লতা মঙ্গেশকরের একক কণ্ঠে তো বটেই, প্রেমের গানই হোক, কি সিরিয়াস গান, যে কোনও ধরনের ডুয়েটেই তাঁর কণ্ঠের চলন ছিল অনায়াস। পর্দায় নায়ক-নায়িকার অন্তরঙ্গ রসায়ন কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তাঁর ডুয়েট গানগুলিতে। কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি, মান্না দে, হেমন্ত কুমার, মুকেশের মতো সহগায়কদের ভরাট, জলদগম্ভীর কণ্ঠের সঙ্গে কীভাবে ওতপ্রোতভাবে খাপ খেয়ে যেত তাঁর মিহি সুরেলা কণ্ঠ, তা বোঝা যায় লতার হিট ডুয়েটগুলি শুনলেই।
গানের মর্ম আত্মস্থ করার মুনশিয়ানায় বরাবরই সুদক্ষ ছিলেন লতা মঙ্গেশকর। এর নেপথ্যে তাঁর শাস্ত্রীয় তালিমের অবদান অনস্বীকার্য। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতচর্চাই তাঁকে শিখিয়ে ছিল কীভাবে কণ্ঠস্বরে নাটকীয়তা তৈরি করতে হয়, আবেগে গলা ভাসিয়েও কীভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয় সুরের উপর। তাঁর একাধিক কালজয়ী গানে এই সংযমবোধকেই আশ্রয় করেছিলেন কোকিল কণ্ঠী লতা। শিল্পী হিসেবে লতার ব্যাপ্তি ভাষায় বর্ণনা করা দুরূহ। ৭০-দশকের দ্বিতীয় ভাগে লতা কণ্ঠের মাধুর্য বয়ে নিয়ে এল এক চিরকালীন ভালোবাসার আবেশ।
হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘অর্জুন পন্ডিত’ এক অনন্যসাধারণ ছবি হিসেবে দর্শকরা আজও মনে রেখেছেন। এ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীবকুমার, অশোককুমার, বিনোদ মেহরা, শ্রীবিদ্যা, দেবেন ভার্মা, বিন্দু, প্রমুখ শিল্পীরা। লতা কণ্ঠে পরিবেশিত দুটি একক গান এই ফিল্মের সম্পদ। ‘ও বোলো প্রীতম কেয়া বোলি থি ম্যায় আগে রে’ এবং ‘বাদলো মেঁ ওয়াদিয়োঁ মেঁ ঢুঁনঢো রে কহিঁ’। লিখেছিলেন প্রতিষ্ঠিত গীতিকার মজরুহ সুলতানপুরী। এই ছবির সুরসংযোজনায় শচীন দেববর্মণ শ্রোতাদের মাতিয়ে দেন।

নবকেতন প্রোডাকসন্সের ব্যানারে তৈরি ছবি ‘বুলেট’ পরিচালনা করেছিলেন বিজয় আনন্দ। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন মূলত দেবানন্দ, পরভিন বাবি, রাকেশ রোশন, কবীর বেদি, জ্যোতি বক্সী, সোনিয়া সাহানি-দের মতো শিল্পীরা। লতা কণ্ঠের একটি চমকপ্রদ গান, কাহারবা তালে বাঁধা ‘যব তুম চলে যাওগে তো ইয়াদ বহুত আওগে’ আজও সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে আলোড়ন তোলে। গুণী কম্পোজার রাহুল দেববর্মণের অসাধারণ সুরের বিন্যাস এই গানকে পৌঁছে দিয়েছিল তার কাঙ্খিত উচ্চতায়। অন্তরার কথাগুলো গানের মিটার অনুযায়ী চমৎকার ভাবে সাজিয়েছিলেন প্রখ্যাত গীতিকবি আনন্দ বক্সী। ছত্রগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক –
‘মেরি আখোঁ নে এক খোয়াব দেখা হ্যায়,
য্যায়সে কাটোঁ মে গুলাব দেখা হ্যায়,
কিসি চেহরে পে নকাব দেখা হ্যায়,
তুম মেরে ইস খোয়াব কি তাবির দেতে যানা’।
