banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

ছোটগল্প: জোড়াতালি

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Short story about Covid Lockdown

হ্যালো… হ্যালো শুনতে পাচ্ছি না রে, পরে ফোন করছি…।

দিদির কথাগুলো গিলে নিল মেট্রোর টানেল। অফিসফেরতা সুদেষ্ণা এতক্ষণে ইতিউতি চাইল। ভিড় এসি-মেট্রোর লেডিজ় সিটে কোনও কোণা খালি আছে কি…! নাঃ ..। হতাশ হয়ে দেখল অনেকগুলো নির্লিপ্ত মুখ মনোযোগী মোবাইলে। ঘাড়ে ব্যথাটা বড্ড বেড়েছে। বস্তার মতো ভারী ব্যাগটা কারও কোলে দিতে পারলে ভাল হত। কিন্তু সে আর হচ্ছে কই। এক ছাদের তলায় থাকা মানুষটাই ফুরসত পায় না মুখ তুলে তাকানোর, দুটো কথা বলার। তো মেট্রোর অপরিচিত লোককে দোষ দিয়ে লাভ কী!

সুদেষ্ণা যাবে অনেক দূর। সেই লাস্ট স্টেশন, নিউ গড়িয়া। কালীঘাট পেরলে বসার জায়গা পাকা। রোজ তাই হয় মোটামুটি। সুড়ঙ্গ থেকে বেরলে, মেট্রো খোলা আকাশের নীচ দিয়ে গেলে ফোনের সিগন্যালটা ফেরে। দিদিকে কটা জরুরি কথা বলার ছিল। ভাবতে ভাবতে কালীঘাটের আগে যতীন দাস পার্কেই বসতে পেয়ে গেল সুদেষ্ণা। মোবাইলটা তখনও মরা। টালিগঞ্জ ঢুকতে ঢুকতে পরপর শব্দে জেগে উঠল মুঠোফোন। এত কিসের অ্যালার্ট! খবরের কাগজ দেখার সময় হয় না তার। তাই বাংলা ইংরেজি মিলিয়ে কিছু নিউজ় অ্যাপই ভরসা।

পাঁচ বছরের ছেলের স্কুল, পড়াশোনা, নিজের অফিস, সংসারের খুঁটিনাটি সামলে ফুরসত বলে যে কিছু হয়, কবেই ভুলে গেছে সুদেষ্ণা। বাপের বাড়ির টান বলতে সল্টলেকে দিদির কাছে যাওয়া অবরে সবরে। বাড়িতে ছোট ছেলেটা আর তমালের দিদান। মানে সুদেষ্ণার দিদিশাশুড়ি। তমালের মা বাবা ওদের বিয়ের আগেই মারা গিয়েছেন। ছোট ছেলে আর বুড়িটার জন্য তবু বাড়ি ফেরাটা এখনও ফেরা। তমাল তো এখন অন্য মানুষ… অচেনা কেউ। 

ভাবনার তার কাটে অ্যালার্টে চোখ রেখে। দিদিকে আর ফোন করাও হয় না। এসব কী বলছে! দুদিন পর থেকে লকডাউন? জনতা কার্ফুতে সাধ মিটল না? আবার লকডাউন? সব বন্ধ হয়ে যাবে? মানেটা কী? ২৪ ঘণ্টা বাড়িতে থাকতে হবে? তা-ও আবার সেই মানুষটার সঙ্গে, যে এককালে পরম প্রিয় থেকে অন্য কেউ হয়ে গেছে! সবার আগে শুধু এই চিন্তাটাই মাথায় এল সুদেষ্ণার। খাবে কী, বাড়িতে কত দিনের জিনিস মজুত আছে, বুড়ি দিদানের ফিজিওথেরাপি ছাড়া কী করে চলবে, বাবিনের পড়াশোনার কী হবে… এ সব কিচ্ছু মাথায় এল না। 

