ভিড়ে ঠাসা কলেজ স্ট্রিট। এক দিকে পুরনো বইয়ের দোকানে ব্যস্ত দোকানীর হাঁকডাক, অন্য দিকে আবার কলেজ পড়ুয়াদের হই হট্টগোল। শাড়ির দোকান থেকে শুরু করে ব্যান্ড পার্টি, সব আছে উত্তর কলকাতার এই পুরনো পাড়ায়। ওই কথায় আছে না আলপিন টু এলিফ্যান্ট সবই পাওয়া যায় এখানে। আর এই ভিড়ভাট্টা থেকে একটু আড়ালে গলির ভিতর আছে ছোট্ট একটা চা-এর দোকান। আশপাশ দিয়ে গেলেই শুনতে পাবেন পুরনো গান, সবই কিশোর কুমারের গাওয়া। এই চা দোকানের এটাই কিন্তু বিশেষত্ব।
কলকাতা আর চা-এর সম্পর্ক তো আজকের নয়। তর্ক-বিতর্ক-আড্ডা সবের মাঝে এর জোরালো উপস্থিতি অস্বীকার করা যায় না। যতই শহরে ঝাঁ চকচকে কফির দোকান তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার করুক না কেন, ভাঁড়ের চা-এর নেশা আজও অমলিন। প্রেমালাপ থেকে আলোচনা, সব কিছুর ঠেকই কিন্তু চায়ের দোকান। অনুষঙ্গ এক কাপ থুড়ি এক ভাড় গরম ধোঁয়া ওঠা চা। তা সেই চা-এর খোঁজেই গেছিলাম কলেজ স্ট্রিট। তালতলার দোকানে সব সময়ই মানুষদের সমাগম। ভোর সাতটা থেকেই পল্টন দা হাজির হয়ে যান কাজে। কাজের বদলে অবশ্য রিলে রেস বলা ভাল। এক দিকে পেল্লায় ডেকচিতে চায়ের জল ফুটছে। অন্য দিকে ফুটছে দুধ। তড়িৎ গতিতে চায়ের পাতা দিচ্ছেন জলে। আবার ভাড় মুছে চিনি মেশাচ্ছেন। তার পর ঠিক সময়ে চা-দুধ মিলে মিশে তৈরি করছেন সাক্ষাৎ অমৃত। সকালটা এইভাবে শুরু হলে আর কী চাই!

না, সেভাবে দেখতে গেলে সকাল সকাল গরমাগরম চা-এ গলা ভেজাতে পারলেই সিংহভাগ বাঙালি খুশি। কিন্তু পল্টন দা আবার তড়িবতে বিশ্বাস করেন। তাই তো চায়ের সঙ্গে টা-এর আয়োজনও করেন। বিস্কুট, কুকিজ, ফ্রেঞ্চ টোস্ট, ম্যাগি তো আছেই, বিশেষ সংযোজন, কিশোর কুমারের গান। হ্যাঁ, ঠিক পড়েছেন। পল্টনদার দোকানে সারা দিন কিশোর কুমারের গান বাজে। হিন্দি, বাংলা সব ভাষার গানই শুনতে পাবেন এখানে। দারুণ মনোরম পরিবেশ। চাইলে আপনিও গলা মেলাতে পারেন। দোকানে কুমার শানু, সৌরভ গঙ্গোপাধ্য়ায়ের মতো তারকাদের ছবি সুসজ্জিত। জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারলাম, এঁরা সকলেই পল্টনদা-র চা এবং গানের গুনমুগ্ধ ভক্ত। বহু বার এসেছেন এবং রীতিমতো আড্ডা মেরেছেন এখানে বসে।

পল্টনদা নিজে কিশোর কুমারের বিশাল ফ্যান। ছোট থেকেই একনিষ্ঠ ভক্ত। বাড়িতে সারা দিন গান গাইতেন। এখনও সেই রীতি চালু রেখেছেন। কিশোর কুমারের জন্মদিনে রীতিমতো সেজে ওঠে এই চায়ের দোকান। দু’খানা বেঞ্চি মাত্র, তাতেই লোকজন ভিড় করে এসে বসে। অনেকে আবার দাঁড়িয়ে থাকেন ঠায়। কারণ দু’টো। একটা পল্টনদা-র আদা-এলাচ দেওয়া পরম উপাদেয় মশলা চা আর দ্বিতীয় পল্টন দা-র গান। মাইক নিয়ে পল্টনদা ময়দানে নামেন। আর শ্রোতাদের গান শোনাতে থাকেন। অনুরোধের আসরও বলা যেতে পারে। পল্টনদার গায়কীর ভক্ত অনেকেই। অথচ কোনও প্রথাগত প্রশিক্ষণ নেই ওঁর। শুধু নিখাদ ভালবাসা বলেই হয়তো গলা দিয়ে এমন সুর বেরোয়। আর এখন তো পল্টনদা-র নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলও আছে। বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই ও ইদিন হাজির হয়ে যান পল্টন বাপি টি স্টলে। আর এখন তো এটা পুরো রেওয়াজ হয়ে গেছে। সকলেই জানেন কিশোর কুমারের জন্মদিনে পল্টনদা তাঁর গানের খাতা খুলে বসবেন। ফলে তাঁর রোজকার খদ্দেরা তো বটেই, আরও অনেকে ছুটে আসেন এই চায়ের দোকানে। সত্যিই তো এ রকম নির্ভেজাল আনন্দ আর কোথায় বা পাবেন তাঁরা। আজকের দুরন্ত, স্ট্রেসফুল জীবনে পল্টনদার দোকান যেন উন্মুক্ত বারান্দার মতো। এখানে সব রকম টেনশন ভুলে, শুধু মনের আনন্দে কিছুক্ষণ নিজের সঙ্গে সময় কাটানো যায়। সকালটা এরকম শুরু হলে ক্ষতি কী!
