লতা মঙ্গেশকরের অতুলনীয় কণ্ঠপ্রয়োগে যে স্বর্গীয় আবেশের সৃষ্টি হয় তা যুগ-যুগ ধরে সঙ্গীতপিপাসু মনকে সমৃদ্ধ করেছে। মারাঠি নন-ফিল্ম গানের জগতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। প্রতিটি গানের বাণী, তালের মাত্রা, সুরের সঠিক প্রয়োগ এবং সাংগীতিক ভাবের যে রীতি তিনি মেনে চলতেন, তা এক কথায় অকল্পনীয়। ১৯৪৮ সালে তাঁর কণ্ঠে প্রথম যে মারাঠি বেসিক গানটি বিপুল সাড়া ফেলেছিল, সেটি জি কে দাতারের কথায় ও নাগেশ মাসুতের সুরে রেকর্ড করা– ‘চল নাচ নাচ রে নন্দকিশোরা’। ৭৮-পাক রেকর্ডের অপর পিঠের গান– ‘হসতেস আসি কা মানি’ আজও তার আবেদন বজায় রেখেছে। এই গানটি লিখেছিলেন প্রসিদ্ধ গীতিকার রাজা বঢ়ে।
কিংবদন্তী মারাঠি কম্পোজার দত্তা দাওজেকরের সঙ্গে লতার বোঝাপড়া গড়ে উঠেছিল চল্লিশ দশকের শেষ প্রহরে। ওঁর লেখা ও সুরে চারটি বেসিক গান আজও মনে রেখেছেন মারাঠি সঙ্গীতের গুণগ্রাহীরা। গানগুলি হল– ‘হো আলি দিওয়ালি মঙ্গলদায়ি আনন্দ ঝালা’, ‘আ তুজ স্বপনি পাহিলে রে’, ‘গেলা কুঠে বাঈ কানহা্’ ও ‘ভাওবিজেলা আলা মাঝা’। ১৯৪৯ সালে বিশিষ্ট মারাঠি সুরকার বসন্ত প্রভুর সুরে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া দুটি আধুনিক গানের আবেদন আজও স্মৃতিমেদুর করে তোলে সঙ্গীত অনুরাগীদের। ‘গঙ্গা যমুনা ডোলয়াৎ উম্ভয়্য কা’ (রেকর্ড নং– GE 8453) এবং ‘হসলে গ বাঈ হসলে অন কায়মচি মি ফসলে’– গান দুটি লতা কণ্ঠের মাধুর্যে এক অনন্য উচ্চতায় বিরাজ করছে। গানের অন্তরায় অনুপ্রাস অলঙ্কারের অসাধারণ ব্যবহার করেছিলেন কবি পি সাভলারাম। মারাঠি সাহিত্যে এই গীতিকবিতা এক চিরনবীন ধারার প্রবর্তক হিসেবে ধরা দিয়েছিল। তার ছত্রে ছত্রে রয়েছে প্রেম নিবেদনের এক নির্মল আর্তি যা পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করে নিপুণভাবে। ভাবের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় সেই করুণ রসের ধারা।

লতা-বসন্ত প্রভু জুটি তার চিরকালীন আবেদন বজায় রেখেছিল প্রায় ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত। সঙ্গীতপিপাসু মানুষের হৃদয়ের আবেদনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই জুটির গানগুলি আজও অমর হয়ে রয়ে গেছে এক চিরকালীন সম্পদ হিসেবে। কিছু মনমাতানো গানের উল্লেখ করা যাক–
‘তুজে ডোলে পানইয়ানে ভরলে’ (১৯৫০)
‘কৃষ্ণা মিলালি কোয়েনেলা’ (১৯৫০)
‘শ্রীরামা ঘনশ্যামা বধশীল কধি তু রে’ (১৯৫১)
‘রঘুনন্দন আলে আলে’ (১৯৫১)
‘বিঠ্ঠল তু আলা আলা’ (১৯৫৩)
‘কল্পবৃক্ষ কন্যেসাথি লাবুনিয়া বাবা গেলা’ (১৯৫৩)
‘সপ্তপদী হে রোজ চলাতে’ (১৯৫৪)
‘লিম্বালোনা উতারতা অশি কা’ (১৯৫৪)
‘বাপ রখুমাইচ্যা বরা আলিঙ্গুনি’ (১৯৫৫)
‘বালা হাওঁ কশি উতরাই’ (১৯৫৫)
‘হৃদয়ই জাগা তু অনুরাগা’ (১৯৫৫)
‘হরওয়লে তে গৌসলে কা’ (১৯৫৫)
‘আ প্রেম স্বরূপ আই’ (১৯৫৫)
‘মধু মাগাশি মাইয়া সখ্যা পরি’ (১৯৫৫)
‘প্রেম তুঝ্যাবর করিতে মি রে’ (১৯৫৬)
‘নব বধূ প্রিয়া মি বাওরতে’ (১৯৫৬)
‘আ প্রতিমা ওরি ধারুনি’ (১৯৫৭)
‘ঘরৎ হসারে তারে অসতা মি’ (১৯৫৭)
‘ঘরোঘরি বধদীন মাইঝা’ (১৯৫৮)
‘আ চাফা বোলেনা’ (১৯৫৮)
‘রামা হৃদায়িন রাম নাহি’ (১৯৫৮)
‘মানসাকন্যা কানওয়ামুনিচি’ (১৯৫৮)
