্রকাণ্ড গেট খুলে যাবে। দেখা যাবে তোমাদের বাড়ির কারও এক ঝলক। গাড়ির কাঁচ নামিয়ে সানগ্লাস মাথায় তুলে সামান্য ঠোঁট ফাঁক করবে আমাদের দিকে তাকিয়ে। আমাদের লেন্সরা ক্ষুধার্ত ব্যগ্রতায় নানারকম ভাবে অ্যাডজাস্ট করে নেবে নিজেদের। তারপর তোমাদের ধরে নেব নিজেদের মধ্যে। আমাদের মধ্যে ধরে রাখা ছবি নানা  মিডিয়াম বেয়ে পৌঁছে যাবে হাজার হাজার মানুষের কাছে। দূর থেকে দূরান্তে, ছোটো কয়েকইঞ্চির ফোন স্ক্রিন থেকে চকচকে ম্যাগাজিনের পাতায়, সন্ধ্যেবেলা বেরনো ট্যাবলয়েডে, সকালের কাগজের পেজ থ্রিতে। আমাদের থেকেই কিন্তু শুরু।

যেখানেই যাও তোমরা, আমরা ঠিক পৌঁছে যাই…..

ভালোবাসি তোমাদের।
তোমাদের চোখ
, ঠোঁট, চুল, শরীরের প্রত্যেকটা বাঁক!
তোমার মায়ের টপ আর হট প্যান্টের মাঝে দু’তিন ইঞ্চি গোলাপি মসৃণতায় দেখতে না পাওয়া ট্যাটুর আভাস, অশ্লীল রকমের দামি ব্যাগ, জুতো, তোমার বাবার সযত্নলালিত আনশেভন লুক, সিক্সপ্যাক… সব, সঅঅঅঅব আমাদের বড় প্রিয়। মিড্ ডে মিলের লোভে স্কুলে যাওয়া, আর বাকি সময় লোকের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করে ক্ষয়ে যাওয়া কিশোরীই হোক বা, পুলকারে অফিস যাওয়া, সারাদিন কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে আর মিটিংয়ে কাটানো তরুণী, অথবা সেলুনে বসে তোমার মায়ের ছবি দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ভুঁড়িওলা মধ্যবয়স্ক… সবার কাছেই পৌঁছে যায় আমাদের তোলা ছবি। চিটচিটে বা ঝলসানো গরমে সিদ্ধ হতে হতে বাসে, ট্রেনে গুঁতোগুঁতি করে  রোজকার জীবনটাকে কোনওভাবে বয়ে নিয়ে চলা, অথবা এসির স্বস্তিদায়ক আরামের নিচে দিনযাপন করা সমস্তরকম দেশবাসীই আগ্রাসী ক্ষিধে নিয়ে অপেক্ষা করে।

Short Story
তোমার বাবা মায়ের জনপ্রিয়তার মুকুটে উজ্জ্বল পালক হলে তুমি। ছবি সৌজন্য – saatchiart.com

ওই খুলে যাওয়া দরজার পেছনে তোমার মায়ের সাগরসেঁচা চোখ, পোর্সেলিনের মতো ঝকঝকে হাসি, তোমার বাবার নিত্যনতুন হেয়ারস্টাইল, জার্মানি থেকে অবিশ্বাস্য দাম দিয়ে বানানো কাস্টম মেড বাইকের একটু ঝলক চেটেপুটে খায়, স্বপ্নে দেখে। তোমার মা আর বাবার বিয়ের অনুষ্ঠান আর তার মিডিয়া কভারেজের টাকায় অনেক অনেক গরিব পরিবারের সারা বছরের ভাত জুটে যেত। ওদের বিয়ের সময়ে ঘটে যাওয়া অনেক দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, নেতাদের দুর্নীতির খবর একটুও মনোযোগ টানতে পারেনি মানুষের। 

ওরা যে দেশের মানুষের হার্টথ্রব!

