(Kanan Devi) তাঁর অসাধারণ রূপমাধুর্য এবং অভিনয়ের গুনমুগ্ধ ছিলেন সেকালের আট থেকে আশি। তাঁর সঙ্গে অভিনয় করাকে সৌভাগ্য মনে করেছিলেন স্বয়ং উত্তমকুমারও! অভিনয়ের পাশাপাশি গানেও ছিলেন সমান পারদর্শী! পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মতে তিনিই ‘ফার্স্ট সিঙ্গিং স্টার অফ নিউ থিয়েটার্স’, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁর গান শুনবেন বলে, আবার তাঁর গানের অনুরাগী ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল থেকে কে এল সাইগলের মতো দিকপালেরা!
তিনি কিংবদন্তি অভিনেত্রী ও গায়িকা, বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রথম ‘সুপারস্টার’ কানন দেবী! পরিচারিকার কাজ করা থেকে শুরু করে যাবতীয় বঞ্চনা, উপেক্ষা আর অভিমানকে কাটিয়ে কানন থেকে কানন বালা, ও কালক্রমে কানন দেবী হয়ে ওঠা বাংলা সিনেমার সবচেয়ে আশ্চর্য সাফল্যগাথা!
কাগজে-কলমে তাঁর জন্ম ১৯১৬ সালের ২২ এপ্রিল। মতভেদে কানন দেবীর জন্মদিন ৮ই জ্যেষ্ঠ। তাঁর সঠিক পরিচয় নিয়েও রয়েছে নানা কথা। এভাবেই জন্মস্থানও স্থির হয়েছে কলকাতার কাছেই, হাওড়ায়। জানা যায়, হাওড়ার এক গরিব পাড়ায় ছোট্ট কাননের দেখা মেলে প্রথমবার। স্কুলে ভর্তিও হয়েছিল মেয়েটি। বেতন দিতে না পেরে স্কুল ছাড়তে হয়। তবে কানন দেবীর জীবনীতে যে কথা স্পষ্ট, তা হল কাননকে প্রতিপালন করেছেন রাজবালা দেবী ও রতনচন্দ্র দাস।
অবশ্য তিনি এমনও বলেছেন, ‘কে বাবা, কে মা, এই ভেবে বুকের ব্যথা বাড়িয়ে লাভ কী! আমি কানন, এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।’ জীবনে কখনও অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেননি। কিন্তু বাঁচার অবলম্বন হিসেবে যখন অভিনয়কেই বেছে নিতে হল, তখন এটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন, জীবিকা, ধ্যান-জ্ঞান।
‘কাকাবাবু’ তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সূত্রে মাত্র ১০ বছর বয়সে, ম্যাডান থিয়েটারে অভিনয়ের সুযোগ এসে গেল তাঁর। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায় পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘জয়দেব’-এ রাধার ভূমিকায় অভিনয় করলেন কানন দেবী। পারিশ্রমিক মিলল পাঁচ টাকা। অথচ পাওয়ার কথা ছিল ২৫ টাকা! শুনলেন বাকি টাকাটা ‘মিডলম্যান’রা নিয়ে নিয়েছে। ১৯২৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত নির্বাক ছবি ‘শঙ্করাচার্য’-তে বালিকা কানন অভিনয় করেন। এরপর ‘ম্যাডান থিয়েটার’-এর দ্বিতীয় সবাক ছবি ‘জোর বরাত’-এ নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করলেন মিস কাননবালা নামে। (Kanan Devi)
ভিডিও: ‘সাম্যের এক নাম’ – জন্মদিনে রুমা গুহঠাকুরতা
একে একে ‘ঋষির প্রেম’, ‘প্রহ্লাদ’, ‘বিষ্ণুমায়া’ ছবিতে অভিনয় ও গান করা শুরু। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫-এর মধ্যে একের পর এক দ্বিভাষিক ছবি করলেন কানন দেবী। ‘শ্রী গৌরাঙ্গ’, ‘চার দরবেশ’, ‘কণ্ঠহার’, ‘বাসবদত্তা’, প্রভৃতি। ‘চার দরবেশ’ সে-বছর (১৯৩৩) ভারতজোড়া হিট টকি ছিল। আর এরপরেই ১৯৩৫ সালে এল কাননবালার জীবনের সেরা ছবি ‘মানময়ী গার্লস হাই স্কুল’। পরের বছর ‘কৃষ্ণ সুদামা’, ‘কণ্ঠহার’-এর হিন্দি এবং ‘বিষবৃক্ষ’ করে ওঁর বাংলা ছবির প্রথম তারকা নায়িকা হয়ে ওঠা। (Kanan Devi)