সুড়ঙ্গ থেকে বেরলে, মেট্রো খোলা আকাশের নীচ দিয়ে গেলে ফোনের সিগন্যালটা ফেরে। দিদিকে ক’টা জরুরি কথা বলার ছিল। ভাবতে ভাবতে কালীঘাটের আগে যতীন দাস পার্কেই বসতে পেয়ে গেল সুদেষ্ণা। মোবাইলটা তখনও মরা।

অচেনা মানুষটিও গত দুতিন বছরে দিব্য মানিয়ে চলছেন। যথাসম্ভব কম কথা। কেজো কথা। ঝগড়া অশান্তি বন্ধ। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। প্রেম টেম ভুলে এভাবেই চলছে। বাবিনের মা-বাবার রোলে ঘাটতি নেই কারও। ঘাটতি কখনও তৈরি হলেও অনুযোগ অভিযোগ নেই। সকলে জানে তমাল-সুদেষ্ণা সুখী দম্পতি। ফেসবুক তাই বলে। প্লাস পয়েন্ট বাবিন আর দিদান। বিবাহবার্ষিকী, জন্মদিনে ওদের গলা জড়িয়ে দুচারটে ছবি দিলেই কেল্লাফতে। নিভৃতে মনে কার কী হল, কে জানছে।

***

এভাবেই কেটে যাবে আরও কিছু বছর। ভেবেছিল সুদেষ্ণা। বাবিন বড় হলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু বাবিন মা বা বাবা কোনও একজনের স্নেহ পাবে, এটা সে মানতে পারছিল না। তমাল নীরব সমর্থন জানিয়েছিল। সেই থেকে আলগা সুতোয় দাম্পত্য দুলছে। কিন্তু এই লুকোচুরি, এড়িয়ে যাওয়া, কেউ কাউকে না দেখা, এসব একসঙ্গে সারাক্ষণ থাকলে হয় নাকি। দিদানও তো সব ধরে ফেলবে এবার।

আনসান ভাবতে ভাবতে মেট্রো থেকে নেমে অটোয় ওঠে সুদেষ্ণা। চার দিকে এক আলোচনা। বাজারের কী হবে… আবার কালোবাজারি না হয়… কাজের লোক আসবে না তাহলে? সব বন্ধ করলে অর্থনীতির কী হবে? অটোয় লোকগুলোর মুখ বন্ধ করে দিতে ইচ্ছে করছিল সুদেষ্ণার। নিকুচি করেছে দেশের দশের! আমার ঘরে কী হবে তার নেই ঠিক, বাজে বকতে পারে লোকজন শুধু। 

বাড়ি ঢুকতেই দিদানেরও একই রিঅ্যাকশন।
ওরে জানতে পেরেছিলি তো তোর মোবাইলের টুংটাংয়ে?
ওহ্ দিদান হ্যাঁ।
বাবাহ্ এখনই এত বিরক্তি! সময় তো পড়ে আছে বাপু। লড়তে হবে অনেক। মাথা ঠান্ডা রাখ। মালতী ফোন করে বলেছে কাল এলেও পরশু থেকে কী হবে কেউ জানে না। গাড়ি ঘোড়া বন্ধ। নতুন সকাল আসছে। তৈরি হও।

দিদানের কথার বন্যা সামলে ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে হাঁপ ছাড়ল সুদেষ্ণা।
দেখ দিদান, আগেই লাফঝাঁপ শুরু কোরও না। বয়সটা অনেকদিন আশি পেরিয়েছে, আশা করি মনে আছে? যা করব সবাই মিলে দেখেশুনে কথা বলে তারপর।
বয়স তুলে আর খোঁটা দিস না। তিরিশ পেরিয়ে তোর মতো কাঁধের ব্যথা নিয়ে কোঁ কোঁ করতাম না। আমায় বয়স দেখাচ্ছে!