তারপর একটা ঘটনা ঘটল; তুমি এলে পৃথিবীতে। এক বছর পর্যন্ত তোমার পরিবার তোমাকে প্রায় আমাদের চোখের আড়ালেই রেখেছিল। তারপর একদিন হল কি, বেশ রাত্রে একটা ভেকেশন থেকে ফিরছিল তোমরা। এয়ারপোর্টে কিছুটা হেঁটে গাড়িতে এসে উঠতে হয়েছিল তোমাদের। বাবার কাঁধে মাথা রেখে একটা ছোট্ট পুতুলের মতো ঘুমোচ্ছিলে তুমি।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। তোমাদের দেখে ছবি তোলার জন্য মরিয়া কিছু সাধারণ লোকেদের সঙ্গে তোমার বাবার গন্ডগোলে। অবাক কাণ্ড! একটুও ভয় পাওনি তুমি। অত লোকের সেলফোন ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মাঝখানে ঘুম ভাঙা চোখে তাকিয়ে একটা মিলিয়ন ডলারের হাসি উপহার দিয়েছিলে।
সেই শুরু।
তোমার ওই ছবিটা সোশ্যাল মিডিয়াতে পরদিন কুড়ি লক্ষেরও বেশি ভিউ হয়।
তারপর আর কি
?
তোমার বাবা মায়ের জনপ্রিয়তার মুকুটে উজ্জ্বল পালক হলে তুমি।
তোমার ছবি ওদের সঙ্গে
, আলাদা আলাদা, পার্টিতে, পিকনিকে, শুটিং লোকেশনে বাবার কাঁধে, মার পেরামবুলেটরে।
আমরা যারা তোমাদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতাম মানুষের হাতে হাতে, আমাদের নতুন লক্ষ্য হলে তুমি।
তোমার মা-বাবাও সানন্দে উপভোগ করতে শুরু করল এই নতুন জনপ্রিয়তা।

আজ মনে পড়ে সেই রাত্রিটার কথা। তোমাদের বাড়িরই সামনে অপেক্ষা করা কয়েকজন ফটোজার্নালিস্টদের কাছে সেটা ছিল একটা গুমোট বেরঙিন দিন। কিচ্ছু পাওয়া যায়নি। তেমন কেউ আসেনি, যায়নি। একটু সন্ধ্যে রাতের দিকে তোমাদের গেটটা কিছুক্ষণের জন্য খোলা ছিল, কোনও কাজ চলছিল বোধহয় ভেতরে।
হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে এলে তুমি বাইরের প্যাসেজে। বাড়িতে এত লোকজন, কেউ টের পায়নি। এক দৌড়ে বেরিয়ে এলে, খরগোশ-পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরে নিলে দু’পাক… আর তারই মধ্যে আশপাশ আলোয় আলো হয়ে উঠেছে মুর্হুমুহু আমাদের ফ্ল্যাশের ঝলকে> প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চোখে হাত উঠল তোমার একবার— তারপরই হাসলে আমাদের দিকে তাকিয়ে।
সেই ভুবন ভোলানো হাসি। তারপর নির্ভয়ে এগিয়ে এলে কোর্টইয়ার্ড পেরিয়ে মেন গেটের কাছাকাছি
, হাত নাড়তে নাড়তে।
বেবি বেবি। একবার এদিকে তাকাও”…
বেবি এদিকে এদিকে”… অর্ধবৃত্তাকার একটা ভিড়ের এদিক ওদিক থেকে ভেসে আসছে ডাক।
তুমি কিন্তু ওই তীব্র চোখ ঝলসানো আলোর মাঝখানেও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। ঠিক সেই সময় বাড়ি থেকে দু’জন দৌড়ে বেরিয়ে এসে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়োতে শুরু করল। তুমি তখনও হেসে যাচ্ছ। হাত নেড়ে যাচ্ছ।
আর আমরা প্রাণপণ বন্দি করে নিচ্ছি। তোমাকে। আমাদের মধ্যে।
দেশের নতুন সুইটহার্টকে।

 

******

হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে 

কী উজ্জ্বল সেই বিদ্যুৎ রঙা আলো, অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে থাকা সেই চোখগুলো। চোখ তো নয়, লেন্স!
আর কাদের যেন ডাক!
স্বপ্নটা এতক্ষনে পুরো স্পষ্ট হল…
ধড়মড়  করে উঠে বসলো আদৃতা। ফিরে এসেছে আবার
, খুশির গরম বেলুনগুলো বুকের মধ্যে।
ছোট্ট আদৃতার মুখের হাসি এখন তার মধ্যে কুলকুল করে বইছে।

ফ্রিজ খুলে অৰ্ধেক শেষ করা জুসের বোতল শেষ করে ফেলল সে। অস্থির অস্থির করছে ভেতরটা। সে জানে বড্ড কম সময় থাকবে এই আনন্দ। একটু পরেই মাকড়সার মতো গুড়ি মেরে ফিরে আসবে স্যাঁতস্যাঁতে ওই অন্ধকার। চেয়ারটা টেনে বসল পড়ার টেবিলের সামনে।অন্যমনস্ক হাতে নাড়াচাড়া করছে ফোনটা। ওয়ালপেপারে তাদের তিনজনের ছবি। কী জ্বলজ্বলে সবার মুখ! পেছনে তার বিছানার হেডবোর্ড। কোনও একটা ছুটির সকাল। তারা তিনজন আদৃতার বিছানায়। বাবার তোলা, সেলফি। 