‘নিজল্যা তান্যাভরি মাউলি’ (১৯৫৮)
‘কালা জ্যা লাগল্যা জিভা’ (১৯৫৮)
‘পাহুনি রঘুনন্দন সাওলা লাজলি সীতা’ (১৯৬০)
‘মুকুন্দা রুসু নাকো’ (১৯৬০)
‘বিঠ্ঠলা সমচারন তুঝে’ (১৯৬০)
‘তুচা করতা আনি করবিতা শরণ তুলা’ (১৯৬০)
‘অনাম বীরা জিথে’ (১৯৬৪),
‘আডবাটেলা দূর এক মাল’ (১৯৬৪) ইত্যাদি।
লতা, ভাই হৃদয়নাথ মঙ্গেশকরের সুরে প্রথম বেসিক গান পরিবেশন করেন ষাটের দশকের মাঝামাঝি। ‘মাভলাত্যা দিনকারা অর্ধও তুঝ’ ও ‘আ দে মালা গে চন্দ্রিকে প্রীতি তুঝি’ প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। আজও গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহকেরা এই শেল্যাক-টির খোঁজে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়ান। কলম্বিয়া লেবেলে প্রকাশিত এই রেকর্ডটি ‘কালেক্টার্স আইটেম’ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত, লতা-হৃদয়নাথ জুটির আর একটি গান আকাশচুম্বী সফলতা লাভ করে। ‘তিনি সাঞ্জা সাখে মিলালয়্য’ লিখেছিলেন বি আর তাম্বে। লতা মঙ্গেশকরের অসাধারণ পরিবেশনায় এই গানটির সুর পরে বাংলা ভাষায় জনপ্রিয়তার চরম শিখরে পৌঁছেছিলো। ‘দূরে আকাশ শামিয়ানায়’ মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। বাংলা গানটির রচয়িতা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।

তাম্বের মারাঠি রচনাটি ভাবসঙ্গীতের সাগরে এক দুষ্প্রাপ্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল সমঝদারদের দরবারে। এর অপূর্ব সুরের বিন্যাস, ঢিমে লয়ে চমকপ্রদ পরিবেশন এই গানকে নিয়ে গিয়েছিল এক স্বর্গীয় উচ্চতায়। অতুলনীয় স্ক্যানিং ও ইন্সট্রুমেনটেশন এই গানের প্রাণকাড়া সম্পদ। অন্তরায় ভাবের যে ধারা তৈরী করেছিলেন সুরকার, তা অকল্পনীয়। সঙ্গে লতার মার্জিত কণ্ঠের ভাবাবেশে আকুল হয় শ্রোতার হৃদয়। তাই এই গান আজও কালোত্তীর্ণ।
১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি প্রকাশিত লতা কণ্ঠের আত্মিক নিবেদন ‘আ ঘনু বাজে ঘুন ঘুনা, বারা বাহে রুনঝুনা’ সন্ত ধ্যানেশ্বর রচিত এক নির্মল নিবেদন হিসেবে খ্যাত। এই গানে ভক্তিরসের প্রকাশের বাহুল্য চোখে পড়ার মতো। লতা কণ্ঠের মাধুর্য গানের চরিত্রে এনে দিয়েছিল এক বিশাল পরিবর্তন যা ইতিপূর্বে মারাঠি ভক্তিমূলক পর্যায়ের গানে দেখা যায়নি। ওই একই রেকর্ডের গান ‘মোগারা ফুলালা’ (কাহারবা তালে আধারিত) পরবর্তীকালে বাংলায় সলিল চৌধুরীর কথায় চিরনবীন সংযোজন ‘নাও গো মা ফুল নাও’।
মারাঠি গানটি শুনলেই মনে হয় লতা ভক্তিরসে ডুবে গিয়ে নিজেকে শুদ্ধিকরণের মার্গে চালিত করেছেন। উচ্চারণে স্পষ্টতা, আবেগের নিয়ন্ত্রণ গানটিকে অতুলনীয় করে তুলতে সাহায্য করেছে। চিত্তের অপার শুদ্ধতা না থাকলে এই পরিবেশন সত্যিই অসম্ভব। হয়তো লতা সাধনার সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষে পৌঁছতে পেরেছিলেন অকল্পনীয় পরিশ্রম ও সাধনার বিনিময়ে। হৃদয়নাথের সুরে ‘ওম নমঃ জি আদ্যা বেদ প্রতিপাদ্যা’ গানটিও ভক্তিরসের ধারা বইয়ে দিয়েছিল ষাটের দশকের অন্তিম লগ্নে। এ গান আজও মনে রেখেছেন ধর্মভীরু সঙ্গীতগুণী মানুষেরা। মহারাষ্ট্র রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত মন্দিরগুলির জনপ্রিয়তম ভজন হিসেবে এই গানের আবেদন আজও তার সুনাম অক্ষুন্ন রেখেছে।