সুদেষ্ণা জানে এই আলোচনাটা কোথায় গড়াবে। তাই ক্ষান্ত দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল। মনে মনে ভাবল, এমনিতেও এখন দিদানকে হাতে রাখতে হবে। তমালের সঙ্গে পাহাড়প্রমাণ দূরত্বটা ধরে ফেললেই হয়েছে। দুবছর ধরে বুড়ির চোখকে ফাঁকি দিতে কম পরিশ্রম তো ওদের করতে হয়নি। তমাল এসব ব্যাপারে ভীষণ কোঅপারেটিভ। দিদানকে খুশি রাখা, আদর্শ স্বামীর ভূমিকায় ওর অভিনয় অস্কার পাওয়ার মতো। 

সেই থেকে আলগা সুতোয় দাম্পত্য দুলছে। কিন্তু এই লুকোচুরি, এড়িয়ে যাওয়া, কেউ কাউকে না দেখা, এসব একসঙ্গে সারাক্ষণ থাকলে হয় নাকি। দিদানও তো সব ধরে ফেলবে এবার।আনসান ভাবতে ভাবতে মেট্রো থেকে নেমে অটোয় ওঠে সুদেষ্ণা। 

আজকাল সুদেষ্ণার সব গুলিয়ে যায়। কী নিয়ে অশান্তি হয়েছিল যেন তমালের সঙ্গে? ঠিকঠাক মনেও পড়ে না। তৃতীয় কারও অনুপ্রবেশ অন্তত তখন ঘটেনি। এখনকার কথা জানে না সুদেষ্ণা। শুধু সব পেরিয়ে মনে থাকে দুজনের ইগো। সে পাঁচিলটা এত উঁচু করে ওরা কবে গেঁথে ফেলল কে জানে। তমালের হাতে সময় নেই। বাচ্চা-বৌ-বাড়ি কিছুই তার কাছে ইমপরট্যান্ট নয়। কাজ বাদে কিছু ভাবতে পারে না। এমন সমস্যা তো ঘরে ঘরে। তা বলে কেউ এমন ঠান্ডা মেরে যায়! কে জানে। 

আসলে সুদেষ্ণা ঝগড়াটাও গুছিয়ে করতে পারে না। তাই তমাল যেন খানিকটা হাতে চাঁদ পেয়ে গিয়েছিল। বৌ রাগ অভিমানে গোঁজ হয়ে বসে রয়েছে, তাকে আবার মানাতে হবে? অত পোষায় না ভাই। পরদিন বসের কাছে জবাবদিহি অনেক চাপের। বৌ বৌ করে প্রোমোশনটা খোয়াই আর কী! এই হল তমালের পলিসি। এই করে করে দাম্পত্যে চাওয়া-পাওয়া ঝগড়া-অভিমান-ভালবাসাবাসি হাওয়া। পড়ে ছিল পাশাপাশি বেঁচে থাকাটুকু। কিন্তু করোনার ঠেলায় এবার সেটা এমন আক্ষরিক হয়ে যাবে কে জানত!

***

খানিক পরে তমাল ফিরল অফিস থেকে। অন্যদিন ফিরে ছেলের সঙ্গে খানিক ধ্বস্তাধ্বস্তি করে মজায় সময় কাটায়। আজ সেটা হল না। দিদান সামনে ছিল। বলল, ‘চা করে দিই। খা। বেশি টেনশন করিস না। সব ঠিকঠাক ম্যানেজ হয়ে যাবে। এমনিই তোর কাজের এত চাপ…।

রান্নাঘর থেকে দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে সুদেষ্ণা। শাশুড়ির খোঁটা তাকে শুনতে হয়নি কোনওদিন। আর দিদান এমন একজন মানুষ যার খরখরে কথাও মনে লাগে না। এখন হাসি পেল নাতির জন্য চিন্তা দেখে। সুদেষ্ণা ফেরার পর তো এসব ভুলেও বলল না! তমাল দিদানকে ঘাড় নেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

পরদিন অফিস থেকে ফিরল একস্ট্রা একটা ল্যাপটপ নিয়ে। সবারই বাড়ি থেকে কাজ হবে এবার। সুদেষ্ণার অ্যাকাউন্টস। তমালের সেলস। কাজটা করতে হবে ঘরে, এটা একটা বাঁচোয়া। কিন্তু ওদের ফ্ল্যাটটা বড়ই ছোট। দিদানের ঘরে অ্যাডজাস্ট করে বসতে হল সুদেষ্ণাকে। আর তমাল নিজেদের ঘরের টেবিলের দখল নিল।

