‘অ্যার্লবার্ট পিন্টো কো গুসসা কিউঁ আতা হ্যায়?’
নাসিরুদ্দিন শাহ্, শাবানা আজমির সেই ছবি মনে পড়ে? অ্যার্লবার্ট অর্থাৎ নাসিরুদ্দিনের ছোট ছোট ঘটনায় অস্বাভাবিকরকম রেগে যাওয়া নিয়েই এগিয়েছিল ছবির প্লট| রাস্তায় ট্র্যাফিক লাইট দেখলে, অটোচালক সাইড না দিলে, এমনকি প্রেমিকার স্কার্ট দৈর্ঘ্যে খানিক খাটো হলেও ভয়ঙ্কর রেগে যেতেন অ্যার্লবার্ট| আর তার থেকেই ঘটে যেত বড় বড় দুর্ঘটনা| নিজের অজান্তেই সে হারিয়ে ফেলত মূল্যবান সম্পর্ক| ফাটল তৈরি হত বন্ধুত্বে|
গল্প গুটি গুটি এগোলে বোঝা গিয়েছিল অ্যার্লবার্টের রাগের পেছনের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটটা| পরিবারের উপার্জনক্ষম বড় ছেলে, মোটর মেকানিক, ‘স্বভাব রাগি’ অ্যালবার্ট পিন্টোর তর্জন গর্জন এতটুকুও কমেনি ছবির শেষেও| শুধু বদলে গিয়েছিল রাগের কারণগুলো|
বাংলায় বিধানসভা ভোটের মুখে এমনই রাগের বর্ষণ বার বার চোখে পড়ছে রাজনৈতিক মঞ্চ, টেলিভিশনের পর্দা অথবা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে| মাত্রারিতিক্ত রাগ, ক্ষোভ, উষ্মার জ্বলজ্বলে বহিঃপ্রকাশ সর্বত্র| এগুলো কী শুধুই রাগ? নাকি রোগ? জানার কৌতুহলে প্রশ্ন করেছিলাম মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে|
যে কোনও রাগই কি রোগ?
“এই ধরনের যে কোনও অশোভন প্রতিক্রিয়াকেই ‘রোগ’ বলে দাগিয়ে দেওয়াটা উচিত্ হবে না| তাতে ওই মানুষটির তাঁর আচরণের প্রতি আর কোনও দায় বর্তায় না| চারপাশে নেতানেত্রীরা আজকাল যে আচরণ করছেন, মতানৈক্যের অজুহাতে সুস্থ তর্কের পরিধি থেকে বেরিয়ে এই যে পারস্পরিক কুরুচির প্রদর্শন ও প্রতিদ্বন্দ্বীতা চলছে তা কোনও রোগের আওতায় পরে না|” এটা বরং সামগ্রিক একটা ঘৃণার বাতাবরণের থেকে আসা অনাকাঙ্খিত আচরণ| কারণ এর কোনও ধারাবাহিকতা নেই| তাই ‘অসুখ’ বললে এঁদেরকে একটা ঢাল দিয়ে দেওয়া হয়|” বললেন অনুত্তমা|
আর সেই অ্যার্লবার্ট পিন্টোরা, যাঁদের আমরা প্রায়ই দেখতে পাই রোজকার জীবনে? যাঁদের কেউ হয়তো শুধুমাত্র সবজিগুলো সমান কাটা হয়নি বলে প্রেসার কুকারভর্তি গরম মাংস উল্টে দেন রাগে| সামান্য তর্কে দিগবিদিগজ্ঞানশূন্য হয়ে মেঝেয় আছাড় মারেন নিজেরই ল্যাপটপটিকে| কিংবা সেই লোকগুলো যাঁদের আমরা হামেশাই দেখতে পাই টিকিটের লাইনে অথবা রাস্তায় গাড়ির ড্রাইভিং সিটে| শুনতে পাই তাঁদের অশ্রাব্য গালিগালাজ? সামান্য কারণে মাত্রারিরিক্ত রাগে যাঁরা নিজেকে হারিয়ে ফেলেন বার বার?
