রাঢ় বাংলার মাঠঘাট আর কাঁদড়ের আনাচে আনাচে জেগে উঠছে বসন্ত দিন। দু-চারটে গিরিপুষ্প গাছে সারাদিন ফুলের বৃষ্টি দেখে দেখে মন যেন আর ভরে না। ঝরে পড়া পাতার উপর দিয়ে কারা যেন চলেছে ওই। এই তো আর কদিনেই এই শাল মহুলের জঙ্গল কস্তূরী মৃগের মতো গন্ধের শরীর হয়ে উঠবে। নরম নরম সবুজ পাতায় আলোরা খেলে বেড়াবে অকারণ। এই আলোর মায়া দেখে দেখে সুরুলি সোরেনের কত চাঁদ যে পেরলো! এখন আর শরীরে দেয় না তেমন। কিন্তু উনো-কুঁজো হয়ে সুরুলি গোগো এখনও উনোনের পাশটিতে বসে বসে পাতার থালা বানান, বাটি বানান। ওঁর হাতে পায়ে বনজ গন্ধ। সে গন্ধেরা কবেকার কোন রান্নার গল্পের শরিক সব। নদীর পাড়ের কুমোরদের সঙ্গে সুরুলির খাতির ভালো। এক বস্তা মহুল দিয়ে একেকদিন ও মেটে হাড়ি কিনে নিয়ে আসে। সেই মেটে হাড়িতে মোল সেদ্ধ হয়, শুকনো শাকপাতা দিয়ে আতপের খুদ রান্না হয়। সেসব রান্নার গল্প নিয়ে সুরুলির আস্ত একখানা জীবন।
এই আলোর মায়া দেখে দেখে সুরুলি সোরেনের কত চাঁদ যে পেরলো! এখন আর শরীরে দেয় না তেমন। কিন্তু উনো-কুঁজো হয়ে সুরুলি গোগো এখনও উনোনের পাশটিতে বসে বসে পাতার থালা বানান, বাটি বানান। ওঁর হাতে পায়ে বনজ গন্ধ। সে গন্ধেরা কবেকার কোন রান্নার গল্পের শরিক সব।
কে বলেছে এই শাল মহুলের জঙ্গলে পৃথিবীর ডাক পৌঁছয়নি! সেই পৃথিবী বলছে সুরুলির রান্না ভারী সাধারণ, ভারী পুরনো। ওসব রান্নার এবার ফুরিয়ে আসার পালা। এসব জানে সুরুলি নিজেও। কিন্তু কী করবে সুরুলি? ওর রান্নায় জড়িয়ে আছে ওর শৈশব, ওর শালবন। পৃথিবীর ওপার থেকে কার সাড়া পাবে সুরুলি?

আমার একেকদিন ইচ্ছে করে ওর পাশটিতে বসে লতার (Lata K.) গল্প ভাগ করে নিতে। সুরুলি স্কেল মেপে মানচিত্র না বুঝুক, রান্নার গল্প তো বোঝে! আসলে জীবন তো খানিকটা গল্পের মতোই। সে গল্পে কতজন যে সুরুলির মতো পুরনো চাঁদের মায়া দিয়ে জোছনা বুনে চলেছে, সেসব আর জানা হবে না সুরুলির। আমারই কি জানা হত! তবু, এই পৃথিবীর জানলায় বসে থাকতে থাকতে একদিন লতা’র সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
লতা.কে (Lata K.)— কেরালার প্রথম মহিলা শ্যেফ, স্পাইস এক্সপার্ট। কে বলে রান্নাঘরে লড়াই নেই! ঘরে বাইরে কত যে লড়াই লড়তে হয়েছে ওকে! এই উপমহাদেশের মেয়েরা তো চিরকাল শুনে এসেছে, রান্নাঘরেই জীবনের মোক্ষ। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন, লতা কেবল মেয়ে বলেই কালিনারি ইস্কুলে ভর্তি হতে পারছিল না। এমনকী ইন্টার্নশিপে কোনও হোটেল রেস্তোরাঁ ওকে কাজের সুযোগ দিচ্ছিল না পর্যন্ত। মেয়েরা রাঁধুনি হতে পারে, শ্যেফ হবে কেন? এমনকী ওর মাও বিশ্বাস করতেন সেকথাই। ভাগ্যিস বাবা আর নিজের স্বামীকে পাশে পেয়েছিল লতা। এইটুকুই যথেষ্ট ছিল ওর জন্যে। তাই তো ওর (লতার) রান্নাঘর গন্ধের শরীর হয়ে উঠেছে ক্রমে।

