‘নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা’?সবলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি সেই সময়ের ব্যক্তি ও সমাজের প্রতিফলন। রবীন্দ্রযুগে নারী আহত হয়েছে বারে বারে।তাই এই মরমী লেখনী। পুরুষ সমাজে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে নারী। প্রতি পলে। প্রতি পদক্ষেপে। অন্ধকার ছিল প্রবল বেগে সেই সময়েও। আবার ছিল অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো। প্রথম মহিলা কবি কে?এই প্রশ্ন শুনে অনেকেই মাথায় হাত দেবেন। রবীন্দ্রযুগের বহু আগেই ষোড়শ শতাব্দীতে চন্দ্রাবতী ছিলেন প্রথম বাঙালি মহিলা কবি। তাঁর জন্মকাল ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে। বাবার আদেশে তিনি রামায়ণ রচনা করেছিলেন। এভাবেই যুগে যুগে শত অন্ধকারের মাঝেই নারী বিকশিত হয়েছেন আপন মহিমায়। সাহিত্যের মতো সিনেমা, সঙ্গীত, ক্রীড়ায় মহিলাদের ভূমিকা আজ আলোকিত এবং আলোচিত। তবুও কোথাও একটা ক্ষোভ থেকে যায়। লাইমলাইটের কৃপাধন্য মহিলারাই আমাদের নয়নমণি হন। বাকিরা তলিয়ে যান সময়ের সুরঙ্গে।
ক্রীড়া বা খেলা আনন্দ দেয় বিশ্বের তামাম দর্শককে। আবার কখনও কখনও তা হয়ে ওঠে আত্মরক্ষার হাতিয়ার। ক্যারাটে এমনই খেলা যারমধ্যে মিশ্রিত আনন্দ এবং আত্মরক্ষা। ক্যারাটে নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কারও কারও মতে ক্যারাটে বা কারাতে জাপানের রিউকু দ্বীপে প্রকাশিত একটি মার্শাল আর্ট। আবার বুদ্ধিস্ট কালচারে ক্যারাটের কথা জানা যায়।আবার কোনও কোনও ক্যারাটেবিদ মনে করেন ক্যারাটের বীজ ছিল এই ভারতবর্ষেই। শুনলেই কেমন অবাক লাগে,তাই না? এই ক্যারাটেই যখন হয় নারীর সুরক্ষার একমাত্র মাধ্যম,তখন সেই সমস্ত নারীরা হয়ে ওঠেন আমার বা আপনার জীবনের সিলেবাস।
বাঁকুড়া জেলার বাসিন্দা অভয়া চঁন্দ। না, কোনও গ্রামে নয়। বাঁকুড়া জেলার শহরাঞ্চলে থাকেন অভয়া। অভয়া অর্থাৎ ভয় নেই যাঁর। শেক্সপীয়র বলেছিলেন-ওয়াটস ইন আ নেইম? কিন্তু নামের মর্মার্থ যে অভয়ার দৈনন্দিন জীবনের দিনলিপি হবে, তা আগে কে জানত? হয়ত জানত না
স্বয়ং অভয়াও। ২০১৪ সাল। বিনা নোটিসে বাবার মৃত্যুর পরে মুহূর্তেই পালটে যাচ্ছিল অভয়ার পারিবারিক ভিত। হঠাৎ সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মতোই জেগে উঠল অতীত। অভয়ার মনে পড়ল ছোটবেলার কথা। মেয়েবেলায় ক্যারাটে দেখেছিল সে। বড় হওয়ার পরে পরিবেশ ও পরিস্থিতির
কারণে ক্যারাটেই হোল তার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড। অভয়ার কথায়, ‘আমার দিদিরা আমাকে সাপোর্ট করেছেন খুব। আমি শিখতে চাইলাম। আর ওঁরাও মত দিল সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের বয়সে নরম্যালি মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। কুড়ি বছর বয়সে আমি ক্যারাটে শিখতে শুরু করি ।আমার
বেশিরভাগ বন্ধুদের তখন সম্বন্ধ দেখা শুরু হয়েছে। প্রথমে আমার ক্যারাটে শেখাটাকে অনেকেই ভাল চোখে দেখেননি। বাইরের লোকে তো বলবেই। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আমার নিজের জন্য কিছু করা দরকার। ক্যরাটে শিখলে সেলফ কনফিডেন্স বাড়ে। আমার বাড়িতে ভাই বা দাদা কেউ নেই। আমাকেই সব কিছু দেখতে হয়। এখন দিদিরা বাইরে থাকে। আমি প্রথমে বাঁকুড়া মার্শাল আর্ট ক্লাবে ক্যারাটে শিখতে শুরু করি। আমার টিচার ছিলেন সেনসেই সুদীপ্ত কর্মকার। জীবনে অনেক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে গেছি। সেই সময়ে বড় ক্যারাটেশিয়ান হওয়ার স্বপ্ন ছিল না। সেফটিটাই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রায় পাঁচ বছর হোল। এখনও আমি ক্যারাটে শিখছি। ভবিষ্যতেও শিখব’।
