লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের জাদুতে একসময়ের ভারতবর্ষের আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল। স্বাধীন ভারতের সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনে নানাসময় সমস্যা এসেছে নানারকম। তার মধ্যেও হিন্দি ছায়াছবি ও আধুনিক গানে ভারতীয়দের মন মজে ছিল। ছিল অগণিত শিল্পীর সমাবেশ। মানুষের হৃদয়ে পাকা আসন করে নিয়েছিলেন তাঁরা সবাই। এঁদের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল হলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। সেই চল্লিশের দশক থেকে যিনি আমাদের সুরের জাদুতে আবিষ্ট করে রেখেছেন। মাসকয়েক আগে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। কিন্তু সে তো তাঁর নশ্বর দেহমাত্র। শেষ হল জাগতিক নিয়মে। তাঁর মতো কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পীর কি সত্যিই মৃত্যু হয়? তিনি তাঁর গানে অমর, অক্ষয়। বারে বারেই মনে হয়, লতা মঙ্গেশকরের মতো অবিস্মরণীয় শিল্পীদের কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়া সুরের আজ বড় প্রয়োজন, যা স্নিগ্ধতাকে আমন্ত্রণ জানায়, বিশ্ব চরাচরকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে।
ফিরে আসি লতার গানের আলোচনায়। সত্তর দশকের শেষভাগে কোকিলকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখেছিলেন কিছু অনবদ্য গানের মাধ্যমে। রাজ কাপুর ফিল্মসের ব্যানারে প্রযোজিত বিখ্যাত ছায়াছবি ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ হিন্দি ছবির জগতে এক মাইলস্টোন। রাজ কাপুর পরিচালিত এই ফিল্মের গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল। লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল সুরারোপিত লতা কণ্ঠের গান – ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ লিখেছিলেন পন্ডিত নরেন্দ্র শর্মা। এই গানটি এক যুগান্তকারী নিবেদন যা আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে চিরকালীন। লতার গাওয়া এই ছবির আর একটি অপূর্ব গান, কাহারবা তালে বাঁধা– ‘যশোমতী মইয়া সে বোলে নন্দলালা’ (মান্না দে-র সঙ্গে ডুয়েট) তাঁর মিষ্টতার জন্য খ্যাতি পেয়েছে। এই ফিল্মে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শশী কাপুর ও জিনত আমন।

এর পর বলতে হয়, কৃষ্ণ শাহ্ পরিচালিত ফিল্ম ‘শালিমার’-এর কথা। ছবিতে তাক লাগানো অভিনয় করেন ধর্মেন্দ্র, জিনত আমন ও শাম্মি কাপুর। লতা কণ্ঠের গান– ‘কি আইনা ওহি রেহতা হ্যায়’ আজও অমলিন। রচয়িতা আনন্দ বক্সী। সিপ্পি ফিল্মসের ব্যানারে এরপর মুক্তি পায় ‘তৃষ্ণা’। পরিচালনায় অনিল গঙ্গোপাধ্যায়। শশী কাপুর, রাখি, সঞ্জীবকুমার ও বিন্দু অভিনীত এই ছায়াছবি দর্শকদের ভালোবাসা পেয়েছিল। এই ফিল্মে লতা কণ্ঠের নিবেদন–‘দিন-ব-দিন ও মেরে দিল সে কিউঁ দূর দূর হোনে লগে’ সেই সময়ের রেডিওতে চলা সুপারহিট গান। লিখেছিলেন গুণী গীতিকার অনজান। এই সময়কার এমন অজস্র ছবিরই নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, যেখানে ছবিগুলিকে দর্শক সেভাবে মনে না-রাখলেও অমর হয়ে রয়েছে লতার গাওয়া গান। তেমনই সত্তর দশকের শেষভাগে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া কয়েকটি মেলডি-নির্ভর গানের তালিকায় একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক–
