আগের পর্ব পড়তে: [১]
রবুদার সঙ্গে আমার প্রথম সামনাসামনি দেখা দক্ষিণেশ্বরে মায়ের মন্দিরের সামনে। তখন সদ্য সদ্য আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে শংকরলালের সঙ্গে। শংকর আমার বাড়ির গুরুজনদের কাছে অনুমতি নিলেন আমি ওঁর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর যাব। পুজো দেব। পরে দেখেছি, বুঝেছি শংকর খুব কালী-ভক্ত।
আমি বরাবরই খুব কট্টরমার্কা, সংস্কারসম্পন্ন মানুষ। উচিত-অনুচিত জ্ঞান প্রখর। শংকরলালের সঙ্গে একা পুজো দিতে যাওয়া আমার একেবারেই সমীচীন মনে হচ্ছিল না। মা’কে যথেষ্ট সমীহ করতাম; সোজা ভাষায় ভয় পেতাম। খুব সন্তর্পণে. ধীরে. আস্তে মার কাছে আপত্তি জানালাম। না মানে, ব্যাপারটা হচ্ছে, এখনও যার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই হয়নি, বিয়ে তো সেই একবছর পরে, তাহলে কেন প্রায় অপরিচিত এক মানুষের সঙ্গে আমি একলা বেরবো বা পুজো দেব। সে যেখানেই হোক, এটা তো একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। বাবা কোনওদিন কোনও ব্যাপারে মত প্রকাশ করতেন না, শুধুমাত্র তাঁর মেয়েদের গতিবিধি এবং জীবনযাপন, পড়াশোনার ব্যাপার ছাড়া। অন্য কারোর সঙ্গে ঘোরাঘুরি একেবারেই বরদাস্ত করতেন না। যা করবে বাড়িতে বাবা-মায়ের চোখের সামনে কর, বাড়িতে বন্ধুবান্ধব নিয়ে এসো। গানবাজনা, গালগল্প যা কিছু বাড়িতে তাঁদের চোখের সামনে, তাঁদের অনুমতি নিয়ে করো। আমরা বোনেরা তাতেই অভ্যস্থ ছিলাম। কোনওদিন তার জন্য কোনও ক্ষোভ ছিল না। আমরা জানতাম এটাই জীবন। বড়রা যা বলবেন সেটাই অবশ্য-কর্তব্য। কিন্তু বাবাও দেখলাম দক্ষিণেশ্বর যাওয়ার ব্যাপারে চুপচাপ সম্মতি জানাচ্ছেন। কি আশ্চর্য!

মা বললেন, গেলেই বুঝবে কেন যেতে বলেছি। যাও তোমার খুব ভাল লাগবে। আর শংকর যখন বলছে তখন না বলা উচিত হবে না। বিয়ে তো তোমার ঠিক হয়েই গেছে, ওরই সঙ্গে। এক বছর ও থাকবে না। এখন তোমাকে নিয়ে একটু-আধটু যদি বেড়াতে চায়, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই।
আমি আমার এতদিনের মা-বাবা কাউকে চিনতেই পারছি না যেন।
পরদিন সাদা পাড়, গোলাপি তাঁতের শাড়ি পরে, হাতখোঁপা বেঁধে শংকরলালের আনা অফিসের গাড়িতে যাত্রা শুরু করলাম। আমার জীবনের নতুন মোড়, সেইদিনই বাঁক নিল।
হু হু করে গাড়ি ছুটছে। পাশে ধুতি-পাঞ্জাবিতে সজ্জিত কিন্তু বিদেশির মতো দেখতে, স্বল্প পরিচিত এক অতি সুদর্শন পুরুষ। জানলার কাচ খোলা, হাওয়ায় আমার চুল এলোমেলো। আমি হঠাৎ অনুভব করলাম, বেশ রোমাঞ্চ হচ্ছে। এই প্রথম স্বাধীনভাবে একদম একলা একজন পুরুষের সঙ্গে, যে কিনা আমার ভবিষ্যৎ স্বামী, ভ্রমণ করছি। এ এক স্বতন্ত্র স্বাদ। এক সদ্যযুবতীর নারী হয়ে ওঠার চিকন বোধ।

—‘তুমি একটু গাড়িতে বসো, আমি আসছি।’ আমি চমকে বাস্তবে ফিরে এলাম।
—‘আপনি কোথায় যাবেন?’
—‘বসো, লালা শ্রীধরের বাড়িতে আমার একটু কাজ আছে। এক্ষুনি আসছি। বসো…’
আমি তাকিয়ে দেখলাম একটি অতি সুপ্রশস্ত সুন্দর বাড়ির সামনে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। শংকরলাল খুব তাড়াতাড়ি ধুতি সামলে ওই বাড়ির গেটের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমার হঠাৎ মনে হল, উফফ্! ভদ্রলোকের পা কীই-ই ফর্সা! বাবার চেয়েও!!!
মিনিট দশেক পরে শংকর এসে গাড়িতে আবার আমার পাশে। ড্রাইভারকে বললেন, সামনের মার্সিডিজ গাড়িকে ফলো করতে। মাথামুন্ডু কিছুই বুঝছি না। আমি অপরিচিত মানুষের সঙ্গে একদমই কথা বলতে পারি না। ভীষণ অস্বস্তি হয়। লজ্জা হয়। সত্যি বলতে কী তাকাতেই পারি না। কিন্তু এবার আস্তে করে চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শংকরের দিকে তাকালাম। খুব মজা পেল ও।
—চলো, তোমার জন্য একটা Surprise আছে!