বাঁকুড়া থেকে পুরুলিয়ার দূরত্ব কতটা? দূরত্ব যাই হোক, একই শিক্ষার সাধনাসঙ্গী আরেকজন। ঝুমা। ঝুমা সহিস। ঝুমা পুরুলিয়ার মেয়ে। ছোটবেলায় টিভিতে হিন্দী ছবি দেখেছিল সে। সে কী ক্যারাটে ফাইট!তখনই মনে হয়েছিল, মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ হতে পারে। শৈশবের সেই ইচ্ছেই আজ যৌবনের স্থির লক্ষ্য। তাই লক্ষ্যভেদ হয়েছে অনায়াসে। শুধু হিন্দী ছবির সস্তা আবেগ নয়, অবচেতনে ছিল আত্মরক্ষার প্রসঙ্গ। ছোট থেকেই মেয়েরা নানা ভাবে বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত। স্পষ্ট কণ্ঠস্বরেবললেন ঝুমা —‘ ২০১৫-র থেকে আমি ক্যারাটের সাথে যুক্ত। রাস্তায় আসা যাওয়ার মাঝে কিছু ছেলে মেয়েদের বিরক্ত করে। রাতে চলাফেরা করা মেয়েদের পক্ষে নিরাপদ নয়। এরকম ঘটনা আমি টিভিতে দেখেছি। শুনেওছি অনেকের মুখে। আমি চাইল্ড লাইন নামে একটা এন জি ও-তে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করি। কিছুদিন আগেই একটা কেস এসেছিল। তিনজন ছেলে একজন মেয়েকে রেপ করেছে। আমি চাই না এই ঘটনা আর ঘটুক। মেয়েরা আত্মরক্ষার স্বার্থে ক্যারাটে শিখুক। আমি পুরুলিয়ার মেয়ে। আমার পরিবার আমার কাজকে সমর্থন করে। কিন্তু পাড়ার কিছু মানুষ একটু বাঁকা নজরে দেখে’। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে ঝুমা নিজেকে তিলে তিলে তৈরি করেছেন। এ লড়াই শুধু বাইরের নয়। ভেতরেরও। কলেজের এক বন্ধু ঝুমাকে নিয়ে যায় ক্যারাটে টিচারের কাছে। শুরু হয় সেনসেই দিপায়ন সিং-এর কাছে প্রশিক্ষণ। শিয়ান শিবাজী গাঙ্গুলী ক্যারাটে একাডেমির শাখা আছে পুরুলিয়ায়। গুরু শিবাজী ও শিবায়ণ গাঙ্গুলীর নেতৃত্বে এভাবেই সাবলম্বী হয়ে উঠছে জেলায় জেলায় মেয়েরা। ঝুমারও ভবিষ্যত স্বপ্ন পুরুলিয়ায় বিভিন্ন মানুষ ও শিশুদের ক্যারাটে শিক্ষায় শিক্ষিত করেবেন। নারীবাদী সমাজের কট্টর ধারণা খানিকটা এরকম — পুরুষ মানেই শোষক বা ধর্ষক। কিন্তু ঝুমা কোনওভাবেই এ তকমায় বিশ্বাসী নয়। ঝুমার ভাষায়, ‘সব পুরুষ খারাপ নয়। আমাদের সেন্সি(টিচার) মেয়েদের-কে সম্মানের চোখে দেখেন। আমাদের সেন্সি ভাল বলেই আমি এত দূরে এগিয়েছি’।
তৃতীয়জন স্নেহা পানিগ্রাহী। স্নেহা কলকাতার বাসিন্দা। কোনও আত্মরক্ষা বা নারীবাদী চেতনা আপাতত স্নেহার মস্তিষ্কে বাসা বাঁধেনি। নিছক আনন্দ এবং আবেগেই স্নেহা শিখছেন ক্যারাটে।
বয়স মাত্র আঠারো। স্নেহা শিহান শিবাজী অ্যাকাডেমিতে স্বয়ং শিহান শিবাজী ও তাঁর ছেলে শিবায়নের কাছে ক্যারাটের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন| উনি বেশ সপ্রতিভ ভাবেই বলল তার ইচ্ছের কথা —‘শুরুর দিকে ক্যারাটেতে আমার ইন্টারেস্ট ছিল না। আমার মা-ই আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। এখন ক্যারাটে আমার প্যাশন। এছাড়া আমাদের শিহান শিবাজী গাঙ্গুলীর কথা বলব। আমি এখন অনেক টুর্নামেন্টে লড়ার সুযোগ পাচ্ছি। এগুলোর ফিলিংসই আলাদা। আমি মনে করি,সেলফ ডিফেন্সের ব্যাপারে ক্যারাটে নানা ভাবে সাহায্য করে। আমরা জাপানিজ স্টাইলেই ক্যারাটে করি । আমার স্বপ্ন; সেন্সি(টিচার)-দের মতো দেশে বিদেশে গিয়ে ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করা। ২০১৫ সালে আমি প্রথম ন্যাশনাল টুর্নামেন্টে থার্ড হই। তারপর রাজ্য স্তরে প্রতিযোগিতায় হয়েছি প্রথম।সামনের ২৪ সেপটেম্বর আবার আসছে শিবাজী গোল্ড কাপে টুর্নামান্ট। দেখা যাক কি হয়’।
শেষ হোল তিন কন্যার জীবনের কিছু টুকরো মুহূর্ত।এই কাহিনি পড়তে পড়তে কি মনে হচ্ছে ওঁদের মতো আপনাদেরও চোখে অসংখ্য স্বপ্ন?যে স্বপ্ন এখনও ডানা মেলেনি। এতক্ষণ যা লিখলাম তা শুধুমাত্র লড়াইয়ের টুকরো ঝলক। সামনেই শিবাজী গোল্ড কাপ টুর্নামেন্ট। বাদ বাকি জানতে আপনাদের সেখানেই যেতে হবে। সেখানে শুধুই লড়াই। লড়াই এখনও বাকি…।
One Response
Excellent Article