(Lake Louise) অনেক বছর ধরে ক্যালগেরিতে (কানাডায়) আছি। বাড়ির জানালা দিয়ে দূরে তাকালেই উন্মুক্ত দিগন্ত আর নীল পাহাড়ের হাতছানি। প্রথম প্রথম ক্যালগেরির আশেপাশে পাহাড়ে খুব ঘুরতাম। গ্রীষ্মে বসন্তে, সারা সপ্তাহে অফিসের কাজ সেরে শনি-রবি হলেই টোটো কোম্পানি। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে! এখন নানান কারণে প্রত্যেক সপ্তাহে আর ঘুরতে যাওয়া হয় না। কিন্তু পাহাড়ের নেশাটা আছে, সুযোগ পেলেই ছুট।

ব্যানফ ন্যাশনাল পার্কের লেক লুইস (Lake Louise) এলাকা গত পাঁচ বছরে খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। এদেশের জনসংখ্যা বেড়েছে। বিভিন্ন দেশ থেকেও প্রচুর টুরিস্ট আসছেন (বছরে চল্লিশ লক্ষ!)। আমাদের বাড়ি থেকে দূরত্ব ২০০ কিলোমিটার।মাত্র দু-ঘন্টার ড্রাইভ। আমরা প্রায় প্রত্যেক গ্রীষ্মে একবার লেক লুইসে যাই, কখনও শীতকালেও।

একবার জ্যেঠুমণিকে লেক লুইসে (Lake Louise) নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশি, বলেছিলেন “রকিস (Rocky Mountain) খুব সুন্দর, শুধু হিমালয়ের আধ্যাত্মিকতা নেই”। কথাটা কিছুটা সত্যি, এখানে পাহাড়ের বাঁকে মন্দির অথবা গুহায় ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর দেখা মিলবে না। যাঁরা প্রকৃতির সৌন্দর্য, বিশলতা, শান্ত-মগ্নতা ভালোবাসেন, তাঁদের কাছে এটাই তীর্থস্থান। এখানেই তাঁদের ঈশ্বর।

লেক লুইস (Lake Louise) আমার দেখা প্রথম হিমবাহ পুষ্ট তুঁতে-নীল লেক। বাকরূদ্ধ করা সৌন্দর্য। পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা লেক লুইসে সারা বছর টুরিস্টদের ভিড়। গ্রীষ্মে হাইকিং-ফোটগ্রাফি, আর শীতে স্কিং। প্রত্যেক ঋতুতে লেকের ভিন্ন ভিন্ন রূপ। মান্না দে’র জনপ্রিয় সেই গান – “একই অঙ্গে এত রূপ দেখিনি তো আগে”।

গ্রীষ্মের দিনে পাহাড় আর ঘন পাইন বনের মধ্যে লেক লুইস (Lake Louise) ফিরোজা-নীল রঙে মোহময়ী। লেকের মুখে দাঁড়ালে উল্টোদিকে পাহাড়ের কোলে ভিক্টোরিয়া হিমবাহ। এখান থেকে লেকের উৎসমুখে, হিমবাহতে হাইকিং করা যায়। আগে কখনও এতো কাছ থেকে হিমবাহ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। পশ্চিম কানাডায় রকিসের উচ্চতা হিমালয়ের থেকে অনেক কম। উত্তর মেরুর কাছে বলে এখানে খুব ঠান্ডা।
গ্রীষ্মের লেক যেন তারুণ্যের প্রতীক। আকাশ ঝকঝকে স্বচ্ছ নীল, পাহাড়ে গাছেরা জেগেছে, লেকের ধারে বুনো ফুল ফুটেছে। পাইনের ডালে চনমনে বাতাস ডাকে “এগিয়ে চলো, থেমো না”। লেকের পাশ দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার সমতল কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভিক্টোরিয়া হিমবাহের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জলস্রোতের শব্দ শুনতে পাই। একেবারে শেষে পাহাড়ি ঝরনা ছোট্ট ছেলের মতন লাফিয়ে নেমেছে।
রকিসে (Rocky Mountain) খুব সামনে থেকে হিমবাহ দেখা যায়। আসলে ততোটাও কাছে নয় যতটা মনে হয়। এদেশের বেশিরভাগ প্রাকৃতিক লেক হিমবাহ গলা জলে পুষ্ট। পাহাড়ের গা বেয়ে হিমশীতল জল নেমে আসার সময়, পাহাড়ের সাথে হিমবাহের ঘর্ষণে খুব সূক্ষ্ম পলিমাটিও নেমে আসে। সূর্যের আলো সেই পলিকণার উপর পড়লে জলের রং তুঁতে-নীল দেখায়। মধ্য দুপুরের উজ্জ্বল আলোতে এই অলৌকিক রং তীব্রতর হয়ে ওঠে। (Lake Louise)

গ্রীষ্মের লেক যেন তারুণ্যের প্রতীক। আকাশ ঝকঝকে স্বচ্ছ নীল, পাহাড়ে গাছেরা জেগেছে, লেকের (Lake Louise) ধারে বুনো ফুল ফুটেছে। পাইনের ডালে চনমনে বাতাস ডাকে “এগিয়ে চলো, থেমো না”। লেকের পাশ দিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার সমতল কাঁচা রাস্তা দিয়ে ভিক্টোরিয়া হিমবাহের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জলস্রোতের শব্দ শুনতে পাই। একেবারে শেষে পাহাড়ি ঝরনা ছোট্ট ছেলের মতন লাফিয়ে নেমেছে। অনেক উপরে, আমাদের দৃষ্টিপথের বাইরে কোনও এক হিমবাহ গলে এই ঝরনা তৈরি হয়েছে। এখান থেকে পাহাড়ের মধ্য দিয়ে নানান দিকে হাইকিং ট্রেইল চলে গেছে।

