আগের পর্ব পড়তে: [১], [২], [৩], [৪], [৫], [৬], [৭], [৮], [৯], [১০], [১১], [১২], [১৩], [১৪], [১৫], [১৬], [১৭], [১৮]
হিল্টনের বিস্তৃত ফয়ারে, মূল প্রবেশদ্বারের সামনে, আশপাশ ও ফুটপাত জুড়ে থিক থিক করছে যুবক-যুবতী, মধ্যবয়সী নারী-পুরুষ। ঘড়ি ধরে সাতটায় এক দুরন্ত গ্রে স্যুটে লিফট থেকে বেরিয়ে এলেন আলি (Muhammad Ali)। আর অমনি সে কী চাঞ্চল্য সবার! আলি এগোবেন কী, ভিড় ঘেরাও হয়ে সামনে পা ফেলাই সমস্যা ওঁর! নেহাত বেজায় লম্বা তাই ভিড়ে আটকে পড়েও সবাই ওঁকে দেখতে পাচ্ছে। একবার ডান হাতটা মুঠো করে তুলে দেখালেন। হাসি মুখে, মৃদু স্বরে বললেন, ‘দ্য গ্রেটেস্ট!’ আর অমনি ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশগান জ্বলা শুরু হল। আর চারিদিক থেকে গণ্ডা গণ্ডা প্রশ্ন। আলি বললেন, ‘কার প্রশ্নের কী উত্তর দেব?’ তখন ভিড়ের ভেতর থেকে রিপোর্টাররা নিজেদের কাগজপত্রের নাম বলা শুরু করল। তাতেও চিড়ে ভেজার নয়। আলির সঙ্গীরা ভিড় সরানো শুরু করলেন। আলি বললেন, ‘খুব খিদে পেয়েছে, প্রশ্নটশ্ন মাথায় যাচ্ছে না। এখন ছেড়ে দিন।’

এই বলতে বলতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন এসে পড়েছিলেন আমার থেকে আট-দশ ফুট দূরত্বের মধ্যে। আমার সামনে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার আর তরুণ-তরুণীদের জটলা, সবাই কিছু না বলে যাচ্ছে আলির উদ্দেশে, তার মধ্যে আমিও হেঁকে বললাম, ‘স্যর, হোয়েন আর ইউ কামিং টু ইন্ডিয়া ফর আ ফাইট?’
‘ইন্ডিয়া? ওখানে কি আমার লড়াই দেখার ভক্ত আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন আলি। উত্তরে আমি বললাম, ‘গুনে শেষ করা যাবে না। তার মধ্যে আমিও একজন।’
আলি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি ইন্ডিয়ান?’
ভীষণ গর্বের সঙ্গে বললাম, ‘ওহ ইয়েস!’
আলি ফের হাঁটা ধরলেন ভিড় ঠেলে। দেখলাম হোটেল পার্কিং-এর দিকে যাচ্ছেন। যেখানে সারি সারি দামি দামি গাড়ি দাঁড় করানো আছে। ভিড়ও পিছন পিছন এগিয়ে গেল সেই পার্কিং-এর রাস্তার ধার অবধি। আমি সেই ভিড়ের কিছুটা সামনেই আছি। দেখছি বক্সিং-এর রাজা, রাজার মতোই গিয়ে উঠলেন একটা কালো স্ট্রেচ লিমুজিনে। পিছনের সিটে বসে, এক পা তখনও মাটিতে। ভিড়ের সবাই হাত নাড়ছে ওঁকে। আর উনি? উনি হাত নাড়ছেন কাকে যেন একটা। এই ‘এসো, এসো’ হাত নাড়াটা কাকে? ভিড়ের মধ্যে মুখ বাড়ানো আমার ভেতর থেকে একটা সাড়া পেলাম ওই ডাক আমাকেই। আমি নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে বোঝালাম – আমাকে? আলি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বুঝিয়ে ফের ইশারা করলেন ‘এসো।’

আমি তখন আশপাশ না তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে পড়লাম ওঁর সামনে। আর শুধু বলতে পারলাম, ‘ইয়েস, স্যর?’