বাজার-টাজার কিছু মজুত করা হল। সুদেষ্ণার সঙ্গে বাড়ির কাজে আরও বেশি করে হাত লাগাল দিদান। সুদেষ্ণার চিন্তা হচ্ছিল, এই বয়সে দিদান এতটা ধকল নিতে পারবে কিনা। তারপর বাবিনের তিড়িংবিড়িং সামলানো কী মুখের কথা! স্কুল নেই। সারাদিন বাড়ি মাথায় করছে। তবে ভাগ্যিস বাবিন ছিল, তা না হলে সুদেষ্ণার সুতোয় টলমল দাম্পত্য ম্যানেজ করা আরও কঠিন হত। বাচ্চাকাচ্চা থাকলে তার দিকেই লোকের নজর যায় বেশি। বাচ্চার বাপ মা কেমন আছে, ওসব নিয়ে কোন বাঙালি আর মাথা ঘামায়!

সকালটা এখন একটু দেরিতে শুরু হচ্ছে। সুদেষ্ণার অফিস শুরু হত ১১টা থেকে। তবে এই মার্চ-এপ্রিলের বাজে গরমে রান্নাঘরের কাজ যত জলদি করে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। দিদান অবশ্য ভোরে উঠে অনেকটা এগিয়ে দেয়। তরিতরকারি কেটে, সকালের খাবারের জোগাড় করে। তারপর বাকিটা সারে সুদেষ্ণা। সব মিটিয়ে বসে যায় ল্যাপটপে। কিন্তু তমালের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না ও। প্রথমদিকে কাজে একেবারে ডুবে বিরাট একটা ব্যাপার চলছিল। কোনওদিকে তাকাতেই পারছেন না বাবু। ছিয়াশি বছরের বুড়ি খাটছে, তা-ও তার চোখে লাগে না।

কিন্তু গত দুদিন ধরে সব অন্যরকম ঠেকছে। দুএকবার ফোনে তমালকে চেঁচামেচি করে কথা বলতে শুনেছে সুদেষ্ণা। ঠিক কী নিয়ে, তাতে মাথা দেয়নি। এসব ওর অনেকদিনের অভ্যাস। কৌতূহলও হয় না। তবে এবার কেন জানি না মনটা চলে যাচ্ছে ওদিকে। চাকরি বাকরি আছে তো? যত উঁচু পদ, তত চিন্তা বেশি। 

রান্নাঘর থেকে দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে সুদেষ্ণা। শাশুড়ির খোঁটা তাকে শুনতে হয়নি কোনওদিন। আর দিদান এমন একজন মানুষ যার খরখরে কথাও মনে লাগে না। এখন হাসি পেল নাতির জন্য চিন্তা দেখে। সুদেষ্ণা ফেরার পর তো এসব ভুলেও বলল না! 

যেচেপড়ে কথা বলতেও ইচ্ছে করে না। বাজারহাট করার সময় যা একটুআধটু কথা। যখন দোকান খোলা থাকছে, তমালই যাচ্ছে নিয়ম করে। নিজেই বলল, ‘সবাই বাইরে গিয়ে রিস্ক বাড়ানোর তো মানে হয় না। এক হাতেই বাইরেটা সামলানো যাক।দুধ বা ডিম তো বেশি দিন স্টক করাও যায় না। ফ্রিজে রেখেও এই গরমে বেশিদিনের পুরনো বের করলেই নষ্ট। কিন্তু গতিক সুবিধের ঠেকছে না। বলতেই হবে কথা, সবে ভেবেছে সুদেষ্ণা। হঠাৎ দরজার বাইরে চোখ গেল। গোয়েন্দা গিন্নির কড়া নজরে তাকে দেখছে দিদান। সুদেষ্ণা কেঠো হাসি হেসে বেরিয়ে এল রান্নাঘর থেকে।