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে মুক্তি পায় ভক্তিমূলক সঙ্গীতস্তুতি ‘জয়স্তুতে শ্রী মহান মঙ্গলে’। এ গানটি লতা কণ্ঠের এক অভূতপূর্ব আত্মনিবেদন। গানটির রচয়িতা বিনায়ক রাও সাভারকর ও সুরসংযোজনায় ছিলেন নামী সঙ্গীতসাধক মধুকর গোলভালকর। গানটির উচ্চপর্দায় আকুতিপূর্ণ স্বরপ্রয়োগ ও কোরাসের বোঝাপড়া এক অনন্য সাংগীতিক পরিমন্ডল সৃষ্টি করে। ওই বছর বালকবি থোমরের কথা ও হৃদয়নাথের সুর মানুষের মন জিতে নিয়েছিল অনেকাংশে। ‘আনন্দী আনন্দা গড়ে ইকড়ে তিকড়ে চোহিঁকন্ডে’ গানটি আজও সঙ্গীতমনস্কদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে বিরাজ করছে স্বমহিমায়।

কিংবদন্তী সুরের কান্ডারী শ্রীনিবাস খালের সুরে লতা তাঁর প্রথম মারাঠি আধুনিক গানটি নিবেদন করেছিলেন ১৯৬৯ সালের মধ্যভাগে। অতুলনীয় সুরের চলন, কথামালার অনুপম প্রয়োগ এই গানকে এক চিরস্থায়ী আসনে বসিয়েছে। গুজরাটি ভাষাতেও লতা বিভিন্ন মেলোডি নির্ভর গান গেয়েছেন অবিনাশ ব্যাস, কল্যাণজী-আনন্দজী, দিলীপ ঢোলাকিয়া, পুরুষোত্তম উপাধ্যায় প্রমুখের সুরসৃষ্টিতে। অন্যান্য ভাষা যেমন অহমিয়া, ওড়িয়া, সংস্কৃত, মণিপুরি, উর্দু, নেপালী, সিন্ধি, রাজস্থানী, তামিল, তেলেগু, মালয়ালম, কন্নড়, কোঙ্কনি, ভোজপুরীতেও লতা তাঁর কণ্ঠ সম্পদের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন রেখে গিয়েছেন।
তবে সত্তর ও আশির দশকে লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠের কিছু হৃদয়স্পর্শী মারাঠি বেসিক গানের কথা না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। উৎসাহী পাঠকদের জন্য রইল কোকিলকণ্ঠী পরিবেশিত কিছু মণিমুক্তোর সম্ভার যা আজও আনন্দ দিয়ে চলেছে সমগ্র ভারতবাসীকে। গানগুলি বলা যাক–
‘নিজ মাজ্যা নন্দলালা রে’ (১৯৭০, সুরকার -শ্রীনিবাস খালে)
‘আজ গকুলৎ রঙ্গ খেলাতো হরি’ (১৯৭১,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘মেনডিচ্যা পানাভর’ (১৯৭১,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘আসা বেভান হা বারা’ (১৯৭২, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘আগা করুণাকারা’ (১৯৭৩, শ্রীনিবাস খালে)
‘গুণী বাল আসা জাগাসি কা রে’ (১৯৭৪, হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘উঠা উঠা হো সাকালিকা’ (১৯৭৫,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘আজ উদাস উদাস’ (১৯৮০,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর),
‘কিতি জিভালা রখ্যাচা’ (১৯৮০,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর),
‘রাজসা জাভালি জারা বাসা’ (১৯৮০,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর)
‘ঘন ওথামবুন ইয়েতি’ (১৯৮০,হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর) ইত্যাদি। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২ জুন ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Apnaarchive, Pipa News, Facebook
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।