আলি বললেন, ‘কাল-সকাল দশটায় চলে এসো। আর তোমার নামটা বলো।’ কাঁপুনি ধরা গলায় কোনও মতে বললাম, ‘শঙ্কর’।
সুভাষের ৯ ওয়ারিংটন ক্রেসেন্টের ফ্ল্যাটে ফিরে ব্যাপারটি বলতে বন্ধুটি রীতিমতো ধাঁ মেরে গেল। বলল, ‘কাল সকালেই হোটেলে ডিউটি। নাহলে তোমার সঙ্গে ভিড়ে যেতাম।’ সুভাষ পেল্টা হোটেল চেনের লন্ডন শাখার মোটামুটি বড় দায়িত্বে, ছুটিছাটার বালাই নেই। মুখ ভার করে কী একটা ভাবতে বসল। আর আমি ডায়াল করতে বসলাম ফটোগ্রাফার অলোক মিত্রর নম্বর। কলকাতা থেকে উৎসাহ জুগিয়ে যাকে নিয়ে এসেছি লন্ডনে রবিশঙ্করের ছবি তোলার জন্য। ও উঠেছে লল্ডনে ওর ভগ্নিপতির বাড়িতে। ওদের পাড়া পিকাডিলি লাইনের ফিন্সবেরি পার্কে।
ফোন তুলতেই অলোককে বললাম, ‘কাল সকাল ন’টায় গ্রিন পার্ক মেট্রোর সামনে ক্যামেরা-ফ্যামেরা, লেন্স, ফ্ল্যাশ সব নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। ও বেশ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, ‘কেন? কী ব্যাপার?’
বললাম, ‘বক্সার মহম্মদ আলির ইন্টারভিউ নিতে যাব।’ উত্তরে ওপার থেকে একটা লম্বা আওয়াজই এল, ‘অ্যাআআআ!’
পরদিন ন’টায় আমাদের দৌড় শুরু হল হিল্টন হোটেলের দিকে। দৌড় মানে দৌড়ই, সাহেব-মেম কাটিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে। আর একসময় এসে পৌঁছে গেলাম হিল্টনের রিসেপশন ডেস্কে। অল্পবয়সী সুন্দরী রিসেপশনিষ্ট ওর পোশাকি বার্তাটাই আওড়াল, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যর?’
যাই হোক, পরদিন ন’টায় আমাদের দৌড় শুরু হল হিল্টন হোটেলের দিকে। দৌড় মানে দৌড়ই, সাহেব-মেম কাটিয়ে উর্দ্ধশ্বাসে। আর একসময় এসে পৌঁছে গেলাম হিল্টনের রিসেপশন ডেস্কে। অল্পবয়সী সুন্দরী রিসেপশনিষ্ট ওর পোশাকি বার্তাটাই আওড়াল, ‘হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যর?’
আমি ভেতরের উত্তেজনাটা সামলে বললাম, ‘আই হ্যাভ অ্যান অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ মিস্টার আলি।’
খুব অবাক হয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, ‘ইউ মিন মিস্টার মহম্মদ আলি?’
বললাম, ‘ইয়েস’।
– অ্যান্ড ইয়োর নেম স্যর?