বাবিনটা যে কোথায় গেল… দেখ আবার ছাদে চলে গেল কি না। বাবিন… বাবিইইন…।
থাক। আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা কোরও না। বলছি এভাবেই কাটাবে বাকি জীবনটা

বেশ জোর গলায় বলে ওঠে দিদান। আশ্চর্য! তমালই বা কোথায় গেল? সুদেষ্ণার দশা প্রায় ধরা পড়া আসামির মতো! পালানোর পথ পাচ্ছে না। 

কী যে বল দিদান…। এভাবেই মানে কী? একসঙ্গে দিব্যি আছি সবাই। তুমি এসব কী বলছ?
বাপ ছেলেতে ছাদে গেছে। তাই কথাগুলো বলার সুযোগ ছাড়লাম না। খুব তালেবর হয়েছ তোমরা। এতদিন বলিনি বলে ভাবছ কিছুই বুঝি না আমি

এই মার্চ-এপ্রিলের বাজে গরমে রান্নাঘরের কাজ যত জলদি করে ফেলা যায় ততই মঙ্গল। দিদান অবশ্য ভোরে উঠে অনেকটা এগিয়ে দেয়। তরিতরকারি কেটে, সকালের খাবারের জোগাড় করে। তারপর বাকিটা সারে সুদেষ্ণা। 

ও বাবা, তুই থেকে তুমি! বুড়ির কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই। সুদেষ্ণা এবার ভণিতা সরিয়ে বলে,
সব যদি বোঝই তাহলে আর জিজ্ঞেস করছ কেন?
হ্যাঁ বুঝি তো কী। আমার প্রথম প্রশ্ন তো তা ছিল না। জানতে চেয়েছিলাম এভাবেই তোরা কাটাবি বাকি জীবনটা?
না, তোমার প্রথম প্রশ্নে তোরা ছিল না। আমি আমার কথা বলতে পারি। তোরার উত্তর চাইলে…
ব্যস বুঝেছি। কথা কেটে দিয়ে বলল দিদান। তুই তোরটাই বল।
দেখ দিদান তুমি তোমার নাতির কোনও দোষই দেখতে পাবে না। কী লাভ আমার কথা বলে? দিদান চুপ দেখে সুদেষ্ণা বলে চলে, ‘এ তো আজকের কথা নয়। বাবিন আসার পরে আমার ব্যস্ততা বেড়েছে। ওরও কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে। তাতে কেউ দূরে সরে যায় কি? আমি অনেকদিন ওয়েট করেছি দিদান। ঝগড়াটগড়া আমার আসে না তুমি তো জানো। কী করব? তাই চুপ হয়ে গেছি। বাবিনের কোনও অযত্ন হবে না কথা দিচ্ছি।

সে তো দেখতেই পাই। বাবা-মা সাজায় তোদের কোনও খামতি নেই। কিন্তু বাকিটা তো বাইরের লোক বুঝবে না। বুঝব আমি। কদিন আর বাঁচব বল? তার মধ্যে তোদের এই অপকম্মে নিশ্চিন্তে মরাও আমার হবে না তা যতই করোনা মরোনা আসুক!
আহ্ দিদান থামো তো। উল্টোপাল্টা কথা থামাও। নয়তো আমি গেলাম।
দাঁড়া দিদিভাই…। সুদেষ্ণার হাতটা টেনে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয় দিদান।
আমি একটা বড় সংসারে ছিলাম। অনেক অভাব অভিযোগ ছিল। তবে মুখ ফুটে বলতে পারিনি। চলে গেছে সময়। আগে তো তাই হত রে। তবে একটা কথা কী জানিস… আমাদের সময়ে আমরা জানতাম ছেঁড়াফাটা জামা তাপ্পি দিয়ে পরে নেওয়া যায়। বাইরে থেকে দেখতে একটু খারাপ লাগে বটে। কিন্তু আরও অনেকদিন টেঁকে। তোদের মতো জামার রং ফ্যাকাশে হলে বা সেলাই খুললেই ফেলে দিতাম না।
জামাকাপড় আর দাম্পত্য এক জিনিস দিদান?
না, এক তো নয়ই। তবে জামার তাপ্পি মারার হালও যদি না থাকত, তাহলে কথাগুলো বলতাম না। আমার মনে হয় এখনও সেলাই করার জায়গা আছে। তবে দরজি না রাজি, তো কেয়া করেগা কাজি! 