না। মা-বাবার ওপর রাগ নেই তার, এতদূরে এত ছোট বয়সে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেবার জন্য। সে মনে করতে পারে ছোটবেলায় তার বেরনো ছবি, তাকে নিয়ে বেরনো সমস্ত খবর, ওর সঙ্গে শেয়ার করত মা। কী মজা করত ওগুলো নিয়ে। মার সঙ্গে ফটোসেশনও করেছে সে। কিন্তু একটু বড়ো হবার পর থেকে ছবিটা পাল্টাতে শুরু করল। মায়ের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। মা-বাবার কথা কাটাকাটি। এখন সে বুঝতে পারে, প্রথমটাতে বেশ খুশি হলেও, সেটা বেশিদিন টেকেনি। বাচ্চার ছবি এরকম ভাবে প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সহজলভ্য হলে তা কত লোকের কাছে পৌঁছচ্ছে কে জানে? বাচ্চারা কবে কোথায় নিরাপদ? সারা পৃথিবীতে বিকৃত লালসা নিয়ে অপেক্ষা করে আছে বহু মানুষ! তার জনপ্রিয়তা একটু বাড়াবাড়ি রকমের হয়ে গেছিল। আত্মীয় বন্ধুরা সবাই ভয় দেখাতে শুরু করল। 

মা বাবার সঙ্গে থেকে শহরের কোনও স্কুল বা দেশের কোনও বোর্ডিং স্কুলও নিরাপদ লাগল না। ছোট্ট বয়সে সে নিজের জায়গা, নিজের পরিবার থেকে বিচ্যুত হল। প্রথমে একটা প্রেপ স্কুলে তারপর এখানে।

বাইরে তাকালো আদৃতা, বৃষ্টি পড়ছে। ইতস্তত হাওয়ায় মাথা নাড়ছে ডগউড গাছের সারি।

 প্রথম দু’টো বছর ঠিকই ছিল এখানে, কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে তার ভেতর থেকে হাসি আনন্দ কী রকম শুষে নিল কেউ। ভেতরটা এই দেশের আবহাওয়ার মতোই অন্ধকার, ভিজে। সে যন্ত্রের মতো পড়াশোনা করে এখানে – হোমওয়ার্ক, প্রজেক্ট, রিসার্চ। গ্রেড মোটামুটি ভালোই থাকে। কিন্তু তার বাইরে কিছু ইচ্ছে করে না তার, কিচ্ছু না। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, কোনও আউটিংয়ে যাওয়া, শপিং, সাজগোজ, সোশ্যাল মিডিয়াতে ছবি পোস্ট। কিচ্ছু না। মাঝে মাঝে ভিডিও কলের বাটনটাও টিপতে ইচ্ছে করে না।
মাকে বলে মা কাল কথা বলি?”
এক সপ্তাহের মধ্যে মা ঠিক পৌঁছে যায় তার কাছে। যতই কাজ থাকুক।

কাউন্সেলিং চলে, মেডিটেশনের ক্লাসে যায়, ওষুধ খায়। পড়াশোনাক্লাব, এক্সট্রা কারিকুলার, খেলাধুলো সব কিছুতেই যায় জোর করে… আস্তে আস্তে একটু ঠিক হয়, আবার একটা প্যাটার্নের মতো ফিরে আসে অবসাদ। কিন্তু না, এখন এই মুহূর্তে আদৃতা অন্য কিছু ভাববে  না। শুধু কী করে একটুখানির জন্য ধরে রাখবে, তার ভেতরের এই আনন্দটুকুকে। ফোনের দিকে চোখ পড়ল তার। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাওয়ার বিষয়ে মায়ের প্রবল নিষেধ। তাও একবার তার পদবি আর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে একটা একাউন্ট খুলেছিল সে, এমনিই। কিন্তু  কেউ বুঝবে না। প্রোফাইল ছবিতে একটা ব্যাঙের ছবি। শুধু স্কুলের হাতেগোনা বন্ধুদের সোশ্যাল লাইফ আর ছবি দেখে সে মাঝেমধ্যে, তাও যদি ইচ্ছে হয়। আজ অন্য কিছু করতে ইচ্ছে হচ্ছে। ফোনের ক্যামেরা অন করে সেলফি মোড করল। না, নিজের ছবি তোলে না সে, সমবয়সী বন্ধুদের মতো; তার ইচ্ছে করে না। তবে যে দিনগুলোতে সে ভালো থাকে, ইচ্ছে হলে সে বন্ধুদের ছবি তুলে দেয় – বাগানে, কমনরুমে, ক্যান্টিনে। ঠিক আলো ,অ্যাঙ্গল, দূরত্ব এসবের একটা খুব সহজাত বোধ আছে তার। আজ হঠাৎ কী মনে হল, নিজের একটা ছবি তুলল।