– শঙ্কর। জার্নালিস্ট ফ্রম ইন্ডিয়া।

রিসেপশনিষ্ট আলির নম্বরে ডায়াল করে আমার নাম বলতেই ওর ফোনে পরিষ্কার শুনতে পেলাম আলির বিশ্ববিখ্যাত কণ্ঠস্বর, ‘ওহ, ইয়েস, ইয়েস, সেন্ড হিম ওভার।’
এবার সত্যি বিস্মিত চাহনি আমাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘হ্যাঁ, আপনি যান। ওঁর সুইট নম্বর এই…’ বলে একটা কাগজে নম্বরটা লিখে আমায় ধরিয়ে দিল।
আমি অলোককে নিয়ে সবচেয়ে কাছের লিফ্টটা ধরে চলে গেলাম আট তলায় আলির সুইটে। সুইটের দরজাতেও দেখলাম পাহারায় একজন। নিজের নাম বলতে ওঁর হাতে ধরা তালিকায় চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘আসুন, মহম্মদ ইজ এক্সপেক্টিং ইউ।’
ওমা, সুইট কোথায়, ঢুকতেই ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের মস্ত হল। আর তা ভরিয়ে রেখেছে পনেরো কুড়ি জন কৃষাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গ নারী পুরুষ ও অন্তত পনেরোটি বালক-বালিকা। তার মধ্যে একটি শ্বেতাঙ্গ বালক হুইলচেয়ারে। আলি বাচ্চাটিকে আদর করতে করতে ওঁর সেক্রেটারিকে বললেন, ‘এই ছেলেটির চিকিৎসার জন্য কত কী টাকা লাগে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। চেকবই আনো, সই করে দিচ্ছি।’
এরপর জমায়েতের দিকে ঘুরে বললেন, ‘শেতাঙ্গ মানেই আমাদের অপছন্দের লোক নয়। শ্বেতাঙ্গ ভালোমানুষদের চিনে নিয়ে বন্ধু করতে হবে। তবেই কালোদের সংগ্রাম মজবুত হবে। কালোর শক্তি কত বুঝতে এই গ্রেটেস্টের দিকে তাকাও।’ বলেই নিজের বুকে টোকা দিলেন।
মেয়েটা নাম শুনে বলল, ‘ইন্ডিয়ান জার্নালিষ্ট?’ যখন বললাম, ‘হ্যাঁ’ ও কিছু বলার আগে শুনি দ্য গ্রেটেস্টের বিখ্যাত স্বর ‘এসো এসো। আমি এখন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বসব।’ এই বলতে বলতে আলি আমার পিঠে হাত রেখে, নিয়ে চললেন হলের এক পাশে এক মস্ত সোফায়।
আমার হাতে আমার অ্যাটাচি কেস ছিল। একটি মেয়ে এসে বলল, ‘আপনার ব্যাগটা চেক করতে পারি?’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগটা খুলে ওর সামনে ধরলাম। তাতে আমার টেপ রেকর্ডার, কিছু ক্যাসেট, কয়েকটা কলম, একটা রাইটিং প্যাড এবং একটা মস্ত বড় চকোলেট। ও দেখে ব্যাগ বন্ধ করতে যাচ্ছিল। আমি চকোলেটটা বার করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা মিষ্টার আলির বাচ্চা মেয়ের জন্য।’ আসার পথে বাচ্চাটার জন্য চকোলেট কিনেছিলাম। মেয়েটা চকোলেট হাতে নিয়ে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ। দিয়ে কী নাম বলব আপনার?’ বললাম, ‘শঙ্কর’। মেয়েটা নাম শুনে বলল, ‘ইন্ডিয়ান জার্নালিষ্ট?’ যখন বললাম, ‘হ্যাঁ’ ও কিছু বলার আগে শুনি দ্য গ্রেটেস্টের বিখ্যাত স্বর ‘এসো এসো। আমি এখন তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে বসব।’ এই বলতে বলতে আলি আমার পিঠে হাত রেখে, নিয়ে চললেন হলের এক পাশে এক মস্ত সোফায়। আমি টেপ রেকর্ডার বার করে চালু করলাম। কিন্তু কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না যা ঘটছে তা সত্যিই আমার জীবনে ঘটছে। কত যে কথা (যা তিনদিন ধরে আনন্দবাজার পত্রিকায় বেরিয়েছিল, সঙ্গে অলোকের ছবি)। আর একবার চমকেও গেলাম আলি আলতো করে ওঁর হাত আমার পিঠে রাখতে। বললেন, একটা স্বচ্ছ, সরল শব্দ -আস্ক! প্রশ্ন!
আমার প্রথম প্রশ্নটাই ছিল- ‘আপনার ভয়ডর আছে?’