‘ডুব রাহা হ্যায় মেরা দিল’ (টুটে খিলৌনে, ১৯৭৮)
‘আপকি ম্যাহকি হুই জুল্ফ কো’ (ত্রিশূল, ১৯৭৮)[যেশুদাসের সঙ্গে ডুয়েট)
‘তুমহে্ দেখতি হুঁ তো’ (তুমহারে লিয়ে, ১৯৭৮)
‘অপনা দর্দ ছুপানা হ্যায়’ (বিশ্বনাথ, ১৯৭৮)
‘সইঁয়া বিনা ঘর সুনা সুনা’ (আঙ্গন কি কলি, ১৯৭৯) [ভূপিন্দরের সঙ্গে ডুয়েট]
‘তুমহারে বিন গুজারে হ্যায়’ (আত্মারাম, ১৯৭৯) [মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট]
‘সিমটি হুই ইয়ে ঘড়িয়াঁ’ (চম্বল কি কসম, ১৯৭৯) [মহম্মদ রফির সঙ্গে ডুয়েট]
এল আশির দশক। আর লতা মঙ্গেশকর পৌঁছে গেলেন শিল্পীজীবনের চরম উৎকর্ষে। বিখ্যাত পরিচালক কালীদাস নির্দেশিত হিন্দি ছবি ‘আখরি ইনসাফ’ বক্স-অফিসে সাড়া জাগিয়েছিল মূলত অশোককুমার, প্রদীপকুমার, জারিনা ওয়াহাব, বিজয়েন্দ্রর অভিনয়ের দৌলতে। এই ছবিতে লতার গাওয়া নজ়ম– ‘আইয়ে আপসে হম প্যায়ার কা ইজহার করেঁ’ হিন্দি ফিল্ম সঙ্গীতের এক অনন্য সংযোজন। গানটির সুরকার রাজেশ রোশন ও লেখক কুলবন্ত জানি। এরপর সানলাইট ফিল্মস প্রযোজিত ছবি ‘আঁচল’–এ সুরের ঝরনা বইয়ে দিলেন রাহুল দেববর্মন। লতা কণ্ঠের পরিবেশনা– ‘ভোর ভয়ে পঞ্ছি ধুন ইয়ে সুনায়ে’ এক উদাস করা সাংগীতিক মূর্ছনা হিসেবে মনে গেঁথে রয়েছে।

জে ওমপ্রকাশ নির্দেশিত ছবি ‘আশা’ সে সময়ের হিট ছবি। এই ফিল্মে লতার গাওয়া দাদরা তালে– ‘শিশা হো ইয়া দিল হো’ সাফল্যের শীর্ষ অতিক্রম করেছিল। বলা চলে, ১৯৮০ সালে এমন অসংখ্য ছবি মুক্তি পেয়েছিল যাদের পরিচিতি আজও লতা মঙ্গেশকরের গান দিয়েই। আবদুল্লা, এগ্রিমেন্ট, আলিবাবা অউর চালিশ চোর, অপনে পরায়ে, বদলা অউর বলিদান, বন্দিশ, বে-রেহম, বোম্বে ৪০৫ মাইলস, চক্র, চালবাজ, চোরোঁ কি বারাত, দো অউর দো পাঁচ, দো প্রেমী, গঙ্গাধাম, গরম খুন, গুনাহগার, হাম নহিঁ সুধরেঙ্গে, জল মহল, জ্যোতি বনে জ্বালা, লুটমার, মনপসন্দ, মাঙ্গ ভরো সজনা, নিশানা, পতিতা, ফির ওহি রাত, কাতিল কৌন, সবুত, সিতারা, স্বয়ম্বর, থোড়ি সি বেওফাই ইত্যাদি এমনই কিছু ছবি। তবে এর মাঝে দোস্তানা, কর্জ় বা শান-এর মতো হিট ছবিও অবশ্যই ছিল, যাদের গানও ছিল সুপারহিট।
১৯৮৩ সালে রিলিজ হওয়া ফিল্ম ‘রাজিয়া সুলতান’ আক্ষরিক অর্থেই এক ঐতিহাসিক ভেঞ্চার। কমল আমরোহি পরিচালিত এই ছবিতে ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী ও পারভীন বাবির অভিনয় তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। খৈয়াম সাহেবের সুরে লতার পরিবেশনা– ‘অ্যায় দিল-এ-নাদান’ এক চিরকালীন মাইলস্টোন হিসেবে পরিচিতি পায়। লিখেছিলেন প্রখ্যাত উর্দু কবি জান নিসার আখতার। আর একটি ছবির কথা না বললেই নয়, সেটি হল আশির দশকের ব্লকবাস্টার হিট ছবি সূরয বরজাতিয়া পরিচালিত ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিয়া’। রামলক্ষ্মণ–এর সুরে, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া এই ফিল্মের সবকটি গান সুপার ডুপারহিট হয় এবং তামাম ভারতবাসীকে উন্মাদনায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ‘দিল দিওয়ানা বিন সজনা কে মানে না’ গানটি একসময় গ্রাম শহর নির্বিশেষে ভারতের প্রতিটি ঘরে, দোকানে বাজারে অনুষ্ঠানে বাজতে শোনা যেত। এছাড়াও– ‘আতে যাতে হসতেঁ গাতে’, ‘কবুতর যা যা যা’, ‘আজা শাম হোনে আয়ি’ গানগুলিও সুপারহিট হয়।
