মানুষ দেখে বেড়ানো আমার শখ। সে কথা বহুবার বলেছি। সবাইকে কি আর চাক্ষুষ দেখি! নাহ,সে অসম্ভব। তবে, একেকদিন হাটে বাজারে একেকটি মুখ আমায় স্থাণু করে দেয়। সে মুখ আমায় দিয়ে অনেককিছু বুঝিয়ে নিতে চায়। চোখের চাউনি, মুখাবয়বের পেশী এ সমস্ত দিয়ে একজন মানুষকে দেখি আমি। একজন মা’কে দেখি। বাজারে তো কতজন কত কী বিক্কিরি করে, সকলের মুখে কি আর সে আলো আছে! সাধনা মাসিমা নিজেই আলো হয়ে থাকেন। পরিপাটি শাড়ি, কথার বাঁধুনি, এ সমস্ত দিয়ে তখন তাকে আমার মফস্বল জীবনের বুনিয়াদি ইস্কুলের দিদিমণি বলে ভ্রম হয়। অথচ, সাধনা সরকার সেসব কেতাবি জীবন থেকে কত কত দূরে বসে সারাদিন কেবল শুঁটকি মাছ, শিদল আর নোনা ইলিশ বিক্কিরি করেন লেক চৌমুনির বাজারে। তার দোকান ভরা কত রকমের যে শুকনো মাছ! চান্দা, বাতাসি, গলসি ট্যাংরা থেকে শুরু করে মায় হাঙর পর্যন্ত। না দেখলে সেসব বিশ্বাস যাওয়া মুশকিল।

গায়ে গায়ে সার বাঁধা দোকান। পুরুষ শাসিত দোকানদারির পাশে কে ওই সাধনা সরকার! তিনি তো কেবল শুকনো মাছ বেচেন না,সময়ে সময়ে খরিদ্দারকে রান্নার উপায়ও বাতলে দেন। তা নইলে কেমন করেই বা জানতুম কোন মাছে কেমন করে জুতের রান্না করা লাগে! এসব দেখতে দেখতে আমি টের পাই,দোকানদারি আসলে একটা আর্ট। খানিকটা ডাকঘর নাটকের দইওয়ালার মতো আমারও তখন মনে হয়, এমন করে মাছ বিক্কিরিতে কী যে সুখ! গালের কষে পান-দোক্তার গন্ধ মেখে হাতের পাতায় বেছে বেছে যিনি এমন করে শুকনো মাছ বেচেন তাকে দেখে অবাক হতে হয়। একটা পুরুষগন্ধী বাজার তো তাকে খুব সহজে আস্ত একখানা দোকানঘর ছেড়ে দেয়নি বেমালুম! দেশান্তরি মানুষেরও পৌরুষ বড় কম না। আজ এতদিন পরে সেসব সহজে টের পাওয়া যায় না বটে কিন্তু মুখের রেখায়, ঋজু করতলে যুদ্ধের ক্ষত কি সহজে মেলায়! কয়েক কিস্তি আগে হর্ষাদিদির কথা লিখেছিলাম। তার চেয়ে সাধনা মাসিমার লড়াই ঢের ঢের কঠিন। তবু কী আশ্চর্য রকমের হাস্যোজ্জ্বল তিনি। শুকনো মাছের গন্ধ যেন তাঁকে স্পর্শ করছে না এতটুকু। যে দেশে বিধবাদের পুড়িয়ে মারা হতো, সময়ে সময়ে পত্রপাঠ বাপের বাড়ি পাঠানোর নিদান দেওয়া হতো, সেখানে কেউ যদি শরিকি দোকান সামলানোয় দক্ষ হয়ে ওঠে সে বড় আনন্দের।
সাধনা মাসিমাকে যত দেখি, যত বেশি রান্নার খুটিনাটি শিখি – ততই টের পাই মানুষ বুকে করে রান্নাও নিয়ে আসে। সে রান্নায় মাটির গন্ধ মিশে থাকে, মায়ের গন্ধ মিশে থাকে, তাই সে রান্না আমাদের চেনা রান্নার চেয়ে ঢের ঢের অন্যরকম। একেই তো ভালোবেসে বলি ইণ্ডিজেনাস কুকিং (indigenous cooking)।