শাম্মি কাপুর নির্দেশিত ছবি ‘বন্ডলবাজ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৬ সালে। পুষ্পা পিকচার্স প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে প্রযোজিত এই ছায়াছবিতে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেন রাজেশ খান্না, সুলক্ষণা পন্ডিত, শাম্মি কাপুর, রঞ্জিত, জনি ওয়াকার, আসরানি, ফরিদা জালাল ও আরও অনেকে। রাহুল দেববর্মণের সুরারোপ এই ছবির গানের আবেদন বাড়িয়ে দিয়েছিল অনেকাংশে। সুরসম্রাজ্ঞীর কণ্ঠে দুটি অসাধারণ মেলোডি নির্ভর গান আজও শ্রোতামহলে সমাদৃত। মহম্মদ রফির সঙ্গে পরিবেশিত ডুয়েট– ‘নগমা হমারা গায়েগা ইয়ে জমানা’ ও কিশোরকুমারের সঙ্গে– ‘বেমৌসম বাহার কে দিন ক্যায়সে আয়ে’ হিন্দি ছবির গানের জগতে দুই অনুপম সংযোজন হিসেবে গণ্য হয়।
সুরকার বাপ্পি লাহিড়ীর সাংগীতিক মুনশিয়ানার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল কৈলাশপতি পিকচার্সের ‘চলতে চলতে’ ছবিতে। এখানে প্রধান চরিত্রগুলি ফুটিয়ে তুলেছিলেন বিশাল আনন্দ (ভীষ্ম কোহলি), সিমি গারেওয়াল, নাজনিন, ডাঃ শ্রীরাম লাগু, জগদীশ রাজ, চন্দ্রিমা ভাদুড়ী প্রমুখ। এ ছবির দুটি গান আজও জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে। লিখেছিলেন, প্রতিভাবান গীতিকার অমিত খান্না। গান দুটি কী? ‘দূর দূর তুম রহে পুকারতে হম রহে’ এবং ‘প্যায়ার মেঁ কভি কভি অ্যায়সা হো যাতা হ্যায়’ (শৈলেন্দ্র সিংয়ের সঙ্গে ডুয়েট)।
রামানন্দ সাগরের ছবি ‘চরস’ ৭০- দশকের মধ্যভাগে আলোড়ন তুলেছিল। প্রাণবন্ত অভিনয়ের নিদর্শনস্বরূপ এই ফিল্মে অসাধারণ কাজ করেছিলেন ধর্মেন্দ্র, হেমা মালিনী, অজিত, আমজাদ খান, অরুণা ইরানি, কেষ্ট মুখোপাধ্যায় ও আরও অনেকে। আনন্দ বক্সীর কথায় লতা কণ্ঠের তিনটি গান সফলতার শীর্ষে ওঠে। গানগুলি হল- ‘ঝুম কে ম্যায়ঁ তো চলতি না থি’, ‘কল কি হসিঁ মুলাকাৎ কে লিয়ে’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট), ‘দিল ইনসান কা এক তরাজু যো ইনসাফ কো তোলে’ (মহম্মদ রফি ও আনন্দ বক্সীর সঙ্গে ডুয়েট)।

সুবোধ মুখোপাধ্যায় প্রোডাকসন্সের সামাজিক ছবি ‘দিওয়ানগি’ মানুষের মনে ছাপ রেখেছিল মূলত শশী কাপুর ও জিনত আমনের অভিনয়ের দৌলতে। এটি ছিল কর্তা শচীন দেববর্মণ সুরারোপিত শেষ ছবি যদিও ছবির কাজ সম্পন্ন করেছিলেন মিষ্টি সুরের কান্ডারী রবীন্দ্র জৈন। দাদরা তালে বাঁধা ‘পুজা কি বিধি না জানু’ ও ‘প্যায়ার যব তেরা মেরা হুয়া’ আজও সঙ্গীতবোদ্ধাদের মধ্যে জনপ্রিয়। স্বনামধন্য নির্দেশক সি পি দীক্ষিতের চমকপ্রদ ছবি ‘ফকিরা’ তার সঙ্গীতের জন্য বিখ্যাত। এই ছবিতে লতা কণ্ঠের দুটি গানও তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কাহারবা তালে বাঁধা ‘দিল মে তুঝে বিঠাকে’ খুব হিট হয়েছিল। রবীন্দ্র জৈনের কথা প্রেমের ভাবনাকে এক নতুন পথ দেখিয়েছে এই গানের অন্তরায়। কথাগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক–