দেখি তো কেমন এল… একি! কী বিচ্ছিরি লাগছে তাকে! কী শুকনো তার মুখ, নিষ্প্রাণ ভেতরে বসে যাওয়া চোখ, চোখের নিচে কালি। 

না কিছুতেই মন খারাপ করবে না অড্রি…নিজেকে বলল সে। 

তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে কাবার্ডের ভেতরটা হাতড়ে মেকআপের জিনিস বার করে আনল। আগে একটা কনসিলার দরকার, চোখের নিচের কালিটা ঢাকার জন্য। একটু মেকআপের পর তোলা ছবিটা তেমন  খারাপ এল না। এরপর তো ফটোশপে আরও একটু সুন্দর করে তোলাই যায়। এ কাজটাও খুব অনায়াসে পারে সে। একটু চোখের, ঠোঁটের এডিটিং। তারপর একটু ব্রাইটনেস। খুব সূক্ষ্মভাবে সেটা করতে করতে হঠাৎ আঙ্গুলগুলো থেমে গেল তার। পরক্ষণেই হৃৎপিণ্ডটা একটু জোরে জোরে চলতে শুরু করল।

একি! তাকে কী ভীষণ মায়ের মতো দেখাচ্ছে!
মা নিজেও বলে সে কথা। বলে দিদা, মাসিরাও। তার নিজের কখনও মনে হয়নি। কোথায় মা আর কোথায় আদৃতা!
কিন্তু এই ছবিটাতে… মা তার কেরিয়ারের প্রথম দিকে যখন মডেলিং শুরু করেছিল তখনকার মতো।
পোস্ট করবে সে ছবিটা?
করবে?

******

ফিরে আসা 

অনেক অনেক দিন কেটে গেছে, তোমাকে পাই না । তোমাকে মিস করছি।

এই তোএতদিন বাদে তোমার একটা ছবি নিলাম। তুমি নাও আমাকে হাতে, অন্যের ছবি নাও, কিন্তু তোমাকে দেখতে পাই না। তোমার ফোনের ভেতর এখন আমি, আমার লেন্স ছোট্ট, প্রায় অদৃশ্য। কিন্তু ক্ষমতা তো কম নয়! আজ কতদিন বাদে ফিরে পেলাম, একদম নতুন লাগছে তোমাকে। ফিরে এসো আমাদের পৃথিবীতে। আমি তো শুধু একটা খোলা দরজা! গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করছে, তোমাকে ছোঁওয়ার জন্য, তোমাকে টেনে নিয়ে যাবার জন্য। তোমাকে উপভোগ করার জন্যতোমাকে ঘিরে ফেলবে ওই পৃথিবী। ওখানেই ঘরবাড়ি, ওখানেই শ্বাস প্রশ্বাস, শরীরটা শুধু থাকবে যেখানে আছো। বাকি সব ওখানেই। এই তো তোমার কোলে খোলা ল্যাপটপ, তোমার মুখ মনিটরের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। চোখের মণি ওঠানামা করছে।

কমেন্টস আসতে শুরু করছে। চড়চড় করে বাড়ছে ফলোয়ার। 

“OMG is this Ayesha Kapoor’s daughter?”
“She has become so pretty..when did she become so grown up?”
“Lovely”
“Exquisite!”
“A future glamour girl like mom?”
“When is the first movie? Anyone knows?”
“WTF will Bollywood ever get out of this f…ing loop? Kuch kaam kar yaar!”
“What’s the big deal that she looks like her mom? You people have nothing else to do?”
“Remember Ayesha’s first Pepsi ad? She looks like that…”
“Come on! She is a child”!

তোমার মুখের রং বদলাতে শুরু করেছে।
তোমার চোখের পলক পড়ছে না।
তোমার ঠোঁটে ফিরে এসেছে সেই ছোটবেলার হাসি।

জন্ম, বড় হয়ে ওঠা কলকাতায়। গত একুশ বছর ম্যাসাচুসেটস,আমেরিকা প্রবাসী। বাংলা সাহিত্যের একনিষ্ঠ পাঠক। এখন পর্যন্ত লেখা বেরিয়েছে ওয়েব ম্যাগাজিন পরবাসে এবং আনন্দবাজারে।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com