আমি গাড়ির খোলা কাচের জানলা দিয়ে আসা হু হু হাওয়ার আস্বাদ নিতে নিতে চোখ বন্ধ করলাম। আমি এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হলাম। বাঃ শংকরলাল তো বেশ। কেমন সুন্দর কথা বলেন। ঠিক যেন আমার বাবা। আমি শুধু শুধুই একলা আসতে ভয় পাচ্ছিলাম।
বাবা, মা তোমরা ঠিক করেছ আমাকে পাঠিয়ে। দেখো মা. আমি তাহলে সত্যি সত্যি বড় হয়েছি।
তাই না… ও বাবা?
আমি বরাবরই গাড়িতে করে বেড়াতে ভালবাসি। গাড়ির কাচ খোলা থাকবে। দুরন্ত বাতাস এসে বারবার আমার মুখে ঝাপটা মারবে। চুল এলোমেলো করে দেবে। চারপাশের গাছপালা, গাড়ি, বাড়ি, নানারকম মানুষজন গাড়ির দুরন্ত গতির সঙ্গে ছুটে ছুটে হারিয়ে যাবে। আমি বারবার খুঁজে খুঁজে তাদের দেখব। কী যে আনন্দ হচ্ছে! হাতখোঁপায় বাঁধা লম্বা, ঘন, বাদামি, সোনালি-কালো মেশানো কেশরাশি খুলে দিলাম। হাওয়া এলোমেলো করে দিল আমার সব ভাবনা, এতকালের সংস্কার। আমি পাল্টে যাচ্ছি। আমি বড় হচ্ছি। কৈশোর ছেড়ে আস্তে আস্তে যুবতী হচ্ছি!
এ তো বেশ অন্যরকম! আমার অসম্ভব নিয়মে চলা জীবন, এ স্বাদে বঞ্চিত।
ভাবলাম এর চেয়ে সুখ আর কীই-ই বা আছে! বাঃ! কী সুখী আমি।
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম মনে মনে… ঈশ্বর হাসলেন।

আমি তো তখনও জানি না কী অপেক্ষা করছে আমার জন্য! দক্ষিণেশ্বর এসে গেল। গাড়ি থেকে নামলাম। মার্সিডিজে যাঁরা ছিলেন দেখি তাঁরাও নামছেন।
আমি মুগ্ধতায় তখনও আচ্ছন্ন। মায়ের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম—অনেকটা পথ আসার ক্লান্তি। যে কোনও দেবস্থান আমাকে বরাবর টানে। এক অদৃশ্য শক্তি আমায় বারবার নতুন করে জন্ম দেয়। শংকরলালের ডাকে আমার সম্বিত ফিরল। আমার সামনে অতি সৌম্যদর্শন, ছোটখাটো, ফর্সা, ঘাড় পর্যন্ত বিন্যস্ত চুল, সুদৃশ্য পাঞ্জাবি-কুর্তা পরিহিত এক অসম্ভব আকর্ষণীয় দেবদূত দাঁড়িয়ে। পা ছুঁয়ে প্রণাম করতেই বললেন, “ও শংকর, এই বুঝি ইন্দ্রাণী! তা এই মা লক্ষ্মীকে কোথায় খুঁজে পেলে গো!”
আমি তাড়াতাড়ি করে খোলা চুলের খোঁপা নিজের হাতেই জড়িয়ে বেঁধে নিলাম।

ইনিই তো পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সত্যি তো! এঁর কত ছবি দেখেছি। রেডিওগ্রামে লং প্লেয়িং রেকর্ডে এঁর বাজানো সেতারে কত রাগ, বন্দিশ, দ্রুত্ ঝালা শুনেছি।
ইনিই তো সেই জগৎবিখ্যাত রবিশঙ্করজী।
আমি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছি? সত্যি?
উনি কত কী বলছেন আমার দিকে তাকিয়ে। আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নদীর স্রোত বইছে। আমার হাতের তালু ভীষণ ঘামছে। আমার কানে পণ্ডিতজীর তৈরি নান্দ (আনন্দী) রাগের বন্দিশ বাজছে। আমার সামনে সেই বিশ্বশ্রুত লেজেন্ড। আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এক ভয়ঙ্কর সুখানুভূতির সুঘ্রাণ তখন আমার চারপাশ ছেয়ে আছে।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
আগামী পর্ব প্রকাশ পাবে সেপ্টেম্বর, ২০২৩
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
2 Responses
বাহ!! অসম্ভব সুন্দর লেখা। চোখের সামনে সব কিছুই পরিষ্কার দেখতে পেলাম। অনেক কিছু জানা ও হলো। কিন্তু ওই যে আগে বলেছিলাম, ঘটনা গুলোর সময়কাল জানা হলো না। এটা হলে মনে হয় সর্বাঙ্গসুন্দর হবে।
আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি পরের পর্ব পড়ার জন্য।
Dhorle chhara mushkil…amon agroho niye shuru theke shesh korlm.