দুধ বা ডিম তো বেশি দিন স্টক করাও যায় না। ফ্রিজে রেখেও এই গরমে বেশিদিনের পুরনো বের করলেই নষ্ট। কিন্তু গতিক সুবিধের ঠেকছে না। বলতেই হবে কথা, সবে ভেবেছে সুদেষ্ণা।হঠাৎ দরজার বাইরে চোখ গেল। 

সুদেষ্ণা হেসে ফেলে। দিদানকে বলে,
আচ্ছা দাঁড়াও দেখছি, একটু সময় দাও। ওর অফিসে কিছু একটা হয়েছে জানো দিদান। এমনিই কথা বলব ভাবছিলাম।
সে কী! দেখ বাবা বুঝেশুনে। আমিও তাই ভাবি, এতক্ষণ কাজ ফেলে ছেলের সঙ্গে ছাদে খেলার পাত্তর তো সে নয়!
হ্যাঁ সেইদীর্ঘশ্বাস গোপন করে না সুদেষ্ণা। বাবার ভূমিকায় তমাল যেমন লড়ে যায় ঠিক। তবে কাজ তার জন্য সাফার করে না। কী হল দেখতে হচ্ছে, চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সুদেষ্ণা।

***

কিন্তু বলব তো ভাবলেই তো বলা যায় না। বাধো বাধো লাগছে। ছেলেকে নিয়ে নীচে ফিরে বাবু আবার ফোনে মন দিয়েছেন। কথা বলার সুযোগ সময়ই বা কোথায়? বাড়িতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে যেন! ভাল লাগে না বাবা। ওই বোধহয় ফোন রাখল। সুদেষ্ণা এগলো ঘরের দিকে। ঢুকতে গিয়ে প্রায় মুখোমুখি হচ্ছিল আর কী। তমাল চমকে পিছিয়ে যায়। এমন তো সচরাচর ঘটে না আজকাল। তমাল বলে ওঠে, ‘কিছু বলবে?’ 

সুদেষ্ণা একটু থতমত খেয়ে বলে, ‘হ্যাঁ ওই বাবিনের স্কুল থেকে মেসেজ করেছে। নেক্সট উইক থেকে নাকি অনলাইন ক্লাস। তাহলে ওর জন্য ল্যাপটপ লাগবে কিনা ভাবছিলাম।’ 

কী বলতে এসে মুখ দিয়ে কী বেরলো, নিজেকে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল সুদেষ্ণার। তমাল অবশ্য এতটুকু অবাক না হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ সবারই তাই হচ্ছে। আপাতত আমার একস্ট্রা ল্যাপটপে ওর ক্লাস চলে যাবে। ওটা এখনই লাগছে না।
সে কী, তোমার অফিসের কাজ?
আর অফিস! এত দিন যার জন্য করে মরলাম, এখন বিনা নোটিসে লোক তাড়িয়ে দিচ্ছে।
ও… তোমার… 

তমাল ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না আমারটি এখনও আছে। তবে যে হারে নিজে হাতে কোম্পানির নির্দেশ মেনে লোক তাড়াচ্ছি, আমারও গেল বলে।

সুদেষ্ণা আর কথা বাড়ায় না। এইটাই তো সমস্যা। তমাল ভাবছিল। মন খুলে দুটো কথা বলতে গেলাম। নির্লিপ্ত হয়ে চলে গেল। চাকরি গেলেই যেন খুশি হত। অদ্ভুত! ফাঁকা ঘরে বসে তমাল। কেন এমন হয়ে গেল সুদেষ্ণা? এত ঠান্ডা? কিসের এত অভিমান? কোনওদিন বলল না। কীভাবে বেঁচে আছে তারা? বিয়ের দশ বছর হতে না হতে সব দম্পতি কি এভাবে বেঁচে থাকে? বাইরে থেকে কেউ কিছু বোঝে না? কী মানে এই বেঁচে থাকার?