আলি আমার ক্যাসেট রেকর্ডারের উপর হাত বুলোতে বুলোতে ওপরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয় মানুষের থাকেই, তবে তাকে সাহস দিয়ে মেরে দিই।’
-তার মানে আপনি সাহসী। আপনার আত্মজীবনী বা নর্মান মেলরের বইয়ের কোথাও আপনাকে ভয় পেতে দেখছি না।
আলি বললেন, ‘হ্যাঁ, নিজেকে সাহসীই বলব। কারণ যাঁদের সঙ্গে লড়েছি… লিস্টন, জো ফ্রেজিয়ার, জর্জ ফোরম্যান, কেন নর্টন এরা ভয় ধরানো জিনিস সব। তবে শুধু লড়িনি, হারিয়েছিও এদের। তার মানে শুধু সাহসীই নই, আমার পাওয়ার, স্কিল এবং…এবং…

ধরিয়ে দেওয়ার জন্য বললাম, জিনিয়াস?
লুফে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সেটাও আছে, সবার চেয়ে বেশি।
কেন জানি না জিজ্ঞেস করে ফেললাম, আপনার পাঞ্জাটা একটু দেখব?
উনি হেসে বললেন, এই নাও ধরো। বলেই করমর্দনের ভঙ্গিতে আমার হাতটা ধরলেন। বাঘের মতো বড় পাঞ্জা, কিন্তু খুবই নরম। আমি একটু অবাক হলাম ওই নরম ভাবটায়।
আলি দেখি আমার হাত আর ছাড়েন না। আর একটু একটু করে চাপ বাড়াচ্ছেন। আমি সহসা অনুভব করলাম একটু আগের ওই নরম হাত, ইস্পাতের মতো কঠিন ও উষ্ণ হয়ে উঠেছে। কী অকল্পনীয় শক্তি ওই আগুনে হাতে এবং কত দ্রুত শক্তি ভর করে মসৃণ মুঠিতে আমার বুঝতে বাকি রইল না।
করমর্দন শেষে আলি হাত সরিয়ে নেওয়া মাত্রই বললাম, এই ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার তৈরি করাটাই কি আপনার বাঁ হাতের জ্যাবের রহস্য? আলি হেসে বললেন, আমার দু-হাতেই বিভিন্ন রকমের রহস্য আছে। সেটা ধরতেই সবাই হিমশিম খাচ্ছে।
করমর্দন শেষে আলি হাত সরিয়ে নেওয়া মাত্রই বললাম, এই ইনস্ট্যান্ট পাওয়ার তৈরি করাটাই কি আপনার বাঁ হাতের জ্যাবের রহস্য?
আলি হেসে বললেন, আমার দু-হাতেই বিভিন্ন রকমের রহস্য আছে। সেটা ধরতেই সবাই হিমশিম খাচ্ছে।
বললাম, রিং-এ আপনার গোটা উপস্থিতিটাই রহস্যপূর্ণ। হলিউডের এক অভিনেত্রী রিং-এর পাশ থেকে আপনার ছবি তুলতে তুলতে মনে করেছেন আপনি ওঁর সেরা মেল সেক্স সিম্বল।
আলি জানতে চাইলেন, কে সে?
বললাম, ক্যান্ডিস বার্গেন।
বললেন, ও সব মেয়েদের ব্যাপার। কী বলে, না বলে।
বললাম, কেন, আপনি কনশাস নন?
আলি ভুরু কুঁচকে বলেন, তুমি খেপেছ? একবার রিং-এ গিয়ে দাঁড়াও, টের পাবে।
আমার মনে পড়ল ওঁর বইয়ে ম্যানিলায় জো ফ্রেজিয়ারের সঙ্গে ওঁর রক্তারক্তি, কালজেয় আগুন ধরানো, শতাব্দীর সম্ভবত সেরা লড়াইকে বলেছিলেন ‘দ্য নিয়ারেস্ট থিংগ টু ডেথ’। মৃত্যুর নিকটতম ঘটনা।
সাক্ষাৎকার শেষে ক্যাসেট রেকর্ডার প্যাক করছি, শুনলাম আলি বলছেন, গুড লাক, ছোকরা।
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, একটা শেষ কথা। রিং মানে কি শুধু হার-জিত, রক্তপাত আর মৃত্যু?
সোফা থেকে উঠে আমার কাঁধে হাত রেখে শতাব্দীর সেরা অ্যাথলিট বললেন, নো, ইটস লাইফ। না, ওটাই জীবন।
(চলবে)
শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।