আসা-যাওয়ার পথে মানুষের সাথে “হ্যালো” বলা চলতেই থাকে। পিঠে স্ট্রোলারে (Stroller) ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে বাবা মায়েরা, লাঠি হাতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা, পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে চনমনে তরুণ-তরুণী চলেছেন। লেকের জলে অনেক মানুষকে লাইফ জ্যাকেট পরে ক্যানোইং (canoeing) করতে দেখা যায়। দূর থেকে তাদের লাল-হলুদ-সবুজ বিন্দুর মতন দেখতে লাগে। একটা আলোকিত-উজ্জ্বল দিনে, নীল-তুঁতে জলের পটভূমিকায়, পাহাড়-জঙ্গলের মাঝে শুধু চুপচাপ বসে থাকতেও খুব ভালো লাগে। বেলা বাড়ছে , মেঘ নামছে, জলের রূপ বদলাছে, পাহাড়ে বুকে আলো-বাতাসের খেলা।
আরও পড়ুন: আলোকিত টিউলিপ বাগানে
এবার শীতে ফিরি। কানাডার সব চেয়ে লম্বা ঋতু। বেশ কিছু বছর আগে কাজের জন্য শীতকালে লেক লুইস যেতাম। ওখানে আমদের কোম্পানির Ski for Heart – Fund raising event হতো। শীতের লেক পবিত্র ধ্যানমগ্ন ঋষির মতন। এই সময়ে হিমায়িত লেকের এক অন্য সৌন্দর্য, চারিদিকে নিরবিচ্ছিন্ন সাদা চাদর পাতা।
খুব সকালে উঠে কাজ শুরু হওয়ার আগে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটতাম। এই সময় পাইন বনে এক স্বর্গীয় সুগন্ধ। শুধুমাত্র শীতের পাহাড়েই এই সুবাস পাওয়া যায়। অনেক দিন পরে ২০২৪-এর ফেব্রুয়ারিতে আবার লেক লুইস গিয়েছিলাম। সেই শনিবারে এতো সুন্দর ঝকঝকে আকাশ আর জোড়ালো রোদ্দুর ছিল যে, আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম। গ্রীষ্মে রকিস ভারি সুন্দর। শীতে সাদা বরফে-ঢাকা নীল পাহাড় আরও মায়াবী। এক একটা বয়সে মানুষের যেমন আলাদা লাবণ্য, এক এক ঋতুতে পাহাড়ের তেমন আলাদা আলাদা রূপ।

পুরো লেকটাই জমে গিয়ে বরফের উপত্যকা হয়ে গেছে। চারপাশের পাহাড়গুলোর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বরফে ঢাকা।যেন রূপকথার দেশ। পাহাড়ের ভিতর দিয়ে যে হাইকিং ট্রেইলগুলো চলে গেছে সেখানে এখন লোকেরা স্কি করছে। চারিদিকে শুধুই বরফ – কোথায় শুরু, কোথায় শেষ কে জানে?
পার্কস কানাডার কর্মীরা লেকের মাঝখানে বরফের উপর একটা অস্থায়ী পথ তৈরি করেছেন। সেই পথে পায়ে পায়ে মানুষ চলেছে। লেকের উপরদিকের জল জমে গিয়ে তাপমাত্রা নিরোধক (insulator) কম্বলের আবরণ তৈরি করেছে। নীচে লেকের জল কিন্তু জমে নি, সেখানে মাছেরা দিব্বি বেঁচে আছে।

সূর্যের আলো বরফের উপর পরে চোখে একেবারে “সর্ষে ফুল” দেখছিলাম। সানগ্লাস পরতেই দৃশ্যপট পরিষ্কার হয়েছিল। তাপমাত্রা মাইনাস ১১। এদেশের ফেব্রুয়ারির তুলনায় যথেষ্ট ভালো তাপমাত্রা হলেও মোটা জ্যাকেট, পশমের টুপি-গ্লাভস পরেও কনকনে ঠান্ডার কামড়। বিশেষ করে গ্লাভস খুলে ফটো তুলতে গিয়ে আঙুল জমে একশা।
আমরা বেশ সাবধানে হাঁটছিলাম। পাশ দিয়ে একদল তরুণ-তরুণী হুড়মুড়িয়ে স্কি করতে চলে গেলো। ওরা বোধহয় দূরে যাবে, তাড়া আছে। লেকের উপরে বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে পার্কস কানাডা স্কেটিং রিঙ্ক (Skating rink) বানিয়েছে। বাচ্চা-বুড়ো লেকের উপরে স্কেটিং করছে।

বেলা পড়তে সূর্যদেব মুখ ফিরিয়েছেন। পাহাড়গুলোর বিশাল ছায়া লেকের উপর এসে পড়তেই, ঠান্ডাটা ভালোভাবে মালুম হলো। সত্যি বলতে কি, এতো বড় লেকের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে চলছি, ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। এই অনুভূতিটা মনকে স্নিগ্ধ আনন্দে ভরিয়ে তুললো।
পিছন ফিরে দেখি অনেকটা চলে এসেছি, আবার এতোটা পথ ফিরতে হবে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মুখোমুখি হয়ে বার বার “আমার আমি ভেঙে, নতুন আমিতে” উত্তীর্ণ হয়েছে। মনে হচ্ছিল, আমাদের ছোটখাটো পাওয়া-না-পাওয়াগুলো এই বিপুল পৃথিবীর বুকে তুচ্ছ। তালু-বন্দি জলকণার মতো এক ফুঁ’তে কোথায় হারিয়ে যাবে।
ছবি: লেখক, Pexels
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।