স্পাইস গার্ল লতা সেই ছোট্টটি থেকে দেখেছে ওর ঠাকুমাকে, ওর দিদিমাকে। ওর দিদিমা চাষ করতেন, খেত-খামার নিয়েই ছিল ওঁর জীবন। ঠাকুমা কাজ করতেন মন্দিরে। মন্দিরের প্রসাদ রাঁধতেন। লতা, ছোট থেকেই ওর মা আর ঠাকুমার রান্না দেখে বড় হয়েছে। সাধারণ রান্নাই নিষ্ঠা আর ভালবাসায় কত সুস্বাদু হয়ে উঠতে পারে সেকথা লতার চেয়ে ভালো করে আর কেউ জানে না। তাই আজকের লতা বলতে পেরেছে, মন ভালো না থাকলে সেদিন রান্না কোরো না।
স্পাইস গার্ল লতা সেই ছোট্টটি থেকে দেখেছে ওর ঠাকুমাকে, ওর দিদিমাকে। ওর দিদিমা চাষ করতেন, খেত-খামার নিয়েই ছিল ওঁর জীবন। ঠাকুমা কাজ করতেন মন্দিরে। মন্দিরের প্রসাদ রাঁধতেন। লতা, ছোট থেকেই ওর মা আর ঠাকুমার রান্না দেখে বড় হয়েছে।
শ্রমের রাজনীতির বাইরে গিয়ে রান্নাঘরকে যারা দেখতে শিখিয়েছেন নিশ্চয়ই লতা তাদেরই একজন। মালাবার রান্নার আদি স্বাদ-প্রকরণকে ও পৌঁছে দিতে চেয়েছে মানুষের পাতে। গাছ, মাটি আর আকাশকে ভালবেসে যে প্রাচীন জনজাতির মানুষেরা রান্নাঘরে রূপকথা বুনে দিতে পেরেছিলেন, লতা সেসব রান্নায় ডুবে যেতে ভালোবাসে। বছরখানেক ভায়ানাদের গাছগাছালি ঘেরা মানুষ-জীবনে পড়ে থেকেছে ও। সে কেবল জল-জঙ্গলের মানুষের রান্না শিখবে বলে। এহেন লতা যখন তালের পাতায় ওর ঠাকুমার রান্না দিয়ে মেনু সাজিয়ে পরিবেশন করেন গ্র্যান্ড হায়াতের (Grand Hyatt) টেবিলে তখন ওর সামনে এসে দাঁড়ায় আস্ত একখানা ভারতবর্ষ। আস্ত একখানা সুরুলি সোরেন। সেসব ভেবেই তো লতা বলতে পারেন রান্না কেবল হাড়ি পাতিল দিয়ে একখানা চৌকো ঘর ভরিয়ে তোলবার কারবার নয়। লতার কথায়— ‘Cook as a doctor, cook as a scientist, cook as a psychiatrist, do not let ego take over you.’

অনেক ভেবে ক্রমে মনে হয়েছে— লতার এই ভাবনার মধ্যে নিহিত আছে ওর জীবনবোধ। ওর ঠাকুমার প্রসাদ রান্নার মধ্যেও কি এই ভাবনাটিই মিশে ছিল না সমগ্র চেতনা জুড়ে! তবু একথা তো ঠিক, অহং না থাকলে একজন মানুষের থাকেই বা কী! এই উপমহাদেশের গল্পে বারবার যে অহং’কে অতিক্রম করার সংকল্প ফিরে ফিরে আসে সে তো কাজের নিষ্ঠা আর ধ্যান নয়, বরং সে হল এই ‘আমি’ দিয়ে গড়ে তোলা আমার আপনার চেতন জগত। মানুষের মন বুঝে আর কেই বা রান্না করে বলুন! অথচ কী আশ্চর্য এই ভাবনা, এই মূল্যবোধ! কেবল মেয়ে বলেই লতা এমন করে ভাবতে পেরেছেন— আমার কিন্তু তেমনটা মনে হয় না। বরং আমার মনে হয়েছে, লতা বারবার ওর রান্নার মধ্যে মানবিক যাপনকে বিন্যস্ত করতে চেয়েছে। গার্হস্থ্য জীবন আমাদের অনেক কিছু শেখায় না চাইতেই। রান্নাঘরে আসলে প্রেম স্নেহ শুশ্রূষার ভাষা এসে মিশছে প্রতিদিন। এক বাটি রান্না খেয়ে মানুষ যদি খুশি হয়, তার চেয়ে আনন্দের আর কিছু আছে! যে মানুষ সেই মনটিকে স্পর্শ করতে চান স্বাদ-গন্ধের মধ্য দিয়ে, তিনি ঠিক জানেন কখন বর্ষার দিনে মরিচের বাগার বাড়িয়ে দিতে হবে। এসব বহু বছরের শিক্ষানবিশি। বহুদিনের চর্চিত সত্য। ফাল্গুনের দিনে ঠাকুমা কেমন করে কী রাঁধতেন সেকথা ভুলে গেলে চলবে কেন! সেই তো চিনিয়ে দেয় ঋতুরঙ্গের রান্নাঘরটিকে।

লতা’ও নিশ্চয়ই তেমন করেই রান্নার পথ খুঁজেছেন প্রতিদিন। আর বার বার মানুষকে বলেছেন, মন ভালো নেই? তাহলে আজ রান্না কোরো না। কিন্তু কী অকারণ দেখুন! অবসাদে তলিয়ে যেতে যেতে রান্নাঘর কেবল মেয়েলি হয়ে উঠেছে প্রতিদিন। যে দেশ অবসাদের ভাষা বোঝে না সে কেমন করে বনজ কুসুমের গন্ধে কস্তূরী খুঁজে পাবে? তখন বাকি দিনে রাতে কেবলই হাঁড়ি পাতিলে ছড়িয়ে পড়বে ক্লেদজ কুসুমের গন্ধ। লতা সেই কবেই ওর শিলে বাটা মশলায়, ওর ঠাকুমার রান্নায় বসন্ত বিকেলের রং ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। শাল মহুলের জঙ্গল পেরিয়ে আমাদের রান্নাঘরের চৌখুপিতে সে ডাক পৌঁছাবে নিশ্চয়ই কোনোদিন।
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Britannica
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।