‘না কোই বন্ধন জগৎ কা
কোই প্যাহরা না দিওয়ার,
কোই না জানে দো দিওয়ানে
জি ভর কর লে প্যায়ার,
কদমোঁ মেঁ তেরে আকে
কর লুঙ্গি ম্যায় বন্ধ আঁখে’।
এছাড়াও কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট– ‘(ও) তোতা ম্যয়না কি কাহানি’ এই ছবির এক বিরল স্মৃতি।
এ সময়ের একটি প্রচলিত গান শোনা গিয়েছিল নবকেতন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যানারে তৈরি ‘জানেমন’ ছবিতে। চেতন আনন্দ পরিচালিত এই ছবিতে চমৎকার অভিনয় করেছিলেন দেবানন্দ, হেমা মালিনী, প্রেমনাথ, দুর্গা খোটে, পেইন্টাল প্রমুখ। লতা কণ্ঠের নিবেদন– ‘আয়েগি, আয়েগি, আয়েগি কিসিকো হমারি ইয়াদ আয়েগি’ এক অনন্যসাধারণ সংযোজন। এভিএম প্রোডাকসন্স প্রযোজিত ও মুরুগন কুমারন পরিচালিত হিন্দি ছবি ‘জীবন জ্যোতি’ বক্স-অফিসে সাড়া ফেলেছিল। কিংবদন্তী সুরকার সলিল চৌধুরী সুরারোপিত এই ছবির গান রেডিওর অনুরোধের আসরে প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এই ফিল্মে অনবদ্য গান লিখেছিলেন আনন্দ বক্সী। লতার নিবেদন, কাহারবা তালে বাঁধা গানগুলিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক– ‘দুনিয়া রঙ বদলতি যায়ে’, ‘জিস দুয়ারে পে ঘর কি বহু’, ‘ম্যায়নে দিল সে তুমহারি তসবির উতারি’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট)।
এ বার আসা যাক যশরাজ ফিল্মসের হিন্দি ছবি ‘কভি কভি’-র কথায়। এ ছবির অনন্য সঙ্গীত আজও শ্রোতাদের মনে অমলিন। এই ছবিতে আমরা পেয়েছিলাম লতা মঙ্গেশকর পরিবেশিত কিছু অমূল্য গানের ডালি– ‘কভি কভি মেরে দিল মে খায়াল আতা হ্যায়’ (মুকেশের সঙ্গে ডুয়েট), ‘মেরে ঘর আয়ি এক ননহি পরী’, ‘তেরা ফুলোঁ য্যায়সা রঙ’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট), ‘তেরে চেহেরে সে নজর নহি হটতি’ (কিশোরকুমারের সঙ্গে ডুয়েট)। এর পরেও যে ছবির নাম করতে হয় তা হল, তরুণ তুর্কি পরিচালক সুভাষ ঘাইয়ের ছবি ‘কালীচরণ’। এ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন শত্রুঘ্ন সিনহা, রিনা রায়, প্রেমনাথ, অজিত, অলকা, ডেভিড, শৈলেশকুমার ও অন্যান্যরা। রাজকবি ইন্দ্রজিৎ সিং ‘তুলসি’র অনবদ্য লেখা গান লতা কণ্ঠে মূর্ত হয়ে উঠেছিল এই ছবির হাত ধরে। ব্যক্তিগত স্তরে এই গানটি আমারও প্রিয় গানের তালিকায় রয়েছে। এই গানে লতা কণ্ঠের মডিউলেশন চমকে দেয় আপামর সঙ্গীতবোদ্ধাদের। গানটি – ‘যারে যা ও হরজাই দেখি তেরি দিলদারি’। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৬ জুন
ছবি সৌজন্য: Pinterest, Indian Express, TOI, Youtube
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।