ম্যাডান থিয়েটার, রাধা ফিল্মস পেরিয়ে কাননদেবী যোগ দেন বিখ্যাত নিউ থিয়েটার্সে। ‘মা’, ‘খুনি কৌন’, ‘মুক্তি’, ‘বিদ্যাপতি’ প্রভৃতি সিনেমায় কাননদেবীর অভিনয় জয় করল ভারতচিত্ত। অভিনয়ের পাশাপাশি আধুনিক গান ও রবীন্দ্রসংগীতেও তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। ১৯৩৭ সালে মুক্তি ছবিতে প্রথমবার রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যাবহার করা হয়। সেই ছবিতে কানন দেবীর কণ্ঠে দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত আপামর দর্শক শ্রোতাদের মন কেড়ে নেয়। (Kanan Devi)
কানন দেবীর গাওয়া ‘আমি বনফুল গো’, ‘তুফান মেইল যায়’, ‘যদি ভালো না লাগে তো দিও না মন’, ‘ঘর যে আমাকে ডাক দিয়েছে’, ‘প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম’ ‘তোমারে ভুলতে পারি না’-র মতো একাধিক গান শুনলে বোঝা যায় কণ্ঠশিল্পী হিসাবেও তিনি কত উঁচু দরের ছিলেন। সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আল্লারাখার কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে হাতেখড়ি। গান শিখেছেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়াল, কাজী নজরুল ইসলাম, পঙ্কজ কুমার মল্লিকের মতো দিকপালদের কাছে। এভাবেই, রেকর্ডের লেবেলে এক সময় কাননবালা থেকে তিনি হয়ে উঠলেন কানন দেবী! (Kanan Devi)
১৯৪৮ সালে শিল্পীদের স্বাধীনতার কথা মাথায় রেখে এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন! শুরু করেন নিজের প্রযোজনা সংস্থা ‘শ্রীমতী পিকচার্স’। আবার পরে বিগত দিনের মহিলা শিল্পীদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘মহিলা শিল্পীমহল’-এর মতো সংস্থাও। বর্ণাঢ্য কেরিয়ারে প্রায় ৭০-টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। ১৯৪১ সালে নীতিন বসু পরিচালিত ‘পরিচয়’ ও এই ছবির হিন্দি সংস্করণ ‘লগন’-এ অসাধারণ অভিনয়ের জন্য বিএফজেএ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মানে ভূষিত হন কানন দেবী। (Kanan Devi)
চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ১৯৬৮ সালে ভারত সরকার তাঁকে ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত করে। সারা জীবনব্যাপী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৬ সালে লাভ করেন ‘দাদাসাহেব ফালকে’ পুরস্কার। ১৯৯০ সালে সিনে সেন্ট্রাল কর্তৃক হীরালাল সেন পুরস্কার এবং ১৯৯১ সালে ‘ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ভারতের ডাক বিভাগ কানন দেবীর স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করে। আজ কিংবদন্তি এই শিল্পী, অভিনেত্রী ও গায়িকার জন্মদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য। (Kanan Devi)
বাংলালাইভ একটি সুপরিচিত ও জনপ্রিয় ওয়েবপত্রিকা। তবে পত্রিকা প্রকাশনা ছাড়াও আরও নানাবিধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে থাকে বাংলালাইভ। বহু অনুষ্ঠানে ওয়েব পার্টনার হিসেবে কাজ করে। সেই ভিডিও পাঠক-দর্শকরা দেখতে পান বাংলালাইভের পোর্টালে,ফেসবুক পাতায় বা বাংলালাইভ ইউটিউব চ্যানেলে।