‘ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসওর্ডার’
এখানেই অনুত্তমা বললেন, ‘ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসওর্ডার'(IED)-এর কথা| যেখানে ‘রাগ’ অবশ্যই একটা ‘রোগ’| “মানসিক স্বাস্থ্যের ম্যানুয়ালে কিন্তু বার বার এই ধরনের আচরণ করাকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে| কোনও ব্যক্তি যখন কার্যকারণের সঙ্গে ‘অসামঞ্জস্যপূর্ণ’ এবং ‘হঠকারী’ একটা রাগ দেখাচ্ছেন বারংবার, রেগে গিয়ে নিরীহ পশুপাখির ওপর আক্রমণ করছেন, সামান্য কারণে কুত্সিত ভাষা প্রয়োগ করছেন তখন তা IED-এর আওতায় পড়বে| এই রোগীদের ক্ষেত্রে মানসিক স্থিতিতে ফেরার পর অনুশোচনা না হলেও একটা খারাপ লাগা কাজ করতে পারে|” বললেন অনুত্তমা|
সচেতনতার অভাব
তবে এই রোগের ক্ষেত্রে সমাজে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলেই মনে করেন বিশিষ্ট মনোবিদ অনুত্তমা| তাঁর মতে, ‘ও একটু রাগী’ এই বলে অনেকসময়ই ছোটবেলা থেকে এই ধরনের আচরণের প্রতি উদাসীন থাকেন পরিবারের মানুষ-জন| কিন্তু ‘রাগী’ যে কখন রোগী হয়ে গিয়েছে সেটা বুঝতে বুঝতে অনেকটা দেরি হয়ে যায়| আর ক্রমশ বেড়ে যায় এই ধরণের প্রবনতা যার থেকে বড় ধরণের দুর্ঘটনা পর্যন্ত ঘটে যেতে পারে| তাই এই অসুখের ক্ষেত্রে পরিবারের ও নিজের একটা প্রাথমিক সচেতনতা খুব প্রয়োজন|”
নিরাময়ের পথ
একদম প্রাথমিক স্তরে যদি এই অসুখের চিকিৎসা শুরু করা যায় সেক্ষেত্রে কিন্তু থেরাপি ও অন্যান্য অনেক পদ্ধতি রয়েছে যেগুলির সাহায্যে এই অনিয়ন্ত্রিত রাগের নিয়ন্ত্রণ সম্ভব বলে দাবি করেন অনুত্তমা| তিনি এও বলেন, অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায়, বিবাহের পরে এই অসুখ সামনে আসছে| কারণ পরিবারের পক্ষ থেকে এই আচরণগুলিকে দীর্ঘদিন ধরে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে| এই অসুখে আক্রান্ত মানুষকে চিকিৎসা বা থেরাপিতে নিয়ে আসাটাও সবসময় সহজ হয় না| কারণ অনেক ক্ষেত্রে এঁদের মধ্যে ওই রাগ প্রকাশের মধ্যে দিয়ে একটা কমফোর্ট কাজ করে| সেক্ষেত্রে পরিবারের উচিত্ তিনি যে নিজেরও কতটা ক্ষতি করে ফেলছেন সেটা তাঁকে বোঝানো|
‘লো ফাস্ট্রেশন টলারেন্স’ এবং ‘লো ডিসকম্ফোর্ট টলারেন্স’ কিন্তু এই অসুখের অন্যতম লক্ষণ| ‘না’ শুনতে না পারা, সামান্য অসুবিধেতেও অসামান্য রাগের বহিঃপ্রকাশ– IED-এর ক্ষেত্রে বারবারই এই জায়গাগুলি উঠে আসে চিকিৎসায়| সেখানেই রোগীকে শেখানো হয়, তোমার অসুবিধেটা বলে দেওয়াটুকুই অভিপ্রেত| অসুবিধের জন্য কারও বা নিজেরও ক্ষতি করে ফেলাটা কখনওই কাম্য নয়| আর সেখান থেকেই একটু একটু করে চিকিৎসার মাধ্যমে সেরে উঠতে পারেন ইন্টারমিটেন্ট এক্সপ্লোসিভ ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি|
আর এভাবেই আমাদের চেনা-জানা ‘অ্যার্লবার্ট পিন্টো’রাও ফিরতে পারেন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে|
এক সময় বাংলা খবরের চ্যানেলে প্রোডাকশনের পেশায় যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে লেখালেখি করে আর দুই সন্তানের দেখভাল করেই হুশ করে কেটে যায় সংযুক্তার দিন। অবসর সময়ে ভালোবাসেন পরিবারের সকলের সঙ্গে বেড়াতে যেতে।