এসব কী ভাবছে তমাল? কই এতদিন তো একবারের জন্যও এই সব কথা মাথায় আসেনি। শুধু ছুটেছে জীবনের সঙ্গে। আজ ফাঁক পেয়ে এত কথা কখন ঢুকে পড়ল ভেতরে! 

ছেলেকে নিয়ে নীচে ফিরে বাবু আবার ফোনে মন দিয়েছেন। কথা বলার সুযোগ সময়ই বা কোথায়? বাড়িতেই অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতে হবে যেন! ভাল লাগে না বাবা। ওই বোধহয় ফোন রাখল। সুদেষ্ণা এগলো ঘরের দিকে।

অথচ বছর দুয়েক আগে পর্যন্তও সব দিব্য ছিল। বাবিনের বড় হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছিল সময়। একসঙ্গে বেড়ানো, খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখা। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে তমালের কাজের চাপ বেড়েছে। পরপর বেশ কয়েকবার বেড়ানোর প্ল্যান হয়ে ক্যানসেল হয়ে গেছে। সারাদিনে ফোনে দুটো কথা বলার অবসরও হয়নি। কিন্তু এসব কি এত বড় ব্যাপার? এগুলোর জন্য কেউ এতটা দূরে সরে যায়?

ওর নিজের দিকের আর কোনও খামতি দেখতে পায় না তমাল। এভাবে কত দিন চলা সম্ভব? মা-ঠাকুমাদের আমলে এসব হত। অর্থহীনভাবে বছরের পর বছর একসঙ্গে থেকে যাওয়া, শুধু সন্তানের মুখ চেয়েসন্তান বড় হয়ে গেলে তখন যে শূন্যতা গিলতে আসবে? কোনওরকম ভালোবাসা নৈকট্য উষ্ণতা ছাড়া সম্পর্ক থাকে?

তমাল ওভাবেই বসে। কখন সুদেষ্ণা আবার ঘরে ফিরে এসেছে বুঝতে পারেনি। কেন জানি না সুদেষ্ণার মনে হচ্ছে জামাটায় তাপ্পি লাগানো যায়। সে বলে ওঠে তমাল, আমরা কি একটু ভাবতে পারি নিজেদের নিয়ে?’ 

তমাল ওকে খুব অবাক করে দিয়ে বলে, ‘শুধু বাবিনের জন্য আর এক ছাতের তলায় থাকা যাচ্ছে না তাই তো? টানা এতটা সময় কাটাতে না হলে কে-ই বা বুঝতাম বল? লকডাউন আমাদের জন্য আশীর্বাদ। একটু সবুর কর। দেখছি…

তমাল আরও কীসব বলে যাচ্ছিল। কিছু ঢুকছে না সুদেষ্ণার কানে। দুএকটা শব্দ ছিটকে আসছিল শুধু। উকিল, পেপার্স…। চোখ দুটো শুকনো রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে ও মনে মনে বলে ওঠে, ‘দরজি না রাজি দিদান…হঠাৎ চটক ভাঙে তমালের ধাক্কায়। কী হল, এটাই চাও তো?’ ওর হাত ঝাঁকিয়ে বলে উঠল তমাল। 

অথচ বছর দুয়েক আগে পর্যন্তও সব দিব্য ছিল। বাবিনের বড় হয়ে ওঠা দেখতে দেখতে পেরিয়ে যাচ্ছিল সময়। একসঙ্গে বেড়ানো, খেতে যাওয়া, সিনেমা দেখা। হ্যাঁ, ধীরে ধীরে তমালের কাজের চাপ বেড়েছে। পরপর বেশ কয়েকবার বেড়ানোর প্ল্যান হয়ে ক্যানসেল হয়ে গেছে। 