এই যেমন নিলজা ওয়াংমো (Nilza Wangmo)! কী আশ্চর্য মেয়ে। বাপকে যে কখনও চোখেই দেখেনি, সেই বাপের ভিটের এসে হঠাৎ যদি সে একখানা ঘর দাবি করে বসে,তখন কাকা জ্যাঠারা কী করে! তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার থাকে কি? কলেজ ছুট মেয়ের তবু জেদ কমে না। শরিকি লড়াইয়ে হেরে যাবে বলে কি মায়ের হাত ধরে এতদূরে এসেছে? আর কেউ না থাক,মায়ের বাড়ির লোকেরা তো মন্দ নয় তার। একখানা বাড়ি জুটে যায় তাই। ক্রমে ক্রমে নিলজা একখানা রান্নাঘর খুলে বসে। আপনারা যাবেন সেখানে? লেহ থেকে মাত্র ছেষট্টি মেইল দূরে আলচি মোনাস্টারির পাশে নিলজার ‘আলচি কিচেন’ (Alchi Kitchen)। লাদাখি রান্নার গন্ধ এমন করে ছড়িয়ে দেবে বলেই না কলেজ পড়া হয়নি ওর! কাকা জ্যাঠাদের প্রতিবেশি হয়ে কেমন করে ফুল ফোটানোর মন্ত্র শিখলো নিলজা! ও তো রক্তকরবী পড়েনি! ও তো কিশোরকে চেনে না! তবু ও শিখেছে, কেমন করে ওদের মারের ওপর দিয়ে রক্তকরবী ফুটিয়ে তুলতে হয়। লাদাখি রান্নাকে কেমন করে আরও উপভোগ্য করে তোলা যায়, এসব ভেবে ভেবে ও আশ্চর্য স্বাদের চা বানিয়েছে অ্যাপ্রিকটের দানা দিয়ে। সকলে ভেবেছিল, এমন রান্না দেখে লোকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। সাদামাটা ঘরোয়া রান্না কি আর লোক টানতে পারে? সে রান্নায় আর যাই থাক চমক নেই স্বাদের। অথচ কী অদ্ভুত! মানুষেরা সে খাবার খেয়ে আপ্লুত। সকলেই জানতে চায়,কালিনারি ইস্কুলেই কি নিলজা এমন অপূর্ব সব রান্না শিখেছে! ও কেমন করে বোঝায় ওদের! ও কেমন ছেলেবেলা থেকে দেখেছে বাপ মরা মেয়েকে বুকে আগলে মা কেবল স্নেহ মিশিয়ে রান্না করেছে বুকের ওমটুকু দিয়ে। সেই ওই শেখার শুরু। সেটুকুকে সম্বল করেই ও একখানা রান্নার ইস্কুল করেছে লাদাখি মেয়েদের জন্য। সে মেয়েরা তো জানেনা, প্রতিদিনের ঘরকন্নায় যে রান্নাকে তারা সাধারণ বলে জানে তাবড় পৃথিবীর মানুষদের কাছে তার মূল্য অনেক।

রান্নায় মায়ের আর মাটির গন্ধ মিশে থাকে বলেই না তার স্বাদ এমন! বিশ্বায়নের পৃথিবী রান্নাকেও এক ছাঁচে গড়ে পিটে নিতে চায়। যারা জানেন প্রতিদিন কত কত কত ভাষা আর উপভাষা হারিয়ে যাওয়ার গল্প, তারা এটুকুও জানবেন ভাষা আর উপভাষা হারালে রান্নাও হারিয়ে যায়। নিলজা এত কিছু ভাবে না হয়তো! ও কেবল স্বপ্ন দেখে মেয়েরা স্বাধীন হবে একদিন। ছেলেদের রান্না শেখানোয় বরং ওর আগ্রহ খানিক কম। ও বিশ্বাস করে: “লাদাখি রান্নার জন্য চাই ধৈর্য্য আর এখানকার মেয়েরা রান্নায় এমনিতেই পটু। পুরুষ রাঁধুনিদের ব্যাপারে আমি এখনও ততটা ভরসা পাই না। তাছাড়া এখানে ছেলেদের রান্নায় তেমন আগ্রহও নেই। মেয়েরা বরং রান্না শেখার ব্যাপারে খুব উৎসাহী”। (Ladakhi cuisine needs patience and most girls here are good at cooking. I was not sure of men as chefs as that culture is not popular yet, in Ladakh. Girls seem more keen to learn.) ঘরকন্নার কাজও যে কাজ, সে কাজও যে শিখতে হয় একথা বুঝিয়ে দেবার সময় হয়েছে বোধহয়। আপাত ভাবে দেখতে গেলে নিলজার গল্প সামান্য একখানা জীবনের গল্প। সাধনা মাসিমার গল্পও যেমন। ওরা পেরেছে। কত কত মেয়ে তো এমন করে ভাবতেই পারে না। পথে ঘাটে চলতে ফিরতে এমন মেয়েদের তাই কুর্নিশ জানাই অনায়াসে। লাদাখি মেয়ের রূপকথা আর ত্রিপুরার সাধনা সরকারকে মিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। উজবেকি সুজানির মতো এও যেন এক মন ভাল করা নকশি কাঁথা। সব লড়াই কি আর উচ্চকিত! করতলে কার যে কতখানি ক্ষত! লেক চৌমুনি বাজার পেরিয়ে হাঁটি বরং। মানুষ দেখে বেড়ানোই যে আমার কাজ! বিশেষ করে বললে– মেয়েমানুষ দেখা।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।