এবার একটু বলি লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া হিন্দি আধুনিক গানের কথা। লতার বাংলা আধুনিক গানের মতো এ গানও সমৃদ্ধ করেছে সারা বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীদের। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত গজলের লং-প্লে রেকর্ড ‘লতা মঙ্গেশকর সিংস গালিব’ ছিল তাঁর এক অভিনব প্রচেষ্টা। এই অ্যালবামের গান –‘দর্দ মিন্নত কশ-এ-দওয়া না হুয়া’, ‘ফির মুঝে দীদার-এ-তর ইয়াদ আয়া’, ‘কোই উম্মীদ বর নহি আতি’, ‘কভি নেকি ভি উসকে জি মেঁ’ তার অনন্যতার জন্য প্রসিদ্ধ। ১৯৭০–এর মাইক্রো গ্রুভ রেকর্ড ‘লতা মঙ্গেশকর রিসাইটস ভগবদ্গীতা’ও এই তালিকায় এক চমকপ্রদ সংযোজন। হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে পরিবেশিত প্রত্যেকটি স্তবক যেন এক একটি রত্নখনি। লতার গাওয়া মীরার ভজনের রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে। এই লং-প্লে রেকর্ডটিও প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। সঙ্গীতবোদ্ধাদের হৃদয়ে আজও গেঁথে রয়েছে আটটি অপূর্ব গানের বন্দনা– ‘সাওরোঁ নন্দনন্দন’, ‘কিনু সঙ্গ খেলুঁ হোলি’, ‘মহারা রে গীরধর গোপাল’, ‘থানে কাণী কাণী সুনাওয়া’ ইত্যাদি।

১৯৭৫ সালে এল লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ‘চলা ভাহি দেস’ নামে উৎকৃষ্ট ভজনের অ্যালবাম। হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরসংযোজনায় এই রেকর্ডটি কালেক্টার্স আইটেম হিসেবে গন্য হয়ে থাকে। গানগুলো ছিল– ‘সাওঁরে রঙ্গ রাচি’, ‘গড় সে তো মীরাবাঈ উৎরি’, ‘করম কি গতি ন্যায়রি’, ‘পপিহা রে পিউ কি বাণী না বোল’, ‘উড় যা রে কাগা’ ইত্যাদি। মিউজিক ইন্ডিয়া প্রকাশিত মাইক্রোগ্রুভ ‘রাম রতন ধন পায়ো’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। এই রেকর্ডে আমরা পেয়েছি লতা মঙ্গেশকর নিবেদিত কিছু ভক্তিরসাত্মক অপূর্ব গান। ‘জয় রাম স্তোত্র’, ‘পাইও জি ম্যায়নে রাম রতন ধন’, ‘ঠুমক চলত রামচন্দ্র’, ‘শ্রী রামচন্দ্র কৃপালু ভজমন’, ‘রামচরিতমানস’, ‘বৈষ্ণব জন তো তেনে কহিয়ে’, ‘জয় জগদীশ হরে’ আজও আমাদের পূজার অর্ঘ্য।
আসলে লতা মঙ্গেশকরের গান থেকে তো মুক্তি নেই লঘুসংগীতের শ্রোতাদের। বিশ শতকের কিন্নরকণ্ঠীর গানে কান পাততে হয়েছে একুশ শতকের শ্রোতাদেরও। হালফিলের গানবাজনা যতই লঘু বা ক্ষণস্থায়ী হবে, ততই দীর্ঘ হবে লতার ইমেজ। ছোটখাটো চেহারা, সাদা পোশাকের নম্রভাষী এই কণ্ঠশিল্পী ফেনোমেনন হয়ে আছেন গানের ভূখণ্ডে। গানের ওস্তাদ থেকে সাধারণ মানুষ, সকলেই লতাকণ্ঠে মজে রয়েছেন বিগত কয়েক দশক ধরে। তাঁকে সাফল্যের মালা পরিয়ে আল্টিমেট শিল্পী হিসেবে সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছেন গান পাগল জনতা। তাই লতা হয়ে উঠেছেন অবিসংবাদী আইডল। (সমাপ্ত)
*ছবি সৌজন্য: Indian Express, Somoy News, MSN
*ভিডিও সৌজন্য: Youtube
লেখায় প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।