অনেকদিন পরে এতটা কাছে তমাল। কীরকম একটা অচেনা অনুভূতি হচ্ছিল সুদেষ্ণার। কোনওমতে সেটা কাটিয়ে কী করে যেন বলে ফেলে সুদেষ্ণা, ‘মানেটা কী? আমি কবে এসব বললাম। তুমি এতদূর ভেবে ফেলেছ! বাবিনের জন্যই শুধু পড়ে আছি এক ছাতের তলায়?’ অনেকদিন পর সুদেষ্ণার মুখে একসঙ্গে এতগুলো কথা শুনে খানিক ভেবলে যায় তমাল। আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ‘নয়তো কী? হঠাৎ নিজেদের নিয়ে আলাদা করে ভাবার কী আছে তাহলে?’ 
না ভাবার তেমন কিছুই নেই। তবে দুটো অচেনা লোকের মতো পাশাপাশি বেঁচে থাকাটা খুব স্বাস্থ্যকর কি

ওরা বুঝতে পারেনি কোন ফাঁকে মাঝখানে ঢুকে পড়েছে বাবিন। ওর প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফেরে ওদের।
কারা অচেনা লোক মা? স্ট্রেঞ্জার্স? তারা কি আমাদের বাড়িতে অ্যাটাক করবে? তমাল বিড়বিড় করে বলে যায়,
না বাবা অ্যাটাক করার লোক এবাড়িতেই বসে রয়েছে।
কথাগুলো অবশ্য সুদেষ্ণার কানে ঢোকেনি।

***

বেশ কয়েকটা দিন পেরিয়ে যায় আবার। নিত্যনৈমিত্তিক। এর মধ্যে একদিন ঘুম ভেঙে সুদেষ্ণা সকালে দেখে তমাল ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে থম মেরে বসে। তবে কি আশঙ্কা সত্যি হল? সুদেষ্ণা কাছে গিয়ে তমালের কাঁধে হাত রাখে। তমাল খুব একটা চমকায় না। শুধু বলে, ‘ছেড়েই দিলাম গো। কাল রাতে আরও পাঁচজনের চাকরি খাওয়ার জন্য মেল করেছিল কোম্পানি। তারপর থেকে আর ঘুম আসেনি। ওদের মধ্যে একটা ছেলে… কত টাকাই বা মাইনে পায়… আমি জানি ওর বৌ প্রেগন্যান্ট। এই সিচুয়েশনে জাস্ট জলে পড়ে যাবে। গোটা বাড়ির দায়িত্ব ওর ঘাড়ে। কী করে পারব? আপত্তি করতেই ওপরওয়ালা বলল, এত ইমোশনাল হলে কাজ করা যায় না, আপনি নিজের দিকটা দেখুন ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর কথা বাড়াইনি। চুপচাপ মেল করে দিয়েছি। সকাল হতেই ভয় করছে এবার। তুমি কি ক্ষমা করবে আমায়?’ 

ওরা বুঝতে পারেনি কোন ফাঁকে মাঝখানে ঢুকে পড়েছে বাবিন। ওর প্রশ্ন শুনে সম্বিত ফেরে ওদের। কারা অচেনা লোক মা? স্ট্রেঞ্জার্স? তারা কি আমাদের বাড়িতে অ্যাটাক করবে? তমাল বিড়বিড় করে বলে যায়, না বাবা অ্যাটাক করার লোক এবাড়িতেই বসে রয়েছে।

সুদেষ্ণা উজ্জ্বল চোখে তখন তমালের দিকে তাকিয়ে। অনেকদিন ধরে তোলা দেওয়ালটা মনে হচ্ছে যেন নিমেষে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
কী গো কিছু তো বল? তমাল অধৈর্য।
তোমায় ভীষণ ভালবাসতে চাই। লকডাউন আর করোনা চলে গেলে আমার সঙ্গে নীল জল দিগন্ত ছুঁতে যাবে?
চোখ ভিজে আসে সুদেষ্ণার। চেয়ার থেকে উঠে স্ত্রীকে আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে তমাল।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com